ভবঘুরেকথা
ব্রাহ্মসামাজ

বিবিধ অবস্থায় প্রার্থনা

প্রাত:কাল

হে প্রাণস্বরূপ পরম দেবতা, করুণাময় প্রভু পরমেশ্বর! গত রজনীতে তোমারই কৃপায় সুখে নিদ্রিত ছিলাম, তোমারই কৃপায় পুনর্ব্বার গাত্রোত্থান করিতেছি। দীনবন্ধো! দিবসের প্রারম্ভে তোমার শরণাপন্ন হইয়া তোমাকে বার বার প্রণাম করি। দয়াময়! আর্শীর্ব্বাদ কর যেন সমস্ত দিন তোমাতে নিষ্ঠা ও ভক্তি স্থির রাখিয়া তোমার প্রিয় কার্য্য সাধন করত দিবস অতিবাহিত করিতে পারি।

মধ্যাহ্নকাল

বিশ্বজননি! মাত:! এই বিশাল বিশ্বে মধ্যাহ্নকালে তোমার উদার সদাব্রত দ্বার উদ্ঘাটন করিয়া জীবকে প্রতিপালন করিতেছ। জীবের অভাব জানিয়া তুমি দান করিয়া থাক। ক্ষুধার্ত্তকে অন্ন দিতেছ, তৃষ্ণার্ত্তকে জল দিতেছ, রোগীকে ঔষধ দিতেছ, অজ্ঞানকে জ্ঞান দান করিতেছ, দুর্ব্বলের প্রতি বলবানের দৌরাত্ম দেখিয়া তাহার সুবিচার করিতেছ। জননি!

সমাজে প্রতি পরিবারে, চিকিৎসালয়ে, বিদ্যালয়ে, ধর্ম্মমন্দিরে, বিচারালয়ে তোমায় পূর্ণ আবির্ভাব প্রত্যক্ষ করিয়া কৃতজ্ঞতার সহিত তোমাকে যেন প্রণাম করিতে পারি। মাত:! আশীর্ব্বাদ কর, যেন তোমার এই নঙ্গল আদর্শ সম্মুখে রাখিয়া সর্ব্বদা অনলসভাবে তোমার সেবা করিতে পারি। স্নেহময়ি জননি! আমি তোমাকে শ্রদ্ধা ভক্তির সহিত বার বার প্রণাম করি।

ভোজন সময়ে

করুণময় দীনবন্ধু পরমেশ্বর! আমাকে ক্ষুধার্ত্ত দেখিয়া এই অন্ন প্রদান করিয়াছ। আমি কৃতজ্ঞচিত্তে তোমাকে করযোড়ে প্রণাম করিয়া তোমার প্রদত্ত অন্ন গ্রহণ করি।

সায়ংকাল

প্রভু পরমেশ্বর! অন্ধ তোমার কৃপায যত দূর নিজ কর্ত্তব্য সম্পন্ন করিয়া এবং জ্ঞান ধর্ম্ম উপার্জ্জন করিয়া জীবনের উন্নতি করিয়াছি, তজ্জন্য তোমাকে প্রণাম করি। প্রভো! অদ্য যদি পরোপকার প্রভৃতি কোন ধর্ম্ম কার্য্য করিয়া থাকি, তজ্জন্য তোমাকে ধন্যবাদ প্রদান করি। পতিতপাবন। অদ্য যদি মিথ্যা, অসত্য ব্যবহার, অহঙ্কার, পরনিন্দা প্রভৃতি পাপাচারণ করিয়া থাকি, সেই অভ্যস্ত পাপ হইতে আমাকে উদ্ধার কর। দীনবন্ধো! সমস্ত দিন তোমার যে অপার করুণা ভোগ করিয়াছি, তজ্জন্য তোমাকে বার বার প্রণাম করি।

শয্যায়

প্রাণস্বরূপ করুণাময় পরমেশ্বর! তোমার সুস্নিগ্ধ পরিবত্র ক্রোড়ে মস্তক রাখিয়া শয়ন করিতেছি। যদি এই নিশা আমার জীবনের শেষ নেশা হয়, তাহা হইলে পরলোকে তোমার ক্রোড়ে আনন্দ লাভ। করিতে যেন সক্ষম হই, নতুবা পূর্ব্বের মত ভবধামে জাগরিত হইয়া যেন উদ্যমের সহিত তোমার কার্য্যে নিযুক্ত হইতে পারি।

বিদেশ যাত্রাকালে

প্রভু পরমেশ্বর! আমি স্বদেশ এবং স্বজন আত্মীয় বন্ধুগণ নিকটে বিদায় লইয়া তোমার আজ্ঞা পালন করিতে বিদেশে গমন করিতেছি। প্রভো! তুমি স্বদেশে ও বিদেশে সমভাবে অবস্থিতি করিয়া সকলকে প্রতিপালন করিতেছ। দয়াময়, তুমি আমার সহায় হও, আমার দুর্ব্বল হৃদয়ে বল দাও। সিদ্ধিদাতা! আমার শুভসঙ্কল্প পূর্ণ কর।

সম্পদে

দয়াময়! আমাকে কৃপা করিয়া অনেক ঐশ্বর্য্য প্রদান করিযাছ। দেখো, প্রভো, আমি যেন ধনমদে অহঙ্কারী না হই। পরমেশ্বর, বড় ভয় হয়। ভয় হয় যে পরম ধার্ম্মিক ব্যক্তিও ধনবান্ হইয়া ভোগবিলাসে ঘোর বিলাসী হইয়া পড়িলে পাপ সংসারসক্তির দাসত্ব শৃঙ্খলে বদ্ধ হইতে পারে।

তাই প্রভো! অত্যন্ত ভীত হইয়া তোমাকে ডাকিতেছি ; দীনবন্ধো! আমি যেন বাহিরের ঐশ্বর্য্য, তুমিই আমার সুখ শান্তি। তোমাকে যেন না ভুলি। করুণাময়! তুমি যে আমাকে ধন রত্ন দিয়াছ, তজ্জন্য তোমাকে প্রণাম করি। এই ধন রত্ন দ্বারা তোমার পুত্র কন্যাদিগের সেবা করিয়া যেন জীবন সার্থক করিতে পারি।

বিপদে

বিপদভঞ্জন পরমেশ্বর! তুমি রক্ষাকর্ত্তা, আমার ভয় কি? আমাকে যে বিপদে ফেলিয়াছ, তজ্জন্য আমি তোমাকে ধন্যবাদ প্রদান করি। কেবল সম্পদ ভোগ করিলে তোমাকে ভুলিয়া যাইতাম। তোমার কৃপায দু:খ বিপদ আমাদের শক্তিকে জাগরিত করে, বিশ্বাস ও নির্ভর বর্দ্ধিত করে, জীবনে তোমার করুণার মূল্য প্রকৃত রূপে অনুভব করিতে শিক্ষা দেয়।

বিপদকালে হৃদয় মন তোমার দিকে অধিক ব্যাকুল হইয়া ধাবিত হয়, পরিবারের স্নেহ প্রীতির বন্ধন সকল অধিক দৃঢ় হয়। হে করুণাময ঈশ্বর, তুমি আমাকে ধৈর্য্য ও নির্ভর শিক্ষা দিবার জন্য এই বিপদ প্রেরণ করিয়াছ, তজ্জন্য তোমাকে প্রণাম করি। প্রভো! এই বিপদে যেন নিজ কর্ত্তব্য উপযুক্ত রূপে করিতে পারি।

পারিবারিক অশান্তি

হে জগতের পিতামাতা পরমেশ্বর! তুমিই কৃপা করিয়া আমাকে পরিবারে সংস্থাপন করিয়াছ। যখন মাতার গর্ভে ছিলাম, তখন একাকী ছিলাম। ভূমিষ্ট হইয়াই ভাই ভগ্নী, পিতামাতা লাভ করিয়া বাল্যকালে আনন্দে ছিলাম। যৌবনে বিবাহ করিয়া স্ত্রীপুরুষে পরিবারবদ্ধ হইলাম। ক্রমে সন্তান সন্ততি হইল। মস্তকের উপরে গুরুভার। প্রভো! কি উপায়ে এই গুরুভার বহন করিব, তাহা জানি না।

পদে পদে পারিবারিক অশান্তি উপস্থিত হওয়াতে আমার শরীর মন অস্থির করিয়া তুলিয়াছে। যে গৃহ দেবতা! তুমি আমাকে পারিবারিক শান্তি লাভের উপায় বলিয়া দাও। আমি যেন পরিবারস্থ সকলের অমরাত্মার প্রতি সম্মান প্রকাশ করিতে পারি। শান্তিদাতা পরমেশ্বর, আমার পরিবারে শান্তি দান কর, এই তোমার নিকটে প্রার্থনা।

সুস্থতায়

প্রাণস্বরূপ, জীবনের জীবন, পরমেশ্বর! তুমি কৃপা করিয়া আমার শধীর সবলও সুস্থ রাখিয়াছ, তজ্জন্য তোমাকে কৃতজ্ঞতার সহিত বারংবার প্রণাম করি। দয়াময়! এমন স্বাস্থ্য সম্ভোগ করিয়া যেন আলস্যে দিনপাত না করি। তোমার প্রদত্ত বিবিধ খাদ্যবস্তু, জল, বায়ু, সূর্য্য, চন্দ্র, নক্ষত্র, সমস্ত জগৎ আমার সেবা করিতেছে। প্রভো! আমি যেন কৃতঘ্ন হইয়া তোমাকে না ভুলি।

তোমার পুত্রকন্যাদিগের সেবায় আমার এই নশ্বর অসার দেহকে সর্ব্বদা নিযুক্ত রাখিতে পারি। তুমি যেমন আমাকে এক দণ্ডও ভোল না, আমিও যেন তোমাকে না ভুলি। দীনবন্দো! আমাকে তোমার দাসত্ব পদ প্রদান কর। তোমার কার্য্যেই যেন জন্ম শেষ হয়, এই মনোবাঞ্ছা পূর্ণ কর।

রোগে

দয়াময় প্রভো! রোগের তীব্র যন্ত্রণা অসহ্য হইতেছে। দীর্ঘকাল রোগীর সেবা করিয়া আত্মীয় বন্ধুগণ অতিশয় শ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছেন। ইহাতে আমার ক্লেশ হইতেছে। এই সময়ে তুমিই আমার একমাত্র সহায় ও আরাম স্থল। দোহাই প্রভু! এ সময়ে তোমার করুণায় যেন অবিশ্বাস না হয়, ঘোর কষ্টের সময় ‘দীনবন্ধু-দয়াল’ বলিয়া যেন দুটি বাহু তোমার দিকে প্রসারণ করিতে পারি।

প্রভো! তোমার নিয়ম লঙ্ঘন জনিত যে শান্তি তাহা যেন বিশ্বাসপূর্ণ মনে আনন্দের সহিত বহন করিতে পরি। “ঘোর বিপদেও বলব তোমায় দয়াময়”। দয়াল প্রভো! তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হউক। করুণাময়, তুমিই ধন্য, তুমিই ধন্য, তোমাকে অবনত মস্তকে প্রণাম করি।

শোকে

করুণাময় ঈশ্বর! মানব হৃদয়ে শোক দিয়া অপার কৃপা প্রকাশ করিয়াছ। এই শোকই ইহলোকবাসীর সহিত পরলোকবাসীর হৃদয়কে এক সূত্রে বাঁধিতেছে। মোক না থাকিলে পরলোকবাসী আত্মাকে ভুলিয়া যাইতাম। দেখো প্রভো! এই শোকের সীমা অতিক্রম করিয়া যেন মোহপাশে বন্ধ না হই।

শোকের তীব্রতা সময়ে হ্রাস হইয়া যায়, কিন্তু যথার্থ শোকচিরস্থায়ী ; এই শোকের প্রকৃত উদ্দেশ্য বুঝিয়া দৃঢ় করিয়া দিতেছ। ধন্য প্রভো! শোকের প্রকৃত উদ্দেশ্য বুঝিয়া যাহাতে পরলোকে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন পূর্ব্বক পরলোকগামী আত্মাদিগের সঙ্গে সম্বন্ধ স্থির ও পবিত্র রাখিতে পারি, এই প্রার্থনা করি।

মৃত্যুকাল

ভবকর্ণধার, দয়াময় দীনবন্ধো! প্রভো! আমার ভবের খেলা শেষ হইয়া আসিল। চক্ষু দৃষ্টিহীন হইয়া আসিতেছে, সম্মুখস্থ প্রিয়জনদিগকে আর দেখিতে পাইতেছি না। কর্ণ বধির হইল, তাহাদের ক্রন্দন ধ্বনি আর কর্ণে প্রবেশ করিতেছে না। হস্ত পদ অবসন্ন হইল। ইন্দ্রিয়গণ আর বিষয় ভোগে স্পৃহা করিতেছে না। পতিতপাবন! এখন আমি ইহলোক ত্যাগ করিতেছি। একাকী আসিয়াছিলাম, একাকী যাইতেছি।

হে ভবকর্ণধার! এখন এক বার মাভৈ: রবে সম্মুখে দাঁড়াও। আমি তোমায দেখিয়া ইহলোক হইতে অপসৃত হই। জয় জয় করুণাময় দীনবন্ধো। জয় জগদীশ, প্রাণারাম পতিতপাবন।

…………………………
ব্রাহ্মধর্ম্ম ও ব্রাহ্মসমাজ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

………
আরও পড়ুন-
ব্রাহ্মসমাজ
সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের সভ্য হইবার যোগ্যতা
ব্রাহ্ম ধর্মের মূল সত্য
ব্রহ্ম মন্দিরের ট্রাস্টডিড
ব্রাহ্মধর্ম্মের মূল সত্য
আত্মা
মানুষের ভ্রাতৃত্ব
উপাসনা ও প্রার্থনা
শাস্ত্র
গুরু
মধ্যবর্ত্তী ও প্রেরিত
সুখ-দু:খ : দু:খবাদ ও আনন্দবাদ
পাপ ও পুণ্য
পুনর্জ্জন্ম
পরকাল
স্বর্গ ও নরক
ধর্ম্ম রক্ষা
পরিবারে পুরুষ ও নারীর অধিকার-সাম্য
ব্রাহ্মসমাজের প্রতি ব্রাহ্মদিগের কর্ত্তব্য
সমবেত উপাসনা
পূর্ণাঙ্গ উপাসনার আদর্শ 
স্তুতি
বিবিধ অবস্থায় প্রার্থনা
নৈমিত্তিক অনুষ্ঠান
সন্তান জন্ম
ব্রাহ্মধর্ম্ম গ্রহণ ও ব্রাহ্মসমাজে প্রবেশ
ধর্ম্মসাধন ব্রতে দীক্ষা
ব্রাহ্মধর্ম্ম গ্রহণ ও ধর্ম্মদীক্ষা
বিবাহ ও তাহার আনুসঙ্গিক অনুষ্ঠান
বিবাহের বাগদান
বিবাহ
মৃত্যু ও অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া
শ্রাদ্ধ
গৃহ প্রবেশ
ব্রহ্ম ও ব্রহ্মের স্বরূপ
ব্রহ্ম ধ্যান
ব্রাহ্মধর্ম
সকলেই কি ব্রাহ্ম?
ব্রাহ্মোপসনা প্রচলন ও পদ্ধতি
আদি ব্রাহ্ম সমাজ ও “নব হিন্দু সম্প্রদায়”
পূর্ণাঙ্গ উপাসনার আদর্শ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!