ভবঘুরেকথা

শ্রীমৎ গোস্বামী রূপচাঁদের জীবন কথা

পরম তেজস্বী সাধু রূপচাঁদ নাম।
খুলনা জেলার মধ্যে হুকড়াতে ধাম।।
তারক চাঁদের কৃপা হল তাঁর পর।
সাধুর চরণ করি শুভ নমস্কার।।
বার শত বাহাত্তর সালের প্রথমে।
নামিলেন রূপচাঁদ এই ধরাধামে।।
বাল্য হতে মহাশয় অতি বলবান।
দৈহিক শক্তির কেহ ছিলনা সমান।।
নমঃশূদ্র কুলে জন্ম কৃষি কার্য়ে রত।
সেই কার্য্যে কেহ নাহি ছিল তার মত।।
দিনে দিনে দিন যায় সংসার মায়ায়।
হেন কালে ডাক তাঁরে দিল দয়াময়।।
শ্রীতারকচাঁদের গুণে বলিহারি যাই।
যাঁর গুণে শক্তি শালী বহু ভক্ত পাই।।
হুকড়া আসরে গান রসরাজ করে।
মুগ্ধ হয়ে রূপচাঁদ দেখিলেন তাঁরে।।
কিবা সে মোহন রূপ মধুর বচন।
দেখামাত্র লয় হরে ধন জন মন।।
তারকে দেখিয়া চিত্ত ব্যকুল হইল।
দিবা নিশি তার রূপ ভাবিতে লাগিল।।
অসহ্য পীঢ়ন দাহ অন্তরে সদায়।
ইতি উতি ধায় সাধু শান্তি নাহি পায়।।
এই ভাবে ক্রমে ক্রমে ভাদ্র মাস এল।
চাষ বাস কার্য্য সব শেষ হয়ে গেল।।
অমনি ছুটিল সাধু জয়পুর পানে।
উপনীত জয়পুর হল একদিনে।।
কিভাবে কেমনে গেল কিছু নাহি জানে।
বিস্মিত তারক তাহাশুনিয়া শ্রবণে।।
উপযুক্ত পাত্র বুঝি প্রাণে দয়া হয়।
আপন কম্বল খানি দিল তার গায়।।
কম্বল তাহারে দিয়া তারক বলিল।
‘‘ঘরে গিয়ে রূপচাঁদ শুধু হরিবল।।’’
আজ্ঞা পেয়ে সাধু এল নিজ দেশে ফিরে।
দিবা রাত্রি ‘‘গোপী যন্ত্রে’’ হরিনাম করে।।
ভাব দেখি দেশবাসী বলে ‘‘একি কান্ড।
হরি হলে সাধু হবে রূপচাঁদ ভন্ড।।
নিন্দা কি বন্দনে সাধু কাণ নাহি দেয়।
গুরু বাক্য নিষ্ঠা রেখে হরিগুণ গায়।।
পূর্ব্ব ভাব সব ছেড়ে বলে হরিবল।
হরি হরি বলে তাঁর চক্ষে বহে জল।।
শত্রু মিত্র যায় সাথে হয় দরশন।
কেন্দে বলে সাধু তার ধরিয়া চরণ।।
‘‘আশীর্ব্বাদ কর যেন হরিভক্তি পাই।
হরি ভক্তি বিনা আর কিছু নাহি চাই।।’’
তাহা দেখি নিন্দুকেরা বলে পুনরায়।
‘‘এ কি আশ্চর্য্য কান্ড বল মহাশয়।।
এত নয় সে মানুষ, মানুষ হয়েছে।
না জানি কেমন ভাব মানুষ পেয়েছে।।’’
এইভাবে হরি নাম করে নিরন্তর।
দৈবচক্রে দেহে তাঁর হল মহাজ্বর।।
শুধু জ্বর নয় সাথে দেহে হল ক্ষত।
চুপে চুপে জ্বালা সাধু সহে অবিরত।।
কয় দিন পরে নাহি জানি কি কারণে।
গৃহ ছাড়ি রাত্রে সাধু যায় কোন খানে।।
তাঁর সতী নারী নাম ফুলমালা দেবী।
শুদ্ধা শান্তা ভক্তিমতী করুনার ছবি।।
স্বামীর উপরে তাঁর বহু স্নেহ রয়।
স্বামী সেবা লাগি ব্যস্ত রহে সর্ব্বদায়।।
স্বামীর বৈরাগ্য দেখি সতী ভাবে মনে।
স্বামী ভিন্ন এ জীবনে বাঁচিব কেমনে?
তই যবে রাত্রি ভাগে সাধু কোথা যায়।
স্বামীর সন্ধানে দেবী পিছে পিছে ধায়।।
দেখে সাধু লোকালয় ছাড়িয়া চলিল।
নিরালা ভিটার পরে উপস্থিত হল।।
তেলীভিটা নামে স্থান অতি ভয়ঙ্কর।
দিবসে যাইতে সেথা লোকে পায় ডর।।
খড়মিলি শয্যা করি বসি তার পরে।
‘‘গোপীযন্ত্র’’ নিয়ে সাধু হরি নাম করে।।
ফুলমালা দেবী সব দিখয়া নয়নে।
সংঙ্গা হারা হয়ে পড়ে স্বামীর চরণে।
অকস্মাৎ দৃষ্টিপাত সাধু যদি করে।।
ফুলমালা বলে তারে চিনিলেন পরে।
সংঙ্গা প্রাপ্তে ফুলমালা বলিছে কান্দিয়া।
‘‘কোথা তুমি যাবে নাথ আমারে ফেলিয়া।।
এসব বৈরাগ্য ভাব সব ছেড়ে দাও।
গৃহেবসে হরিবলে জগত মাতাও।।’’
সতীর বাক্যেতে সাধু গৃহেতে ফিরিল।
সেই হতে রোগ তার দুরে চলে গেল।।
রোগে মুক্ত হয়ে সাধু জয়পুর যায়।
কান্দিয়া পড়িল সেথা তারকের পায়।।
তারিক বলিল তারে ‘‘শোন রূপচাঁদ।
পূর্নব্রহ্ম ভগবান প্রভু গুরুচাঁদ।।
ওড়াকান্দী অবতীর্ণ জীবের কারণে।
শরণ লহ গো তুমি তাঁহার চরণে।।’’
রূপচাঁদ বলে প্রভু ‘‘কিছু নাহি জানি।
দয়া করে যা শিখাও তাই মাত্র মানি।।
আমার বলিতে প্রভু নাহি কিছু আর।
দয়া করে লহ মোর জীবনের ভার।।’’
তারক বলিল তবে ‘‘লইলাম ভার।
ওড়াকান্দী যাতায়াত কর এইবার।।
তারকের সঙ্গে সাধু যায় ওড়াকান্দী।
শ্রীগুরুচাঁদেরে দেখে উঠিলেন কান্দি।।
প্রভু কয় ‘‘হে তারক এই কোন বীর?
বৃহৎ উন্নত দেহ সু-উন্নত শির।।’’
তারক সংক্ষেপে তার দিল পরিচয়।
পরিচয় অন্তে প্রভু তাঁরে ডেকে কয়।।
‘‘মোর বাক্য রূপচাঁদ একবার লও।
শ্রীহরিচাঁদের নাম জগতে ছড়াও।।’’
সেই হতে ওড়াকান্দী করে যাতায়াত।
কখন একাকী কভু তারকের সাথ।।
অধিকাংশ কালে যায় জয়পুর গ্রামে।
ভৃত্য ভাবে রহে পড়ি তারকের ধামে।।
ভক্তি গুণে বাধ্য তাঁর বাড়িত পুলক।
যেই কালে সে তারক দেহ ছাড়ি যায়।।
বহুকাল রূপচাঁদ আছিল তথায়।।
প্রাণপনে সেবা তাঁর বহুত করিল।
তাঁর কোলে শুয়ে সাধু জীবন ত্যাজিল।।
তারকের শক্তি নাকি রূপচাঁদ পায়।
তাঁর যত শিষ্য তারা এই কথা কয়।।
বহু শক্তিধারী ছিল রূপচাঁদ স্বামী।
কিছু তার উপখ্যান বলি এবে আমি।।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!