ভবঘুরেকথা
ফকির গণি শাহ্

-ফকির সামসুল সাঁইজি

আমার সাঁইজির গুণের কথা বলে তো শেষ করা যাবে না। শুরু করবো কোথা থেকে? আমার সাঁইজির তো আসলে কোন তুলনা হয় না। এত নম্র, এত শান্ত স্বভাবী মানুষ। এত তীক্ষ্ণ যে বিচার জ্ঞান আমার সাঁইজির, লালন সাঁইজির উপরে। আমিতো ভাবতেই পারি না। আমার সাঁইজি জাগতিক শিক্ষা একেবারে নাই বললেই চলে।

কোনরকম সইটা করতে পারত, পারতেন আর কি। লালন সাঁইজির পদের ব্যাখ্যাগুলো সাঁইজি এতো সুন্দর করে করতেন। আমি বসে বসে শুনতাম। যার জন্য আমি সাঁইজির আশেপাশে বেশি বসে থাকতাম। বিভিন্ন দেশের আনাচে কানাচে থেকে অনেক জ্ঞানীগুণী মানুষ এসে আমার সাঁইজির কাছে সাঁইজির অভিমত জানতে চাইতেন।

এমনকি বিদেশীরিও। কি উত্তর সাঁইজি দেন আমি বসে চুপ চুপ করে শুনতাম। এতো সুন্দর যে ব্যাখ্যা দিতেন, তা চিন্তাই করা যায় না। যেমন আমি একদিন একটা বিষয় জানতে চাইলাম। লালন সাঁইজির এখানে দেখি ইলিশ মাছের সেবা হয়। মানে লালন সাঁইজির সাধু সেবায়। তো ইলিশ মাছ কেন এখানে দিতে হয়, কেনই’বা সাধুরা ইলিশ সেবা নেয়?

সাঁইজি বললেন, বাবা! ইলিশ মাছ হচ্ছে, উজান ধাওয়া মাছ। এতো উজান পাতে অন্য কোন মাছ পাবে না। যত স্রোত বেশি তত ইলিশ উজানে আসবে। তাই সাগর থেকে মেঘনা, যমুনা, পদ্মাতে যে ইলিশগুলো আসে। এই স্রোত যখন বেশি হয়; তাইতো সে সময়তো একটা আনাগোনা নদীতে। তাহলে উজান ধাওয়া মাছ, আর সাধুদের করণও উজান করণ।

তখন থেকে সাঁইজি, যেকোন আমাদের মধ্যে যে অনুষ্ঠানগুলো, মানে সাঁইজির সিঁড়িতে সবচে আমার সাঁইজির ভক্ত বেশি। এ রাজশাহীতে চারটে থানাতে ভক্ত আছে। দূর্গপুরায় আছে, মহনপুর আছে, বাগমারায় আছে, পবায় আছে। চাইরট্টা থানার সমাহার কিন্তু এ জায়গাটা।

এতো চমৎকার কথা আমার সাঁইজির কাছে পেলাম, যে এ ব্যাখ্যাতো কোনদিন পাইনি। আর ইলিশ মাছ হচ্ছে গভীর জলের মাছ, সাধুদেরও গভীর জলেরই কর্ম। তাও সাঁইজির স্মৃতিচারণে আমি কথাটা তুলে ধরেছিলাম। অনেকে বললো বাহ্, ইলিশ মাছ সম্বন্ধে তো আমাদের আজ পর্যন্ত এ ধারণা নাই। আমরা দীর্ঘ দিন থেকে দেখছি লালন শাহ্’তে ইলিশ সেবা হয়; কেন হয় আজকে’তো বুঝলাম।

আমার সাঁইজির স্মৃতিচারণে এই কথাটুকু তুলে ধরেছিলাম আমি। তো অনেকেরই ধারণাটা এসে গেল সেই দিন। এভাবে যে বিষয়টাই জানতে চাইতাম এত সূক্ষ্মভাবে সাঁইজি বুঝায়ে দিতেন, চিন্তাই করা যায় না। তাঁর পাশে বসে বসে আমিও বসে বসে দু’এক কথা অনুমতি নিয়ে বলতাম; তো হঠাৎ করে একদিন আমার সাঁইজি এক জনাকীর্ণ সমাবেশে অর্থাৎ একটা অনুষ্ঠানে; আমাকে ডেকে বলেন বাবা, সামসুল আছো গো?

জী, সাঁইজি আছি, তো আসো এখানে কিছু কথা বলো। এ প্রথম বাক্য এটা!! মঞ্চে উঠে কিছু কথা বলা। আমি চিন্তা করলাম সর্বনাশ করেছে। আমার তো গা কাপঁতে শুরু হলো। এদিক গুরু বাক্য, আমি মঞ্চে শুধু আমি উঠবো কেমন করে। প্রচুর জ্ঞানীগুণী মানুষের সমাগম কুষ্টিয়াতে। তো উঠলাম; না উঠেতো উপায়ও নাই, সাঁইজি বাক্য দিয়ে দিলেন।

কয়েকটা কথা বললাম। তো গুরু কেন ধরতে হয়, এই প্রসংঙ্গ নিয়ে কয়েকটা কথা। নেমে আসার সময় আমার পা’দুটো থরথর করে কাপঁছে। মানুষের মধ্যেতো কথা বলা ওটি আমার প্রথম। তো সাঁইজি আমাকে উৎসাহ দিলেন, বাহ্ কত সুন্দর কথা হলো গো!! বলতে বলো পারোনা দেখ, কত সুন্দর কথা হলো।

এই যে উৎসাহটা দিলেন, সাঁইজি উৎসাহ দিলেন হিসেবে আরতো বলতে পারছি না খারাপ হলো, তো আমার মনের কাছে অতো সুন্দর তো মনে হলো না। কিন্তু সাঁইজি বললেন খুব সুন্দর হলো গো, দেখোতো। আবার হঠাৎ ডাক দিয়ে বলছে, বাবা সামসুল আসো এদিকে একটা গান বলো সাঁইজির; কালাম গাও। এইবার আমি সমস্যার মধ্যে পরলাম, মানুষের মধ্যে আমি হা করে একটু সুর কেমন করে দিবো।

না হয় কর্কশ কণ্ঠে কয়েকটা কথা না হয় বললামই। সেই উঠে আবার একতারা দিয়ে সাঁইজির কালাম গাইলাম। এইভাবে ভয়-ভীতি অন্তরে নিয়ে, বাহ্ কত সুন্দর হলো গো দেখতো। তখন থেকে সাঁইজি, যেকোন আমাদের মধ্যে যে অনুষ্ঠানগুলো, মানে সাঁইজির সিঁড়িতে সবচে আমার সাঁইজির ভক্ত বেশি। এ রাজশাহীতে চারটে থানাতে ভক্ত আছে। দূর্গপুরায় আছে, মহনপুর আছে, বাগমারায় আছে, পবায় আছে। চাইরট্টা থানার সমাহার কিন্তু এ জায়গাটা।

এ পুরো বাইশ বৎসর উনি আমার জীবদ্দশায় ছিলেন, তো এই যে পরীক্ষাটা। সাঁইজি তো আর পরীক্ষা করা যায়না। গুরু বাক্যটাই যে বিশ বছর ধরে আমি লালন করছিলাম, কি হয়, সাঁইজির কি হয় দেখি। বিশ বছর পরে আবার কি হচ্ছে; এই যে বাক্য সিদ্ধি।

এখানে এসে বিভিন্ন জায়গায় যে অনুষ্ঠানগুলো আমার সাঁইজির বর্তমানে হয়েছিল। প্রত্যেকটা অনুষ্ঠানে সাঁইজি বললেন, সামসুল আসো বাবা কিছু বলো। এই যে একটা প্রকিৃয়া শুরু হয়ে গেল কুষ্টিয়াতে, তারই ফলশ্রুতিতে আজকে দু’কথা বাবা আমাকে বলতে হচ্ছে। ঐ শিল্পকলাতে যে দু’কথা বলতে হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেয়ে বলতে হলো।

এটা আমার সাঁইজির একটা আধ্যাত্মিক একটা শক্তি নিশ্চয়ই আমার ভিতরে কিঞ্চিৎ প্রদান করে ছিলেন বিধায়; তাছাড়া আমারতো কোন ক্ষমতা নাই যে, আমি হা করো কিছু বলবো। এই যে অনুভুতিটা আস্তে আস্তে আমার ভিতর প্রবেশ করলো, সাঁইজির এ ক্ষমতাটা যে কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ যে আমাকে সাঁইজি দান করলেন।

এটা একটা আধ্যাত্মিক বিশাল শক্তি আমার সাঁইজির। এটাকে পুঁজি করে নিয়ে বাবা আমি একটু চলি। খুব সহজ সরল মানুষ; তো বাসায় এসে আমাকে বললেন, যে গুরু বাক্যগুলো কত, গুরুর মুখের বাক্যটা এক্ষুনি প্রতিফলিত হলো কি না এটা কিন্তু বিচার করা যাবে না। আমার সাঁইজির যে বাক্য সিদ্ধি এটা আমি, বুঝতে আমাকে বাইশ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে।

শুধু একটা বাক্যের উপরই। তাহলে গুরুকে পরীক্ষা করিনি। আমি বয়াত নিবো, সাঁইজি বললেন বাপ তুমি যাও আমি রাজশাহী এসে বয়াত দেবো তোমায়। আমি বললাম, সাঁইজি যদি আমি এর মধ্যে মারা যাই কিংবা আপনি হয়তো চলে গেলেন, তাহলে আমার কি উপায়। আমি যে বর্জক বিহনে গুরু বিহনে চলে যাবো; তাহলে তো আমি জীবে যাবো।

তবে তো মানব কূলটা রক্ষা হতো যদি আজকে বর্জক আমি নিয়ে যেতে পারতাম। তো ঠিক আছে বাপ যাও, আমি আরো বিশ বৎসর গুরুর কৃপায় বেঁচে আছি। এই যে সেই দিন থেকে বিশ বৎসর বৎসর পর্যন্ত আমাকে, এই অপেক্ষায় থাকতে হবে যে, কবে যে বিশ বৎসর হবে তারপর কি হচ্ছে আমার সাঁইজির।

এই বাক্যটা দু’বছর/বিশ বৎসর ধরে আমি হৃদয়ে লালন করে নিয়ে ছিলাম বাবা। তারপরও আরো দুই বৎসর পর সাঁইজি দেহ রেখেছেন। বাইশ বছর। এ দু’বছর হাতে যখন ছিলো, বিশ বৎসর পার হয়ে, সেই সময় সাঁইজি আমাকে বললেন, বাপ খেলাফত নাও; বাবা, আমি আর বেশি দিন থাকবো না। এই বেশিদিন থাকবো এই কথাটার মধ্যে ঐ দুইটা বৎসর ছিলেন।

এ পুরো বাইশ বৎসর উনি আমার জীবদ্দশায় ছিলেন, তো এই যে পরীক্ষাটা। সাঁইজি তো আর পরীক্ষা করা যায়না। গুরু বাক্যটাই যে বিশ বছর ধরে আমি লালন করছিলাম, কি হয়, সাঁইজির কি হয় দেখি। বিশ বছর পরে আবার কি হচ্ছে; এই যে বাক্য সিদ্ধি।

এই দিকে যে ও মাছটা নিয়ে হাড়িতে নিয়ে বসে আছে, প্রতিক্ষায়, এটাতো আর জানতাম না। এসে দেখসি এরকম। তো একটা একশো দশ টাকা দিয়ে বড় একটা জিওল মাছ একটা ছেলে নিয়েছে, বিশাল একটা জিওল। তো আমি বললাম যে, ভাই জিওল নিয়ে নিয়েছেন? হ্যাঁ ভাই কেন? জিওলতো আমার সাঁইজি নিতে আমাকে পাঠাইসে।

তারপরে, কি যেন একটা আমাকে বললেন, যাক, সব কথাতো এখন স্মরণে হচ্ছে না। তো অনেকগুলোন বাক্য সাঁইজির আমি দেখেছি, হুবহু সে প্রতিফলিত হয়েছে। আমাকে বললেন সাঁইজি; বাপ, আজকে বোয়াল মাছ যদি পাও, তবে বোয়াল মাছ নিয়ে আসো। তো সাঁইজি বোয়াল কেন খাইতে ইচ্ছে হচ্ছে? আপনার কি বোয়াল খেতে খুব ইচ্ছে করে, ভালো লাগে?

বাপ, লালন সাঁইজির ভক্ত নদী থেকে একটা তাজা বোয়াল এনে দিয়ে বললেন যে, সাঁইজি আজকে একটা বোয়াল মাছ পেয়েছি। তো সাঁইজি দেখে বললেন, বাহ্, খুব সুন্দর মাছ গো। তো তারপর বাবা বোয়াল খেতে আমারও মন চায়। তো সাঁইজি খুব ভালো বলেছেন। তো বোয়াল আনতে আমি গেলাম কানপাড়ার বাজারে; এই বাজারে।

ছোট হাট, তো এ গুলোতেতো চাওয়া মাত্রই সব পাওয়া যায় না। গিয়ে দেখছি যে, একজন একটা বোয়াল মাছ নিয়ে বেঁধে ফেলেছে; নিয়ে যাবেন। আমি বলছি বাবা, এ মাছ কি তুমি নিয়েছ? জী! কেন বাবা? তো মাছ তো তোমার নেওয়া হচ্ছে না। মাছ যে আমাকে নিতে হচ্ছে; আমার সাঁইজি বোয়াল কিনতে আমাকে হাটে পাঠাইসে, আমার গুরু।

তো বাবা বোয়ালটা আজকে তোমার আর নেওয়া হচ্ছে না। তো আচ্ছা, আচ্ছা, আচ্ছা বাবা; ঠিক আছে ঠিক আছে। আপনার গুরু যখন বোয়াল খেতে চেয়েছে; নিয়ে যান নিয়ে যান। তার ক্রয়কৃত মাছ আমাকে দিয়ে দিলো। নিয়ে আসলাম; সাঁইজি একটাই বোয়াল, এই ভাবে নেওয়া; বাহ্ খুব ভালো মানুষ গো সে। এই যে বোয়ালটা তোমাকে ফেরত দিয়েছে, খুব ভালো মানুষ গো।

গো গো করে কথা বলে, কুষ্টিয়ার ভাষায়। আরেকদিন আমি বাজারে যাচ্ছি সাঁইজির জন্য মাছ আনতে, এ ঠিক আজকের মতো জিওল মাছ আনতে। আজও যে জিওল হাটে এ ভাবে পাওয়া যাবে জানি না। জিওল পট্টিটা ঐ সাইডে। যেয়ে দেখছি যে, মাছইতো নাই ঐ সাইডে। জিওল, শোল বা এ জাতীয় মাছ গুলো ঐ দিকে পাওয়া যায়।

এই দিকে যে ও মাছটা নিয়ে হাড়িতে নিয়ে বসে আছে, প্রতিক্ষায়, এটাতো আর জানতাম না। এসে দেখসি এরকম। তো একটা একশো দশ টাকা দিয়ে বড় একটা জিওল মাছ একটা ছেলে নিয়েছে, বিশাল একটা জিওল। তো আমি বললাম যে, ভাই জিওল নিয়ে নিয়েছেন? হ্যাঁ ভাই কেন? জিওলতো আমার সাঁইজি নিতে আমাকে পাঠাইসে।

আমি অবাক হয়ে গেলাম, যে সাঁইজি সম্ভবত আর থাকছে না। কেন আজকে আমি বাঁশ পাতা পাচ্ছি। নিলাম সব; নিয়ে বললাম সাঁইজি, আপনার পছন্দের প্রায় মাছগুলো আজকে যে আমি পেলাম যে। তাই বাপ? হ্যাঁ। তার কিছুদিন পরেই সাঁইজি চলে গেল। মাত্র কয়েকদিন পর।

আমার সাঁইজি যে জিওলের মাছ খাবে, আপনি সেটা আজকে নিয়েন না ভাই। তাই? তো আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে। সেটাও যায়ে দেখছি সেটাও একই ঘটনা। এই দুটা মাছ নিয়ে নিয়েছে, অথচ আমি যে অনুরোধ করে নিলাম; সাঁইজির কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দিল। তো যে জিওল কিনতে যেয়ে পাওয়া গেল!!

বোয়াল কিনতে যেয়ে পাওয়া গেল!! শেষের কতগুলোন বিষয় নিয়ে আমি খুব শঙ্কিত ছিলাম, খুব চিন্তিত, যে বাঁশ পাতা যে ছোট সাইজের যে মাছগুলো। বাঁশ পাতা। কুষ্টিয়াতে বেশ পাওয়া যায়। প্রায় মাছ মার্কেটেই পাওয়া যায়। আমি একদিন বললাম, সাঁইজি বাঁশ পাতা মাছ প্রায় বাজারে দেখছি, আমাদের রাজশাহীতে এভাবে দেখতে পাইনা।

বললেন, বাবা বাঁশ পাতা মাছ খুবই খেতে সুন্দর/সুস্বাদু খুব ভালো। এই যে খুব ভালো বললেন, না বললেন; আমি সেই দিন থেকে বাঁশ পাতা মাছ খুঁজতে শুরু করলাম, অথচ মাছ বাজারে গেলেই আমি বাঁশ পাতা দেখতে পেতাম; কুষ্টিয়ায়। যেকটা মার্কেট, সে ক’টা মার্কেটে খুঁজে খুঁজে আর বাঁশ পাতা পাই না। এই করতে করতে বেশ মনে হয় বছর দুই-তিনটা পার হয়ে গেল, বাঁশ পাতা নাই।

অন্য সময় উঠলেও, যা যখন যায় তখন আর নাই। কোনো কোনো ভাই গেলে আমি বলি, বাঁশ পাতা পেলে আমার সাঁইজিকে কিনে দিয়ে আসবে। আমি টাকা দিয়ে দেবো, কিন্তু পায় না। সাঁইজির অন্তিম মূহুর্ত প্রায় এসে গেছে, এ মতবস্থায় আমি বাজারে যেয়ে দেখছি ঐ বাঁশ পাতা মাছ, চিংড়ি মাছ। ইলিশ মাছ খুব পছন্দ করতেন সাঁইজি।

সেটা প্রায়ই পাওয়াই যেত। ইলিশ মাছ, পাবদা মাছ এই মাছগুলো বেশি পছন্দ করতেন। প্রত্যেকটা পছন্দের মাছ দেখছি সেই দিন বাজারে। আমি অবাক হয়ে গেলাম, যে সাঁইজি সম্ভবত আর থাকছে না। কেন আজকে আমি বাঁশ পাতা পাচ্ছি। নিলাম সব; নিয়ে বললাম সাঁইজি, আপনার পছন্দের প্রায় মাছগুলো আজকে যে আমি পেলাম যে। তাই বাপ?

হ্যাঁ। তার কিছুদিন পরেই সাঁইজি চলে গেল। মাত্র কয়েকদিন পর। এই শেষ বাঁশ পাতা মাছ, সেটাই খাওয়া। মনে হয়, ইলিশ মাছ সেটাই শেষ খাওয়া। ঐ পাবদা মাছ, চিংড়ি মাছ সেটাই শেষ খাওয়া। যদি শেষে এই মাছটুকু আমি সাঁইজিকে সেবা দিতে না পারতাম, আমার বাকী জীবনটা (আবেগাপ্লুত হয়ে পরেন)… এতে আমি তৃপ্ত। সাঁইজি সঙ্গোপনে খেয়েছেন।

কোন দিন খুঁজতে চেষ্টাও করিনি আমার সাঁইজির অপরাধ। যার জন্য আমার সাতীর্থ (সাথী) ভাইদের আমি গর্ব করে বলে ছিলাম। এতো বৎসরের মধ্যে আপনারা কোন দিন দেখেছেন, আমার সাঁইজির বিরুদ্ধে কোন শব্দ উচ্চারণ হয়েছে আমার মুখ দিয়ে।

আমার মনে হয়ে, প্রতিটা ভক্তকে গুরু ভালোবাসে। আমি মনে করি যে, পৃথিবীতে কোন গুরুর ভক্ত মনে হয় আমার মতো এতো আদর পেয়েছে কিনা। কোন গুরুর ভক্ত, যে আদর আমাকে আমার সাঁইজিকে দিসেন। আমি বিচারে পাইনা যে, আমার গুরু’তো দূরে থাক, কোন গুরুর ভক্ত পেয়েছে কি না। হয়তো এ কথাটা আমার একটু অহংকার হয়ে গেল।

কেন এতো ভালবাসতেন আমি বুঝতে পারি না। লোকে কয়, তোকেই গুরু সবচে বেশি ভালবাসে। আমিও মনে করি ভক্তরা যেন বলে, সবচে আমার সাঁইজি আমাকে বেশি ভালবাসে। আমি বলতাম যে, সাঁইজি মনে যে সবচেয়ে আমাকে বেশি ভালবাসে। এ কথাটা যেন প্রতিটা ভক্তের মধ্যে প্রবেশ করে, আমাকে যেন আমার গুরু সবচেয়ে বেশি ভালবাসে। তাই আমি, কোন শ্রেণী বিন্যাস করে ভক্তদেরকে পরিচালনা করিনা বাপ।

যাক, সেই দিন ‍যদি ঐ মাছ আমি খাওয়াতে গুরুকে না পারতাম; আমার বাকি জীবনটা বৃথা যেত। আর এ দুশ্চিন্তাটা আমার মন থেকে দূর আর হতো না। কেন, সাঁইজি বোয়াল খেতে চেয়ে আমি দিতে পারলাম না? কেন পাবদা মাছ দিতে পারলাম না? কেন বাঁশ পাতা দিতে পারলাম না? সেই মাছ কয়টা দিয়ে বাপ আমার বাকী জীবনটা যেন আমি ধন্য মনে করছি।

তো আমার সাঁইজির গুণের কোন জায়গাতে হাত দিয়ে কথা বলবো বাবা; তাঁর আপাদমস্তক কোথাও ফাঁক নাই। যেমন সাঁইজির কোন ত্রুটি আমার জীবনে, একটা বিন্দু ত্রুটিও ধরা পরেনি। কোন দিন খুঁজতে চেষ্টাও করিনি আমার সাঁইজির অপরাধ। যার জন্য আমার সাতীর্থ (সাথী) ভাইদের আমি গর্ব করে বলে ছিলাম।

এতো বৎসরের মধ্যে আপনারা কোন দিন দেখেছেন, আমার সাঁইজির বিরুদ্ধে কোন শব্দ উচ্চারণ হয়েছে আমার মুখ দিয়ে। আর আমি যদি বলি, এমন কোন গুরু ভাই নাই, আমার সাঁইজির বিরুদ্ধে কথা বলেন নি। আমার চ্যালেঞ্জ থাকলো যে, আপনার বলেন, তখন ওরা মনে মনে খুঁজে তাই তো; হে হে. এই আর কি হে হে… কি বলবো আর?

………………………
ভিডিও লিংক : ভিডিও লিংক:

……………………….
-ফকির সামসুল সাঁইজি, সাঁইনগর, রাজশাহী
শ্রুতি লেখক : মাশফিক মাহমুদ

……………………….
স্থিরচিত্র: গুরু গণি শাহ্’র সঙ্গে ফকির সামসুল সাঁইজি

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

…………………………………….
আরো পড়ুন:
ফকির মনোরঞ্জন গোঁসাই
আমার দেখা কবিরাজ গোঁসাই

মরমী সাধক মহেন্দ্রনাথ গোস্বামী
একজন লালন সাধকের কথা
আমার পিতা ভক্ত মনোরঞ্জন গোঁসাই ও তাঁর দর্শন

মনোরঞ্জন গোঁসাই : বাউল সাধনার শুদ্ধপুরুষ -এক
মনোরঞ্জন গোঁসাই : বাউল সাধনার শুদ্ধপুরুষ -দুই
মনোরঞ্জন গোঁসাই : বাউল সাধনার শুদ্ধপুরুষ -তিন

মনোরঞ্জন গোঁসাই: স্বরূপ সন্ধানী দার্শনিক
মনোরঞ্জন গোঁসাই ও তাঁর জীবন দর্শন
দরবেশ লালমিয়া সাঁই
সহজ মানুষের পূর্ণ ঠিকানা ‘খোদাবক্স ফকির’
ফকির গণি শাহ্
ফকির জাফর মস্তান

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!