ভবঘুরেকথা
জীবনবেদ বিবর্তন সৃষ্টিতত্ত্ব

-ড. এমদাদুল হক

৬১
বাজারে এতো বেশি ধর্মীয় বই রয়েছে যে, সহস্র জনমেও পড়ে শেষ করা যাবে না। সুতরাং এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতেই পারে যে, ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে ধর্মজ্ঞান লাভ করা সম্ভব না। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে ব্যাপারটি এমন না। সত্য এতোই স্পষ্ট, এতোই সরল যে একজন নিরক্ষর ব্যক্তিও সরাসরি সত্যজ্ঞান লাভ করতে পারে।

একজন নিরক্ষর নারীও মা হতে পারে। একজন নিরক্ষর নারীও যখন সন্তান ধারণ করে, সন্তানের জন্ম দেয় তখন সে এই বিষয়ে সরাসরি অভিজ্ঞতা লাভ করে। একজন পুরুষ স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ হাজার বই পড়েও এই অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারে না।

অভিজ্ঞতা থাকলেই তা প্রকাশ করা যায় না। অভিজ্ঞতা প্রকাশ করতে হলে ভেতরে শব্দসম্ভার থাকা দরকার, বাক্য রচনার শিল্প আয়ত্তে থাকা দরকার, মননশীলতা ও সৃজনশীলতা থাকা দরকার, দৃষ্টির গভীরতা থাকা দরকার।

এখনেই অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞার মধ্যে পার্থক্য। যার অভিজ্ঞতা আছে কিন্তু প্রকাশের ভাষা নেই, তার জ্ঞান অন্যের কাজে লাগে না। যে সঠিকভাবে তার অভিজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারে সে প্রজ্ঞাবান। তার অভিজ্ঞতা থেকে অন্যরা শিক্ষা নিতে পারে।

প্রজ্ঞাবান তার অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেন শব্দ মাধ্যমে। এই শব্দগুলো মুখস্থ করলে কিংবা বারবার আবৃত্তি করলে অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ তৈরি হয় না। এখানেই সাধক ও মোল্লার মধ্যে পার্থক্য।

সাধক নিজের অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেন। মোল্লারা সাধকের বর্ণিত অভিজ্ঞতার ব্যাখা, অপব্যাখ্যা নিয়ে হৈচৈ করে।
মোল্লার অভিজ্ঞতা নাই- শাস্ত্র মুখস্থ।

সাধক শাস্ত্রের উল্টাব্যাখ্যা দেন না- নিজ অভিজ্ঞতার কথা বলেন। তা যদি কারো কাজে লাগে ভালো, না লাগলেও ভালো। কারণ ব্যক্ত করার প্রক্রিয়ায় সাধক নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করেন।

দ্রষ্টব্য: জীবনবেদ ৫১ থেকে ৬০ ফেসবুকে প্রকাশ করা হলো না। গ্রন্থাকারে সন্নিবিষ্ট হবে।

৬২
আমরা বুঝি, একজন আরেকজনের মতো হতে পারে না। কিন্তু তুলনা থামে না। অবিরাম আমরা নিজেকে তুলনা করি অন্যদের সাথে। একজনকে তুলনা করি অন্যজনের সঙ্গে। তুলনা আমাদের জীবনের সঙ্গে এমনভাবে মিশে গেছে যে- এটি খুব স্বাভাবিক বলেই মনে হয়।

আমরা বুঝতেই পারছি না যে, তুলনার মাধ্যমে দুঃখের সড়ক তৈরি হয়। সুখ চলে যায় নদীর ওপারে। ওপারের ঘাস যদি বেশি সবুজ মনে হয়, তাহলে কি করা উচিত? ওপারে যাওয়ার চেষ্টা করা, নাকি নিজের ঘাসে সেচ দেয়া?

প্রতিটি মানুষ অনন্য। তুলনা ছাড়া গরিবও নেই, ধনীও নেই; সুন্দরও নেই কুৎসিতও নেই। তুলনা ছাড়া আমি হচ্ছি আমি- এক ও অদ্বিতীয়।

তুলনার মাধ্যমে আমরা নিজেদের একটি স্থির চিত্র কল্পনা করি; অন্যদেরও একটি স্থির চিত্র কল্পনা করি। আমরা জানি জীবন স্থির নয়, তবু আমরা স্থির করে নেই আমি এমন- সে তেমন। আমাদের দুঃখ- আহা আমি যদি তেমন হতাম, কিংবা সে যদি এমন হতো।

জীবনের সত্যিকারের শিক্ষা হলো, যা যেমন তা তেমনভাবে গ্রহণ করা। এর ব্যতিক্রম মানেই লোভ। জীবন যেমন হওয়া উচিত তেমনি আছে। অন্য রকম হলে ভালো হতো, এই ভাবনাই বিভ্রম। তুলনা না করলে সবাই অতুলনীয়।

৬৩
ঢেউ যেমন সমুদ্রের আচরণ, চিন্তা তেমন মনের আচরণ। ঢেউ কোত্থেকে উৎপন্ন হয়? সমুদ্র থেকে। কোথায় ফিরে যায়? সমুদ্রে। চিন্তা কোত্থেকে উৎপন্ন হয়? মন থেকে। কোথায় ফিরে যায়? মনে। ঢেউ সমুদ্রে ফিরে যায় কিন্তু সমুদ্রের প্রকৃতি পরিবর্তন করে না। চিন্তা মনে ফিরে যায় এবং পরিবর্তন করে মনের প্রকৃতি। কেন?

কারণ ঢেউ যখন সমুদ্রে ফিরে যায় তীর থেকে কিছুই নিয়ে যায় না। চিন্তা যখন মনে ফিরে যায় তখন এর সঙ্গে করে নিয়ে যায় বাসনা। কীভাবে?

অনেক চিন্তা আসে। যখন কোনো একটি চিন্তাকে আমরা ধরে ফেলি তখন চিন্তার সঙ্গে বাসনার তরঙ্গ উৎপন্ন হয়। আবার সেই চিন্তা মন ঘুরে ফিরে আসে। আবার ধরলে তরঙ্গটি আরেকটু বড় হয়। এইভাবে একই চিন্তা ঘুরেফিরে আসে বারবার, হাজারবার। ফলে ঝড় উৎপন্ন হয়। মন অস্থির হয়ে বাসনা পূরণের উপায় অনুসন্ধান করতে থাকে। শুরু হয় যুদ্ধ।

যেভাবে সাগর পাড়ে বসে সাগরের ঢেউ দেখি সেভাবে যদি চিন্তার ঢেউগুলো দেখা যায়, তবে কি হবে? চিন্তারজগৎটি সমুদ্রের মতো বিশাল হয়ে উঠবে। হয়তো উপলব্ধিতে আসবে- “আমি সমুদ্রের এক বিন্দু জল নই, এক বিন্দু জলে গোটা সমুদ্র।” অন্যথায়, কথাটি রুমীর অর্থহীন উদ্ধৃতি মাত্র।

সমুদ্রের উপরিভাগে ঢেউ থামানোর চেষ্টা করলে ব্যর্থতা অনিবার্য। মনের উপরিভাগে চিন্তা থামানোর চেষ্টা করলে উন্মাদ রোগ অনিবার্য।

ধ্যানের জন্য নিজের উপর বলপ্রয়োগ করা যায় না। মনের বাড়ি সাজানো ধ্যান নয়- ধ্যানের বলাৎকার।

সমুদ্রের তলদেশে যেমন ঢেউ নেই, তেমনি মনের তলদেশে চিন্তা নেই। এক অন্তহীন নীরবতা, যা চিন্তা ধরতে পারে না। জীবনের লক্ষ্য, এই অন্তহীন শূন্যতাকে উপলব্ধি করা। জগতের সব সাধন পদ্ধতি মিলে গেছে শূন্যতার এই অপার সৌন্দর্যে।

৬৪
সে গুরুকে খুব ভয় পায়। গুরুও তার ভয় উপভোগ করেন। তিনি তাকে দেখিয়ে গর্ব করে বলেন- ‘এর নামই তাকওয়া’।

তাকওয়া কী? গুরুভয় নাকি গুরুপ্রেম?

ধর্ম আমাদের চিন্তার জগৎটি দোজখের ভয়ে ভরে দিয়েছে। অথচ, তিনি নাকি প্রেমময়! প্রেমময় ভয়ঙ্কর হয় কি করে?

যাকে ভয় পাই তাকে ভালোবাসা যায় কি? সাপকে আমরা ভয় পাই। সাপকে ভালোবাসতে পারি কি? প্রজা রাজাকে ভয় পায়, ভৃত্য ভয় পায় প্রভুকে, সিপাহি ভয় পায় জেনারেলকে। গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক কেমন হবে? রাজা-প্রজার? প্রভু-ভৃত্যের? সিপাহি-জেনারেলের? নাকি, প্রেমিক-প্রেমাস্পদের?

ভৃত্য পেশিশক্তির দাস। প্রভু দূরে থাকলে ভৃত্যের ভালো লাগে। যে ভৃত্য প্রভুকে ভয় পায়, সে প্রভুর মৃত্যু কামনা করে। যেখানে ভয় থাকে সেখানে স্বাধীনতা থাকে না। মন পালাই-পালাই করে, যাই-যাই করে।

মান-অভিমান, অনুরাগ-বিরাগের সম্পর্ক যার সঙ্গে নেই, তার সঙ্গে আত্মিক দূরত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পায়। প্রভুর ভয়ে ভৃত্যদের আতঙ্ক ভক্তি নয়। ভক্তি হলো প্রেমের শিখর।

প্রেমের মূল শত্রু হলো ভয়। ভয় আর প্রেম একসঙ্গে থাকতেই পারে না। ভয়ে মানুষ চুপসে যায়- প্রেমে উন্মুক্ত হয়। ভয়ে পালায়- প্রেমে কাছে আসে। ভয়ের সঙ্গে থাকে জড়তা, শীর্ণতা, সংকীর্ণতা, সন্দেহ।

প্রেমের সঙ্গে থাকে সজীবতা, তেজ, উদারতা, বিশ্বাস। ভয়ে হৃদয় শুকিয়ে যায়। প্রেমে হদয় সিক্ত হয়। সুতরাং গুরুভীতি তাকওয়া নয়কো- তাকওয়া হলো গুরুপ্রেম।

৬৫
চিন্তা সত্য। কর্ম সত্য। জীবন সত্য। ক্ষুধা সত্য। তৃষ্ণা সত্য। আহার সত্য। নিদ্রা সত্য। স্বপ্ন সত্য। মৈথুন সত্য। কাম সত্য- কামনা সত্য। চাওয়া সত্য- পাওয়া সত্য। লোভ সত্য। মোহ সত্য। রাগ সত্য- রাগমোচনও সত্য।

উত্তাপ যেমন অগ্নি থেকে পৃথক নয় তেমনি অস্তিত্ব পৃথক নয় ক্ষুধা তৃষ্ণা থেকে; সত্য কীভাবে পৃথক হবে? সিক্ততা যেমন জল থেকে পৃথক নয় তেমনি চিন্তা পৃথক নয় অস্তিত্ব থেকে; সত্য কীভাবে পৃথক হবে?

জীবন পৃথক নয় নিদ্রা মৈথুন থেকে- সত্য কীভাবে পৃথক হবে? মানুষ সত্য পায় না, কারণ সত্য খুঁজে জীবনের বাইরে। যেখানে যা নেই, সেখানে কি তা পাওয়া যায়?

রাবেয়া বসরি সুঁই খুঁজছেন উঠানে। হাসান বসরি জিজ্ঞেস করলেন- “সুঁইটি হারিয়েছো কোথায়?” রাবেয়া বললেন- ‘ঘরে’।- ‘হারিয়েছো ঘরে, বাইরে খুঁজো কেন?’। রাবেয়া বললেন, ‘তুমি তো তাই করছো!’।

মানুষ সত্য পায় না- কারণ সত্য হারিয়েছে ভেতরে- খুঁজে বাইরে। মানুষ সত্য পায় না, কারণ চিন্তায় সত্য খুঁজে না, বচনে সত্য খুঁজে না, কর্মে সত্য খুঁজে না, সম্পর্কে সত্য খুঁজে না।

মানুষ সত্য পায় না, কারণ সত্য খুঁজে কাবা কৈলাস মসজিদ মন্দির দরবারে। মানুষ সত্য পায় না, কারণ সত্য খুঁজে বেদ বাইবেল ত্রিপিটক কুরআন হাদিসে।

জীবনের বাইরে কোনো সত্য নাই। সম্পর্কের বাইরে কোনো সত্য নাই। সত্য খাই, সত্য যাই; সত্য দেখি, সত্য বলি, সত্য বসি, সত্যবাসি- সত্য হই। জীবনযাপনের মধ্যে সত্য প্রতিষ্ঠাই সাধনা। বাকি সব ভাওতাবাজি।

……………………
আরো পড়ুন-
জীবনবেদ : পর্ব এক
জীবনবেদ : পর্ব দুই
জীবনবেদ : পর্ব তিন
জীবনবেদ : পর্ব চার
জীবনবেদ : পর্ব পাঁচ
জীবনবেদ : পর্ব ছয়
জীবনবেদ : পর্ব সাত
জীবনবেদ : পর্ব আট
জীবনবেদ : পর্ব নয়
জীবনবেদ : পর্ব দশ
জীবনবেদ : পর্ব এগারো
জীবনবেদ : পর্ব বারো
জীবনবেদ : পর্ব তেরো
জীবনবেদ : পর্ব চৌদ্দ
জীবনবেদ : পর্ব পনের
জীবনবেদ : পর্ব ষোল
জীবনবেদ : পর্ব সতের
জীবনবেদ : পর্ব আঠার
জীবনবেদ : পর্ব উনিশ
জীবনবেদ : পর্ব বিশ
জীবনবেদ : শেষ পর্ব

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!