ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

শ্রীরামকৃষ্ণ, নরেন্দ্র ও সর্বধর্ম-সমন্বয়
(HARMONY OF ALL RELIGIONS)

নরেন্দ্র ও অন্যান্য কৃতবিদ্য যুবকগণ, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সকল ধর্মের উপর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা দেখিয়া বিস্ময়াপন্ন হইয়াছিলেন। সকল ধর্মে সত্য আছে, এ-কথা পরমহংসদেব মুক্তকণ্ঠে বলিতেন। কিন্তু তিনি আরও বলিতেন, সকল ধর্মই সত্য – অর্থাৎ প্রত্যেক ধর্ম দিয়া ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানো যাইতে পারে। একদিন, ২৭শে অক্টোবর (১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দে) কেশবচন্দ্র সেন কোজাগর লক্ষ্মীপূজার দিন দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে স্টীমারে করিয়া দেখিতে গিয়াছিলেন ও তাঁহাকে তুলিয়া লইয়া কলিকাতায় ফিরিয়া আসিয়াছিলেন। পথে জাহাজের উপরে অনেক বিষয়ে কথা হয়। ঠিক এই সকল কথা ১৩ই অগস্ট অর্থাৎ কয়েক মাস পূর্বে হইয়াছিল। এই সর্বধর্ম-সমন্বয় কথা আমাদের diary হইতে উদ্ধৃত করিলাম।

“কেদারনাথ চাটুজ্যে দক্ষিণেশ্বর-কালীবাড়িতে মহোৎসব করিয়াছিলেন। উৎসবান্তে দক্ষিণের বারান্দায় বসিয়া বেলা ৩।৪ টার সময় কথাবার্তা হইতেছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) – মত পথ। সকল ধর্মই সত্য। যেমন কালীঘাটে নানা পথ দিয়া যাওয়া যায়। ধর্ম কিছু ঈশ্বর নয়। ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম আশ্রয় করে ঈশ্বরের কাছে যাওয়া যায়।

“নদী সব নানাদিক দিয়ে আসে কিন্তু সব নদী সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। সেখানে সব এক।

“ছাদে নানা উপায়ে উঠা যায়। পাকা সিঁড়ি, কাঠের সিঁড়ি, বাঁকা সিঁড়ি আর শুধু একটা দড়ি দিয়াও উঠা যায়! তবে উঠবার সময় একটা ধরে উঠতে হয় – দু-তিনরকম সিঁড়িতে পা দিলে উঠা যায় না। তবে ছাদে উঠবার পর সবরকম সিঁড়ি দিয়ে নামা যায়, উঠা যায়।

“তাই প্রথমে একটা ধর্ম আশ্রয় করতে হয়। ঈশ্বরলাভ হলে সেই ব্যক্তি সব ধর্মপথ দিয়ে আনাগোনা করতে পারে; যখন হিন্দুদের ভিতর থাকে, তখন সকলে মনে করে হিন্দু; যখন মুসলমানদের সঙ্গে মেশে, তখন সকলে মনে করে মুসলমান; আবার যখন খ্রীষ্টানদের সঙ্গে মেশে, তখন সকলে ভাবে ইনি বুঝি খ্রীষ্টান।

“সব ধর্মের লোকেরা একজনকেই ডাকছে। কেউ বলছে ঈশ্বর, কেউ রাম, কেউ হরি, কেউ আল্লা, কেউ ব্রহ্ম। নাম আলাদা, কিন্তু একই বস্তু।

“একটা পুকুরে চার ঘাট আছে। একঘাটে হিন্দুরা জল খাচ্ছে, তারা বলছে ‘জল’। আর-একঘাটে মুসলমান, তারা বলছে ‘পানি’। আর-একঘাটে খ্রীষ্টান, তারা বলছে ‘ওয়াটার’। আবার একঘাটে কতকগুলো ওক বলছে ‘aqua’ (সকলের হাস্য)। বস্তু এক – জল, নাম আলাদা। তবে ঝগড়া করবার কি দরকার? সকলেই এক ঈশ্বরকে ডাকছে ও সকলেই তাঁর কাছে যাবে।”

একজন ভক্ত (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) – যদি অন্য ধর্মে ভ্রম থাকে?

শ্রীরামকৃষ্ণ – তা ভ্রম কোন ধর্মে নাই? সকলেই বলে, আমার ঘড়ি ঠিক যাচ্ছে। কিন্তু কোন ঘড়িই একেবারে ঠিক যায় না। সব ঘড়িকেই মাঝে মাঝে সূর্যের সঙ্গে মিলাতে হয়। “ভুল কোন্‌ ধর্মে নাই? আর যদি ভুল থাকে, যদি আন্তরিক হয়, যদি ব্যাকুল হয়ে তাঁকে ডাকে, তাহলে তিনি শুনবেনই শুনবেন।

“মনে কর, এক বাপের অনেকগুলি ছেলে – ছোট বড়। সকলেই ‘বাবা’ বলতে পারে না। কেউ বলে ‘বাবা’, কেউ বলে ‘বা’, কেউ বা কেবল ‘পা’। যারা ‘বাবা’ বলতে পারলে না, তাদের উপর বাপ রাগ করবে নাকি? (সকলের হাস্য) না, বাপ সকলকেই সমান ভালবাসবে।১

“লোক মনে করে, আমার ধর্ম ঠিক; আমি ঈশ্বর কি বস্তু বুঝেছি, ওরা বুঝতে পারে নাই। আমি ঠিক তাঁকে ডাকছি, ওরা ঠিক ডাকতে পারে না; অতএব ঈশ্বর আমাকেই কৃপা করেন, ওদের করেন না। এ-সব লোক জানে না যে, ঈশ্বর সকলের বাপ-মা, আন্তরিক হলে তিনি সকলকেই দয়া করেন।”

কি প্রেমের ধর্ম! এ-কথা তিনি তো বারবার বলিলেন, কিন্তু কয়জন ধারণা করিতে পারিল? শ্রীযুক্ত কেশব সেন কতকটা পারিয়াছিলেন। আর স্বামী বিবেকানন্দ জগতের সম্মুখে এই প্রেমের ধর্ম অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হইয়া প্রচার করিলেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মতুয়ার বুদ্ধি (Dogmatism) করিতে বারবার নিষেধ করিয়াছিলেন। “আমার ধর্ম সত্য ও তোমার মিথ্যা” এটির নাম ‘মতুয়ার বুদ্ধি’ – এইটি যত অনর্থের মূল। স্বামী এই অনর্থের কথা চিকাগো ধর্মসমিতিসমক্ষে বলিলেন। বলিলেন, খ্রীষ্টান, মুসলমান ইত্যাদি অনেকেই ধর্মের নামে রক্তারক্তি, কাটাকাটি, মারামারি করিয়াছেন।

“Sectarianism, bigotry and its horrible descendant fanaticism have long possessed this beautiful earth. They have filled the earth with violence, drenched it often and often with human blood, destroyed civilization and sent whole nations to despair.”

  • Lecture on Hinduism, (Chicago Parliament of Religions.)

স্বামী অপর এক বক্তৃতায় ‘সকল ধর্ম সত্য’, এ-কথা বিজ্ঞানশাস্ত্রের প্রমাণ দিয়া বুঝাইতে চেষ্টা করিলেন, –

“If any one here hopes that this unity will come by the triumph of any one of these religions and the destruction of the others, to him I say, Brother, yours is an impossible hope. Do I wish that the Christian would become Hindu? God forbid. Do I wish that the Hindu or Buddhist would become Christian? God forbid.

“The seed is put in the ground, and earth and air and water are placed around it. Does the seed become the earth or the air or the water? No, it becomes a plant, it assimilates the air, the earth and the water, converts them into plant substance and grows a plant.

“Similar is the case with religion. The Christian is not to become a Hindu or a Buddhist nor the Hindu or the Buddhist to become a Christian. But each must assimilate the others and yet preserve its own law of growth.”

আমেরিকায় স্বামী Brooklyn Ethical Society নামক সভায় হিন্দু ধর্ম সম্বন্ধে একটি বক্তৃতা দিয়াছিলেন। অধ্যাপক Dr. Lewis James সভাপতির আসন গ্রহণ করিয়াছিলেন। সেখানেও প্রথম কথা, সর্বধর্ম-সমন্বয়। স্বামী বলিলেন, একজনের ধর্ম সত্য বলা একটি ব্যাধিবিশেষ বলিতে হইবে। সকলের পাঁচটি আঙুল, আর-একজনের যদি ছয়টি হয়, বলিতে হইবে যে ইহা তাহার একটি রোগবিশেষ।

“Truth has always been universal. If I alone were to have six fingers on my hand while all of you have only five, you would not think that my hand was the true intent of nature, but rather that it was abnormal and diseased. Just so with religion. If one creed alone were to be true and all the others untrue, you would have again to say that, that religion is diseased. If one religion is true all the others must be true. Thus the Hindu religion is your property as well as mine.”

  • Lecture at Brooklyn.

স্বামী চিকাগো ধর্ম-মহাসভা সম্মুখে যে দিন প্রথম বক্তৃতা করিতে দণ্ডায়মান হয়েন, যে বক্তৃতা শুনিয়া প্রায় ছয় সহস্র লোক মুগ্ধ হইয়া তাঁহাকে মুক্তকণ্ঠে আসন ত্যাগ করিয়া অভ্যর্থনা করিয়াছিলেন২ সেই বক্তৃতামধ্যে এই সমন্বয়বার্তা ছিল। স্বামী বলিয়াছিলেন, –

“I am proud to belong to a religion which taught the world both tolerance and universal acceptance. We believe not only in universal toleration, but we accept all Religions as true. I belong to a religion into whose sacred language, the Sanskrit, the word ‘exclusion’ is untranslatable.”

………………………………
১ ঠিক এই কথা একখানি ইংরেজী গ্রন্থে আছে – Maxmuller’s Hibbert Lectures. মোক্ষ মূলরও এই উপমা দিয়া বুঝাইয়াছেন যে, যাঁহারা দেবদেবী পূজা করেন, তাঁহাদের ঘৃণা করা উচিত নহে।
২ “When Vivekananda addressed the audience as sisters and brothers of America, there arose a peal of applause that lasted for several minutes.” (Dr. Barrow’s Report) “But eloquent as were many of the brief speeches, no one expressed so well the spirit of the Parliament of Religions and its limitations as the Hindu monk. * * He is an Orator by divine right.” – New York Critique, 1893.

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!