ভবঘুরেকথা

-নুর হাবিবা মোস্তফা

ত্যাগ বা যজ্ঞ হলো উচ্চতর আনন্দের জন্য অপেক্ষাকৃত নিম্নতরটিকে ত্যাগ করা। যে প্রেম দেহে কামরূপে বিরাজ করে তাই উচ্চতর অবস্থায় হৃদয়ে বাসা বাঁধে আরও উচ্চতর অবস্থায় উন্নীত হলে তা ভক্তিতে পরিণত হয়ে দেহ, মন, প্রাণ ছাড়িয়ে আত্মিক সম্পর্ক হয়ে প্রেমিক প্রেমিকার চেতনার ঊর্ধ্ব স্তরে চলে যায় যেটা হলো প্রেমের বা কামের ঊর্ধ্বগতি।

উঠতি বয়সে বাৎসায়ন মুনির কামসূত্র বইটি আমার হাতে এসে পড়েছিল। বইটিতে কাম চরিতার্থ করার জন্য বিভিন্ন উপায় কলাকৌশলের কথা বলা হলেও তাবৎ প্রাণীর মধ্যে বিদ্যমান এই মৌলিক প্রবৃত্তির কারণ বিশ্লেষণ করে কিছু বলা হয়নি।

বইটি আমার কৌতুহল নিবারণের জন্য যথেষ্ট নয় বলে পরিত্যক্ত হল। ঠিক ঐ সময় ‘অবধূত ও যোগী সঙ্গ’ নামে রাজযোগ ও তন্ত্রযোগের উপর লেখা একটি বই আবিষ্কার করলাম যশোর পাবলিক লাইব্রেরীর পরিত্যক্ত বই-এর স্তূপ থেকে।

প্রমোদ বন্ধু বন্দোপাধ্যায়ের লেখা এই বইটি তন্ত্র যোগশাস্ত্রের প্রতি আমাকে কৌতূহলী করে তুললো। লাইব্রেরিয়ান মোশারফ হোসেন পলাশ যিনি আমাদের কাছে পলাশ মামা বলে পরিচিত ছিলেন তাঁর অনুমতি নিয়ে পরিত্যক্ত ছেড়া বইটি আমি দীর্ঘদিন কাছে রাখলাম পড়লাম।

যোগশাস্ত্র অধ্যয়ন ও অনুশীলনের কারণে আমাকে ঘিরে একটা পরিমণ্ডল গড়ে উঠেছিল যারা সবাই কমবেশি যোগচর্চা করতো। কিন্তু তন্ত্র সাধনা? ও পথে আমরা কেউ মাড়াইনি। আরো পরিণত বয়সে তন্ত্রযোগের উপর লেখা ওশো রজনিশের একটি বই পড়ে তন্ত্র সম্বন্ধে ধারণা আরেকটু স্বচ্ছ হলেও উপযুক্ত পরিবেশ ও সঙ্গীর অভাবে এর চর্চা সম্ভব নয় বলে অভিমত প্রকাশ করা ছাড়া গত্যন্তর নাই।

প্রথমত যে আধ্যাত্মিক চেতনা নিয়ে নারী-পুরুষের যুগ্ম সাধনা এই তন্ত্র শুরু হয়েছিল সেই আধ্যাত্মিক চেতনা কোথায়? নারী-পুরুষের স্বাভাবিক সম্পর্ক কাম থেকে প্রেমে উত্তীর্ণ না হলে তন্ত্র কেন কোন সাধনাই সম্ভব নয়। প্রেম তো কোন ঠিক কোন সম্পর্ক নয়।

খাদ্য গ্রহণ থেকে শুরু করে হজমের মাধ্যমে প্রাণশক্তি অর্জনের প্রক্রিয়া ভালো ভাবে সম্পন্ন না হলে যেমন আহারের কোন মূল্য থাকে না, ঠিক তেমনি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত সব অভিজ্ঞতা ঠিক ঠাক ভাবে কাজে লাগিয়ে ইন্দ্রিয়াতীত জ্ঞান বা চেতনা লাভ দ্বারাই মানব জীবনে উৎকর্ষতা লাভ করে।

এটা হলো কোন সম্পর্ককে ধরে মনের একটা উন্নত অবস্থা, আনন্দময় রূপ। এই আনন্দ স্রষ্ঠার যে পরমা প্রকৃতি থেকে জগতের উৎপত্তি তার সাথে যুক্ত হয়ে পরিপূর্ণতা পায়। স্রষ্ঠার যে মঙ্গলানন্দ থেকে জগতের উৎপত্তি তার সাথে যুক্ত হওয়া যায় কামনাহীন প্রেমের মাধ্যমে।

আর কাম থেকে প্রেমে উত্তরনের পন্থাই হলো এই তন্ত্রযোগ। মূল সাধনা অর্থাৎ জীবনের শুরু থেকে ব্রাহ্মচর্য অভ্যাস না থাকলে তন্ত্রসিদ্ধ হওয়া যায় না। জীবনের শুরু থেকে হঠযোগ ও রাজযোগ অবলম্বনে ব্রাহ্মচর্য অভ্যাস না থাকলে তন্ত্রের পিচ্ছিল পথে পা হড়কানোর সমূহ সম্ভাবনা।

তন্ত্রের প্রথম পাঠ প্রাণায়ামের মাধ্যমে মনের একাগ্রতা অর্জন। ধীর স্থির মনে প্রাণকে (নিশ্বাস-প্রশ্বাসকে) যথাসম্ভব শান্ত ও দীর্ঘায়ত করে নারী-পুরুষ জুটির যে মিলন হয় তা প্রলম্বিত হয়ে তাদেরকে সমাধির দিকে নিয়ে যায়। নিশ্বাস-প্রশ্বাস যত ধীর, প্রলম্বিত ও ছন্দময় ভাবে চলবে সমাধির সম্ভাবনা তত বেশি।

মান ও হুশ সম্পন্ন উচ্চ জীব মানুষ সন্তান ক্ষুধা ছাড়া মিলনের যে তাগিদ অনুভব করে তার কারণ ক্ষণিকের জন্য হলেও তারা এর মাধ্যমে সমাধি অবস্থা প্রাপ্ত হয়ে থাকে। প্রাণায়ামের মাধ্যমে প্রাণকে তথা কামকে নিয়ন্ত্রণ করে প্রেমের পথ ধরে মিলনের যে পথ মহাযোগী শিবের আবিষ্কার তা অনধিকারীর হাতে পড়ে কামাচারে পরিণত হয়ে সভ্য সমাজ কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়েছে।

উপযুক্ত পরিবেশে উপযুক্ত জুটির দ্বারা সাধিত হলে এই ঘোর কলিতেও তন্ত্র সাধনা সম্ভব বলে তন্ত্রযোগীরা দাবী করেন। তারা বলেন এ হেন দম্পতির ঘরে বুদ্ধ, যীশু, নিউটন, আইনস্টাইনের মত মহামানবদের আগমন হয়। প্রেমে নিষ্ফল কামুক জুটির সন্তান দুর্বল শরীর ও মন নিয়ে জন্মায় ও বড় হয়।

তন্ত্রযোগের মূলে রয়েছে ভোগে যোগ এই মহান তত্ত্ব। যে কোন ভোগে সংযম না থাকলে ভোগ যথাযথরূপে পূরণ হয় না। যেমন সময় ও পরিমাণ জ্ঞান না থাকলে আহারের দরুন স্বাস্থ্য লাভ না হয়ে স্বাস্থ্য হানি হয়। ইন্দ্রিয় দ্বারা লব্ধ সব ভোগের ক্ষেত্রেই কথাটি প্রযোজ্য।

পরিমিতি বোধ না থাকলে বা গুণাগুণ না বুঝে আহার করলে সেই ইন্দ্রিয়াতীত জ্ঞান বা আনন্দ কোনটাই অর্জন করা সম্ভব নয়।

খাদ্য গ্রহণ থেকে শুরু করে হজমের মাধ্যমে প্রাণশক্তি অর্জনের প্রক্রিয়া ভালো ভাবে সম্পন্ন না হলে যেমন আহারের কোন মূল্য থাকে না, ঠিক তেমনি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত সব অভিজ্ঞতা ঠিক ঠাক ভাবে কাজে লাগিয়ে ইন্দ্রিয়াতীত জ্ঞান বা চেতনা লাভ দ্বারাই মানব জীবনে উৎকর্ষতা লাভ করে।

সাধনার শুরুতে ভালো ভাবে রাজযোগ অভ্যাস না থাকলে মহাযোগী শিবের আবিষ্কৃত সংসারী সাধকদের জন্য নির্ধারিত যুক্ত সাধনার এই পথে এগুনো গৃহী-অগৃহী কারুর জন্য ফলদায়ক হবে না। বৈষ্ণব ও বাউল সাধকরা গোপনে এই যোগ অভ্যাস করলেও সাধারণ মানুষের কল্পনাতীত যুক্ত সাধনার এই পদ্ধতি তাঁরা প্রকাশ করেন না।

ইন্দ্রিয়াতীত জ্ঞান বা চেতনা কিন্তু ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান বা অভিজ্ঞতারই পরিণত ফল হিসাবে আসে। ইন্দ্রিয় দ্বারা প্রাপ্ত স্থূল ভোগের বিষয়ই যোগের দ্বারা পরিশীলিত হয়ে সূক্ষ্ম চেতনারূপে মনে বিমলানন্দ রচনা করে।

ভোগে আসক্তিকে প্রশ্রয় না দিয়ে তা পরিমিতি বোধ বা সংযম দ্বারা পরিচালিত হলে ভোগের বিষয়টি স্থূল ইন্দ্রিয় অতিক্রম করে মনের সূক্ষ্ম তন্ত্রীতে সাড়া জাগায়ে যে সূক্ষ্ম ভাবের সূচনা করে, যথাযথ পরিণতি লাভ করলে তাই সুরের মুর্চ্ছনার মত ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে চেতনার সর্ব স্তরে।

ভোগে যোগ অর্থাৎ সংযম না থাকলে কিন্তু মন আসক্তিির প্রশ্রয় এড়িয়ে সূক্ষ্ম এই ভাব সৃষ্টি করতে পারে না। ইন্দ্রিয় ভোগের মাধ্যমে প্রাপ্ত আনন্দকে ইন্দ্রিয়াতীত আনন্দে রূপায়নের যে পন্থা তন্ত্রযোগ নামে তার প্রচলন শুরু হলেও যথাযথ সংযম বা যোগের অভাবে তা যোগ নামের মর্যাদা রক্ষা করতে না পারায় তান্ত্রিক নামে উচ্ছৃঙ্খল জনগোষ্ঠীর উৎপত্তি ঘটায় যারা তন্ত্র সাধনার নামে উগ্র ইন্দ্রিয়ভোগ নিয়ে মেতে থাকে ভোগে যোগের মহান তত্ত্ব ভুলে।

মানুষের মত বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন জীব যে পরিমিতি বোধ হারিয়ে ভোগপরায়ন স্থূল জীবে পরিণত হোক এটা পরমা প্রকৃতির কাম্য নয়। মানুষ প্রকৃতির বিরোধিতা করে উচ্চ জীবনের বদলে নীচ জীবন বেছে নেওয়ায় প্রকৃতি মাতা রুষ্ট হয়ে নিত্য নতুন রোগ বালাই দিয়ে তাকে শাসন করে বলে যাচ্ছেন, মানুষ এখনও সময় আছে সংযত হও, যোগযুক্ত হয়ে আসক্তির প্রশ্রয় এড়িয়ে বাসনামুক্ত হও, বুদ্ধি বিবেকহীন পশুর ভোগ তোমার জন্য নয়, অমৃতের সন্তানেরা পশু জীবন ছেড়ে নিজ অবস্থানে উঠে এসো।

উপমহাদেশের অন্যতম ধর্ম সংস্কারক রাজা রামমোহন রায় পারিবারিক সূত্রে তান্ত্রিক যোগী ছিলেন বলে শোনা যায়। বর্তমান কালে তন্ত্রযোগের প্রচার ও প্রসার করতে গিয়ে রজনিশ বিতর্কিত ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। বস্তুত কাম ও অন্যান্য প্রবৃত্তি মুক্ত হয়ে প্রেমে উত্তরনের এই পথ সাধারণের জন্য নয়।

সাধনার শুরুতে ভালো ভাবে রাজযোগ অভ্যাস না থাকলে মহাযোগী শিবের আবিষ্কৃত সংসারী সাধকদের জন্য নির্ধারিত যুক্ত সাধনার এই পথে এগুনো গৃহী-অগৃহী কারুর জন্য ফলদায়ক হবে না। বৈষ্ণব ও বাউল সাধকরা গোপনে এই যোগ অভ্যাস করলেও সাধারণ মানুষের কল্পনাতীত যুক্ত সাধনার এই পদ্ধতি তাঁরা প্রকাশ করেন না।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

2 Comments

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • জাহাঙ্গীর আলম , বুধবার ২৬ আগস্ট ২০২০ @ ১০:০৮ অপরাহ্ণ

    মহামুল্যবান লিখা। মোবারকবাদ।

    • ভবঘুরে , সোমবার ৩১ আগস্ট ২০২০ @ ১০:১৮ অপরাহ্ণ

      জয়গুরু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!