ভবঘুরেকথা

তারকচাঁদের তিরধান ও সূক্ষ্মদেহে দর্শণ
হরি-গুরুচাঁদ বন্ধি যুগল চরণ।
তারকের লীলা গীতি করিব বর্ণন।।
হরিভক্ত শিরোমণি তারক গোঁসাই।
যাহার মস্তকে থাকে ক্ষীরোদের সাই।।
সত্যবাদী জিতেন্দ্রিয় পুরুষ রতন।
শোক তাপ দুরে যায় করিলে স্মরণ।।
প্রশস্থ গার্হস্থ্য ধর্ম পালন করিত।
নামে রুচি জীবে দয়া সবে শিক্ষা দিত।।
বিবাহ করিল তিনি ঠাকুরের মতে।
এক কন্যা জন্ম নিল তাহার গর্ভেতে।।
চিন্তামণি নামে ভার্যা পতি পরায়ণা।
পতি পদ ভিন্ন সতী কিছুই জানেনা।।
তারকের আজ্ঞা মতে সতত চলিত।
স্বভক্তি অন্তরে সতী চরণ সেবিত।।
এক কন্যা সেই গর্ভে যখন জন্মিল।
শংকরী বলিয়া নাম তাহার রাখিল।।
পুত্রের বাসনা তার নাহি ছিল মনে।
তারকের কথা মতে চলে তার সনে।।
কন্যাটিকে যত্ন করি পূর্ণ অভিলাষ।
আর না করিল সতী স্বামী সহবাস।।
এই ভাবে কত দিন গত হয়ে গেল।
ক্রমে ক্রমে সেই কন্যা বাড়ীতে লাগিল।।
শংকরী কে বিয়ে দিয়ে রাখিল বাড়ীতে।
এক পুত্র জন্ম নিল তাহার গর্ভেতে।।
সে পুত্রের নাম রাখে শৈলেন্দ্র বলিয়া।
তারক রাখিল নাম কি যেন ভাবিয়া।।
পুত্র পেয়ে শংকরীর ভরে ওঠে বুক।
কোলে করে সেই পুত্র কত পায় সুখ।।
এই ভাবে কত দিন গত হয়ে গেল।
দিনে দিনে সেই পুত্র বাড়িতে লাগিল।।
তারকেরে দাদু বলে ডাকিত যখন।
কোলে করে তারকের আনন্দিত মন।।
মুখে চুমু দিয়ে তারে ভালবাসা দিত।
ভালবাসা পেয়ে শিশু আনন্দে হাসিত।।
তাই দেখে সাবাকার আনন্দিত মন।
সুখের সাগরে ভাসে তারক সুজন।।
এই ভাবে কত দিন গত হয়ে গেল।
শংকরী ডাকিয়া তার পিতাকে কহিল।
আমার ছেলের লাগি জুতা কিনে দাও।
বার বার বলি আমি দিব দিব কও।।
তারক বলেছে মাগো পরবাসে যাই।
দেশে দেশে আমি শুধু কবিগান গাই।।
আসিবার কালে মাগো মনেতে থাকে না।
কিনিব কিনিব বলে কিনিতে পারিনা।।
শংকরী বলেছে বাবা শুন মোর কথা।
মরে গিয়ে দিবে নাকি মোর পুত্রে জুতা।।
তারক বলেছে মাগো হতে পারে তাই।
জুতা কিনে দিব আমি কোন চিন্তা নাই।।
তারপর কতদিন গত গয়ে গেল।
সেই জুতা কোন দিন কিনিয়ে না দিল।।
তারপর দেশে দেশে ঘুরিতে লাগিল।
ঠাকুরের যুগধর্ম পালন করিল।।
গীতি কাব্য লিখিলেন মহাসংকীর্তন।
শুনিলে জীবের হয় শমন দমন।।
হরি লীলামৃত গ্রন্থ মধুর আখ্যান।
ভক্তগণে শোনে তাহা অমৃত সমান।।
এই ভাবে হরিনাম প্রচার করিয়া।
শুভক্ষেণে চলিলেন জগত ছাড়িয়া।।
একদিন ঘুম হতে প্রভাতে জাগিয়া।
হরিনাম করিতেছে কান্দিয়া কান্দিয়া।।
সবে দেখে হরিনাম করিতে করিতে।
প্রাণ পাখী উড়ে গেল দেখিতে দেখিতে।।
আত্ম পরিজন সবে কান্দিয়া ভাষায়।
ব্রহ্মরন্ধ্র ফেটে গেছে দেখিবারে পায়।।
তেরশ একুশ সালে ফাল্গুন মাসেতে।
শিব চতুর্দশী তিথি চড়িপুষ্প রথে।।
চলিলেন রসরাজ ঠাকুরের পাশে।
দীর্ঘ শ্বাস ছাড়িতেছে আকাশে বাতাসে।।
নর নারী যারা ছিল কান্দিয়া ভাসায়।
আকাশে সাতাসে যেন হরিগুণ গায়।।
গ্রাম বাসি যারা ছিল করে হায় হায়।
এহেন দরদী মোরা পাইব কোথায়।।
সোনার মানুষ গেল জগত ছাড়িয়া।
কেমনে বাঁচিব মোরা শোক পাশরিয়া।।
এই ভাবে কতজন কান্দিয়া ভাসায়।
শংকরী মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি যায়।।
কেন্দে বলে ওগো বাবা আখি মেলে চাও।
কোন দেশে যাবে তুমি মোরে কয়ে যাও।।
চিন্তামণি কান্দিতেছে চরণে পড়িয়া।
কেন তুমি ছেড়ে গেলে দাসীকে ফেলিয়া।।
সতী নারী পতি বিনে কিছু নাহি চায়।
কি বুছিয়া ছেড়ে গেলে ফেলিয়া আমায়।।
অভাগিনীর মিনতী চরণে জানায়।
আমি আর বেশি দিন রব না ধরায়।।
কৃপা করে নিও স্বামী তোমার নিকটে।
কেন্দে কেন্দে চিন্তামণি কহে করপুটে।।
তাই শুনে গ্রাম বাসি সবাকে বুঝায়ে।
শব দাহ করিলেন শ্মশানেতে নিয়ে।।
হরিবলে চিতা জ্বেলে করিল দাহন।
চন্দনের বিন্দু বিন্দু হয় বরিষণ।।
চন্দনের বৃষ্টি হয় দেখিল সকলে।
আশ্চর্য্য মানিয়া সবে হরি হরি বলে।।
কেহ কেহ হরি বলে কান্দিয়া ভাষায়।
আকাশে বাতাসে যেন হরিগুণ গায়।।
এই ভাবে দাহ কার্য্য সমাধা হইল।
শোক পাশরিয়া সবে গৃহেতে আসিল।।
তারপর সামাজিক প্রথা অনুসারে।
শ্রাদ্ধ কার্য্য করিলেন দশদিন পরে।।
তারপর কি হইল শুন দিয়ে মন।
ঘটনা প্রবাহ আমি করিব বর্নণ।।
দিঘলিয়া গ্রাম বাসি জগদীশ নাম।
তারকের প্রিয় শিষ্য ভক্ত গুণধাম।।
বাড়ী শ্রেণী ভুক্ত সেই ব্রাহ্মণ নন্দন।
পৈতা ফেলে করিলেন আত্মসমর্পণ।।
মাদারীপুরেতে গেল সেই মহাশয়।
দৈব যোগে তারকের সনে দেখা হয়।।
দেখিয়া সে জগদীশ প্রণাম করিল।
কোথায় চলেছে বাবা মোর কাছে বল।।
তারক বলেছে বাছা বলি তব ঠাই।
হরিবলে আজি আমি ব্রহ্মপুত্রে যাই।।
একজোড়া জুতা কিন আনিয়াছি আমি।
সঙ্গে করে এই জুতা লয়ে যাও তুমি।।
মোর নাতি শৈলেন্দ্রেরে এই জুতা দিও।
কবে ফিরি ঠাই নাই তাহাকে কহিও।।
জুতা নিয়ে জগদীশ গৃহেতে আসিল।
পর দিন জুতা নিয়ে জয়পুর গেল।।
তিন দিন আগে সেই তারক গোঁসাই।
শুনিলেন ছেড়ে গেছে এ জগতে নাই।।
তাই শুনে জগদীশ মাটিতে পড়িল।
চেতনা পাইয়া শেষে কান্দিয়া কহিল।।
গত কাল জুতা কিনে মোর কাছে দিল।
মাদারীপুরেতে বসে আমাকে কহিল।।
কবে আমি দেশে ফিরি তার ঠিক নাই।
বুঝিলাম শেষ দেখা দিলেন গোঁসাই।।
তাই শুনে সবে মিলে কান্দিয়া ভাসায়।
মাটিতে পড়িয়া সবে গড়াগড়ি যায়।।
হেন দশা হল সেথা কহন না যায়।
গ্রাম বাসী সবে এসে করে হায় হায়।।
শংকরী কান্দিয়া বলে সকলের ঠাই।
বাবা যাহা বলে ছিল করে গেল তাই।।
শুন বাবা বলি তোমা হৃদয়ের কথা।
কাহারে বুঝাব আমি পিতৃহারা ব্যাথা।।
চিন্তামণি কান্দিতেছে হা নাথ বলিয়া।
কি খেলা খেলিলে তুমি জগত ছাড়িয়া।।
তোমার বিরহ ব্যাথা সহিব কেমনে।
বলে যাও ওগো স্বামী জানাই চরণে।।
এই ভাবে কেন্দে কেন্দে সবে শান্ত হল।
সেই জুতা যত্ন করি মন্দিরে রাখিল।।
যত্ন করি সেই জুতা সেবা ভক্তি করে।
এইখনে সেই জুতা আছে সে মন্দিরে।।
অধম বিনোদ বলে পাঁচালীর ছন্দে।
তারকের ছবিখানি হৃদয়েতে বন্দে।।
তাই বলি ভাই সব বেলা ডুবে গেল।
হরিচাঁদ প্রীতে সবে হরি হরি বল।।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!