ভবঘুরেকথা
জীবনবেদ ২

-ড. এমদাদুল হক

৯৬
প্রত্যেক কার্যেরই একটি কারণ আছে। এটি একটি মৌলিক প্রাকৃতিক বিধি। জীবনকে যদি এই বিধির প্রতিফলন রূপে দেখা যায়, তবে বুঝা যাবে জীবনের প্রতিটি সুযোগ ও দুর্যোগের মধ্যেই রয়েছে ন্যায়ের প্রকাশ।

জীবনে যে যা পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে, সে তা-ই পায়- কমও না বেশিও না। শ্রদ্ধা করলে শ্রদ্ধা পাওয়া যায়; অপমান করলে অপমান পাওয়া যায়- এটিই স্বাভাবিক নিয়ম।

কাঁঠাল গাছ লাগাও, কাঁঠাল পাবে। আম গাছ লাগাও, আম পাবে। কাঁঠাল গাছে আম, আর আম গাছে কাঁঠাল ধরে না।

কল্যাণ কর্ম কর, কল্যাণ ফল পাবে। অকল্যাণ কর্ম কর, অকল্যাণ ফল পাবে। অকল্যাণ কর্মের ফল কল্যাণ হয় না। কল্যাণ কর্মের ফল অকল্যাণ হয় না।

এই নিখুঁত ন্যায়ের উপরই দাঁড়িয়ে আছে গোটা মহাবিশ্ব। পৃথিবীতে মনুষ্য জীবনধারা বহমান আছে এই ন্যায়ের উপরেই।

যেমন কর্ম তেমন ফল ফলবেই।
অগ্নি দগ্ধ করবেই, জল সিক্ত করবেই।
কার্য আছে কারণ নাই, এটি হতেই পারে না।
কর্ম আছে ফল নাই, এটি হতেই পারে না।

“তস্মাৎ, অসক্তঃ সততং কার্যং কর্ম সমাচর” (সুতরাং কর্মফলের প্রতি অনাসক্ত হয়ে কর্তব্য সম্পাদন কর)।

৯৭
বিশ্বাস করা ভালো। কিন্তু বিশ্বাসের উপর বিশ্বাস করা ভালো না। বিপদে পরলে বিশ্বাসের উপর বিশ্বাস রেখে সান্ত্বনা পাওয়া যায় বটে। কিন্তু মরীচিকার পেছনে ছুটলে তৃষ্ণা আরো বৃদ্ধি পায়। এবং তৃষ্ণার তীব্রতা আরো মরীচিকাবিভ্রম তৈরি করে।

যদি বিশ্বাস থাকে যে, ওখানে গুপ্তধন আছে, তবে খনন করা শ্রেয়। খনন করার পর যদি গুপ্তধন না পাওয়া যায়, তবে বিশ্বাসের উপর বিশ্বাস রাখা মৌলবাদিতা।

প্রমাণ উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত বিশ্বাস রেখে পথ চলা যায়। কিন্তু যদি প্রমাণ উপস্থিত হয় যে, এটি ভুল পথ, তবে বিশ্বাসের উপর বিশ্বাস রেখে পথ চলা নিশ্চিতভাবেই বিপথগামিতা। বিপথগামীরা কখনো গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না।

আয়নাতে ময়লা থাকলে যেমন নিজের চেহারা স্পষ্ট দেখা যায় না তেমনি মৌলবাদী বিশ্বাস থাকলে নিজেকে দেখা যায় না।

তাই নিজেকে জানতে শুরু করা এবং সংস্কারমূলক বিশ্বাস থেকে মুক্ত হওয়া একই সমান্তরালে অবস্থিত। নিজেকে জানার প্রচেষ্টা যারা করতে চায় না তারাই বিশ্বাসের উপর বিশ্বাস নিয়ে বসে থাকে।

জ্ঞানের জন্ম হয় অনুসন্ধান থেকে; আর সংস্কারমূলক বিশ্বাস থেকে জন্ম হয় কুসংস্কার। বিশ্বাস থাকলে বিশ্বাসই দেখা যায়- নিজেকে না। সমস্ত বিশ্বাস থেকে মুক্ত হলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়, সত্যের ঝলকে সে শূন্যতাই লাভ করে পূর্ণতা।

৯৯
আবহাওয়ার পূর্বাভাস আমরা ঠিকমতোই দিতে পারি। মানুষ জানে কোথায়, কেন, কীভাবে ঝড়ের উৎপত্তি হয়। আবহাওয়া অধিদপ্তর প্রায় নিখুঁতভাবে বলে দিতে পারে ঝড়ের গতিপথ ও গতিবেগ; নিম্নচাপ কতক্ষণ থাকবে, আগামীকাল তাপমাত্রা কেমন হবে, ইত্যাদি।

কোনো অধিদপ্তর আছে কি, যে ভেতরের আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিবে? ভেতরের আবহাওয়া আবার কি? ভেতরের আবহাওয়া হলো: ক্রোধের উত্তাপ- বিনয়ের বৃষ্টি; হতাশার মেঘ- আশার কিরণ; কামের ঘূর্ণিঝড়- প্রেমের মৃদু সমীরণ; বিষণ্নতার কুয়াশা- আনন্দের নীল আকাশ।

ষড়ঋতুর ষড়ভাব রয়েছে প্রত্যেকের ভিতরে। বাহ্যজগতের আবহাওয়া যেমন প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হয়, তেমনি ভেতরের আবহাওয়াও প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হয়। সবসময় কেউ এক মেজাজে থাকে না।

পরমাপ্রকৃতিতে যখন ঘূর্ণিঝড় উঠে আমরা নিরাপদ আশ্রয়ে যাই। আপন প্রকৃতিতে যখন ঘূর্ণিঝড় উঠে তখন তছনছ হতে দেই জীবনের লীলাভূমি। কেন?

কারণ আবহাওয়া অধিদপ্তর নাই। ক্রোধের উত্তাপ যখন জ্বালিয়ে দেয় মনের সবুজ ঘাস- বিনয়ের কোমল বৃষ্টি দিয়ে তা রক্ষা করতে পারি না। কেন?

কারণ আবহাওয়া অধিদপ্তর নাই। হতাশার মেঘে জ্বালাতে পারি না আশার আলো। বিষণ্নতার কুয়াশার মধ্যেই আমরা জীবনের দীর্ঘমেয়াদী সিদ্ধান্ত নেই। আবার, স্বচ্ছ নীল আকাশকে উপেক্ষা করে বসে থাকি ঘরের কোনায়। কেন?

কারণ আবহাওয়া অধিদপ্তর নাই। আবহাওয়া অধিদপ্তর আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিতে পারে কিন্তু ঘূণিঝড়, ভূমিকম্প, দাবানল, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি থামাতে পারে না। কিন্তু আমরা ভেতরের আবহাওয়াকে বদলে দিতে পারি।

মানুষ প্রকৃতির খেলার পুতুল নয়। মানুষ পরমাপ্রকৃতির এমন একটি সক্রিয় অংশ, যে সমগ্র প্রকৃতিকে প্রভাবিত করতে পারে।

যদি দুঃখ আসে, তবে চিন্তার গতিপথ পরিবর্তন করে আমরা সুখ লাভ করতে সক্ষম।

আধ্যাত্মিকতা কি? তেমন কিছু না- ভেতরের আবহাওয়া সম্বন্ধে সতর্ক থাকা, পূর্বাভাস বুঝতে পারা এবং ঝড়, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ভূমিকম্প ইত্যাদির রূপান্তর।

১০০
খুঁজছি, কিন্তু জানি না কি খুঁজছি- এটি সম্ভব না। যে খুঁজে- সে নিশ্চয়ই জানে, কী খুঁজে। যে সত্য খুঁজে, সে কী জানে সত্য কি? যদি না জানে, তবে খুঁজে কী? যদি জানে, তবে খুঁজে কেন?

আসলে কেউ সত্য খুঁজে না- সত্য খোঁজার বাহানায় সত্য থেকে পালিয়ে বেড়ায়।

যখনই সত্যের প্রসঙ্গ আসে আমরা পুনরুজ্জীবন, পুনরুত্থান, স্বর্গ, নরক, নবি, রসুল, কুরআন, কিতাব নিয়ে আলোচনা শুরু করে দেই। আমরা এমন সব কথা নিশ্চয়তার সঙ্গে বলতে থাকি, যা নিজের কানে শুনিনি, নিজে দেখিনি, উপলব্ধিও করিনি। আমরা এমনভাবে ওমর-ওসমান কিংবা কারবালার বর্ণনা দেই যেন এইমাত্র নিজের চোখে দেখে এলাম। ফলে নিজের অজান্তেই সত্যের নামে মিথ্যাচারের মধ্যে ডুবে থাকি।

মানুষ পূজার জন্য যেমন দেবতা বানায়, উদযাপনের জন্য যেমন উৎসব বানায় তেমনি খোঁজার জন্য একটি কাল্পনিক সত্য বানায়। বেশিরভাগ মানুষ কল্পনার কষ্টটিও করতে যায় না, নির্ভর করে বুখারী সাহেব কিংবা মীর মশাররফ হোসেনের কল্পনায়।

সত্য খোঁজার প্রয়োজন নাই। সত্য ঘিরে রেখেছে জীবন, আর জীবন ঘিরে রেখেছে সত্য। জীবন যেমন যাপনের ব্যাপার, সত্যও তেমনি যাপনের ব্যাপার।

সত্যযাপন মানে- সম্যক সময়ে সম্যক কাজ;

সত্যযাপন মানে- সত্যযোগ করা- সত্য বলা, সত্যখাদ্য ভোজন করা, সত্য দেখা, সত্য শোনা;

সত্যযাপন মানে- চিন্তার সঙ্গে কথার মিল, কথার সঙ্গে কাজের মিল;

সত্যযাপন মানে- জীবনের প্রতি সম্যক সাড়া;

জীবনের রহস্য উন্মোচিত হতে পারে কেবল সত্য জীবনযাপনের মাধ্যমে। বাকী সব কথার কথা।

……………………
আরো পড়ুন-
জীবনবেদ : পর্ব এক
জীবনবেদ : পর্ব দুই
জীবনবেদ : পর্ব তিন
জীবনবেদ : পর্ব চার
জীবনবেদ : পর্ব পাঁচ
জীবনবেদ : পর্ব ছয়
জীবনবেদ : পর্ব সাত
জীবনবেদ : পর্ব আট
জীবনবেদ : পর্ব নয়
জীবনবেদ : পর্ব দশ
জীবনবেদ : পর্ব এগারো
জীবনবেদ : পর্ব বারো
জীবনবেদ : পর্ব তেরো
জীবনবেদ : পর্ব চৌদ্দ
জীবনবেদ : পর্ব পনের
জীবনবেদ : পর্ব ষোল
জীবনবেদ : পর্ব সতের
জীবনবেদ : পর্ব আঠার
জীবনবেদ : পর্ব উনিশ
জীবনবেদ : পর্ব বিশ
জীবনবেদ : শেষ পর্ব

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!