ভবঘুরেকথা
সুভাষ চন্দ্র বসু

স্টিয়ারিঙ শক্ত হাতে ধরে বসে আছে চালক। মুখ তার ভাবলেশহীন। অন্তরের শংকা প্রকাশ পাচ্ছে না মুখে। আর সেই পাঠান যুবক? চোখ বুজে সে যেন ধ্যানমগ্ন…।

কে এই পাঠান?

সুধীজন, আপনারা নিশ্চই এতক্ষণে অনুমান করে ফেলেছেন তাঁর পরিচয়! হ্যাঁ, নেতাজী, আমাদের প্রিয় নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। এলগিন রোডের বাড়ি থেকে বৃটিশ পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে দেশের বাইরে পালিয়ে যাচ্ছেন সুভাষ পাঠান যুবকের ছদ্মবেশে।

উদ্দেশ্য, ভারতের স্বাধীনতা। স্বাধীনতায় আমাদের জন্মগত অধিকার। আমরা স্বাধীনতা চাই। সুভাষের মনের মাঝে ভেসে ওঠে স্বামী বিবেকানন্দের ছবি, যাঁর প্রেরণা, বাণী বুকের মাঝে নিয়ে এতদূর এগিয়ে আসা। হে মহাপ্রাণ, শক্তি দাও। এই বিরাট কাজের ভার বইবার শক্তি দাও। নেতাজী সুভাষচন্দ্র স্বামীজী সম্পর্কে বলেছেন, শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দের নিকট আমি যে কত ঋণী তা ভাষায় কী করে প্রকাশ করব? চরিত্র গঠনের জন্য ‘রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ সাহিত্য’ অপেক্ষা উৎকৃষ্ট সাহিত্য আমি কল্পনাও করতে পারি না।

চুঁচুড়া, ব্যাণ্ডেল, শক্তিগড়, বর্ধমান, আসানসোল, বরাকর ব্রীজ পেরিয়ে গেল গাড়ি। পুব আকাশে আলো ফুটছে। ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে অন্ধকার। আর দেরি নয়। দ্রুত পৌঁছতে হবে গন্তব্যস্থলে। বলা যায় না, পুলিশের চর চারপাশেই ছড়ানো। অবশেষে গাড়ি থামল ধানবাদে একটি বাংলোর সামনে। সে দিনের মত যাত্রার বিরতি। আবার যাত্রা শুরু হবে সূর্যাস্তের পর।

রাত তখন অনেক। এক পাশে উঁচু পাহাড়ের সারি। নীচ দিয়ে এঁকে বেঁকে চলে গেছে রেললাইন। স্টেশন গোমো জংশন। বেশ খানিকটা দূরে অন্ধকারের আড়ালে লুকিয়ে আছে একটা গাড়ি। ভেতরে চার জন যাত্রী। তাঁদের মধ্যে এক জন মহিলা। ঘুমন্ত স্টেশন একসময় জেগে উঠল। ট্রেন আসছে।

গাড়িটা ধীরগতিতে এগিয়ে গেল স্টেশনের দিকে। এ বার সুভাষকে বিদায় নিতে হবে। গাড়ি থেকে নেমে দৃঢ় পদক্ষেপে তিনি এগিয়ে গেলেন প্লাটফর্মের দিকে। বিদায়! সুভাষকে পৌঁছে দিয়ে তিন জন ফিরে এলেন শূন্য মনে। কারা এঁরা? মোটরগাড়িতে করে সুভাষকে নিয়ে এতদূরের পথ পাড়ি দিয়েছিলেন সুভাষেরই ভাইপো শিশির বোস। তিনিই ছিলেন সুভাষের সারথি। আর দুজন ছিলেন শিশির বোসেরই দাদা শ্রী অশোক বোস এবং তাঁর স্ত্রী।

এদিকে ট্রেন ছুটে চলেছে হু হু করে। আর পেছনে তাকানো নয়। এখন শুধুই এগিয়ে চলা। মরণপণ সংগ্রামই এখন জীবনের মূল লক্ষ্য।

ট্রেন অনেক পথ পেরিয়ে যখন পেশোয়ার ক্যান্টনমেন্টে থামল, নামলেন সুভাষ। পূর্ব পরিকল্পনামত উঠলেন তাজমহল হোটেলে। এ বার গন্তব্য কাবুল। কিন্তু কোথায় সেই দুঃসাহসী কর্মী ভকতরাম? যে তাঁকে পৌঁছে দেবে কাবুল?

হ্যাঁ, ভকতরাম হাজির। খুব খুশি সে। বঙ্গাল কা শের সুভাষচন্দ্র বোস আ গয়া। এখন শুধু হুকুম তামিলের অপেক্ষা। কিন্তু দেরি হল কয়েক দিন কাবুলের পথে যাত্রা শুরু করতে। কারণ, আগেকার পথের পরিবর্তে যেতে হবে অন্য পথ দিয়ে। সে পথ আরও দুর্গম, আরও বিপদসংকুল।

১৯৪১ সাল, ২৬শে জানুয়ারি। শুরু হল ঐতিহাসিক যাত্রা। গাড়িতে পাঁচজন যাত্রী। সুভাষ, কমরেড ভকতরাম, গাইড, আবাদ খাঁ ও ড্রাইভার। গাড়ি এগিয়ে চলেছে শহরের সীমানা পেরিয়ে অনেক দূরে খাজুরি ময়দানের দিকে। বহু দূরে আকাশের গায়ে পাহাড়ের সারি। ঢেউখেলানো উপত্যকা।

মাঝে আঁকাবাঁকা পথ। খাজুরি ময়দানে গাড়ি এসে থামলে সুভাষ ভকতরাম আর গাইডকে সঙ্গে নিয়ে পা বাড়ালেন দুর্গম গিরিপথের দিকে। এই গিরিপথ ধরেই এ বার এগিয়ে যেতে হবে পায়ে হেঁটে। দুর্ধর্ষ উপজাতীয় অঞ্চল। কোথা থেকে শত্রু এসে হানা দেবে তার কোনও ঠিক নেই। প্রকৃতিও রুক্ষ, শুধু পাথর আর পাথর। পথ বলেও কিছু নেই।

এখানে ওখানে পাথরের ফাটলে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে বনস্পতির দল। সমতলে বড় হয়ে ওঠা সুভাষ তবু সব কষ্ট সহ্য করে এগিয়ে চললেন। যেভাবেই হোক ভারতের সীমান্ত তাঁকে পেরোতেই হবে। দুচোখে তাঁর স্বাধীনতার স্বপ্ন। কত বড় আদর্শের সংকল্পে এই পথচলা।

পথচলার বিরাম নেই। ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে শরীর। দেহ টলছে, পা কাঁপছে। এ আর কতটুকুই বা পথ! আরো কত পথ পাড়ি দিতে হবে তাঁকে। কি আছে পথের শেষে, তা ঈশ্বরই জানেন। সামনেই উঠে গেছে একটা খাড়া পাহাড়। তার চূড়ো বরফে ঢাকা। তাঁরা এসে থামলেন পাহাড়ের নীচে। ক্লান্ত সুভাষ প্রশ্ন করেন, আর কত পথ বাকি বর্ডার পার হতে?

বর্ডার? বর্ডার তো আমরা কখন পার হয়ে এসেছি। বলে ওঠে সুভাষের বিশ্বস্ত ছায়াসঙ্গী ভকতরাম।

সুভাষের মনের মাঝে আবার ভেসে উঠল স্বামী বিবেকানন্দের মুখ। জয় বীরেশ্বর বিবেকানন্দ। জয় ভারতমাতা কি জয়। বিপদ আপাতত কেটে গেছে।

সঙ্গী ভকতরামকে নিয়ে এবার দুর্গম পাহাড়ি পথে কাবুলের দিকে এগোতে লাগলেন সুভাষ। হাড়-হিম করা ঠাণ্ডা আর পথের বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে আছে মরণ ফাঁদ। চারিদিকে তুষারের প্রাচীর। তা থেকে জল পড়ছে চুঁইয়ে। পিচ্ছিল হয়ে পড়ছে চলার পথ, যদি তাকে পথ বলতে পারা যায়। কোথাও কোথাও লুকিয়ে আছে চোরা ফাটল। ক্ষণিকের ভুলে তলিয়ে যেতে হতে পারে কোনও এক অতল গহ্বরে।

বিপ্লবের পথ কখনই কুসুমাস্তীর্ণ নয়। এ পথ চিরকালই ক্ষুরধার। এ পথে যারাই এসেছে, তারাই পদে পদে হয়েছে লাঞ্ছিত, জর্জরিত। সুভাষচন্দ্র বসুও এর ব্যতিক্রম নন। অভাব তো তাঁর ছিল না কিছুরই – অর্থ, যশ, শিক্ষা, দীক্ষা, সম্মান, প্রাচুর্য। তবু সে সব হেলায় ত্যাগ করে তিনি যুদ্ধে নেমেছেন প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রিটিশের সাথে কেবল তাঁর দেশমায়ের মুখের দিকে চেয়ে।

দুরন্ত দুর্গম পথ পেরিয়ে অবশেষে আফগানিস্তানের কাবুলে এসে পৌঁছলেন সুভাষ। কাবুলে পা রেখেই আর দেরি করলেন না সুভাষ। যোগাযোগ করলেন রুশ দূতাবাসের সঙ্গে। যুদ্ধের আগুনে তখন সারা ইউরোপ জ্বলছে। বিভিন্ন রাষ্ট্রের গুপ্তচরদের কাছে কাবুল হল গিয়ে স্বর্গরাজ্য। এই অবস্থায় এখানে বেশি দিন অপেক্ষা করাও বিপজ্জনক।

ইংরেজদের হাতে কোনও ভাবে ধরা পড়ে গেলে এত কষ্ট, এত পরিকল্পনা সব জলে যাবে। কিন্তু রুশ দূতাবাসে কোন আশার আলো দেখা গেল না। রাশিয়ার সাহায্যের আশা ত্যাগ করে সুভাষ পা বাড়ালেন জার্মান দূতাবাসের দিকে। জার্মান রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা হল।

প্রতিশ্রুতিও পাওয়া গেল সাহায্যের। তবে তৎক্ষণাৎ কিছু করা সম্ভব নয়। এ দিকে চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে গোয়েন্দা পুলিশের চর। এই অবস্থায় সুভাষকে আশ্রয় দিলেন উত্তমচাঁদ নামে এক ভারতীয় ব্যবসায়ী। নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে জার্মান দূতাবাসের সঙ্গে। কিন্তু বার্লিন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নির্দেশ আর আসে না। না, আর অপেক্ষা করতে রাজি নন সুভাষ। অদূরে রুশ সীমান্ত।

যেভাবেই হোক সীমান্ত পার হয়ে তাঁকে রাশিয়ায় ঢুকতে হবে। সেই অনুযায়ী পরিকল্পনাও ছকে ফেলা হল। কিন্তু ঈশ্বরের অভিপ্রায় ছিল অন্য। কারণ হঠাৎই বার্লিন থেকে খবর এল সুভাষকে ইতালীয় দূতাবাসে দেখা করতে হবে। ওখান থেকেই সুভাষের আফগানিস্তানের বাইরে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু এক জায়গায় একটু গোলমাল হল।

রুশ সরকার সুভাষকে ভিসা দিতে দেরি করায় যাত্রা পিছিয়ে গেল কিছু দিন। অবশেষে রুশ সরকারের অনুমতি পাওয়া গেলে ইতালিয়ান দূতাবাসের মারফত সুভাষ যাত্রা করলেন ইউরোপের উদ্দেশ্যে। ১৯৪১ সাল, ১৭ই মার্চ। বিদায়ের লগ্ন আসন্ন। কাবুলপ্রবাসী ভারতীয়দের ঋণ তিনি কোনও দিনই শোধ করতে পারবেন না। কিছুদিন পর বার্লিন থেকে ইথার-তরঙ্গে ভেসে এল সেই দৃপ্ত কন্ঠস্বর, ‘আমি সুভাষ বলছি’।

আর এ দিকে ব্রিটিশ সরকার; কি করল তারা; তাদের ধরপাকড় আর পৈশাচিক নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পেলেন না, সুভাষের অন্তর্ধানে যাঁরা সাহায্য করেছিলেন, তাঁরা।

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এমনিভাবেই রক্তের অক্ষরে লেখা হয়ে গেছে বিপ্লবীদের নাম। হয়তো এমন সব নাম যাঁরা কালের গহ্বরে ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে গেছেন নিজেদের শেষ রক্তবিন্দু দেশের জন্য উৎসর্গ করে।

নামের জন্য নয়, যশের জন্য নয়, অর্থের জন্যও নয়, কেবল দেশমাতৃকার পরাধীনতার শৃংখলমোচনের জন্য। তাঁদের এই নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ কি বিন্দুমাত্র বিচলিত করে না আমাদের? আমরা যারা স্বাধীন ভারতের নাগরিক; যেন কখনও ভুলে না যাই কত মানুষের রক্তের মূল্যে এসেছে আমাদের এই বহু আকাংক্ষিত স্বাধীনতা।

আজ ২৩শে জানুয়ারি নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিন। এই লেখার মাধ্যমে তাঁকে জানালাম আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা।

…………………………………………
ঋণস্বীকার:
লেখাটি সংকলিত হইল আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে….
১) ‘আমি সুভাষ বলছি’, শৈলেশ দে।
২) ‘এম এন রায় বিপ্লবী, রাজনীতিক ও দার্শনিক’, শ্যামলেশ দাশ।

আরও আধ্যাত্মিক তথ্য পেতে ও জানতে ভারতের সাধক সাধিকা

পুণঃপ্রচারে বিনীত -প্রণয় সেন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!