ভবঘুরেকথা
তোমার দয়া বিনে চরণ সাধবো কি মতে

-মূর্শেদূল মেরাজ

মাই ডিভাইন জার্নি : বারো

তখন সকাল ৬টা ৩৫মিনিট। আমি আর আশিক সদ্য ভ্যান থেকে নেমে জ্যোতিধামের সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। কুয়াশা পাতলা হয়ে আসলেও সূর্যের আলো ফোটেনি। মাথাটা খানিক উঁচু করে খোলা দরজার উপরের ফলকে জ্যোতিধাম নামটার পাশে সালটা দেখে আমরা দুজনেই একটু আৎকে উঠলাম।

প্রশ্ন জাগলো প্রতিষ্ঠার কত বছর পর আমরা স্বশরীরে এখানে উপস্থিত হতে পারলাম? প্রতিষ্ঠার সাল যদি হয় ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দ তাহলে আমরা কত বছর পর এর সামনে দাঁড়িয়ে? ৬২ না ৫২ বছর? একটা গোটা নির্ঘুম রাতের কারণে ; নাকি শেষ পর্যন্ত উপস্থিত হতে পারার উত্তেজনায় হিসাবে গড়মিল হচ্ছিল তা বুঝতে পারিনি তখনো।

বহুকাল ধরেই লবান সাঁইজির খলিশাকুণ্ডির জ্যোতিধামে যাওয়ার অভিলাষ নিয়ে মনে মনে ঘুরে বেড়িয়েছি। কিন্তু কখনোই কাল-লগ্ন-যোগে মিল খায়নি। তাই ইচ্ছাটা ইচ্ছা পর্যন্তই থেকে গিয়েছিল। তবে লোকমুখে এই সাধুসঙ্গের বহু গল্প শুনেছি।

একবার এক সাধু তো বলেই বসেছিল, ‘সাধুসঙ্গের আদিভাব দেখতে হলে খলিশাকুণ্ডি চইলা যাইবেন বাপ।’ শুনে মনে মনে ভেবেছিলাম কোন এক কার্তিকে উপস্থিত হবই হব। কিন্তু হয়ে উঠেনি।

এইবারও যে যাওয়া হবে এমনটা জোর দিয়ে ভাবতে পারিনি। যাওয়ার ইচ্ছেটা ছিল চূড়ান্ত রকমের। তবে ইচ্ছে থাকলেই তো আর যাওয়া হয়ে উঠে না। তারজন্য চাই জোগাড়যন্ত্র। প্রথমে ভেবেছিলাম লালন সাঁইজির তিরোধানে যেয়ে একবারে লবান সাঁইজির সাধুসঙ্গ সেরে তবেই ফিরবো।

সাধুগুরুদের প্রত্যেক ঘরের একটা নিজস্ব-স্বতন্ত্র-সনাতনী ‘সৌন্দর্য’ থাকে। মূল আচার এক হলেও প্রত্যেক ঘরের নিজস্ব একটা ভিন্ন ভাবধারা থাকে। যা গুরুশিষ্য পরম্পরায় এগিয়ে চলে। এই ভাবটা ধরতে পারা জরুরী। নয়তো বেশিভাগ মানুষ তুলনা শুরু করে দেয়।

কিন্তু তাও বা হলো কই। এই দম বন্ধ করা শহর ঢাকায় ফিরতেই হলো লবান সাঁইজির সাধুসঙ্গের দিন কয়েক আগে।

শহরে ফিরে যখন কোনো কিছুতেই মন বসছিল না তখন অপ্রত্যাশিতভাবেই আশিক ফোন করে বললো, চলেন ব্যবস্থা হয়ে গেছে। এই কথা শুনবার জন্য প্রস্তুত না থাকলেও ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিতে সময় লাগলো না। সাধুসঙ্গের আগের রাতেই বাসে চেপে বসলাম দুইজনে।

উদ্দেশ্য খলিশাকুণ্ডি, ফকির আবদুর রব শাহ’র জ্যোতিধাম।

ফকির আবদুর রব শাহ’র জন্ম ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে সাবেক নদিয়ায়; বর্তমান কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার খলিশাকুণ্ডি গ্রামে। তিনি ফকির লালন শাহ’র সাক্ষাত শিষ্য ভোলাই শাহ’র সরাসরি শিষ্য। জানা যায়, লালন সাঁইজি ঘরের আরেক সাধক কোকিল শাহ ছিলেন তাঁর দীক্ষা গুরু।

গুরুর কাছে খেলাফত প্রাপ্তির পর থেকে তিনি লবান শাহ নামে পরিচিত হন। তিনি ১৩ কার্তিক ১৪১৬ বঙ্গাব্দ (২৮ অক্টোবর ২০০৯ খ্রিস্টাব্দ) বুধবার ৮৭ বছর বয়সে দেহত্যাগ করেন। তার আখড়াবাড়ি জ্যোতিধাম নামে পরিচিত। আর আমাদের উদ্দেশ্য সেই জ্যোতিধামেই যাওয়া। যদিও সেখানে দেখা মিলবে না স্বশরীরে লবান সাঁইজির।

সাধুগুরুদের প্রত্যেক ঘরের একটা নিজস্ব-স্বতন্ত্র-সনাতনী ‘সৌন্দর্য’ থাকে। মূল আচার এক হলেও প্রত্যেক ঘরের নিজস্ব একটা ভিন্ন ভাবধারা থাকে। যা গুরুশিষ্য পরম্পরায় এগিয়ে চলে। এই ভাবটা ধরতে পারা জরুরী। নয়তো বেশিভাগ মানুষ তুলনা শুরু করে দেয়।

উমুক ঘর ভালো-তমুক ঘর খারাপ। উমুক ঘরে এই হয়-তুমুক ঘরে ঐ হয়। ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলে বিষয়টা এমন নয়। প্রত্যেক ঘরের যে স্বতন্ত্র ভাবটা থাকে সেটা বুঝে নিলে চিন্তার জটিলতা-কুটিলতা যেমন কমে; তেমনি ভাবনার ব্যাপকতাও বাড়ে।

কোনো ঘরে হয়তো আনন্দের ভাব বিরাজমান সর্বত্র। কোনো ঘরে হয়তো নিরবতা। কোনো ঘরে হয়তো আদবই প্রধান। আবার কোন ঘরে কেবল ভক্তিভাব। ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রত্যেক ঘরকে তার নিজের সৌন্দর্যে বুঝেই শুদ্ধজ্ঞানে ভক্তিমনেই বিচার করতে হয়। তুলনায় যাওয়া বোকামি।

লবান সাঁইজির প্রধানতম বেশ কয়েকজন শিষ্যের সাথে যৎ-কিঞ্চিত পরিচয়-আলাপচারিতা ও তাদের আখড়ার যাওয়ার সৌভাগ্যের সুবাদে দেখেছি এই ঘরে আদব একটা অন্যতম সৌন্দর্য। লবান সাঁইজি ধরাধামে দেহধারী না থাকলেও তার হাতে বায়াত লালন অনুসারীরা সেই ধারা অব্যাহত রেখেছেন।

দেশ-বিদেশের লালন অনুসারীদের সাধুসঙ্গগুলো যখন কেবল মেলায় বা স্মরণোৎসবে রূপ নিচ্ছে তখনো লবান সাঁইজির ঘরে লালনের আদি ভাবধারায় সাধুসঙ্গ করার চেষ্টার অন্ত নেই। সে দৃশ্য সাক্ষাৎ না দেখলে বলে বোঝানো মুশকিল।

সুযোগ থাকার পরও আমরা যারা আজও সাধুসঙ্গের সুধা পূর্ণরূপে পান করেন পারিনি আমাদের সকলের জন্য আবারো বলতেই হয়-

গুরুদোহাই তোমার, মনকে আমার
লও গো সুপথে।
তোমার দয়া বিনে তোমায় সাধবো
কি মতে।।

কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে বিশেষ করে বলতে গেলে লবান সাঁইজির ঘরে। লালন ঘরের সকল নিয়ম মেনে, সকল পর্ব অনুসরণ করে অষ্টপ্রহরের সাধুসঙ্গ অনুষ্ঠিত হয়। অধিবাস দিয়ে শুরু হওয়া সাধুসঙ্গ শেষ হয় পরেরদিন পূর্ণসেবার মধ্য দিয়ে।

লবান সাঁইজির ঘরের সাধুসঙ্গ দেখলে সকলেই মানতে বাধ্য হবেন যে, কোনো একাডেমী দিয়ে নয় সাধুসঙ্গ অনুষ্ঠিত হতে হবে সাধুগুরুদের হাত ধরেই। তবেই তা পূর্ণরূপে প্রকাশ পাবে। তবেই না আগত উৎসুখ-জিজ্ঞাসু-নবীনদের মননে সাধুসঙ্গের ভাব উদয় হবে। সেই সুধা পানের আকাঙ্ক্ষা জাগবে। জাগবে ভক্তি-আসবে স্থিরতা-চর্চিত হতে শুদ্ধতা।

একটা দীর্ঘ সময় গরাগরি দিয়েও যখন বুঝতে পারলাম, নাহ্! ঘুম আর আসবে না তখন উঠে পরলাম। ততক্ষণে অবশ্য সাধুগুরুরা আসতে শুরু করে দিয়েছে। জ্যোতিধামের আখড়া ঘরের সাদা ফকিরদের যুগল আসনগুলো ধীরে ধীরে ভরে উঠতে শুরু করেছে।

জ্যোতিধামের সদর দরজা ধরে যে মেঠোপথটা ধামের ভেতর চলে গেছে। সেটা দিয়ে বিস্ময় চোখে আমরা যখন এগিয়ে চলছি। তখন মাত্র দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে। সাধুগুরুদের মধ্যে যে গুটিকয়েকজন এসে উপস্থিত হয়েছেন। তারা লবান সাঁইজির সমাধিসৌধ ঘেরা আখড়া ঘরে উঠে বসেছেন।

কেউ কেউ মুখে জল দিতে বের হচ্ছেন। দুই হাত জড়ো করে ভক্তি দিতে দিতে এগিয়ে যেতে যেতে মূল বাড়িতে প্রবেশ করে পাওয়া গেলো বুড়ি মা’কে। তিনি সকালের সেবা প্রস্তুতের তদারকি করছেন। ফকির নহির সাঁইজির কন্যা বুড়ি মা এক অসাধারণ চরিত্র। যার হাসি মুখ দেখলে মুহূর্তেই মন ভালো হয়ে যায়।

ভেতরবাড়ির বিশাল উঠানের একপাশে শীতের আগমনী সবজি কাটা হচ্ছে এই সাত সকালেই। সাধুসঙ্গের আগে এক দফা ঘুমিয়ে নিতে পারলে মন্দ হয় না। দুপুর হয়ে গেলে আর অষ্ট কেনো দ্বাদশ প্রহরেও ঘুমের সুযোগ পাওয়া যাবে কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছেই। বুড়ি মা মনের ভাব বুঝেই বললেন-স

‘কালের সেবাটা নিয়ে তারপর ঘুমাও। চারটায় অধিবাস। এর আগ পর্যন্ত ঘুমাবা।’

যথা আজ্ঞা বলে উপস্থিত সাধুগুরুদের সাথে কুশলাদী বিনিময় করতে করতে সেবা চলে আসলো। বুড়ি মা’র হাতের রান্না যাদের গ্রহণের সৌভাগ্য হয়েছে তারাই বুঝতে পারবেন সেই স্বাদের প্রকারভেদ। সবজি খিচুড়ি পাতে পরতে না পরতেই বুড়ি মা দুই হাতে দুই থালা নিয়ে উপস্থিত।

এক থালাতে জাম্বুরা ভর্তা অন্য থালাতে কদবেল ভর্তা। জাম্বুরা-কদবেল ভর্তা সহযোগে যে খিচুড়ি খাওয়া যেতে পারে এই বিষয়টা আগে কখনো ভাবনাতেও আসেনি আমাদের। আমরা অবাক হলেও বুড়ি মা হাসি হাসি মুখ করে সবার পাতে দিতে দিতে এগিয়ে চললেন। নেই নেই করে তখনো আমরা বিশ-বাইশ জন বসেছি সেবা নিতে।

একটা দীর্ঘ সময় গরাগরি দিয়েও যখন বুঝতে পারলাম, নাহ্! ঘুম আর আসবে না তখন উঠে পরলাম। ততক্ষণে অবশ্য সাধুগুরুরা আসতে শুরু করে দিয়েছে। জ্যোতিধামের আখড়া ঘরের সাদা ফকিরদের যুগল আসনগুলো ধীরে ধীরে ভরে উঠতে শুরু করেছে।

ক্রমশ তা আখড়া ঘর-বারান্দা পেরিয়ে উঠানে গিয়ে ঠেকছে। পরিচিত-অপরিচিত সাধুগুরুদের দরশনে মন প্রফুল্ল হয়ে উঠতে লাগলো। নির্ঘুম রাত-ভ্রমণের ক্লান্তি আর কাছেপিঠে ভিড়বার সাহস করলো না।

যেমন কথা ছিল তেমনি দুপুরের সেবার পর কাটায় কাটায় চারটার সময় শুরু হয়ে গেলো অধিবাস। নহির সাঁইজির সভাপতিত্বে বাদ্য বাজিয়ে ফকির লালনের কালাম গেয়ে অধিবাস পর্ব চলতে লাগলো। সামসুল ফকিরের ডঙ্কার তালে বাজানো ডুগি, বুড়ি মার জুড়ি, বহররম ফকিরের দোতারা, রওশন ফকিরের হারমোনিয়ামসহ আরো বেশকিছু বাদ্যযন্ত্রে যখন মুখোর তখন গান ধরলেন নহির সাঁইজি-

কোথায় রইলে হে দয়াল কাণ্ডারি।
এ ভবতরঙ্গে আমায় দাও এসে চরণতরী।।

পাপীকে করিতে তারণ
নাম ধরেছ পতিত পাবন,
সেই ভরসায় আছি যেমন
চাতক মেঘ নিহারি।।

যতই করি অপরাধ
তথাপি হে তুমি নাথ,
মারিলে মরি নিতান্ত
বাঁচালে বাঁচতে পারি।।

সকলরে নিলে পারে
আমারে না চাইলে ফিরে,
লালন বলে এ সংসারে
আমি কি তোর এতই ভারি।।

অধিবাসের পরপরই চাল-জল-ভক্তি সেরে মুড়ি-খৈ সেবা। ধীরে ধীরে মানুষ বাড়ছে সাথে লোকজনও। মানুষ আর লোকজনের যে সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে তা তো আর বলে বোঝাতে হবে না এতোদিন পর। যাক সে কথা। অনেক পরিচিত মুখ চারপাশে ভরে উঠছে।

নতুন করে পরিচয় হচ্ছে কত জনের সাথে। প্রবেশপথের দুই ধারে জমতে শুরু করেছে মেলা। চায়ের দোকানগুলোতে জমে উঠছে সাধুগুরুভক্তদের আলাপচারিতা। রঙবেরঙের জ্বলে উঠা বাতির নিচে যে যার মতো গল্পে মেতে উঠতে শুরু করেছে।

আমাদের মাঝে গুটিকয়েক মানুষই পারে সাধুসঙ্গ থেকে খুঁজে খুঁজে সুখ স্মৃতি-শুদ্ধ মানুষ-সদালাপকে স্মরণে রাখতে। আর বেশিভাগ লোক তো বেদনার স্মৃতি-দুষ্ট লোক-নষ্ট আলাপকে স্মরণে রাখতে পছন্দ করে।

হয়তো এরমাঝে কেটে গেছে বেশ কিছু সময়। বহুদিন পর সেই সাধুর সাথে সাক্ষাৎ হবে ভেবে ভেবে আপনি হয়তো অনেক বেশি উত্তেজিত। একসময় সেই কাঙ্ক্ষিত মুর্হূতও উপস্থিত হলো। কিন্তু দেখা গেলো সেই সাধু আপনাকে চিনতেই পরলো না। ঝুপ করে আপনার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। তাই তো?

মন খারাপ করার মতোই ঘটনা বটে। কিন্তু সাধুর হাটে কি আর মন খারাপ করে থাকলে চলে? সাধুর হাটে নাম জানা না জানা কত লোকের সাথেই তো দেখা হয়-সাক্ষাৎ হয়-আলাপচারিতা হয় কিন্তু সকলকে কি আর মনে থাকে? কতজনের সাথে কতশত কথাই তো হয় কিন্তু তার কতটা স্মরণে থাকে?

কত ঘটনার সাথেই তো যুক্ত হয়ে যেতে হয়; কিন্তু তার কতটা মনে রাখতে পারি বা মনে রাখতে চাই। আসলে স্মৃতির গহ্বরে সবই লুকিয়ে থাকে। হারায় না কিছুই। কেবল উপযুক্ত পরিবেশ পেলেই তা স্পষ্ট হয়।

তাই চাই উপযুক্ত পরিবেশ এবং নিজে উপযুক্ত হওয়া। তবেই মিলবে যোগ। আর যোগে হবে যোগাযোগ। আর যোগে না মিললে মনে মন মিলবে কি মতে?

আমাদের মাঝে গুটিকয়েক মানুষই পারে সাধুসঙ্গ থেকে খুঁজে খুঁজে সুখ স্মৃতি-শুদ্ধ মানুষ-সদালাপকে স্মরণে রাখতে। আর বেশিভাগ লোক তো বেদনার স্মৃতি-দুষ্ট লোক-নষ্ট আলাপকে স্মরণে রাখতে পছন্দ করে।

প্রথম ভাগের মানুষ নিজে যেমন স্বস্তিতে-শান্তিতে থাকতে পছ্ন্দ করে; তেমনি আশপাশের মানুষকেও শান্তিতে রাখতে পছন্দ করে। আর দ্বিতীয় ভাগের লোকরা এইসব কুবৃত্তিকে ধারণ করে নিজে যেমন অশান্ত হয়ে ওঠে; তেমনি আশপাশের লোকজনকেও অশান্ত করে তোলে।

যে ঘটনা ঘটেই নি বা ঘটার সম্ভবনাও নেই তা নিয়েই মেতে থাকে জীবন ভর। তা সে সাধুসঙ্গেই হোক কিংবা নিভৃত কুঠিরে।

প্রথম প্রথম ধরতে পারতাম না সাধুর হাটে কে কি উদ্দেশ্যে আসে। কে কি চায়। এখনো যে বুঝি তাও না। তবে সাধুসঙ্গে কাদের সাথে সঙ্গ করবো আর কাদের সাথে সঙ্গ করবো না সেটার সিদ্ধান্ত নেয়া জরুরী হয়ে পরেছিল একটা সময়।

সাধুর হাটে এই দুই মধ্যমণি শ্রেণীর পরেই থাকে অবহেলিত শ্রেণী। আর এই অবহেলিত শ্রেণীর প্রথমে ধরা পরে ‘পাগল’ শ্রেণী। মনে রাখতে হবে, এই পাগল কিন্তু উন্মাদ নয়। অনেকেই পাগল আর উন্মাদকে বুঝতে ভুল করে; গুলিয়ে ফেলে।

এই সিদ্ধান্তে আসার জন্য মনে মনে একটা ভেদ-বিচার চলছিল বহুদিন ধরেই। স্থিরতার জন্য অস্থির মানুষের সঙ্গত্যাগ করাটা জরুরী; বিষয়টা বুঝতাম। কিন্তু আমি নিজেই অস্থির তাই অন্যদের বিচার করাটা আমার পক্ষে সহজ ছিল না মোটেও।

যেখানে একটা মানুষের সাথে দীর্ঘকাল বসবাস করেও তার আসল চেহারা বা প্রকৃত স্বভাব ঠাহর করা যায় না। সেখানে হুটহাট করে কারো সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়াও কতটা যৌক্তিক তাও একটা বড় প্রশ্ন। আবার প্রত্যেককে আগাগোড়া বিচার-বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে আসতে গেলে একজনের পেছনেই গোটা জীবন চলে যাওয়ার কথা।

তাই এতোসব ঝামেলায় না গিয়ে সাধুসঙ্গকে সঠিকভাবে শুদ্ধভাবে অনুধাবন করার ক্ষেত্রে মোটা দাগে কাদের সাথে সাধুসঙ্গে সঙ্গ করা যাবে আর কাদের সাথে সাধুসঙ্গে সঙ্গ দেয়া যাবে না তার সহজ পথ খুঁজতে থাকি।

সমস্যার বিষয় হলো সাধুর হাটে সব ধরণের লোকই থাকে। তবে ভালো খবরটা হলো এই যে, এরমাঝে কেবল দুই ধরণের মানুষ হয় মধ্যমণি। এর প্রথমভাগ হলো ‘ফকির’ আর দ্বিতীয় ভাগ হলো ‘ভিখারি’। ফকির হলো সেই শুদ্ধ সাধুগুরু যারা সকল কিছু বিলিয়ে দিয়ে ফকির হয়ে বসে আছেন আলো ছড়িয়ে।

যাদের আকর্ষণে মানুষ পইপই করে ছুঁটে আসে-ভিড় করে সাধুর হাটবাজারে। অন্যদিকে আছে ভিখারি শ্রেণী। যারা প্রথমে আলাপ জমাবে তারপর কৌশলে হাত পাতবে।

সাধুর হাটে এই দুই মধ্যমণি শ্রেণীর পরেই থাকে অবহেলিত শ্রেণী। আর এই অবহেলিত শ্রেণীর প্রথমে ধরা পরে ‘পাগল’ শ্রেণী। মনে রাখতে হবে, এই পাগল কিন্তু উন্মাদ নয়। অনেকেই পাগল আর উন্মাদকে বুঝতে ভুল করে; গুলিয়ে ফেলে।

সাধুর হাটের এই পাগল হলো ভাবের পাগল। তবে এদের মধ্যে কে আসল পাগল আর কে পাগল সেজে আছে তা ধরতে পারা মোটেও সহজ নয়। এর জন্য চাই বাস্তব অভিজ্ঞতা। চাই চোখ দেখে মানুষের সরলতা চিনতে পারার ক্ষমতা। তবে যাই হোক না কেনো এই শ্রেণীকে বেশি না ঘাটানোই উত্তম।

তারপরে যাদের দেখা মেলে তারা হলেন ‘মস্তান’। না মশাই এই মস্তান পাড়া-মহল্লার মাস্তান নয়। এরা দেওয়ানা মস্তান। মুর্শিদের গোলাম। আচরণে একটু ক্ষিপ্রভাব থাকলেও একটু সহজ হয়ে মিশতে পারলে তাদের প্রকৃত রূপের কিছুটা তল পাওয়া যায়।

এদের মধ্যেও আসল-নকল চিনে নিতে হয়। নইলেই বিপদ। তবে এরা প্রেমিকের জন্য প্রেমিক মানুষ। আর ধোঁকবাজের জন্য ভয়ঙ্কর।

এর পরের শ্রেণী হলো আঁতেল শ্রেণী। এরা আপনাকে পেলেই জ্ঞান দেয়া শুরু করে দিবে। এদের বেশিরভাগই অল্প জানা লোক। এদের ধোঁকায় পরলেই বিপদ। মহাবিপদ। এদের থেকে সাবধান থাকতে হয়। নইলে মাথা গুলিয়ে দিবে অল্পতেই।

এরপরেই যাদের পাওয়া যায় তারা এজেন্ট শ্রেণী। এদের কাজ হলো আপনাকে পাকড়াও করে নিয়ে যাবে নিজ নিজ গুরুর কাছে। এবং সেই গুরুর কাছে বায়াত হওয়ার মন্ত্রণা দিয়ে যাবে সমান তালে। এদের বেশিভাগই হয় ধান্দাবাজ প্রকৃতির লোক। এদের থেকে সাবধান থাকাই শ্রেয়।

আরেক শ্রেণী হলো হতাশাবাদী। এরা সাধারণত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষিত-ব্যক্তিত্বসম্পন্ন আলাপী স্বভাবের হয়ে থাকে। এই শ্রেণী নিজেদের অতি বুদ্ধিমান মনে করে। তাদের থেকে যতদূরে থাকা যায় ততই উত্তম। কারণ এরা সকল কিছুতেই দোষ খুঁজে বেড়াবে এবং যাকে পাবে তার সাথেই সেই আলাপ জুড়ে দিবে।

তবে সাধুর হাটে সবচেয়ে সম্মোহনী শক্তি নিয়ে যে শ্রেণী বিচরণ করে তারা হলেন ‘প্রেমিক’ শ্রেণী। এই মানুষগুলোর জন্যই সাধুর হাট হয়ে থাকে প্রাণবন্ত। তবে এদের খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। সহজ মানুষ হলেই এরা ধরা দেয়।

তা শুধু আলাপেই রাখবে না। আশপাশের মানুষকে অস্থির করে তুলবে। যারা নিজে অস্থির তারাই সাধারণত এদের সঙ্গ করে। ঘটে যার সামান্য বুদ্ধি আছে তারা এদের দেখলেই ভো দৌঁড় দেয়।

আড্ডাবাজ শ্রেণীর মানুষজনও সাধুর হাটে জমায়ত হয়। তারা সাধুর হাটে থেকেও সেখানে থাকে না। সারাক্ষণ তাদের অতিতের স্মৃতি আর ভবিষ্যতের কল্পনার কাল্পনিক কাহিনী শুনিয়ে সকলকে মাতিয়ে রাখে। এরা সাধুর হাটের আবর্জনা শ্রেণী।

যারা সত্যি সত্যি জ্ঞান আহরণের উদ্দেশ্যে সাধুর হাটে যায় তারা এই শ্রেণীর খপ্পড়ে পরে সাধুর হাটে থেকেও সাধুগুরুদের সাধন-ভজন-গুরুকর্মের দেখবার-জানবার-বুঝবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। মেতে থাকে প্রাত্যহিক জীবনের অস্থিরতার গল্পে।

আরেক শ্রেণী হলো নেশাগ্রস্থ শ্রেণী। এরা মোটা দাগে দুই ভাগে বিভক্ত। এই শ্রেণীর এক ভাগ যারা জেনে-বুঝে-শিখে নেশা করে। তারা বড় কোনো সমস্যা নয়। দ্বিতীয় শ্রেণী হলো জাত নেশারু। তারা কেবল নেশা করার জন্যই সাধুর হাটে যায়। তাদের পাল্লায় পরলে আপনিও সেই ভাবে ডুব দিবেন। এই জ্বাল ছিঁড়ে বেড়িয়ে আসা প্রায় অসম্ভব।

আরেক শ্রেণীর লোক দেখতে পাওয়া যায় সাধুর হাটে। এরা হলো ব্যবসায়ী শ্রেণী। তারা সকল কিছুর ভেতর নিজের ব্যবসাটা ঠিকঠাক মতো করে নেয়। কাউকে বুঝতে না দিয়েই। এরা সাধারণ লোকজনের সাথে তেমন মিশে না। যাদেরকে দিয়ে ব্যবসা হবে তাদেরকেই টার্গেট করে।

আরেক শ্রেণীর লোক মেলে সাধুর হাটে। যারা নারী-যৌনতা ইত্যাদির খোঁজে সাধুর হাটে ঘুঁড়ে বেড়ায়। এদের মুখের ভাষা খুবই মিষ্ট হয়। সহজে মিশে যেতে পারে সকল আলোচনায়। চকচকে পোষাক-পরিচ্ছদে নিজেকে মুড়ে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কামুক চরিত্রের মানুষ এদের পেছনে মৌমাছির মতো উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়ায়।

তবে সাধুর হাটে সবচেয়ে সম্মোহনী শক্তি নিয়ে যে শ্রেণী বিচরণ করে তারা হলেন ‘প্রেমিক’ শ্রেণী। এই মানুষগুলোর জন্যই সাধুর হাট হয়ে থাকে প্রাণবন্ত। তবে এদের খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। সহজ মানুষ হলেই এরা ধরা দেয়।

নিজের মধ্যে জটিলতা ধরে রাখলে, কুটিলতা জমা করে রাখলে এদের পাশাপাশি থেকেও এদের সান্নিধ্য পাওয়া সহজ হয় না। নিজে প্রেমিক না হলে প্রেমিকের দর্শন মেলে না এই হাটে। প্রেমিকের কাছেই তো প্রেম ধরা দেয়। শুদ্ধ প্রেম রসিক বিনে কেউ কি তা পায়?

যে জন সাধুর হাটে প্রেমিক হয়ে প্রেম বিলাতে যায় সেই তো সন্ধান পায় তাঁর। বাকিরা তো ফাঁকিতে সময় কাটায়। প্রেমিকের জন্যই এই প্রেম বাজার। যার ভেতর যতবেশি শুদ্ধ প্রেম তার কাছে ততবেশি প্রকাশিত হয়-ততবেশি ধরা দেয় সাধুরবাজারের গুঢ়রহস্য। তার জন্যই এই বাজার। বাকিরা কেবল দর্শক।

সাধারণে অবশ্য প্রেম বলতেই বুঝে নরনারীর প্রেম। যে প্রেমে থাকবে যৌনতা। এরবেশি ভাবতে পারে এমন মানুষের সংখ্যা খুবই সামান্য। তারা রাধাকৃষ্ণ নাম শুনলেই খোঁজে যৌনতা। তাদের জন্য সাধুর প্রেম বুঝতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে।

যে প্রেম স্রষ্টার প্রতি সৃষ্টির। এই প্রেম গুরুর প্রতি শিষ্যের। এই প্রেমে প্রেমিক হয় ফানা। সেই প্রেম বোঝার কি সাধ্য আছে রশিক বিনে?

এই যে এতো কথা বলছি। তার আগে কিন্তু একটা কথা থেকেই যাচ্ছে। জগতে এতো আমোদপ্রমোদ থাকতে সাধুসঙ্গ কেন? সাধুসঙ্গে কি আছে? কেনোই বা সাধুসঙ্গ? আর কেনোই বা সেখানে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা? সোজাসাপটা ভাষায় জাগতিক বিচারে সাধুসঙ্গের আসলেই কোনো প্রয়োজনীয়তা দৃষ্ট হয় না।

সেখানেও থেকে যেতে হয় দর্শক রূপেই। এই যেমন প্রকৃতিকে না বুঝলে তার সৌন্দর্যকে নিজের মনে হয় না। মনে হয় বেড়াতে এসেছি অন্য কারো কাছে, অন্য কারো দেশে। আসলে সবই যে আমারই জন্য-সবই যে আমারই; এই ভাবনাটাই জন্মায় না।

কিছু মানুষ সাদা পোষাক ধারণ করে সমগ্র জীবনটা কেনো লালন লালন করে কাটিয়ে দিলো। সমগ্র জীবনটা কেনো মানুষকে সাধন-ভজন করে কাটিয়ে দিলো। সেসব ভাববার সময় কি আমাদের আদৌ আছে?

আমাদের মধ্যে কয়জনই বা পারি নিজের-নিজের পরিবারের চিন্তার বাইরে বের হয়ে জগতের চিন্তা করতে? ভোগ-সুখ-শান্তি-সম্পদ-সম্পত্তির কথা বিবেচনায় না নিয়ে কয়জনইবা জগত মুক্তির কথা-মানব মুক্তির কথা ভাবতে পারি?

আর যারা ভাবতে পারি তাদের মধ্যে কয়জনই বা সেই ভাবনার পথে হাঁটতে পারি; নিজের সংকীর্ণ ক্ষুদ্র গণ্ডি থেকে বেড়িয়ে? সাধুগুরুদের বুঝতে হলে-লালনকে বুঝতে হলে মনের যে বিশালতা প্রয়োজন, যে সামগ্রীকতা প্রয়োজন, যে সর্বজীবে প্রেম-ভালোবাসার বোধের প্রয়োজন তা মনে উদয় না হলে সাধুসঙ্গের রঙে মন রাঙবে কেন?

আর সাধুসঙ্গের ভাবের রঙ গায়ে মাখতে না পারলে সাধুসঙ্গে স্বশরীরে থেকেও সাধারণ দর্শক হয়েই থাকতে হবে। নয়তো সাধুসঙ্গের সমালোচনায় কাটিয়ে দিতে হবে বাকিটা জীবন। তেমনি এই জগতকে না বুঝলে ভ্রহ্মাণ্ডের রস আস্বাধন করা যায় না।

সেখানেও থেকে যেতে হয় দর্শক রূপেই। এই যেমন প্রকৃতিকে না বুঝলে তার সৌন্দর্যকে নিজের মনে হয় না। মনে হয় বেড়াতে এসেছি অন্য কারো কাছে, অন্য কারো দেশে। আসলে সবই যে আমারই জন্য-সবই যে আমারই; এই ভাবনাটাই জন্মায় না।

তাই দূর থেকে দেখা সাধুসঙ্গ আর ভেতর থেকে দেখা সাধুসঙ্গের সঙ্গ পাওয়ার অনুভুতিটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ফকির লালন বলেছেন-

ভজোরে আনন্দের গৌরাঙ্গ।
যদি ত্বরিতে বাসনা থাকে
ধর রে মন সাধুর সঙ্গ।।

সাধুর গুণ যায় না বলা
শুদ্ধচিত্ত অন্তর খোলা,
সাধুর দরশনে যায় মনের ময়লা
পরশে প্রেমতরঙ্গ।।

সাধুজনার প্রেম হিল্লোলে
কত মানিক মুক্তা ফলে,
সাধু যারে কৃপা করে
প্রেমময় দেয় প্রেম অঙ্গ।।

এক রসে হয় প্রতিবাদী
এক রসে ঘুরছে নদী,
এক রসে নৃত্য করে
নিত্যরসের গৌরাঙ্গ।।

সাধুর সঙ্গগুণে রঙ ধরিবে
পূর্ব স্বভাব দূরে যাবে,
লালন বলে পাইবে প্রাণের গোবিন্দ
কররে সৎসঙ্গ।।

তখন বাংলাবাজারের একটা ছোট্ট প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। লালকুঠির পাশে এক বড় ভাইয়ের অডিও ক্যাসেটের দোকান ছিল। তাই সুযোগ পেলেই অফিস থেকে বের হয়ে সেই বড় ভাইয়ের দোকানে যেতাম আড্ডা দিতে।

সেই অডিও ক্যাসেটের দোকানের ক্রেতা ছিল মূলত শ্যামবাজার-বাংলাবাজার-সদরঘাটের মুটে-মজুর-ভ্যান-রিক্সা-ঠেলা চালকেরা। তাদের কারোই ক্যাটেস প্লেয়ার নেই। তারপরও তারা প্রায় প্রতি সন্ধ্যাতেই নতুন নতুন ক্যাসেট কিনত। তাদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে ছিল বিচ্ছেদী গানের ক্যাসেট।

সারাদিন অমানুষিক পরিশ্রম করে মানুষগুলো সন্ধ্যায় সেই টাকায় কেনো ক্যাসেট কিনে জলে ফেলে; তা প্রথমটায় বুঝতাম না। পরে জেনেছি, তাদের প্রায় বেশিভাগই বাড়ি থেকে পালিয়ে এই শহরে এসেছিল। এদিক সেদিক করতে করতে জীবনটা কাটিয়ে দিচ্ছে। তাদের কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই।

কেউ আড়ৎ-এ ঘুমায়, কেউ বা ভ্যান-ঠেলা-রিকসার উপরে। কেউ বা গণ মেসে থাকে। সারাদিন যে পরিমাণ পরিশ্রম করে তাতে রাতে ঘুমের পর আর কোনো হুশ থাকে না। সেসময় সাথে যে টাকা পয়সা থাকে তা আশপাশের মানুষ নিয়ে চলে যায়।

এরজন্যেও নাকি একধরনের পেশাজীবী আছে। যারা এই শহরে রাতে ঘুমন্ত মানুষের পকেট থেকে টাকা পয়সা হাতিয়ে নেয়। এই তালিকায় নাকি পুলিশও আছে। ঘটনার সত্য-মিথ্যা জানি না। এসবই তাদের মুখে শোনা।

ভরসা করে কারো কাছে টাকা রাখার সাহসও করতে পারে না। প্রতিদিন যে পরিমাণ টাকা তারা উপার্যন করে তা যদি জমাতে যায় কয়েকজন মিলে। অল্পদিনেই একটা মোটা অংকের টাকা হয়ে যায়। যার কাছে জমা রাখা হয় সে নাকি লোভ সামলাতে পারে না।

সেই লোকের ছোট ছেলে বিকালের দিকে দোকানে আসতো। সন্ধ্যার পরপরই আবার গাড়ি হাকিয়ে চলে যেতেন। দোকানটা মূলত চালাত বিশাল সাদা দাড়ির শক্তসমর্থ প্রৌঢ় এক ভদ্রলোক। তিনি বলতেন তিনি প্রায় চার দশক ধরে সেই দোকানে ম্যানেজারির চাকরি করছেন।

সেই টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। আর এই ঘটনা এক দুইবার না বহুবার ঘটেছে। এমনকি প্রতিষ্ঠিত সমিতিতে টাকা রেখেও লাভ হয়নি। ফলে টাকা জমানোর ক্ষেত্রে তারা কাউকেই ভরসা করতে পারে না।

তাই তারা প্রতিদিনের টাকা প্রতিদিন খরচ করে ফেলতেই পছন্দ করে। সারাদিন খেটে সন্ধ্যায় যখন গোসল করে ফ্রেস হয়ে বের হয় তখন তারা দামী খাবারদাবার খায়। সিনেমা দেখে। অডিও ক্যাসেট কেনে। কেউ কেউ একটু আধটু নেশা করে।

আরো কত কি। আসলে সবই সময় কাটানোর ধান্দা মাত্র। একাকীত্বের কষ্টকে ভুলে থাকবার কৌশল।

এই খেটে খাওয়া মানুষগুলোর সাথে অল্পদিনেই একটা ভালো সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। দিনের বেলা দেখা হলেই বলতো মামা এটা খাওয়ান ওটা খাওয়ান। কিন্তু সন্ধ্যা হলেই পাল্টে যেত দৃশ্যাপট। পকেটে টাকা আসলেই তারা অন্য মানুষ। তখন তারা কে কোনটা খাওয়াবে তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরতো।

মাসুদ ভাইয়ের অডিও ক্যাসেটের দোকানের উল্টোপাশে একটা সিমেন্ট বিক্রির বিশাল দোকান ছিল। এর মূল মালিক বহু সম্পত্তি রেখে মারা গেছেন। তার ছেলেরা অভিজাত জীবনযাপন করলেও এই দোকানটি তখনো টিকিয়ে রেখেছিল বাবার স্মৃতি হিসেবে।

সেই লোকের ছোট ছেলে বিকালের দিকে দোকানে আসতো। সন্ধ্যার পরপরই আবার গাড়ি হাকিয়ে চলে যেতেন। দোকানটা মূলত চালাত বিশাল সাদা দাড়ির শক্তসমর্থ প্রৌঢ় এক ভদ্রলোক। তিনি বলতেন তিনি প্রায় চার দশক ধরে সেই দোকানে ম্যানেজারির চাকরি করছেন।

দোকান মালিকের ছোট ছেলে ব্যবসায়ীক লোকজন ছাড়া আশপাশের কারো সাথে কথা বলতেন না। গাড়ি থেকে নেমে সোজা দোকানের শেষ প্রান্তের সুসজ্জিত কেবিনে ঢুকে যেতেন। সৌখিন ভদ্রলোক দামী পোষাক-দামী পরফিউম দিতে বেশ পছন্দ করতেন।

আমরা প্রায় সময়ই তার দোকানের সামনে রাখা বেঞ্চিতে বসে আড্ডা দিতাম। আমাদের সাথে কথা না বললেও প্রায়ই আমাদের জন্য চা-নাস্তা পাঠাতেন।

হঠাৎ করে একদিন যেয়ে দেখি সেই দোকানের সামনের বিশাল একটা অংশে পাটি পাতা হয়েছে। সেখানে লুঙ্গি পরা খালি গায়ের এক বিশাল ভুড়িওয়াল লোক চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। তার চারপাশে অনেক খাবারদাবার পরে আছে।

নানা ব্র্যান্ডের সিগারেটের প্যাকেট, চা ইত্যাদি। কিছু মানুষ দূর থেকে দেখছে। আমরা যেই বেঞ্চিটায় বসি। সেটা আছে সেখানেই কিন্তু সেখানে কেউ বসে নাই।

এলাকার সকল মামুর বেটারা গল্প দিতে লাগলো, সিমেন্টের দোকানে আগত সেই লোক নাকি সারাদিন মদ খায় আর ঘুমায়। আরো জানা গেল, সেই মাতাল বাবা নাকি সাত সকালে এই দোকানের সামনে বসে ছিল। তাকে বসবার জায়গা দেয়ার পর থেকে নাকি এই দোকানেই আছে।

দোকানের মালিক তাকে ভক্তি দিয়ে থাকতে বলেছেন। উনি দোকানে প্রবেশের পর থেকেই নাকি দোকানের বেচাকেনা বাড়ছে হু হু করে। আরো নাকি নানা উন্নতি শুরু হয়ে গেছে। এসব বিবেচনায় সেই মাতাল বাবার যা যা প্রয়োজন দোকান মালিক সব ব্যবস্থাই করেছেন।

মাথার উপর একটা ফ্যান থাকার পরও বিশাল সাইজের দুইখানা টেবিল ফ্যানও দেয়া হয়েছে মাতাল বাবাকে। বালিশ-বিছানাপত্র সবই আনা হয়েছে তার জন্য। কিন্তু তিনি সেগুলো ব্যবহার করেন না। পাটির উপরই ঘুমান।

কয়েক দিনের মধ্যেই সেই মাতাল বাবার নামে নানা মিথ ছড়িয়ে পরতে শুরু করল চারপাশে। শুধু বাংলাবাজার-শ্যামবাজারের ছোট-বড় ব্যবসায়ীরাই নয় শহর ছাড়ায়ে শহরতলীর বড় বড় ব্যবসায়ীরাও মাতাল বাবার জন্য বিভিন্ন পদের খাবার-মদের বোতল-সিগারেট সহ নানা কিছু পাঠাতে শুরু করলো।

ভদ্রলোক জাতে মাতাল থাকলেও তালে ঠিক ছিলেন। তিনি সেই সব উপঢৌকন ছুঁয়েও দেখতেন না। কারো সাধ্য ছিল না সেগুলো তার সামনে রাখে। অবশ্য তিনি ঘুমিয়ে থাকলে কেউ কেউ পাটির উপর সেসব উপহার রেখে দ্রুত সরে পরতো।

সেই পাটির চারপাশে সেগুলো জড়ো হতো। বাবা ফিরেও তাকাতেন না সেদিকে। উদাস দৃষ্টিতে ঘোলা চোখে কোথায় যেন তাকিয়ে থাকতেন। ভিড় পছন্দ করতেন না। তার কাছাকাছি গেলেই হুংকার দিয়ে উঠতেন। ভয়ে মানুষজন অনেকটা দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে থাকত।

মাসুদ ভাই এক দুপুরে সেই মাতাল বাবাকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে কৌশলে পাটির কোণার পরে থাকা সিগারেটের প্যাকেটের স্তুপ থেকে একটা প্যাকেট হাতিয়ে নিতে গিয়েছিল। অবশ্য শেষ রক্ষা হয়নি। বাবা ঠিকই টের পেয়ে গেছেন।

অনেক অভিজাত পরিবারের সদস্যদের দেখেছি দামী দামী টিফিন ক্যারেয়ারে খাবার নিয়ে ভয়ে ভয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। তিনি টাকা পয়সা নিতেন না। আর প্রায় সারাদিনই অভুক্ত থাকতেন বলেই হয়তো মানুষজন তার জন্য খাবার নিয়ে আসতো।

তিনি অবশ্য কারো খাবারই গ্রহণ করতেন না। দোকানের ম্যানেজার চৌরঙ্গীর পাশের দোকান থেকে নানরুটি আর ভাজি এনে দিলে একটু আধটু খেতেন।

জোর করে তাকে কিছু দিতে চাইলে বা কোনো খাবার বা অন্য কিছু তার পাটির উপর রাখতে চাইলে তিনি গগন বিদারী হুংকার করে উঠতেন। তবে অনেকেই দূর থেকে তার পাটির উপর সিগারেটের প্যাকেট ছুড়ে দিয়ে পালিয়ে যেত।

চারপাশে দামী দামী সিগারেটের প্যাকেট পরে থাকলেও তিনি বিড়ি খেতেন। কখনো সখনো ইচ্ছে হলে ম্যানেজারকে ইশারা করতেন পাটির উপর পরে থাকা উপহারগুলোকে উৎসুক জনতার মাঝে কাউকে কাউকে দিতে। এই প্রসাদ পাওয়ার জন্য কত জনকে যে দেখেছি সেই সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকতে তার হিসেব নাই।

মাসুদ ভাই এক দুপুরে সেই মাতাল বাবাকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে কৌশলে পাটির কোণার পরে থাকা সিগারেটের প্যাকেটের স্তুপ থেকে একটা প্যাকেট হাতিয়ে নিতে গিয়েছিল। অবশ্য শেষ রক্ষা হয়নি। বাবা ঠিকই টের পেয়ে গেছেন।

তিনি বিশাল এক বাঁশ নিয়ে মাসুদ ভাইকে পুরো এলাকা দৌঁড়েছিল। এলাকার রিকসা চালক করিব সেই ঘটনা রসিয়ে রসিয়ে অভিনয় করে করে দেখিয়েছিল আমাকে।

সেই ঘটনার পর আর কেউ সাহস পায়নি তার পাটির উপর থেকে কিছু নিতে। তবে অন্যের কোনো কিছু গ্রহণ না করায় অল্পদিনে আগত দর্শনার্থীর সংখ্যা এবং আশপাশের ব্যবসায়ীদের উপহার পাঠানো কমে গেলো। কিন্তু তা একেবারে বন্ধ হলো না।

নানাভাবে বিশেষ করে সেই দোকানের ম্যানেজারকে ধরে বাবাকে উপহার বা কি কি লাগবে এসব সকলে খোঁজ নিতো। যদিও সেই বাবার সাথে কোনো চালাকি চলতো না।

মাসুদ ভাইয়ের দোকানটা ঠিক সেই বাবা যেখানে বসে থাকতো তার ঠিক বিপরীতে ছিল। বড় রাস্তার এই পার আর ঐ পার। তখন আমাদের একটা সিগারেট কিনতে তিনবার ভাবতে হয়। আর মাতাল বাবার সামনে পরে থেকে থেকে নষ্ট হয়ে যাওয়া সিগারেটের প্যাকেট দেখতে দেখতে একদিন মাসুদ ভাইকে বলেই ফেল্লাম-

ভাই আমরা টাকার জন্য সিগারেট কিনতে পারছি না। আর মাতাল বাবার সামনে প্যাকেট প্যাকেট সিগারেট পরে আছে।

মাসুদ ভাই আৎকে উঠে বললো, ভাই ঐ সিগারেটের কথা মুখেও আইনো না। সেইদিন যে দৌঁড় খাইছি। আমার জন্মের শিক্ষা হয়ে গেছেরে ভাই। একটুর জন্য জানে বাঁচছি। ঐ বাঁশ যদি মাথায় লাগতো তাহলে আমি কি আর বাঁচতাম?

এই কথা বলতে বলতেই দেখলাম সেই দোকানের ম্যানেজার হাসি হাসি মুখে রাস্তা পার হয়ে মাসুদভাইয়ের দোকানে উপস্থিত। তিনি আমার দিকে এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট এগিয়ে দিয়ে বললো, নেন বাবা আপনারে দিসে।

আমি অবাক তাকিয়ে রইলাম কিছু সময়। পুরো শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেছে ততক্ষণে। একটা শীতল বাতাস শিরদাড়া বেয়ে নেমে গেল যেন। আমি সেই মুর্হূতে টের পাচ্ছিলাম এই মাতাল মানুষটাকে মানুষজন এতো ভক্তি করে কেনো।

সেদিন তাকে উত্তর দেয়ার কিছু খুঁজে পাইনি। আজো তার কোনো উত্তর আমার জানা নেই। এই জন্মে গুরুর তো দর্শন পেলাম না। কিন্তু সাধুগুরুদের যে ভালোবাসা পেয়ে যাচ্ছি তা শোধ দিতে কয়েক জনম লাগবে। একজনমে তা শোধ দেয়া অসম্ভব।

আমি তার সামনে থাকা সিগারেটের কথা বলার পর তিনি কি করে বুঝলেন এতো দূরে বসে? তিনি কখনো এই দোকানের দিকে বা আমার দিকে ভালো ভাবে দেখেছেন বলেও মনে করতে পারলাম না। কি ভেবে প্যাকেট ভর্তি সিগারেট আমার হাতে পৌঁছে দিলেন আমি জানি না।

তবে সেই বয়সে আমি কোনোমতেই কোনো অলৌকিক বিশ্বাসের উপর দিয়ে যায় এমন কিছু মানবো না বলে যে পণ করেছিলাম। তার প্রেক্ষিতে এই ঘটনার নানা যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছিলাম। শেষে হিসেব মিলাতে না পেরে বিষয়টাকে ভুলে যেতে চাইলাম।

কিন্তু মাসুদ ভাই হতবাক হয়ে বসেছিল। এরপরও কয়েকদিন যখন এরকম ঘটনা আরো বার কয়েকবার ঘটলো। তখন আমার যুক্তির দুনিয়া উথাল-পাথাল প্রায়। নিরবে মাসুদ ভাইয়ের দোকানে যাওয়া কমিয়ে দিলাম।

বেশ কয়েকদিন পর যেয়ে শুনলাম সেই মাতাল বাবা কোথায় জানি চলে গেছে। সেই দোকানের মালিক তখন বাবার বিরহে পাগল প্রায়। বাবা খালি পায়ে থাকতেন। তিনিও জুতা পরা ছেড়ে দিয়েছেন। বেনসন ছেড়ে বাবার মতো বিড়ি খাওয়া ধরেছেন।

চারদিকে লোক লাগিয়েছেন বাবাকে খুঁজে বের করতে। চায়ের টং দোকানে একা পেয়ে একদিন আমাকে বললো, ছোটভাই তুমি কি বাবার সন্ধান জানো? তোমাকে বাবা বিশেষ পছন্দ করতো।

সেদিন তাকে উত্তর দেয়ার কিছু খুঁজে পাইনি। আজো তার কোনো উত্তর আমার জানা নেই। এই জন্মে গুরুর তো দর্শন পেলাম না। কিন্তু সাধুগুরুদের যে ভালোবাসা পেয়ে যাচ্ছি তা শোধ দিতে কয়েক জনম লাগবে। একজনমে তা শোধ দেয়া অসম্ভব।

পরদিন সন্ধ্যা লাগার ঠিক আগেই যখন ফেরার জন্য নহির সাঁইজির কাছ থেকে বিদাই নিচ্ছিলাম আশিক আর আমি। তখন স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে দীর্ঘ একটা সময় নিশ্চুপ থেকে নহির সাঁইজি বললেন, ‘বড় খুশি হইলাম গো বাপ। বড় খুশি হইলাম।’

ঠিক তখনি সাঁইজির গানটা মাথার কেউ যেন গেয়ে উঠলো-

পাপীর ভাগ্যে এমন দিন কি আর হবেরে।
দেখ দেখ মনরায় হয়েছে উদয়
কি আনন্দময় এই সাধবাজারে।।

যথা রে সাধুর বাজার
তথা সাঁইর বারাম নিরন্তর,
এনে সাধ-সভায় তবে মন আময়
আবার যেন ফেরে ফেলাস নারে।।

সাধু-গুরু কি মহিমা
দেবে দিতে নাইরে সীমা,
হেন পদে যার নিষ্ঠা না হয় তার
না জানি কপালে কি আছেরে।।

সাধুর বাতাসেরে মন
বনের কাষ্ঠ হয়রে চন্দন,
লালন বলে মন, খোঁজ কি আর ধন
সাধুর সঙ্গে রঙ্গে দেশ করবে।।

(চলবে…)

…………………………..
আরো পড়ুন:
মাই ডিভাইন জার্নি : এক :: মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার
মাই ডিভাইন জার্নি : দুই :: কবে সাধুর চরণ ধুলি মোর লাগবে গায়
মাই ডিভাইন জার্নি : তিন :: কোন মানুষের বাস কোন দলে
মাই ডিভাইন জার্নি : চার :: গুরু পদে মতি আমার কৈ হল
মাই ডিভাইন জার্নি : পাঁচ :: পাপীর ভাগ্যে এমন দিন কি আর হবে রে
মাই ডিভাইন জার্নি : ছয় :: সোনার মানুষ ভাসছে রসে
মাই ডিভাইন জার্নি : সাত :: ডুবে দেখ দেখি মন কীরূপ লীলাময়
মাই ডিভাইন জার্নি : আট :: আর কি হবে এমন জনম বসবো সাধুর মেলে
মাই ডিভাইন জার্নি : নয় :: কেন ডুবলি না মন গুরুর চরণে
মাই ডিভাইন জার্নি : দশ :: যে নাম স্মরণে যাবে জঠর যন্ত্রণা
মাই ডিভাইন জার্নি : এগারো :: ত্বরাও গুরু নিজগুণে
মাই ডিভাইন জার্নি : বারো :: তোমার দয়া বিনে চরণ সাধবো কি মতে
মাই ডিভাইন জার্নি : তেরো :: দাসের যোগ্য নই চরণে
মাই ডিভাইন জার্নি :চৌদ্দ :: ভক্তি দাও হে যেন চরণ পাই

মাই ডিভাইন জার্নি: পনের:: ভক্তের দ্বারে বাঁধা আছেন সাঁই
মাই ডিভাইন জার্নি : ষোল:: ধর মানুষ রূপ নেহারে

Related Articles

2 Comments

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • উজ্জ্বল , বুধবার ১৩ নভেম্বর ২০১৯ @ ৬:৪৮ অপরাহ্ণ

    আমাকে সাঁইজী নিলেন না

    • ভবঘুরে , বৃহস্পতিবার ১৪ নভেম্বর ২০১৯ @ ১:৫১ অপরাহ্ণ

      সবই তাঁর ইচ্ছা সাধু
      জয়গুরু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!