ভবঘুরেকথা
ফকির সামসুল সাঁইজি

লালন সাধনায় গুরু: এক

-ফকির সামসুল সাঁইজি

ঐ যে কথাটা সাঁইজি পদে বললেন-

বে মুরিদেরা যত
শয়তানের অনুগত,
এবাদত বন্দেগি তার তো
সই দেবেনা দয়াময়।।
মুর্শিদকে মানিলে
খোদায় মান্য হয়।

মুর্শিদকে খোদা মান্য করিয়ে, এবাদত বন্দেগী করা হয়। সে তো দয়াময় যদি সই না দেন, এবাদত যদি কবুলই না করে; সই করা মানে কবুল করা, যদি কবুল না করে। তাহলে অহেতুক আমরা কি করতে কি করছি? এ বিষয়টা মূল বিষয়। আর আমরা শয়তানের অনুগত হয়ে কেন থাকবো?

লালনের মতো ওতো বড় প্রখ্যাত সাধু যখন এ কথা বলে গিয়েছেন। এই কথার পিছনে কেউ কলম ধরবে এ ক্ষমতা আর কারো নাই। তাই সে কথাটা আমি এ দিনও আমি মঞ্চে বলেছি। যাদের গুরু মুর্শিদ নাই, সাঁইজির বাণীতে তারা শয়তানের অনুগত। শয়তানের ভক্ত তারা।

যেখানে শয়তান যাবে, সেখানেই তার চেলা যায়। তার কোন ফায়দা হবে না। আকাশ পাতাল জোড়া এবাদত করেছে ইবলিশ, কিন্তু সই পরেনি। যতক্ষণ মানুষ সুরতে সেজদা ভক্তি না করছে। তাহলে গুরু মুর্শিদ না থাকলে আমি কার সুরতের উপরে নজর রেখে এবাদত বন্দেগী করবো বাবা?

তাহলে এখানে এর চাইতে আর বড় প্রয়োজন আর কি বলবো? তথাপিও যদি আমার গুরু মুর্শিদ না থাকে, অন্তিম মূহুর্তে বা মুমূর্ষু সময়ে যে গুরু এসে আমাকে নিয়ে যাবে। সেই কার্য যমে করবে। যম এসে অন্য আকার ধারণ করে সেই সৃষ্টিতে নিয়ে যাবে, জীবান্তরে।

জীব ম’লে যায় জীবান্তরে
জীবের গতি মুক্তি রয় ভক্তির দ্বারে।।

যার গুরু মুর্শিদ নাই, তার ভক্তি সম্বন্ধেতো ধারণা নাই। ভক্তির দ্বারতো তারা চিনতে পারবে না। তাহলে কত প্রয়োজন গুরু মুর্শিদ ধরা। আবার নামাজ তুমি পড়তে যাবে-

পড়গা নামাজ জেনে শুনে।

কিন্তু যার গুরু মুর্শিদ নাই, সে কোন কাবায় নিয়ত করে নামাজ পড়বে? মানুষ মক্কায় যে নিয়ত বাঁধতে হয়। ঐ চারটা দেওয়াল বিশিষ্ট ঘরকে না। চারটে চিজ বিশিষ্ট তৈরী যে দেহ, তার মধ্যে যে ঈশ্বর আছে, সেই ঈশ্বরকে, তাকেই স্মরণ করতে হবে গুরুর মাধ্যমে।

সেই ঈশ্বরের প্রতিচ্ছবি গুরু। আর গুরু না থাকলে আমি কার উপরে, কার সুরতের উপরে সেজদা-সালাত করবো? তাই একটা পদ গেয়ে দিই, নামাজ সম্বন্ধে-

হুজুরের নামাজ এমনি ধারা।

-হুজুরের মানে আজির নাজির জেনে, আল্লাহকে যে স্মরণ করতে হবে, সেজদা করতে হবে। নিরাকারে সেজদা চলবে না বিধায়; আকারের প্রকৃয়াটা এ জায়গা থেকে আসে।

হুজুরের নামাজের আইন
এমনি ধারা,
ইবলিসের সেজদার ঠাঁই
ছেড়ে চাই সেজদা করা।

সেতো করেছে সেজদা
স্বর্গ মর্ত্য পাতাল জোড়া,
কোনখানে বাদ রেখেছে
এবার দেখ না তোরা।।

জায়গার মাহাত্ম্য বুঝে
সেজদা দিতে পারে যারা,
আগমে কয় তাদের
হবে নামাজ সারা।।

কিসে হবে আসল নামাজ,
করো সেই কাজ ভাই সকলরা,
লালন বলে আখের যেন
না যায় মারা।।

তাহলে ইবলিশ; স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল; এখানে পৃথিবীকে তিনটে ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। ত্রিভুবন, আকাশ বা শূন্য হচ্ছে এখানে স্বর্গ বলে অবিহিত করা হয়। আর মর্ত্য, মাটি/ভূমি ও ভূ-গর্ভ এই তিনটা পর্যায়ে বিভক্ত। আকাশ… আসমান জমিন আর পাতাল। এই ত্রিভুবন। এমন কোন স্থান ছিল না, সেখানে ইবলিশ সেজদা করেনি।

একটা জায়গা ব্যতীত। কোন জায়গা? আদম সুরত ব্যতীত। অর্থাৎ আদম সুরতে যে আল্লাহ্ প্রকাশ হলেন, সেই সুরত ব্যতীত, সর্বস্থানে এলোপাতাড়ি সেজদা করা হয়েছে। যথায় তথা, আজও, যারা সেই ইবলিশের সেজদার প্রায় সেজদা করছে এলোপাতাড়ি ভাবে। যথায় মন চাচ্ছে তথায় সেজদা করছে।

একটা নির্দিষ্ট যদি আকার থাকে, তাহলে সে আকারে আমার সেজদা হচ্ছে। আল্লাহর তো অগণিত আকার। আমি একটা আকারকে নির্বাচন করবো। আমার এবাদতের জন্য আমি একটা আকারকে আমি সনাক্ত করলাম। সেটি আমার গুরু আকার। এ ব্যতীত আর সমস্ত আকারের তো আর সাধনা করা যায় না।

সমস্ত আকারের মধ্যেই কিন্তু স্রষ্টা বিরাজ করছে। এক এবাদতের জন্য, একটা আকার নিজ নিজ গুরু। এ ব্যতীত যে সেজদাগুলো হচ্ছে, আমি যেখানে আমার মন, অর্থাৎ আমি যা করি, যা পছন্দ করি, যা ভাবি। ঠিক সেজদার সময় সেই আকারটা, সেই সুরতটা এসে দাঁড়ায়।

আমি ব্যবসা করি, আমার ব্যবসা এসে দাঁড়াবে। চাকরি করি, চাকরি এসে দাঁড়াবে। যে যে পেশায় আমরা আছি। তাহলে মানুষের মন কতক্ষণ? যতক্ষণ একটা মানুষ চেতন আছে, স্ব-জ্ঞান এ আছে। ততক্ষণ কিছু না কিছু সে দেখছেই। অন্তর চোখ দিয়ে। ঐ নামাজের সেজদার সময় সে আকারগুলো নিয়ে সে দাঁড়াবে।

ঠিক না? যার জন্য নিরাকার ঠিক এই জায়গায়, শুধু যে নিরাকারে সেজদা দিতে বলছে, আল্লাহর আকার নাই। তাই যথাই তথাই তারা সেজদা দিয়ে বসে। আর সাধু মতে, একটা নির্দিষ্ট আকারে সেজদা দিতে হবে, তার বাইরে দিলে শিরিক হয়ে যাবে। তাহলে কেন গুরু ধরা প্রয়োজন না বাপ।

লালন সাধনায় গুরু: এক-

……………………….
ফকির সামসুল সাঁইজি
বাগলপাড়া, সাঁইনগর রাজশাহী।
শ্রুতি লেখক : মাশফিক মাহমুদ

…………………………………..
চিত্র:
ফকির লালন সাঁইজির প্রকৃত কোনো ছবি নেই। লেখাতে ব্যবহৃত ছবিটি লালন ফকিরের কাল্পনিক একটি ছবি মাত্র। বহুল ব্যবহৃত হলেও এই ছবির সাথে লালন সাঁইজির আদৌ কোনো যোগসূত্র আছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায় না।

…………………….
আপনার গুরুবাড়ির সাধুসঙ্গ, আখড়া, আশ্রম, দরবার শরীফ, অসাম্প্রদায়িক ওরশের তথ্য প্রদান করে এই “সাধু পঞ্জিকা” দিনপঞ্জিকে আরো সমৃদ্ধ করুন- voboghurekotha@gmail.com

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

………………………..
আরো পড়ুন:
মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজি: এক
মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজি: দুই
মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজি: তিন


লালন ফকিরের নববিধান: এক
লালন ফকিরের নববিধান: দুই

লালন ফকিরের নববিধান: তিন

লালন সাঁইজির খোঁজে: এক
লালন সাঁইজির খোঁজে: দুই


মহাত্মা লালন সাঁইজির দোলপূর্ণিমা
মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজির স্মরণে বিশ্ব লালন দিবস
লালন গানের বাজার বেড়েছে গুরুবাদ গুরুত্ব পায়নি
লালন আখড়ায় মেলা নয় হোক সাধুসঙ্গ
কে বলে রে আমি আমি
ফকির লালন সাঁই
ফকির লালনের ফকিরি
ফকির লালন সাঁই


বিশ্ববাঙালি লালন শাহ্
ফকির লালন সাঁইজির শ্রীরূপ
গুরুপূর্ণিমা ও ফকির লালন
বিকৃত হচ্ছে লালনের বাণী?

লালন অক্ষ কিংবা দ্রাঘিমা বিচ্ছিন্ন এক নক্ষত্র

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!