ভবঘুরেকথা
শ্রী শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী

আর একবার ঢাকার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট চন্দ্রকুমার দত্ত তাঁর স্ত্রীর রোগ নিরাময়ের আশা নিয়ে বারদীর আশ্রমে এলেন বাবার কৃপাপ্রাথী হয়ে। চন্দ্রকান্তবাবুর স্ত্রী নানা রোগ-ব্যাধিতে ভুগে শেষে মরণাপন্ন হয়ে পরেন। প্রচুর অর্থব্যয় করেও অবস্থা যখন দিনের পর দিন অবনতির চরম শিখরে গিয়ে পৌঁছোয়, তখন একবার হতাশ হয়েই ভাগ্য পরীক্ষার জন্য বাবা লোকনাথের কাছে এসে হাজির হন।

চন্দ্রকুমারকে দেখে বাবা বললেন- একসময় আমার ইচ্ছা হয়েছিল আমি মরা মানুষ বাঁচাতে পারি কিনা দেখব ; মনের ইচ্ছামাত্রই মরণাপন্ন রোগীরা একে একে আসতে শুরু করল আমার কাছে। এখন পর্যন্ত মুখের বাক্য দিয়ে বহু মৃতপ্রায় রোগীকে জীবন দান করেছি। এখন আর সে ইচ্ছা আমার হয় না। তবে যদি কেউ সে ইচ্ছা করিয়ে নিতে পারে, তবে এখনও সে সুস্থ হয়।

ম্যাজিস্ট্রেট চন্দ্রকান্তবাবু বাবার এই কথায বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে ওঠেন, তিনি বলেন- কেমন করে সে ইচ্ছা করিয়ে নেওয়া যায়? উত্তরে বাবা বললেন- ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য যেমন দেহের প্রয়োজন, মলমূত্র ত্যাগের জন্য যেমন দেহের প্রয়োজন, তেমনি সেইরূপ প্রয়োজন বোধ যার আমার জন্য হয়, একমোত্র সেই এখনও আমার ইচ্ছা করিয়ে নিতে পারে।

এরপর চন্দ্রকুমারকে বললেন- তোর মাগকে কি আমার কাছে কিছুদিন রেখে যেতে পারবি? কোনোপ্রকার দ্বিরুক্তি না করে চন্দ্রকুমারবাবু তাঁর স্ত্রীকে কিছুদিনের জন্য আশ্রমে রেখে গেলেন। প্রায় মাস দুয়েকের মধ্যে লোকনাথ বাবার কৃপায় এবং গোয়ালিনী মায়ের সেবা-শুশ্রূষায় সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলেন। আশ্রম থেকে বিদায় নেবার পূর্বে চন্দ্রকুমারবাবুকে স্ত্রী স্বহস্তে বাবাকে ভোগ রান্না করে খাইয়েছিলেন।

বাবার এই কথাগুলি একটু গভীরভাবে স্মরণ ও মনন করলেই ভক্তিশাস্ত্রের মূলভাবের অধ্যায়টি উন্মোচিত হয়। তিনি কেবল দেহের রোগমুক্তি বা কৃপালাগের জন্যই বলছেন না, শরণাগতই যে একমাত্র ইচ্ছাশীক্তকে ছাপিয়ে তোলার উপায় সে কথাই বলতে চেয়েছেন।

আমরা যখন ক্ষুধার্ত হয়ে পরি, তখন আহার্য্য বস্তু ছাড়া অন্য কোনোদিকে মনোনিবেশ করতে পারি না, যখন মলমূত্র ত্যাগের প্রয়োজন হয়, তখন অন্য কোনো বিষয়ে আমরা ভাবতে পারি না। তেমনি ভ্ক্ত যখন ভগবান ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারে না, সুখে-দু:খে একমাত্র ভগবানই তার সঙ্গী, তখন সন্তান হিসেবে ভগবানের উপর একটা সহজ এবং স্বাভাবিক অধিকার জন্মায়।

কিন্তু মায়াবদ্ধ মানুষ ক্ষুদ্র স্বার্থের গন্ডীর বাইরে একথা ভাবতে পারে না; কেবল ভগবানের জন্যই ভগবানকে ভাসাবাসা। তাই বাবা বললেন- তেমন ভক্ত যখন ব্যাকুল হয়ে আমার কাছে কিছু চায়, তখন তার প্রার্থনা অপূর্ণ রাখি না।

চন্দ্রকামুরের জীর্ণ, শীর্ণ, মৃতপ্রায় স্ত্রীর দিকে নজর পরতেই বাবার অন্তর করুণায় বিগলিত হয়। তিনি কাছে ডেকে হাতটি বার করতে বললেন। তারপর বাবা তার হাতটি ধরে আপন চরণ যুগল ধরে বললেন- শক্ত করে ধর।

এরপর চন্দ্রকুমারকে বললেন- তোর মাগকে কি আমার কাছে কিছুদিন রেখে যেতে পারবি? কোনোপ্রকার দ্বিরুক্তি না করে চন্দ্রকুমারবাবু তাঁর স্ত্রীকে কিছুদিনের জন্য আশ্রমে রেখে গেলেন। প্রায় মাস দুয়েকের মধ্যে লোকনাথ বাবার কৃপায় এবং গোয়ালিনী মায়ের সেবা-শুশ্রূষায় সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলেন। আশ্রম থেকে বিদায় নেবার পূর্বে চন্দ্রকুমারবাবুকে স্ত্রী স্বহস্তে বাবাকে ভোগ রান্না করে খাইয়েছিলেন।

অতএব মানুষ মাত্রেই কোনো দেবতা বা মহাপুরুষের নিকট কোনো মানত করলে, তাকে সেই সত্য অবশ্যই পালন করা উচিৎ। এর অর্থ এই নয় যে, ভক্তের অর্থ বা কোনো বস্তুর ওপর ভগবান প্রত্যাশী। যিনি সারা বিশ্বজুড়ে তাঁর দয়ার দান ছড়িয়ে রেখেছেন, তিনি আবার কার দানের ভিখারী? কেবল ভক্তকে তাঁর সত্যনিষ্ঠা পালনের কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতন করার জন্যই তার এই লীলা।

এইসময় চন্দ্রকুমারবাবু বাবার কাছে সত্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে- তাঁর স্ত্রী সুস্থ হয়ে গেলে তিনি আশ্রমেরে জন্য পাঁচশত টাকা দান করবেন। বাবার কৃপায় অসম্ভব সম্ভব হলেও কিন্তু তাঁর প্রতিশ্রুত সত্য রক্ষা করেন নি। পরে তিনি বরিশালে বদলি হয়ে গলে কিছুদিন পর বাবা লোকনাথ পত্র দিয়ে স্মরণ করিয়ে দিলেও, তিনি ইচ্ছাকৃত ভাবেই সে সত্যকে অস্বীকার করেন। উত্তরে চন্দ্রকুমারবাবু জানিয়েছিলেন- আপনি তো সন্ন্যাসী মানুষ, আপনার অর্থের কি প্রয়োজন? অর্থের প্রতি আপনার লোভই বা কিসের?

এর প্রত্ত্যুত্তরে বাবা কোনো ক্ষোভ বা দ্বিরুক্তি প্রকাশ করেন নি। তবে একজন সত্যদ্রষ্টা জীবন্মুক্ত মহাপুরুষের সঙ্গে কপটতা করার জন্য চন্দ্রকুমারের স্ত্রী পুনরায় কয়েক মাসের মধ্যে পূর্বের ন্যায় ব্যাধিগ্রস্থ হয়ে পরেন। এই ঘটনায় অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে যে, লোকনাথ বাবার ন্যায় একজন ব্রহ্মবিদ্ দয়ালু মহাপুরুষ মাত্র কয়েকটা টাকার জন্য একজনের জীবন নিয়ে খেলা করলেন কেমন করে?

এই কারণে এখানে কয়েকটি কথার উপস্থাপনা করছি- একথা যদি কেউ ভেবে থাকেন, তবে তিনি ভুল করবেন। কারণ এখানে একটি শিক্ষণীয় বিষয় হল- এই ঘটনার মধ্যে আমরা দেখতে পাই যে, চন্দ্রকুমারবাবু স্বমুখে স্বত:প্রবৃত্ত হয়েই বাবার কাছে সত্য প্রতিশ্রুতি দান করেন।

বাবা তার কর্তব্য সম্বন্ধে পত্র মারফৎ স্মরণ করিয়ে দিলেও একজন সত্যদ্রষ্টা মহাপুরুষের কাছে সেই সত্যকে সযত্নে এড়িয়ে গেলেন। বাবা কিন্তু তাঁর কাছে কিছু চাননি। তিনিই দেবেন বলেছিলেন। সুতরাং কপটতা এবং অতিচালাকির ফলস্বরূপ তাঁর স্ত্রী পুনরায় রোগগ্রস্ত হয়ে পরেন।

অতএব মানুষ মাত্রেই কোনো দেবতা বা মহাপুরুষের নিকট কোনো মানত করলে, তাকে সেই সত্য অবশ্যই পালন করা উচিৎ। এর অর্থ এই নয় যে, ভক্তের অর্থ বা কোনো বস্তুর ওপর ভগবান প্রত্যাশী। যিনি সারা বিশ্বজুড়ে তাঁর দয়ার দান ছড়িয়ে রেখেছেন, তিনি আবার কার দানের ভিখারী? কেবল ভক্তকে তাঁর সত্যনিষ্ঠা পালনের কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতন করার জন্যই তার এই লীলা।

<<লোকনাথ বাবার লীলা : এক ।। লোকনাথ বাবার লীলা : তিন>>

………………………
সূত্র:
শ্রীযামিনী কুমার দেবশর্ম্মা মুখোপাধ্যায়ের ধর্ম্মসার সংগ্রহ গ্রন্থ থেকে।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

…………………
আরও পড়ুন-
লোকনাথ বাবার লীলা : এক
লোকনাথ বাবার লীলা : দুই
লোকনাথ বাবার লীলা : তিন
লোকনাথ বাবার লীলা : চার
লোকনাথ বাবার লীলা : পাঁচ
লোকনাথ বাবার লীলা : ছয়
লোকনাথ বাবার লীলা : সাত
লোকনাথ বাবার লীলা : আট
লোকনাথ বাবার লীলা : নয়
লোকনাথ বাবার লীলা : দশ
লোকনাথ বাবার লীলা : এগারো
লোকনাথ বাবার লীলা : বারো
লোকনাথ বাবার লীলা : তের
লোকনাথ বাবার লীলা : চৌদ্দ
লোকনাথ বাবার লীলা : পনের
লোকনাথ বাবার লীলা : ষোল
লোকনাথ বাবার লীলা : সতের
লোকনাথ বাবার লীলা : আঠার
লোকনাথ বাবার লীলা : উনিশ
লোকনাথ বাবার লীলা

……………..
আরও পড়ুন-
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : এক
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : দুই
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : তিন
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : চার
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : পাঁচ
লোকনাথ ব্রহ্মচারীর উপদেশ : উপসংহার

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!