ভবঘুরেকথা
ধ্যান চক্র সপ্তচক্র যোগ আসন

-প্রণয় সেন

মানুষকে দীর্ঘজীবী করাই হঠযোগের উদ্দেশ্য। স্বাস্থ্যই মুখ্য ভাব, এটাই হঠযোগীদের একমাত্র লক্ষ্য। ‘আমার যেন রোগব্যাধি না হয়’ -এটাই হঠযোগীর দৃঢ়সঙ্কল্প। তাঁর রোগব্যাধি হয়ও না, তিনি দীর্ঘজীবী হন, শতবর্ষ জীবিত থাকা তাঁর পক্ষে কিছুই নয়।

দেড়শো বছর বয়সে তিনি পূর্ণ যুবক ও সতেজ থাকেন, তাঁর একটি কেশও শুভ্র হয় না; কিন্তু এই পর্যন্তই। বটগাছও কখনো কখনো পাঁচ হাজার বছর জীবিত থাকে, কিন্তু ওটা বটগাছই থেকে যায়, তার বেশি কিছু নয়। দীর্ঘজীবী মানুষ একটি সুস্থকায় প্রাণী, এইমাত্র।

হঠযোগীদের দুই-একটি সাধারণ উপদেশ খুব উপকারী। সকালে ঘুম থেকে উঠে, যদি নাক দিয়ে জল টানা হয়, তাহলে তোমাদের মস্তিষ্ক বেশ পরিষ্কার ও শীতল থাকবে। তোমাদের কখনই সর্দি লাগবে না। নাক দিয়ে জল পান করা কিছু কঠিন নয়, অতি সহজ। নাক জলের ভিতর ডুবিয়ে নাক দিয়ে জল টানতে থাক, গলার মধ্যে দিয়ে ক্রমশঃ জল আপনা-আপনি ভিতরে যাবে।

আসন সিদ্ধ হলে কোন কোন সম্প্রদায়ের মতে নাড়ী শুদ্ধি করতে হয়। রাজযোগের অন্তর্গত নয় বলে অনেকে এটার আবশ্যকতা স্বীকার করেন না। কিন্তু যখন ভাষ্যকার শঙ্করাচার্যের ন্যায় প্রমাণিত ব্যক্তি এটা করার বিধান দিয়েছেন, তখন আমি মনে করি, এহা উল্লেখ করা উচিত।

আমি শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের ভাষ্য হতে এ-বিষয়ে তাঁর মত উদ্ধৃত করবো- ‘প্রাণায়াম দ্বারা যে-মনের ময়লা ধুয়ে গেছে, সেই মনই ব্রহ্মে স্থির হয়। এই জন্যেই শাস্ত্রে প্রাণায়ামের বিষয় লেখা হয়েছে। প্রথমে নাড়ী শুদ্ধি করতে হয়, তবেই প্রাণায়াম করবার শক্তি আসে।’

পদ্মাসন, সুখাসন, সিদ্ধাসনে মেরুদণ্ড খাড়া করে বসে, ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ডান নাকের ছিদ্র চেপে ধরে বাম নাক দ্বারা যথাসাধ্য বায়ু গ্রহণ বা পূরক করতে হবে, পরে মধ্যে বিন্দুমাত্র সময় না নিয়ে বাম নাক বন্ধ করে ডান নাক দিয়ে বায়ু ত্যাগ বা রেচক করতে হবে‌‌। পুনরায় ডান নাক দিয়ে বায়ু গ্রহণ করে বাম নাক দিয়ে বায়ু রেচক করতে হবে।

ধারাবাহিক ভাবে চারবার অর্থাৎ সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা ও রাতে এই চারটি সময়ে এই প্রক্রিয়া তিনবার অথবা পাঁচবার অভ্যাস করলে এক পক্ষ অথবা এক মাসের মধ্যে নাড়ী শুদ্ধি হয়; তারপরে প্রাণায়ামে অধিকার হবে।

অভ্যাস একান্তই আবশ্যক। তুমি প্রতিদিন অনেকক্ষণ বসে আমার কথা পড়তে পার। কিন্তু অভ্যাস না করলে এক বিন্দুও অগ্রসর হতে পারবে না। সবই সাধনের উপর নির্ভর করে। প্রত্যক্ষনুভূতি না হলে এ-বিষয়ে সকল তত্ত্ব কিছুই বোঝা যায় না। নিজে অনুভব করতে হবেই হবে, কেবল ব্যাখ্যা বা মত শুনলেই চলবে না।

সাধনের অনেক বিঘ্ন আছে। প্রথম বিঘ্ন ব্যাধিগ্রস্ত দেহ- শরীর সুস্থ না থাকলে সাধনের ব্যতিক্রম হবে। এজন্য শরীর সুস্থ রাখতে হবে। কিরূপ খাদ্যভ্যাস করি, কাজকর্ম করি এ-সকল বিষয়ে বিশেষ যত্ন ও মনোযোগ আবশ্যক। শরীর সবল রাখবার জন্য সর্বদা মনের শক্তি প্রয়োগ কর-

ব্যস্, শরীরের জন্য আর কিছু করবার আবশ্যক নেই। স্বাস্থ্যরক্ষা উদ্দেশ্য সাধনের একটি উপায় মাত্র- এটা যেন আমরা কখনো না ভুলি। যদি স্বাস্থ্যেই উদ্দেশ্য হত, তবে তো আমরা পশুতুল্য হতাম। পশুরা প্রায়ই অসুস্থ হয় না।

চিত্তবৃত্তি-নিরোধের নামই যোগ- ‘যোগ’ এক প্রকার বিজ্ঞান, যার সাহায্যে আমরা চিত্তের বিভিন্ন বৃত্তিতে রূপান্তরিত হওয়া বন্ধ করতে পারি। এই যোগের নাম অষ্টাঙ্গযোগ, কারণ এর প্রধান অঙ্গ আটটি- যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান এবং সমাধি।

যম
যোগের এই অঙ্গটি সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এইটি সারা জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করবে। এটি আবার পাঁচ ভাগে বিভক্ত :

১. কায়মনোবাক্যে হিংসা না করা।
২. কায়মনোবাক্যে লোভ না করা।
৩. কায়মনোবাক্যে পবিত্রতা রক্ষা করা।
৪. কায়মনোবাক্যে সত্যনিষ্ঠ হওয়া।
৫. কায়মনোবাক্যে বৃথা দান গ্রহণ না করা (অপরিগ্রহ)।

নিয়ম
শরীরের যত্ন, স্নান, পরিমিত আহার ইত্যাদি।

আসন
মেরুদণ্ডের উপর জোর না দিয়ে কটিদেশ, স্কন্ধ ও মাথা ঋজুভাবে রাখতে হবে।

প্রাণায়াম
প্রাণবায়ুকে আয়ত্ত করবার জন্য শ্বাসপ্রশ্বাসের সংযম।

প্রত্যাহার
মনকে বহির্মুখ হতে না দিয়ে অন্তর্মুখ করে কোন জিনিস বোঝবার জন্য বারংবার আলোচনা।

ধারণা
কোন এক বিষয়ে মনকে একাগ্র করা।

ধ্যান
কোন এক বিষয়ে মনের অবিচ্ছন্ন চিন্তা।

সমাধি
জ্ঞানের আলোক লাভ করাই আমাদের সকল সাধনার লক্ষ্য।

যোগীরা বলেন, শরীরের মধ্যে সাতটি পদ্ম বা নাড়ীচক্র আছে। উর্দ্ধশক্তি কণ্ঠে, অধোশক্তি গুহ্যদেশে এবং মধ্য-শক্তি নাভিতে অবস্থিত। আর যিনি এই তিন শক্তির বাইরে তাকেই নিরঞ্জন ব্রহ্ম বলে।

গুহ্যদেশে মূলাধার চতুর্দল, লিঙ্গমূলে স্বাধিষ্ঠান ষড়দল, নাভিতে মণিপুর দশদল, হৃদয়ে অনাহত দ্বাদশদল, কণ্ঠে বিশুদ্ধ ষোড়শদল, ভ্রূমধ্যে আজ্ঞা দ্বিদল এবং মস্তকে সংস্রার সহস্রদল পদ্ম আছে।

আর মেরুদণ্ডের বামভাগে ইড়া, দক্ষিণভাগে পিঙ্গলা ও মধ্যে সুষুম্না নাড়ী আছে। ঐ সুষুম্না নাড়ী মূলাধার থেকে যথাক্রমে ছটি পদ্ম ভেদ করে ব্রহ্মস্থানে সহস্রদলে গিয়ে মিশেছে। কিন্তু সুষুম্নার রাস্তা বন্ধ থাকে যতক্ষণ না কুণ্ডলিনী শক্তি জাগ্রত হয়।

কুলকুণ্ডলিনী আত্মার জ্ঞানশক্তি, চৈতন্যরূপিণী, ব্রহ্মময়ী। তিনি সকল জীবের মধ্যে মূলাধার পদ্মে ঘুমন্ত সাপের মতো যেন নির্জীব ভাবে রয়েছেন- যেন ঘুমুচ্ছেন। তিনি যোগ, ধ্যান, সাধনভজনাদির দ্বারা জাগ্রত হন।

মূলাধারে সেই শক্তি যখন জেগে উঠে সুষুম্না নাড়ীর মধ্যে দিয়ে ক্রমান্বয়ে মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ ও আজ্ঞাচক্র ভেদ করে সহস্রদলে পরমশিব বা পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হন, তখন উভয়ের সংযোগ থেকে যে পরমামৃত ক্ষরণ হয়, তা পান করে জীব সমাধিস্থ হয়। তখনই জীবের চৈতন্য হয়, আত্মস্বরূপের জ্ঞান হয়।

তখন জ্যোতিদর্শন, ইষ্টমূর্তি দর্শন প্রভৃতি অনেক আশ্চর্য আধ্যাত্মিক অনুভূতি সব হয়ে থাকে। গুরু ও পরমেশ্বরের কৃপায় সাধকের সুকৃতি বলে কখনো কখনো তিনি আপনা হতেই অথবা অল্প আয়াসে জেগে থাকেন। সেই নির্বিকল্প সমাধি-অবস্থায়, ঠাকুর বলতেন, সাধারণতঃ একুশ দিনের বেশি শরীর থাকে না, জীব পরমাত্মায় বা পরব্রহ্মে লীন হয়ে যায়।

সাধক যদি এই ছয় চক্রকে ভেদ করতে পারেন তিনি চক্রাতীত ও নমস্য। শরীরের ঊর্দ্ধ দিক হল ব্রহ্মলোক। এবং শরীরের নীচের দিক হল পাতাল লোক। এই শরীর বৃক্ষের মত কিন্তু এর উর্দ্ধদিক হল সেই বৃক্ষের মূল স্বরূপ এবং নিম্নদিক হল সেই বৃক্ষের শাখা স্বরূপ।

হৃদয়ে প্রাণবায়ু, গুহ্যদেশে অপাণবায়ু, নাভিদেশে সমান বায়ু, কণ্ঠে উদানবায়ু, দেহের ত্বকে ও সারা দেহ জুড়ে ব্যান বায়ু অবস্থিত। নাগ বায়ু উর্দ্ধপান হতে আগত এবং কূর্ম্মবায়ু তীর্থ দেশে আশ্রিত। কৃকর বায়ু মানসিক ক্ষোভে, দেবদত্ত বায়ু হাই তুললে এবং ধনঞ্জয় বায়ু গভীর চিৎকার করলে নিবেশিত হয়ে সাম্য রক্ষা করে।

এই দশ প্রকার বায়ু নিরালম্ব (অবলম্বন শূন্য) এবং যোগীগণের যোগ সম্মত। আমাদের শরীরের বাহ্যত নবদ্বার প্রত্যক্ষ করা যায় এগুলি হল- দুটি চোখ, দুটি কান, দুটি নাসারন্ধ্র, মুখ, গুহ্য ও লিঙ্গ এবং দশম দ্বার হল মন।

ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্না এই তিনটি নাড়ী উর্দ্ধগামিনী; গান্ধারী, হস্তি জিহ্বা ও প্রসবা এই তিনটি নাড়ী দেহের সর্ব্বত্র ব্যাপ্ত আছে। শরীরের দক্ষিণ অঙ্গে অলম্বুষা ও যশা এই দুটি ও বাম অঙ্গে কুহু ও শঙ্খিনী এই দুটি নাড়ী ব্যবস্থিত। এই দশ প্রকার নাড়ী হতেই শরীরে নানা নাড়ী উৎপন্ন হয়েছে এবং বাহাত্তর হাজার প্রসূতিকা নাড়ী শরীরের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়।

(চলবে…)

………………………..
সূত্র
রাজযোগ – স্বামী বিবেকানন্দ
প্রাণায়াম রহস্য – স্বামী রামদেব
পরমার্থ প্রসঙ্গ – স্বামী বিরজানন্দ
মন ও তার নিয়ন্ত্রণ – স্বামী বুধানন্দ
ধ্যান ও মনের শক্তি – স্বামী বিবেকানন্দ

আরও আধ্যাত্মিক তথ্য পেতে ও জানতে: ভারতের সাধক ও সাধিকা
পুণঃপ্রচারে বিনীত-প্রণয় সেন

………………………………..
আরো পড়ুন:
দিব্য-আলোক ধ্যান ওঁ স্বং ব্রহ্মের সাক্ষাৎকার : এক
দিব্য-আলোক ধ্যান ওঁ স্বং ব্রহ্মের সাক্ষাৎকার : দুই

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!