ভবঘুরেকথা
পরমহংস যোগানন্দ গাঁধীজিকে ক্রিয়াযোগে দীক্ষা দিয়েছিলেন তিনি

ঈশ্বর তাঁর সন্তানদের অনেক ভাবেই কৃপাধন্য করে থাকেন। মাঝে মাঝে তিনি সন্তানের বাসনা তৎক্ষণাৎ পূর্ণ করে থাকেন। আমি যখন শুধালাম- আজকে সৎসঙ্গের সময় বৃষ্টিটা কি কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ করা যায় না, তখন মা ভগবতীর কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম- “কিছুক্ষণের জন্য রোদ উঠবে।” পরমাত্মার কৃপায় আজ সকালে তাই সূর্যের আলো দেখা দিয়েছে।

ঈশ্বরই হলেন জগন্মাতা, জগৎপিতা ও জগদ্বন্ধু। যদি তাঁকে তোমরা সবচেয়ে নিকটজন বলে সর্বদা ভাব, তাহলে জীবনে অনেক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা লাভ করবে‌। “তিনি আমার সঙ্গে চলেন, কথা বলেন এবং এও বলেন- আমি তাঁরই আপন।” তাই ধ্যানের মধ্যে দিয়ে যদি তোমরা ‘নির্ভীক পদক্ষেপে’ স্বর্গরাজ্যের মধ্যে প্রবেশ করতে পার, তাহলে ঈশ্বর তোমার সঙ্গেও কথা বলবেন।

কবি ফ্রান্সিস টমসন ঈশ্বরকে বলেছেন- “Hound of Heaven” বা স্বর্গের শিকারী কুকুর। দেখানো হয়েছে যেন ঈশ্বরই মানুষকে তাড়া করে বেড়াচ্ছেন, মানুষ তাঁর সন্ধান করছে না। সন্দেহের আঁকাবাঁকা গুহাপথে নিজেকে লুকিয়ে রেখে, মানুষই ঈশ্বরের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তথাপি স্বর্গের শিকারী কুকুর এগিয়ে আসতেই থাকে আর সাবধান করে বলতে থাকে- “যে আমাকে প্রতারিত করে, জগৎ তাকে প্রতারিত করে।”

যদি তোমার জীবনধারা এমন হয় যে, ঈশ্বরও তোমাকে ত্যাগ করেন, তাহলে জানবে- তুমি প্রেমকেই তোমার কাছ থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছ। টাকাপয়সা, ইন্দ্রিয়সুখ- যারই সন্ধান আমরা করি না কেন, আসলে কিন্তু তার মধ্যে আমরা ঈশ্বরকেই সন্ধান করে বেড়াচ্ছি। আমরা সবাই হীরকসন্ধানী।

কিন্তু হীরের বদলে পথের পাশে পড়ে থাকা, সূর্যের আলোয় চকচক্ করে ওঠা, কাঁচের টুকরোকেই সংগ্রহ করে চলেছি। তাদের আকর্ষণে ক্ষণেক মুগ্ধ হয়ে আসল হীরের সন্ধান করাই ভুলে গেছি, কেননা হীরে অত সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না।

অধিকারী হওয়া কিছুটা কঠিন হলেও তোমাদের সু-অভ্যাসগুলিই হলো সেই সমস্ত হীরকখণ্ড, যা তোমাদের স্থায়ী এবং খাঁটি সুখ এনে দিতে পারে। আর কু-অভ্যাস হলো সেই তুচ্ছ কাঁচের টুকরো, যা সহজপ্রাপ্য বলে হয়ত তোমাদের খুশি করতে পারে।

কিন্তু মায়াজাত বলে পরিমাণে তা হতাশাকেই ডেকে নিয়ে আসে। সন্তৃপ্তি তোমাকে আচ্ছন্ন করবে- কোন কিছু থেকেই আর আনন্দ পাবে না। আমাকে ঐ ধরনের অভিজ্ঞতা ভোগ করতে হয়নি, কারণ জাগতিক সুখের পরিণতি আমি জানি এবং একমাত্র ঈশ্বরের কাছেই প্রকৃত ও স্থায়ী আনন্দ আমি পাই।

‘বার্ধক্য’ তাকেই বলে যখন জগৎ ব্যাপারে মানুষ বীতশ্রদ্ধ হয়ে পরে। জাগতিক সুখস্বচ্ছন্দ্য আমাকে দ্রুত ক্লান্ত করে তোলে; আর আমি যদি ঈশ্বর সন্ধান না করতাম, তাঁকে পাওয়ার আনন্দ না পেতাম, তাহলে ইহজগৎ আমার কাছে নিদারুণ একঘেঁয়ে হয়ে উঠত।

তাঁর মধ্যে যে সুখ ও প্রাচুর্য আমি পাই, তার সীমাপরিসীমা নেই। ভক্তহৃদয়ে যখন ঈশ্বরের আবির্ভাব ঘটে তখন যে আনন্দ আসে, অনন্তকাল ধরেও তাকে আমি বুঝিয়ে বলতে পারব না। আমি কোন অতিশয়োক্তি করছি না, কারণ ব্রহ্মনন্দ সত্যিই চিরন্তন-

“তা অফুরন্ত, চির নবীন ও অসীম। মাঝে মাঝে সকলেই আমরা তার কচিৎ আভাস পাই, যা হলো চিরন্তন সুখাবস্থার আত্মিক পুনঃস্মরণ।”

এ জগতে সবাই আমাদের নিজ স্বার্থসিদ্ধির কাজে ব্যবহার করতে চায়। একমাত্র ঈশ্বর ও ভগবানদ্রষ্টা সদগুরুই কেবল আমাদের যথার্থ ভালবাসতে পারেন। প্রেম কাকে বলে, সাধারণ মানুষ তা জানে না। কারোর সঙ্গ যখন তোমাকে সুখী করে, তখন ভাবো- তুমি তাকে ভালবাসো। কিন্তু আসলে তুমি নিজেকেই ভালবাসো। অন্য লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছ বলেই তোমার আমিত্ব সন্তুষ্ট হয়েছে।

এছাড়া আর কিছুই নয়। সেই ব্যক্তি যদি আর তোমাকে সন্তুষ্ট করতে না পারে, তবুও কি তুমি তাকে ভালবাসবে? কাউকে নিজের চেয়েও বেশি ভালবাসি- কথাটা বোঝা একটু দুরূহ এবং সাধারণ মানুষের পক্ষে সেই মত আচরণ করাও দুরূহতর। বিষয়টিকে প্রাঞ্জল করতে আমি তোমাদেরকে একটি খাঁটি প্রেমের ঘটনা বলছি।

ভারতবর্ষের এক প্রেমিক স্বামী ছিল যে তার স্ত্রীকে অন্তর থেকে ভালবাসতো। এখন অন্য একজন পুরুষ সেই নারীতে আসক্ত হয়। মহিলাটি তার প্রেমিক পুরুষের সঙ্গে পালিয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত ঐ লোকটি তাকে সর্বস্বান্ত করে এবং পরিত্যাগ করে।

একদিন স্বামী ভদ্রলোক তার সঙ্গে দেখা করতে আসে এবং বলে, “তোমার আশ মিটেছে তো? ইচ্ছা করলে তুমি এখন আমার সঙ্গে ঘরে আসতে পার?” মহিলাটি মৃদু আপত্তি জানায়, বলে- “আমি তোমাকে আরও অসম্মানের মধ্যে ফেলতে চাই না।”

স্বামী ভদ্রলোক তাকে বলে, “সমাজে কে কি বলল, তাতে আমার কি এসে যায়? আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসি। ঐ লোকটি শুধু তোমার দেহটিকে চেয়েছিল, আর আমি তোমাকে-তোমার প্রকৃত সত্তাকে ভালবাসি। যা ঘটে গেছে তার জন্যে কিছুই এসে যায় না।”

একেই বলে খাঁটি ভালবাসা। স্বামীটি নিজের সম্মানকে বেশি গুরুত্ব দেয়নি। সে কেবল তার প্রেমিকের মঙ্গলের কথাই ভেবেছিল।

খাঁটি ভালোবাসা নিবেদন করার পথে একটা বড় কাঁটা হলো আমাদের অভ্যাস। আমরা সবাই মনে মনে দেবতা হতে চাই, কিন্তু অভ্যাসই আমাদের দানব করে তোলে। হয়ত সকালে মনস্থির করলাম ভালো হয়ে চলবো, কিন্তু কাজের সময়ে আর সে’কথা মনে রইল না। বাইবেলে আছে, “আত্মা বাস্তবিকই ইচ্ছুক, কিন্তু শরীরটাই দুর্বল।”

এখানে শরীর বলতে অভ্যাসের কথা বলা হয়েছে। আমাদের আত্মা, আমাদের জ্ঞান ইচ্ছুক, কিন্তু আমাদের সু-অভ্যাসগুলি বড়ই দুর্বল।

ভগবদগীতায় আছে, “উত্তেজনাপ্রবণ ইন্দ্রিয়গুলি জবরদস্তি করে মোক্ষার্থীর চৈতন্যকে হরণ করার চেষ্টা করে।”

অভ্যাস যে কত সাংঘাতিক হতে পারে, অনেকেই তা বুঝতে পারে না। কারোর কারোর অভ্যাস খুব দ্রুত গড়ে ওঠে। সু-অভ্যাস গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এটা খুবই ভাল; কিন্তু যে সমস্ত কাজ থেকে কু-অভ্যাস গড়ে উঠতে পারে, সে’সব ক্ষেত্রে এটা খুবই মারাত্মক।

এইরকম কোন লোককে যদি তুমি একটা সিগারেট খেতে দাও, তাহলে সে নিয়মিত ধূমপায়ী হয়ে উঠবে। কিম্বা একবার সুরার স্বাদ পেলেই সে হয়ত সারাজীবনের জন্য মদ্যপায়ী হয়ে যাবে।

যেহেতু তোমার অবচেতনায় কি আছে বা তোমার গোপন প্রবৃত্তির স্বরূপটি কি- এসব বিষয়ে তুমি কিছুই জানো না, সেহেতু যে কাজ করলে কু-অভ্যাস তৈরি হতে পারে, সেগুলিকে এড়িয়ে যাওয়াই শ্রেয়। মনে যদি প্রজ্ঞা আর বিচারবুদ্ধির জোর প্রবল না হয়, তাহলে ব্লটিং কাগজের মত তা যাবতীয় কু-অভ্যাসগুলিকে দ্রুত শুষে নেয়।

ইহজগতে কত মানুষেরই না সাহায্যের প্রয়োজন দেখা দেয়! আর যারা স্বেচ্ছায় ভগবৎ প্রেমভাব প্রকাশে ইচ্ছুক হয়, তাদের মাধ্যমেই ঈশ্বর ঐ সাহায্য করে থাকেন। কিছুদিন আগে একটা মর্মান্তিক ঘটনা আমার গোচরে আনা হয়। কোন একজন লোক যখন মদের ঘোরে থাকে না তখন সে খুব ভাল থাকে; কিন্তু মদ খেতে আরম্ভ করলেই তার মাথায় যেন ভুত চেপে বসে।

স্বাভাবিক অবস্থায় কারোর ভালোর জন্য সে অনেক কিছুই করতে পারে। কিন্তু মাতাল হলেই সে বউকে মারে এবং আতঙ্কের কারণ হয়ে ওঠে। এই ব্যাধিমুক্তির জন্যে তাকে আমার কাছে আনা হয়। আমি বুঝেছিলাম- আমার মনের ইচ্ছার সঙ্গে তার মনের সুরটিকে এক সুরে সামান্য ভাবেও যদি সে বাঁধে, তাহলে তাকে সাহায্য করতে পারি। কিন্তু কুঅভ্যাসের প্রভাব কি মারাত্মক দেখ!

মদের প্রভাবে যখন সে থাকে না, তখন পাপের লেশমাত্রও তার মধ্যে তোমরা দেখতে পাবে না। আর সেই সময় মদ খাবার কু-অভ্যাসের কথা ভেবে সে এমন বিবেক-দংশনে ভোগে যে, আত্মহত্যা করার কথাও সে বলে। এত সব সত্ত্বেও সে মদ খাওয়া ছাড়তে পারে না। অভ্যাসের এমনই ক্ষমতা।

মনে ভালো কিছু করার ইচ্ছা হলে অবশ্যই তাকে কাজে পরিণত করবে। কোন বাধাকেই মানবে না। তবে সংকল্প করার আগে বিচার করে দেখবে কাজটি ভালো কি না। কোন বিষয়ে একবার মনস্থির করলে আমি তার প্রতিবাদী বক্তব্য শুনতে চাই না।

কখনো কখনো হয়ত সিদ্ধান্ত নিতে আমার দীর্ঘ সময় লাগে, কিন্তু একবার সিদ্ধান্ত নেবার পর তা থেকে আর পিছিয়ে আসি না। যখন তোমরা কোন বিষয়ে দৃঢ়ভাবে মনস্থির কর এবং সেই সংকল্পে অটল থাকো, তখন একটা ঐশ্বরিক বিধি কার্যকরী হয়।

আমাদের কারোর উদ্দেশ্যেই খারাপ নয়; কিন্তু আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই, অভ্যাস এমন সব কাজ করিয়ে নেয় যা আমাদের নিজেদের এবং অন্যের পক্ষেও ক্ষতিকর। সুতরাং কু-অভ্যাসের বশে ভুল পথে চালিত না হবার ব্যাপারে মনস্থির করা উচিত।

…………………………………
আরও আধ্যাত্মিক তথ্য পেতে ও জানতে: ভারতের সাধক-সাধিকা
পুণঃপ্রচারে বিনীত-প্রণয় সেন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!