ভবঘুরেকথা
স্বামী বিবেকানন্দ

১.
এ সময় এক অদ্ভুত ভাব হয়।

চুপ করে বসে থাকেন মানুষটি। গঙ্গার ধারেই তাঁর ছোট একখানা ঘর। জানলা থেকে চোখ রাখলে সদাসলিলা নদীর বহমানতা দেখা যায়।

সন্ধ্যা নামছে। নির্জন মন্দিরের চাতালে দু’একজনের চলাফেরা টের পাওয়া যায়। মূল মন্দিরে জ্বলে উঠছে প্রদীপ। ঘণ্টার ধ্বনি একবার বেজেই থেমে গেলো।

প্রস্তুতি চলছে সন্ধ্যারতির। একটু পরেই শুরু হবে। পঞ্চবটীতে ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়া ফিরে আসছে।

দিন ফিরছে রাতের চৌকাঠে।

চুপ করে বসে আছেন মানুষটি। কেউ তাঁকে বলে সাধক। কেউ বলে পাগল। দুটোই ঠিক। পাগল না হলে সাধনা হয় না। ভগবান আছে কি নেই, কে জানে? কিন্তু বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরতে গেলে সাধক হতে হয়। অনেকেই বলে, মানে, এ মানুষটি ভগবানকে পেয়েছেন। আর সবাই এ কথা জানে, ইনি যে’ই হন, ঠিক গড়পড়তা সাধারণ নন।

চুপ করে বসে আছেন মানুষটি। কেউ একজন আসবে। মন বলছে তাঁর। একটা ঝড় আসবে।

আরতি শুরু হল।

‘আপনি যে এতো মা মা করেন? মা’কে বলতে পারেন না আমাদের মতো সাধারণ মানুষের যাতে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত জোটে? এটুকুই যদি না হল, তবে কিসের এতো ভগবান?’

নরেন দত্তর প্রশ্নের সামনে নরম মানুষটি কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। মা যে বড় বেইজ্জত করে দিলেন তাঁর। নরেনের এতো কষ্টে তাঁরও যে কম কষ্ট নয়। এতোগুলো ভাই বোন, মা, সব যে নরেনের ঘাড়ে। কি করবে ছেলেটা?

জুতসই কোনো উত্তর নেই। আগুনের গোলার মতো জ্বলছে ছেলেটা। তাঁর দুচোখে ভক্তি নেই।

ধর্মের প্রশ্ন নেই। সমস্ত জিজ্ঞাসা উবে গেছে। রামকৃষ্ণ বড় অসহায় বোধ করছেন এই প্রথম। তাঁর সামনে তাঁর ইষ্টকে কেউ আঙুল তুলছে।

খানিকটা সামাল দেওয়ার ছলে বললেন, ‘আমি তো দিনরাত মা’কে বলছি, মা, নরেনের একটা গতি করে দাও মা। ওর বড় কষ্ট।’

মুখ থেকে কথা কেড়ে নিল নরেন, ‘হ্যাঁ, ছাই করেছেন আপনার মা।’

রামকৃষ্ণ দমে গেলেন। কিন্তু কি মনে করে মৃদু হেসে উঠলেন কিছুক্ষণ পর। চোখ দুটি নিমীলিত।

একটি প্রদীপ কেবল কাঁপা অবস্থায় জ্বলছে।কারুর মুখ স্পষ্ট দেখার কোনো অবকাশ নেই।আরতি সবেমাত্র শেষ হল। প্রসাদ আসবে এবার।

রামকৃষ্ণ চোখ মেললেন। সে চোখে মানুষ নেই।সাধকের চোখ।অধরে নজরে না আসার মতো হাসি। ঠোঁট কাপছে ঈষৎ। সেই অবস্থাতেই নরেনের দিকে ঝুঁকে, যেন খানিক চুপি চুপি বললেন, ‘আজ মঙ্গলবার। বড় জাগ্রত দিন। নরেন, তুই নিজেই একবার মা’কে বলে দেখ না। যা না একবার মন্দিরে…’

নরেন হতভম্ব। লোকটা বলে কি? সে কি মায়ের কাছে আসে? না বিশ্বাস করে? আসে তো এই লোকটার কাছে। তাও খুব বিশ্বাস নিয়ে, তা নয়। আসে কেবল এক মায়ার টানে। সেটা যে কি, তা সে নিজেই জানে না। এখানেই তো মুশকিল।

যুক্তি, তর্ক দিয়ে কিছুতেই সে বুঝতে পারে না, এই অতি নগণ্য গাঁইয়া একটা অজ্ঞানী মানুষের কাছে সে কেন আসে। একটা যুক্তি মনে মনে খাঁড়া করেছে যদিও। একমাত্র এখানে এলেই সে সংসারের নানা প্রশ্নবাণ থেকে নিষ্কৃতি পায়।

এখানে কোনো পাওনাদার নেই। এখানে কেউ বাঁকা চোখে দেখে না তাঁকে। আর একটা কথা, এই লোকটা কিন্তু ভালোবাসে তাঁকে। এর কাছে এলে স্নেহ পাওয়া যায়। সেখানে কোনো স্বার্থ নেই।

কিন্তু এ লোকটা বলে কি?

রাগে শরীর জ্বলে উঠল তার। সরাসরি অস্বীকার করলো সে, ‘আমার ওসব ভক্তি টক্তি আসে না ওতো। উনি আপনার মা, আপনি বলুন গে যান।’

‘উফ্, আমি তো বলেইছি। তোকে ভক্তি দেখাতে হবে নাইকো। একবার শুধু যাবি। বলবি আমায় ধন দাও টাকা দাও। ফিরে আসবি। ব্যাস্। আর কিচ্ছু করতে হবে না তোকে। নিজের জন্য না হয়, আমার জন্য যা একবার।’

যে ভক্তি তার মনে নেই। সে অনুভূতি যেন একটা ছমছমে ভাব নিয়ে প্রকাশ হতে চায়। রামকৃষ্ণর মুখ মনে পড়লো তার। কিছুক্ষণ সে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো। দূরে এক মাঝি গান ধরেছে। একটা প্যাঁচা উড়ে এসে বসলো মন্দিরের শৃঙ্গে। একহাজার পায়রার বকবকম শোনা যায়। ডানা ঝাঁপটানোর শব্দ কদাচিত। কেউ নেই কোথাও। নিশ্চিত নিঃশব্দতা।

দুর্বল হওয়া নরেন দত্তর সাজে না। কিন্তু যে মানুষ শাসনে মরে না, সে ভালোবাসায় মরে। নরেন উঠলো। পেছনে দরজা দিয়ে পা রাখলো মন্দিরের বিশাল চাতালে।

রামকৃষ্ণ বসে আছেন নিজের তক্তোপোষে। নরেন দেখতে পেলো না, তিনি হাসছেন। শুনতে পেলো, মৃদু হাততালি দিচ্ছেন রামকৃষ্ণ। আলতো স্বরে ডাকছেন, ‘মা… মা…’

ক্রমশ সে আওয়াজ কমতে লাগলো। ঝিঁঝিঁর ডাক ছাড়া আর কিছু নেই। নরেন অগ্রসর হতে লাগলেন। কাল এসে দাঁড়িয়েছে আজ, কালীর দ্বারে। সিঁড়িতে পা রাখলেন নরেন। এক পা, দু পা, তিন পা…..

ওই দূরে, চাতালের এক কোনো রামকৃষ্ণর ঘরে আলো জ্বলছে, দেখা যায় এখান থেকে। রামকৃষ্ণ উঠে পায়চারি করছেন ঘরের ভেতর। খিলখিল করে হাসছেন, আর হাততালি দিচ্ছেন।

সাধকের করশব্দে কাম ক্রোধ উড়ে যায়।

রামকৃষ্ণ হাসছেন। কেন, তিনি ছাড়া কেউ জানেন না…

২.
একটি প্রদীপের আলোয় একটি সিংহাসন। তাতে আসীন এক কালীমূর্তি। চকচকে শরীরে হলুদ আলোর শিখা। চোখের দুই মনিতে এক আগুন দুই হয়ে যায়। নরেন তেমন মানুষ নয়, যে ভক্তিতে গলে পড়বে। তবু, অদ্ভুত এক রোমাঞ্চ হতে লাগলো তার।

যে ভক্তি তার মনে নেই। সে অনুভূতি যেন একটা ছমছমে ভাব নিয়ে প্রকাশ হতে চায়। রামকৃষ্ণর মুখ মনে পড়লো তার। কিছুক্ষণ সে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো। দূরে এক মাঝি গান ধরেছে। একটা প্যাঁচা উড়ে এসে বসলো মন্দিরের শৃঙ্গে। একহাজার পায়রার বকবকম শোনা যায়। ডানা ঝাঁপটানোর শব্দ কদাচিত। কেউ নেই কোথাও। নিশ্চিত নিঃশব্দতা।

প্রথম কথা বলে নরেন নিজেই চমকে উঠলো- ‘মা….’

নিজের কণ্ঠের প্রতিধ্বনি নিজের কানেই অচেনা ঠেকলো তার। পরের মুহুর্তে সে বুঝতে পারলো, সে এখানে বেশিক্ষণ থাকতে পারবে না। এ আরেক মায়া। মহামায়া।

এ রূপও বেশিক্ষণ দেখা যায় না। গিলে খেতে আসে। সর্বনাশী, ভয়ংকরী। তবু, এতো মায়া আসছে কেন! চোখ বুজলো নরেন। বিড় বিড় করে বলে যেতে লাগলো, ‘আমায় জ্ঞান দাও, বৈরাগ্য দাও, ভক্তি দাও, শুদ্ধি দাও…’

দরজায় এসে পৌঁছালো যখন, দেখলে মনে হয়,ছাড়া পেয়েছে বন্দীদশা থেকে।

রামকৃষ্ণ প্রশ্ন করলেন, ‘কি রে? বললি মা’কে পয়সার কথা?’

কালীমন্দিরের ভেতর গিয়ে এবার বসে পড়লো সে। জিভে আগল দিয়ে রাখলো কিছুই বলবে না। অনেক ভাবনা আসছে মনে। সেসব অনেক ওপরে, পয়সাকড়ির। নরেন পারলো না আর। তাঁর সমস্ত জ্ঞান, পড়াশুনা, তেজ, বিবেচনা নিয়ে তার অবিচল মাথা আস্তে আস্তে নুয়ে পড়ল এক জড়মূর্তির পায়ে।

নরেন নীরব।

‘চুপ করে আছিস কেনে? বলেছিস তো?’

মুখে উত্তর নেই। শুধু মাথা নাড়লো নরেন, যার অর্থ, না।

রামকৃষ্ণ খানিক কপট বিরক্তি আনলেন মুখে, ‘সে কি রে? তো এতক্ষণ কি করছিলি?’

নরেন চুপ।

‘যা যা আবার যা। এবার ঠিকঠাক বলে আসবি। আর যেন ভুল না হয়…’

নরেন চলল আবার। সেই রাত। সেই সিঁড়ি। সেই নৈঃশব্দ্য। আর সেই মায়া। মহামায়া। সব একই আছে।

এবার আর মা ডাক নয়। কাজের কথাটি বলে ফিরবে সে।

‘কি রে? এবার বলে এলি তো?’

নরেন আবার মাথা নাড়ে। বিধস্ত। অসহায় সে। তেজ উড়ে গেছে। জমে থাকা ভক্তির কাছে হার মেনেছে যুক্তিবাদী মন।কিছু একটা হচ্ছে তার, সে বুঝতে পারছে না। আর রামকৃষ্ণকেও খুশি করতে পারছে না। ভদ্রলোক বিরক্ত হচ্ছেন।

‘এবারও পারলি নে? উফ্।’

বসে পড়লেন খাটে।

‘তুই শুধু একবার বলবি। আমায় ধন দাও। আমার দুঃখ কষ্ট দূর করে দাও। এটুকুই বলে উঠতে পারলি নে? যা যা এই শেষ একবার যা। তিনবারের বার সব সাধনা সফল হয়। এবার কি বলবি একদম ঠিক করে যা।দেখবি, মা তোর সব দুঃখ কষ্ট দূর করে দেবে।’

রামকৃষ্ণ বাচ্চা ছেলের মতো হাসতে লাগলেন।

এ হাসির কাছে অহংকার চলে না। শুধু এই হাসির সরলতার মান রাখতে নরেন আবার গিয়ে দাঁড়ালো চাতালে।

কালীমন্দিরের ভেতর গিয়ে এবার বসে পড়লো সে। জিভে আগল দিয়ে রাখলো কিছুই বলবে না। অনেক ভাবনা আসছে মনে। সেসব অনেক ওপরে, পয়সাকড়ির। নরেন পারলো না আর। তাঁর সমস্ত জ্ঞান, পড়াশুনা, তেজ, বিবেচনা নিয়ে তার অবিচল মাথা আস্তে আস্তে নুয়ে পড়ল এক জড়মূর্তির পায়ে।

বাইরে ঘন হয়ে আসছে রাত।

রামকৃষ্ণ নিজের ঘরে বসে দুষ্টু ছেলের মতো হাসছেন। হাততালি দিচ্ছেন।

‘এইবার বুঝবে শালা… এইবার বুঝবে… জয় মা জয় মা…’

৩.
রাত অনেক। সিমলা পাড়া ঘুমিয়ে পড়েছে। কেবল নরেনের মা জেগে আছেন। খুট করে শব্দ হল সদরে।

‘নরেন এলি?’

‘হ্যাঁ মা’

‘খাবি না?’

‘না, এক বন্ধুর বাড়ি নেমন্তন্ন ছিল। খেয়ে এসেছি।’

শান্ত গঙ্গার ধার।

চুপ করে বসে আছেন মানুষটি।

একটা ঝড় এলো।

কেউ টের পায়নি।

মাঝিরাও নয়।

রামকৃষ্ণ হাসছেন। চোখে জল…

আনন্দের…

……………………………
আরও আধ্যাত্মিক তথ্য পেতে ও জানতে: ভারতের সাধক-সাধিকা
পুণঃপ্রচারে বিনীত -প্রণয় সেন

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………………………….
আরো পড়ুন:
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: এক
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: দুই
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: তিন
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: চার
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: পাঁচ
গুরুপূর্ণিমায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা: ছয়

গুরুপূর্ণিমা
গুরুপূর্ণিমা ও ফকির লালন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!