ভবঘুরেকথা
ফকির লালন শাহ্

-ড হাসান রাজা

মানব সভ্যতার ইতিহাসে যে ক’জন মহামানব পৃথিবীর মানব জাতিকে সকল প্রকার জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র ও সংস্কারের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষকে শুধুমাত্র মানুষ হিসাবে বিশ্বদরবারে উপস্থাপন করেছেন তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম বাঙালি লোকসাধক মানবধর্মের পথ প্রদর্শক বাউল সম্রাট মহামতি লালন শাহ্। লালন শাহের মতো পৃথিবীতে আর একজন মহামানবকেও খুঁজে পাওয়া যায় না। যিনি তার নিজের বংশ পরিচয়কে অস্বীকার করে। নিজেকে শুধু একজন মানুষ হিসাবে পরিচয় দিয়ে মানবিক সত্যের মহিমান্বিত জয়গানে নিজেকে আলোকিত করেছেন।

যার জীবনাশ্রিত আত্মদর্শী মহামানবিক জীবনদর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে, বিস্মিত হয়ে বর্তমান বিশ্বের ধর্মনিরপেক্ষ, জ্ঞানী-গুণী মানুষজন এখন লালন শাহের অমৃতসন্ধানী জীবন দর্শনের মাঝে আশ্রয় খুঁজতে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ার পথে রওনা হচ্ছেন। লালন এখন শুধুমাত্র একজন বাঙালি বাউল সাধক লোক কবিই নন, তিনি এখন এদেশের সীমানা ছাড়িয়ে সারাবিশ্বের। মানবিক সত্যের অশেষ সৌন্দর্যের সৃজনশীল ফল্গুধারায় রচিত হয়েছে লালনের আলোকিত জীবনদর্শন।

লালন একজন মহামানবিক পুরুষোত্তম সত্তা। লালন একজন আত্মবিজ্ঞানী। আত্মমুক্তিকামী সর্বজনীন সাধক মানুষের মানসিক পূর্ণতার নাম লালন। লালন বাঙালির সর্বোত্তম আধ্যাত্মিক স্তর। সর্বজনীন মানব সমাজের ইতিহাসে যুগে যুগে যে সকল সমাজ সংস্কারক মহামানব জগতের বস্তুবাদী ভোগী, উচ্ছৃঙ্খল মানুষকে সাম্য, মৈত্রী, শান্তি, শৃ্খংলা আর আত্মমুক্তির পথ দেখিয়েছেন লালন শাহ্ তাঁদেরই একজন।

স্থান-কাল-পাত্রের ভেদাভেদকে ডিঙিয়ে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, সম্প্রদায়ের উর্ধ্বে উঠে পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে অসাম্প্রদায়িক মানবতাবোধের সর্বোচ্চ চেতনায় আহ্বান জানিয়েছেন লালন। তিনি আত্মনিয়ন্ত্রিত স্বয়ংসম্পূর্ণ সত্যিকার মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে আজীবন সাধনা-গবেষণা ও সংগ্রাম করেছেন।

প্রচলিত বিভিন্ন ধর্মীয় গোড়ামী আর সাম্প্রদায়িক অপব্যাখ্যা থেকে বিশ্বের সকল মানুষকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন গুরুমুখী এক অখণ্ড সত্য সুন্দর, চরম ও পরম ব্যক্তি নিরপেক্ষ সাধনা আত্মদর্শনের পথে। জীবনজুড়ে সাধনা-গবেষণা ও প্রচারণায় প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন মানবিক শুদ্ধতার ধর্ম, সর্বজনীন মানবধর্মকে। গেয়েছেন মানবতার জয়গান।

হাজার বছরের বাঙালি জীবনে লালন সর্বজনীন এক বিশ্ব আত্মা। যাঁর সাধনাশ্রিত জীবনের পরমধন অর্জিত জ্ঞানের সবটুকু জুড়ে তাই ঘোষিত হয়েছে সর্বজনীন মানবাত্মার মুক্তির জয়গাঁথা। সকল কালের সকল ধর্ম দর্শনের মৌলিকত্ব মন্থন কোরে তিনি উজ্জীবীত হয়েছেন মানবিক বোধ আর অসাম্প্রদায়িক চেতনায়।

তথাকথিত প্রচলিত ধর্মদর্শন আর সাম্প্রদায়িকতার বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে চির উন্নত শিরে দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন-

এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে
যেদিন হিন্দু-মুসলমান- বৌদ্ধ-খ্রিস্টান
জাতি-গোত্র নাহি রবে।।

আত্মদর্শনে সিদ্ধ হয়ে জগতে প্রচলিত অতীতের সকল জীবনাচারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন কোরে গেয়ে উঠেছেন প্রজ্ঞাময় ব্যক্তি নিরপেক্ষ আত্মদর্শী বাণী-

আপন ঘরের খবর নে না
একবার আপনাকে চিনতে পারলে
যাবে অচেনারে চেনা।।

মূলত লালন না হয়ে পুঁথিগত বিদ্যা দিয়ে লালনকে বোঝা বা বোঝানো কারো সাধ্য নয়। শুধু লালনই নয়, নজরুল, খৈয়াম, মওলানা রুমিসহ কোনো কালেই সত্যপ্রাপ্ত অল্পসংখ্যক মানুষ ছাড়া কোনো মহাপুরুষকেই জগতের বস্তুবাদী কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভোগী মানুষ সর্বোতভাবে গ্রহণ করে নি।

স্বার্থান্বেষী ধর্মীয় মৌলবাদীদের স্বার্থে আঘাত লাগার ফলে তারা কাউকে শুলে চড়িয়ে, কাউকে জবাই করে, কাউকে ফতোয়া দিয়ে হত্যা করেছে। তবুও সব শেষ হয়ে যায় নি। যে সব ধর্ম ব্যাবসায়ীরা জাতের ধোঁয়া তুলে, ধর্মের নামে ভণ্ডামী করে সেই সব মহাপুরুষের পথ রোধ করেছিলো এবং আজও করছে তারা মহাকালের আবর্তে ধূলায় মিশে গছে এবং অনাগত কালেও সেই সব শয়তানের প্রেতাত্মারা বিলীন হয়ে যাবে সন্দেহাতীত ভাবেই।

অন্যদিকে পৃথিবীতে আজও টিকে আছে সেইসব কালজয়ী মহামানবের দর্শন, জ্ঞান আর প্রজ্ঞাময় মানবাত্মার মুক্তির সর্বজনীন জীবনদর্শন। যুগে যুগে তাঁদের প্রচারিত সেইসব মহাজ্ঞান কখনও কথপকোথনাকারে, কখনও গল্পাকারে কখনও পদ্যকারে লিপিবদ্ধ হয়েছে মানব সভ্যতার সর্বজনীন পাঠশালায়। এই প্রকৃতিগত সৃজনশীল ধারাবাহিকতায় লালন তাঁর আত্মর্জিত জ্ঞান যা গান আকারে শিষ্যদের মাঝে প্রচার করেছিলেন।

কালের প্রয়োজনে শিষ্য পরম্পরায় আবার কখনও বা লালন গবেষকগণ সেইসব গান কিছু সংগ্রহ ও ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করেছন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সর্বপ্রথম লালনের গান ছাপার অক্ষরে প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এই ধারা আজো অব্যাহত।

লালন শুধুমাত্র কোনো ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বই নয় বরং আমাদের কাছে লালন চিরন্তন, চিরশাশ্বত। এমনকি মানব সমাজে প্রচলিত ধর্মীয় গ্রন্থ বেদ, গীতা, ত্রিপিটক ও বাইবেলের মতো তাঁর বাণীও আত্মদর্শী সাধকের কাছে চিরন্তন ও চিরশাশ্বত। এই কথা স্বীকার করে নিয়েই তাঁর গানে তাঁকে সত্যিকারের আবিষ্কার ও মূল্যায়নের সম্যক চেষ্টা করা যেতে পারে।

সকল কালে মহাপুরুষগণ মানবাত্মার মুক্তির জন্য যে সুরে গান গেয়েছেন লালনও ঠিক একইভাবে প্রকৃতির হাতের বীণা হযে বেজেছেন, বেঁধেছন একই সুরে তার সব গান। এই সুর হচ্ছে ধর্ম নিরপেক্ষ, ব্যক্তি নিরপেক্ষ আত্মদর্শনের সুর।

বলার অপেক্ষা রাখেনা আরবি ভাষায় বিশ্বগুরু হযরত মুহাম্মদ (স) এবং তাঁর স্থলাভিষিক্ত মওলা আলী (আ) সর্বজনীন মানবাত্মার মুক্তির জন্য যে মহাসত্যের গুণকীর্তণ করেছেন, বাংলা ভাষায় লালন শাহ্ও সেই একই পরম সত্য সুন্দরের গুণকীর্তণ করেছেন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স) পনের বছর যে গুহায় ধ্যান করেছেন তার নাম হেরাগুহা।

হযরতের হেরা গুহার সেই ধ্যানই হচ্ছে তাঁর প্রকৃত অনুসারীদের জন্য প্রথম সুন্নাত। ধ্যান ছাড়া প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করা যায় না এবং সুন্দরভাবে তার পরিবেশন পদ্ধতিও ধ্যান থেকেই লাভ করতে হয়। যদিও তথাকথিত উমাইয়া-আব্বাসীয় এজিদ পন্থি ইসলামে এই ধ্যানের কোনও সন্ধান আজ আর পাওয়া যায় না। পৃথিবীর সকল মহামানবই তাঁর অনুরক্ত শিষ্যদের আত্মমুক্তির জন্য নিজ দেহের মাঝে এই ধ্যানস্থ হওয়ার বিষয়টি আবশ্যক হিসাবে শিক্ষা দিয়েছেন।

তাই আত্মদর্শনের জন্য হযরত মুহাম্মদ (স) ‘হেরাগুহা’ বা ‘হেরাবন’, কৃষ্ণ ‘বৃন্দাবন’ এবং বুদ্ধ তাঁর সাধনক্ষেত্র হিসাবে ‘জেদবন’কে বেছে নিয়েছেন। এই ‘বৃন্দাবন’, ‘জেদবন’ বা ‘হেরাবন’-এর আধ্যাত্মিক প্রতীক হচ্ছে ‘মানব দেহ’। সকল কালের সকল মহাপুরুষের মতে এই দেহের মাঝে ধ্যানস্থ হওয়া, এর মধ্যে জ্ঞানময় ভ্রমণ, বিচরণ পর্যবেক্ষণ তথা অনুদর্শনের মাধ্যমেই একমাত্র সর্বাত্মক চরম ও পরম সত্য, আত্মমুক্তির সর্বজনীন জ্ঞান আত্মদর্শন অর্জন করা যায়।

এই প্রসঙ্গে জগৎ গুরু মাওলা মুহাম্মদ (স) বলেছেন- ‘মান আরাফা নাফসাহু ওয়া ফাক্বদ আরাফা রব্বাহু।’ অর্থাৎ- যে নিজেকে জানলো বা চিনলো, সে তার আপন প্রভুকে জানলো বা চিনলো। এই একই দর্শন ৪৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিসে জন্ম নেয়া গ্রিক দার্শনিক মহামতি সক্রেটিসের কণ্ঠেও ধ্বণিত হয়েছে। যেমন-‘ Know Thyself’ বা নিজেকে জানো। উপনিষদে এই বিষয়কে বলা হয়েছে ‘আত্মানং বিদ্ধি’। একইভাবে মহামতি লালন শাহ্ও গেয়েছেন-

ও যার আপন খবর আপনার হয় না।
একবার আপনাকে চিনতে পারলে রে
যাবে অচেনারে চেনা।।

আবার :

আপন ঘরের খবর নে না।
অনায়াসে দেখতে পাবি
কোন খানে শাঁইর বারাম খানা।।

সুতরাং তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ শুধু লোক কবি হিসাবে লালনকে চিহিৃত করলেও তার সৃষ্ট আত্মদর্শী সঙ্গীতে যে কালজয়ী সুর বাজে তাতে সত্যানুসন্ধানী সাধকের বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয় যে লালন কত বড় মহামানব, ধর্ম সংস্কারক, মানবধর্ম প্রণেতা ও কালজয়ী পুরুষোত্তম।

লালন শাহ্’র সমগ্র জীবনজুড়ে যে দর্শন আমরা দেখতে পাই তা হচ্ছে গুরুমুখী লোকোত্তর দর্শন। সকল প্রকার লোক, স্তর, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, স্থান, কাল, পাত্র সব ধরণের কু-সংস্কার ও গোড়ামীর উর্ধ্বে বিরাজমান সর্বজনীন চিরশাশ্বত যে মানবিক দর্শন মহাকালের আবর্তে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে স্বমহিমায় ভাস্বর ও প্রকৃতিগতভাবে গতিশীল রয়েছে তাকেই বলে লোকোত্তর দর্শন।

বিশ্বমানবাত্মার মুক্তির জন্য বর্তমানে মানব সমাজে প্রচলিত সকল প্রকার ধর্মের মূল সারবস্তু হচ্ছে এই লোকোত্তর দর্শন। লালন শাহ্ আশ্রিত এই লোকোত্তর জীবন দর্শনের মূল ভিত্তি হচ্ছে প্রকৃতির বিকাশ বিজ্ঞান সর্বজনীন কোরান।

আত্মজয়ী প্রকৃতির বিকাশ বিজ্ঞান নির্ভর পবিত্র আল্ কোরানের মরমীবাদী জীবন দর্শন তাঁর মধ্যে প্রকৃতির চির শাশ্বতরূপে মূতির্মান হয়ে না উঠলে আমরা বাংলা ভাষায় সর্বজনীন সাধক মানুষের মুক্তির রূপরেখা লালন দর্শনের সন্ধান পেতাম না। লালন শাহ্’র গভীর প্রজ্ঞাময় বিবাগীমনের উত্তাল তরঙ্গশীর্ষ রবীন্দ্রমনে প্রতিফলিত হয়ে বাংলা সাহিত্যের সুললিত ফল্গুধারায় ব্যাপকভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে যা বাংলাভাষার বিরাট সম্পদ।

আসলে ক্ষণস্থায়ী এই চলমান বিশ্বে কেনো কিছুই স্থির থাকে না, শুধুমাত্র বিশুদ্ধ মানবমনের অনুরণিত মৌলিক গতিধারায় বিচ্ছুরিত হয়ে কালজয়ী হয়ে উঠতে পারে। লালন শাহ্ এরকম একটি কালজয়ী মহান সুরের মূল উৎসধারা।

‘লালন’ শব্দের বাংলা আভিধানিক অর্থ হচ্ছে-অত্যন্ত যত্ন সহকারে পালন, প্রতিপালন, ভরণপোষন। আরবিতে ‘লালন’ শব্দটির অর্থ দাঁড়ায় সকল প্রকার বিষয় মোহের উর্ধ্বে থেকে অণু বা বিন্দুর জ্ঞানের সাথে জ্ঞানময় থেকে যিনি সর্বজনীন নবীজ্ঞান ধারণ করেন। আবার বিষয় মোহের উর্ধ্বে থেকে মনের মহাশূন্য ‘লা’ অবস্থাকে যিনি ‘লন’ বা গ্রহণ করেন বা প্রাপ্ত হন তিনিই লালন। লালন একটি সাধনার স্তর। সাধকের মানসিক পূর্ণতার নাম লালন।

এছাড়া আমরা স্বভাবতই লালন শাহ্ কে বলে থাকি ‘বাউল’ সম্রাট লালন ফকির। লালন অবশ্য তার গানের বাণীতে নিজেকে ফকির হিসাবেই উল্লেখ করেছেন। যেমন-

লালন ফকির আসলে মিথ্যে
ঘুরে বেড়াই তীর্থে তীর্থে,
সই হল না এক মন দিতে
আসলেতে পলো কম।।

বলার অপেক্ষা রাখে না লালন শাহ্’র নামের সঙ্গে যুক্ত ‘বাউল’ ও ‘ফকির’ এই শব্দ দুইটি যা বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে লালন শাহ্ আশ্রিত লোকোত্তর দর্শনের মূল সুর, লালন শাহ্’র সঠিক সম্যক পরিচয় এবং বিশ্বমানবাত্মার মুক্তির সর্বজনীন সাধন প্রণালীর তত্ত্বগত প্রয়োগধর্মী দিক নির্দেশনা।

‘বাউল’ আরবি শব্দ। আরবি বর্ণমালার তিরিশটি অক্ষর থেকে ‘বা’, ‘আইন’ ও ‘লাম’ এই তিনটি অক্ষর দিয়ে ‘বাাউল’ শব্দটি গঠিত। ‘বা’ বর্ণের অর্থ হচ্ছে সহিত (With), ‘আইন’ বর্ণের অর্থ সূক্ষ্ম জ্ঞানময় অবস্থা এবং ‘লা’ বর্ণের অর্থ ‘না’ বা নফিকরা (Negation)। আবার ‘আইন’ ও ‘লাম’ দ্বারা গঠিত হয় ‘আলী’ বা ‘আলা’। যার অর্থ : সমুচ্চ, ভাসমান, সাঁতারু বা উর্ধ্বে অবস্থানকারী।

সব মিলে বলা যায় মনের (Absolute No) বা অংশীদ্বারিত্বহীন অবস্থা। মূলত সকল প্রকার মূর্ত-বিমূর্ত, বস্তুগত-অবস্তুগত, কামনা-বাসনা, মোহের উর্ধ্বে, পরম শূন্যে স্থিত অবস্থাকে অবলম্বন করে সেই অবস্থার উপর সূক্ষ্মতায় যিঁনি তার আপন অস্তিত্বকে স্থির বা প্রতিষ্ঠিত করেন তাঁর নাম ‘বাউল’। ইংরেজিতে যাকে বলা যায় With the High বা উর্ধ্বে অবস্থানকারী।

এই উর্ধ্বে অবস্থান করা বিষয়টি একটি মানসিক অবস্থা। একজন প্রকৃত বাউল সাধক যিনি সকল প্রকার বিষয়-আশয়, সংস্কাররাশি, তথা মানবদেহে তার সপ্ত ইন্দ্রিয় চোখ, কান, নাক, মুখ, জিহ্বা, স্নায়ু ও ত্বক ইত্যাদি পথে আগত পথে দৃশ্য, শব্দ, গন্ধ, স্বাদ, কথা, চিন্তা ও অনুভূতিরূপে সকল প্রকার মোহযুক্ত ধর্মরাশি, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, ভক্তি-অভক্তি, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, আশা-ভয়, কামনা-বাসনা, ধ্যান-ধারণা, জরা-ব্যাধি, জন্ম-মৃত্যু, সুথ-দুঃখ, হাসি-কান্না, জ্বালা-যন্ত্রণা, ক্ষুধা-তৃষ্ণা, নিশ্বাস-প্রশ্বাস এক কথায় দেহমনের সঙ্গে জড়িত যাবতীয় মূর্ত ও বিমূর্ত সংস্কাররাশির উপর মোহহীনভাবে মানসিক শূন্যতায় লৌকিক চেতনার উর্ধ্বে অবস্থান করেন।

তাই কোরানিক এই বাউল শব্দের আরেক অর্থ দাঁড়ায় ‘আলোর সাথে’ বা লা মোকামে বসবাসকারী মোহশূন্য কামেল সাধক যিনি সর্বদায় বিষয়বস্তুর উর্ধ্বে মানসিকভাবে অবস্থান করেন। লালন শাহ্ তাঁর সর্বজনীন এই লোকোত্তর দর্শনকে, পরম আধ্যাত্মিকতাকে আত্মদর্শী সঙ্গীত হিসেবে বিভিন্ন রূপক ভণিতার মাধ্যমে জগৎবাসীর কাছে বহুবিধ আঙ্গিকে উপস্থাপন করে গেছেন। যেমন-

আমরা বাউল চারণ
মানি না শাসন বারণ
আমরা হই পাখির জাত
হাইটা চলার ভাও মানি না
উইড়া চলার ধ্যাৎ।।

আবার :

মওলা বলে ডাক রসনা
গেল দিন ছাড় বিষয় বাসনা।।

অন্যত্র :

আমি নামব জলে সাঁতার খেলিব গো
অঙ্গে নাহি লাগাইব জল।।

এখানে ‘উইড়া চলার ধ্যাৎ’, ‘বিষয় বাসনা’ ত্যাগ এবং জলে নেমে ‘সাঁতার খেলা’ জাতীয় কথাগুলো বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। এসব ক্ষেত্রে ওড়া, বিষয়-বাসনা ও সাঁতার খেলার দ্বারা সমস্ত বিষয়, সমস্ত বন্ধন, কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য্যু নামক ষড়রিপুসহ ইত্যাদির উপর ভাসমান বা বিজয়ী থাকার কথা বোঝানো হয়েছে।

যিনি বিষয়-আশয় বা মস্তিষ্কে আগত ধর্মরাশিসমূহের উপর জ্ঞানময় থেকে সকল কিছুর উর্ধ্বে তার অবস্থানকে সু-সংহত করেন তিঁনিই ‘বাউল’, মুক্তপুরুষ তথা মুক্তির দেশের মানুষ। অন্য সবাই মোহগ্রস্থ বা বন্দিদশায় বন্দি।

জগতের এই বন্দিদশা থেকে যিনি গুরু নির্দেশিত পথে সাধনা বলে মুক্ত হয়েছেন, আপন অস্তিত্ব মাঝের বিভিন্ন-সংস্কারে আচ্ছন্ন ‘রব’ রূপী পরম পুরুষকে জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন তাঁরই অপর নাম ‘ফকির’। মুক্তপুরুষ লালন শাহ্ তার গানে নিজেকে ফকির বোলেই আখ্যায়িত করেছেন। যেমন-

লালন শাহ্ ফকিরে বলে
আলের খবর কেউ না জানে,
যে জানে সে বলবে কেনে
রয়েছে সে গোপনে।।

আবার :

ইসলাম কায়েম হয় যদি শরায়।
কি জন্যে নবিজী রহে
পনের বছর হেরা গুহায়। ।


‘কায়েমুদ্দীন’ হবে কিসে
অহর্নিশি ভাবছি বসে
দায়েমি সালাতের দিশে
লালন ফকির জানায়।

‘ফকির’ আরবি শব্দ। আরবিতে ‘ফকির’ শব্দটি লিখতে তিনটি আরবি বর্ণ ব্যবহৃত হয়। বর্ণ তিনটি হচ্ছে ‘ফা’, ‘ক্বফ’ ও ‘রা’। সাধু গুরুদের মতে এই তিনটি বর্ণ আবার বিশেষ তিনটি অর্থ বহন করে। ‘ফা’ অক্ষর দ্বারা বুঝায় মধ্যে। ‘ক্বফ’ অক্ষর দ্বারা বুঝায় দুনিয়া নিয়ন্ত্রণকারী খোদায়ী শক্তি। কোরানে উল্লিখিত আল্লাহর ছয়টি গুণবাচক নামের সমষ্টি হচ্ছে ‘ক্বফ’ শক্তি। এই ছয়টি নাম হচ্ছে- এক ক্বাইউমুন, দুই কুদ্দুসুন, তিন ক্বাবিউন, চার ক্বাদিরুন, পাঁচ ক্বাবিদুন এবং ছয় কাহ্হারুন।

হাকিকতের ক্বাইউমিয়াতকে সৃষ্টির মধ্যে স্থায়ীত্ব দান করার জন্যই এই ‘ক্বফ’ শক্তি। কোরানে উল্লিখিত এই মহা শক্তিধর নাম গুলোর অর্থ হচ্ছে :

এক ক্বাইউমুন : চির স্থায়িত্বের শক্তি। কাইউমু : স্থায়িত্ব নির্ধারিত করা হলো।
দুই কুদ্দুসুন : দুর্বল এবং অধঃপতিতকে উন্নত মর্যাদা দানকারী শক্তি।
তিন ক্বাবিউন : চিরঞ্জীব শক্তির উৎস। ক্বাবিউ : সৃষ্টি শক্তিশালী হয়ে উঠল।
চার ক্বাদিরুন : সুপরিমিতি দানকারী শক্তি। তক্বদির দাতা শক্তি। ক্বাদিরু : শক্তিশালী, সৃষ্টিকে শক্তি দেয়া হলো।
পাঁচ ক্বাবিদুন : নিয়ন্ত্রক। সৃষ্টকে নিয়ন্ত্রণ করা হলো।
ছয় ক্বাহ্হারুন : অপপ্রতিহত ক্ষমতা। মৃত্যুদানকারী শক্তি। ক্বাহ্হারু : ধ্বংসকারী।

মূূলত কোরানে পরম প্রকৃতি আল্লাহ্র উক্ত ছয়টি গুণ অর্জন কারীকেই ‘ক্বফ’ শক্তির প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘রা’ অর্থ রাজি থাকা। সুতরাং যিনি সকল সময় সকল অবস্থায় পরম পুরুষ আল্লাহ্র চরম শক্তিধর ‘ক্বফ’ শক্তির মধ্যে রাজি থাকেন, আপন অস্তিত্বের মধ্যে রবরূপী গুরুর নির্দেশিত পথে পরম সত্তার জাগরণের কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন এবং দুনিয়ার কোনও মোহ্ বা বস্তুগত চাওয়া-পাওয়া যাকে বিচলিত করতে পারে না তিনিই ফকির।

গবেষণায় দেখা যায় লালন শাহ্ তাঁর রচিত সকল সঙ্গীতে নিজেকে ‘ফকির’ বলেই উল্লেখ করেছেন। এবং ছহি হাদিসে হযরত মুহাম্মদ (স) ঘোষণা করেছেন : ‘ফকিরী আমার পেশা’ (Asceticism is my profession)। আরবিতে এর সহায়ক আর একটি শব্দ হচ্ছে ‘সণ্যাস’ বা ‘রোহবানিয়াত’।

জীবনযুদ্ধে তথা সংসার জীবনে মানুষ যেমন কোনো না কোনো পেশা অবলম্বন কোরে বেঁচে থাকে তেমনি আত্মমুক্তির সাধন পথে ‘ফকিরী’ বা সণ্যাসভাব সিদ্ধপুরুষের একটি পেশা। বস্তুগত জগতে থেকেও বস্তুমোহ ত্যাগের এই পেশা অবলম্বন ব্যতীত বিষয়বস্তুর মোহ থেকে মুক্ত হওয়া যায় না। পেশা থেকে জগৎবাসী যেমন জীবীকা অর্জন করে থাকে তদ্রূপ সাধনার জীবনে সাধকেরও জীবীকা অর্জিত হয় ‘ফকিরী’ থেকে।

জীবিকা সাধারণত দুই প্রকার। এক বস্তুগত জীবিকা, দুই আধ্যাত্মিক জীবিকা। বস্তুগত রিজিক থেকে মুখ ফিরিয়ে সরাসরি আধ্যাত্মিক রিজিক লাভের জন্য গুরুর নির্দেশিত পথে সাধনার কোনো বিকল্প নাই। সুতরাং লালন শাহ্’র নামাশ্রিত বিশেষণ দুইটির বিশ্লেষণ থেকে আমরা লালন শাহ্’র আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ ও প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে সামান্য ধারণা অন্তত পেতে পারি। যদিও লালন না হয়ে প্রকৃত লালনকে উপলব্ধিতে আনা সম্ভব নয়।

হাজার হাজার বছরের ঐতিহাসিক আবহমান বাঙালির আধ্যাত্মিক জীবনের সর্বোচ্চ স্তর মহামতি লালন। তিনি পুরুষোত্তম, বিশ্ব বাঙালি। এ দেশের মাটি, মানুষ, আকাশ-বাতাস, ফুল-ফল, পশু-পাখি, সমুদ্র-পর্বত, নদ-নদী, চির সবুজ প্রকৃতি হৃদয়ের শাশ্বত বৈভব দিয়ে সৃজন করেছে লালনকে। লালন বাঙালির সর্বজনীন আত্মদর্শন। মানব জীবনের আধ্যাত্মিক পূর্ণতার নাম লালন। চির সুন্দর পরম প্রকৃতির হাতের ঐশি বীণা হয়ে লালন আমাদের শিখিয়েছেন গুরুময় মানব প্রেম, ভক্তি-আরাধনা, আত্মশুদ্ধি-প্রজ্ঞা ও সর্বজনীন আত্মদর্শন।

সমগ্র বিশ্বের মানবসমাজ একটি পরিবার। মানুষের মাঝেই পরম সত্যের বাস। আত্মদর্শী সাধনার মাধ্যমে এই সত্যে প্রতিষ্ঠিত থেকে সহজ সুন্দর সোনার মানুষের জয়গানে আজীবন বিভোর থেকেছেন লালন শাহ্। আবহমান বাঙালির অসাম্প্রদায়িক হৃদয় থেকে উঠে আসা অমৃত সন্ধানী এই বাউল সাধক জাতি-ধর্ম, বর্ণ-গোত্রের উর্ধ্বে উঠে একমাত্র মানুষকেই সর্বোচ্চ আসন দান করেছেন। মানুষের মধ্যে থেকে আত্মশুদ্ধ কামেল মানুষকে মানুষের দীক্ষাদাতা গুরু হিসেবে নিষ্ঠার সাথে অনুসরণ করার আহ্বান জানিয়ে গেয়ে উঠেছেন-

মানুষগুরু নিষ্ঠা যার
সকল সাধন সিদ্ধ হয় তার।।

আবার :

যেখানে যায় মানুষ দেখি
মানুষ দেখে জুড়াই আখি।।

সাধক জীবনের সবচেয়ে মৌলিক কর্ম হচ্ছে ‘আত্মদর্শন’। ‘আত্মদর্শন’ মানে গুরুময় সাধনার দ্বারা নিজের অস্তিত্বকে খুঁটে খুঁটে দেখার মাধ্যমে স্রষ্টার সৃষ্টিরহস্য অবগত হওয়া। বিশ্ব সভ্যতার আদি শিক্ষক গ্রীসের মানবগুরু মহামতি সক্রেটিসের Know Thyself, বিশ্বনবি হযরত মুহাম্মদ (স)-এর ‘মান আরাফা নাফসাহু ওয়া ফাক্বদ আরাফা রব্বাহু’ ও উপনিষদের ‘আত্মানং বিদ্ধি’র মতো নিজেকে জানার মাধ্যমে সকল অজানাকে জানার সর্বজনীন ব্যক্তি নিরপেক্ষ আহ্বানের সুরে সুর মিলিয়ে লালন শাহ্ও আপন মানবদেহকে সকল সাধনার মূল কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করেছেন-

আপনার আপন খবর আপনার হয় না
একবার আপনাকে চিনতে পারলে রে
যাবে অচেনারে চিনা।।

আত্মদর্শী সাধকদের কাছে স্রষ্টা ও সৃষ্টি মূলত একই সত্তা। মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ট জীব তথা আশরাফুল মাখলুকাত। ধর্মীয় গ্রন্থে সৃষ্টিকর্তা ঘোষণা করেছেন : খলাকাল ইনসানা আনা সুরাতিহী, অর্থাৎ, আমি আমার মতো করে মানুষ সৃষ্টি করেছি। এই মানুষ তাই ক্ষণস্থায়ী জীবনের বাইরে স্রষ্টার অন্বেষণ করে থাকে। আত্মশুদ্ধিই সাধক জীবনের সবচেয়ে বড় ধর্ম ও কর্ম। আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে জীবাত্মাকে শুদ্ধকরে পরমাত্মা তথা স্রষ্টার সাথে মিলিত হওয়ার আকাক্সক্ষায় বিশ্বের সকল সাধকের প্রতিনিধিত্ব করে লালন শাহ্ প্রার্থনা করেছেন-

আমি অপার হয়ে বসে আছি ওহে দয়াময়
পারে লয়ে যাও আমায়।।

সাধকগণ আলোর মতো। বিশ্বের কোনো সাধকই নির্দিষ্ট কোনো জাতি, ধর্ম বা গোত্রের জন্য আসেন না। তবু তাদের অন্ধ অনুসারীরা তাদেরকে কুক্ষিগত কোরে সাম্প্রদায়িক গণ্ডির মধ্যে বেঁধে ফেলে। তৈরি হয় সংহাত। কিন্তু গর্ব করে বলার মতো বিষয় হচ্ছে বাংলার একমাত্র সর্বজনীন লোক সাধক ফকির লালন শাহ্। তিনি ব্যতীত বিশ্বের কোনো সাধক বা মহাপুরুষই তাঁর জন্ম এবং বংশ পরিচয়কে অবজ্ঞা করতে পারেন নি।

নিজেকে একজন মানুষ পরিচয় দিয়ে লালন শাহ্ সকল প্রকার জাত-পাত বংশ মর্যাদার উর্ধ্বে উঠে শুধুমাত্র আত্মজ্ঞান, মানব প্রেম ও প্রজ্ঞাকে ভিত্তি করে সকল সম্প্রদায়ের মিথ্যা জাত্যাভিমান, অন্ধত্ব, কু-সংস্কার ও ধর্মীয় গোড়ামীকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাতে সক্ষম হয়েছেন। অশেষ নান্দনিক বৈভবে সৃজিত এই বিশ্বটাকে যারা ধর্মের নামে ভ-ামী করে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পে ভরিয়ে তুলতে চায় তাদের কটাক্ষ কোরে গেয়ে উঠেছন-

জাত গেলো জাত গেলো বলে
এ কি আজব কারখানা,
সত্য কাজে কেউ নয় রাজি
সবই দেখি তা না না না।।


ব্রাহ্মণ চণ্ডাল যবন মুচি
এক জলে সব হয়গো সুচি,
দেখে শুনে হয় না রুচি
যমে তো কাউকে ছাড়বে না।।

বাঙালি কবি সাধকগণ সব সময় অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্ব মানুষকে আহ্বান জানিয়েছেন মানবিক জয়গানে। ঘোষণা করেছেন-

গাহি সাম্যের গান।
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই
নহে কিছু মহিয়ান।।

পৃথিবীতে আগত সকল কালের সকল নবী-রাসুল, পীর-পয়গম্বর, গাউস-কুতুব, অলি-আল্লাহ্ সবাই মানুষ ছিলেন। সাধকদের দৃষ্টিতে তাই স্বয়ং স্রষ্টা নিজেই মানুষরূপে এই জগৎ সংসারের অধ:পতিত মানুষকে গুরু রূপে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় মুক্তির দীক্ষাদান করে চলেছেন। মহামতি লালন শাহ্ও তার আত্মদর্শী গবেষণার মাধ্যমে অদেখা কোনো কাল্পনিক ঈশ্বর নয়, শুধুমাত্র আলোকিত মানুষকে ভালোবেসে তার সেবা করে নিজে একজন কামেল মানুষ, সোনার মানুষ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশ্ব বাসীকে। বলেছেন-

মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।
মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি।।

বর্তমান বিশ্বে ধর্মের নামে মানুষ হত্যার য়ে নৃশংসতা ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়ছে তা সত্যিই ভয়ঙ্কর। সত্যকে অবজ্ঞা কোরে সাম্য, মৈত্রী আর মানুষে মানুষে ভালোবাসার সহজাত সম্প্রীতি ভুলে, মানবিক মূল্যবোধ হারিয়ে মানুষ আজ পশুত্বের, শয়তানের পূজারী। একজন বাঙালি হয়ে এই আত্মঘাতি অপসংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসার একমাত্র আশ্রয় লালন শাহ্।

ধর্মের নামে ভণ্ডামী আর কু-সংস্কারের নাগপাশ থেকে বেরিয়ে এসে মানবিক প্রেমময় সহজ সত্যে সমাসীন হয়ে লালনইতো সাত আসমানের উপরে বসা অদৃশ্য বিমূর্ত চির দু:খী ঈশ্বরকে মানব প্রেম ও দ্রোহ মিশিয়ে আবিষ্কার করেছেন মানব দেহে।

আমাদের কোটি কোটি বছরের মানব সভ্যতার পবিত্র আকাঙ্ক্ষা মানুষকে সর্বোচ্চ আসনে সম্মানিত করা। লালন এই শুদ্ধ সমাধির সফল লোক নায়ক। তিনি তাঁর আত্মদর্শী মহিমান্বিত প্রজ্ঞায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে আমাদের জন্য রেখে গেছেন বিশ্ব মানুষের আত্ম মুক্তির সর্বজনীন অমিয় বাণী, যা বিশ্বসভায় আমাদের বাঙালিদের বিশ্বমানবিক ঐতিহ্যের সুমহান আত্মপরিচয়।

আমরা বাঙালিরা হাজার হাজার বছর ধরে যে অসাম্প্রদায়িক মহামানবিক জীবন দর্শন লালন করি তার আলো আজ লালনের হাত ধরে ছাড়া বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ুক। সবার মাঝে জেগে উঠুক মানব প্রেম। বিশ্বজুড়ে মানবিক বোধের এই ক্রান্তিলগ্নে আমরা তাই বিশ্ব বাসীকে আমন্ত্রণ জানাতে চাই আসুন বাঙালির বিশ্ব মানব লালনের সুরে সুর মিলিয়ে আমরা সবাই গেয়ে উঠি-

মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।
মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি।।

……………………………
ড. হাসান রাজা
লেখক ও গবেষক
রাজশাহী

…………………………………..
চিত্র:
ফকির লালন সাঁইজির প্রকৃত কোনো ছবি নেই। লেখাতে ব্যবহৃত ছবিটি লালন ফকিরের কাল্পনিক একটি ছবি মাত্র। বহুল ব্যবহৃত হলেও এই ছবির সাথে লালন সাঁইজির আদৌ কোনো যোগসূত্র খুজে পাওয়া যায় না।

………………………..
আরো পড়ুন:
মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজি: এক
মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজি: দুই
মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজি: তিন

লালন ফকিরের নববিধান: এক
লালন ফকিরের নববিধান: দুই
লালন ফকিরের নববিধান: তিন

লালন সাঁইজির খোঁজে: এক
লালন সাঁইজির খোঁজে: দুই

লালন সাধনায় গুরু : এক
লালন সাধনায় গুরু : দুই
লালন সাধনায় গুরু : তিন

লালন-গীতির দর্শন ও আধ্যাত্মিকতা: এক
লালন-গীতির দর্শন ও আধ্যাত্মিকতা: দুই

ফকির লালন সাঁই
ফকির লালনের ফকিরি
ফকির লালন সাঁইজি
চাতক বাঁচে কেমনে
কে বলে রে আমি আমি
বিশ্ববাঙালি লালন শাহ্ফকির লালন সাঁইজির শ্রীরূপ
গুরুপূর্ণিমা ও ফকির লালন
বিকৃত হচ্ছে লালনের বাণী?
লালন ফকিরের আজব কারখানা
মহাত্মা লালন সাঁইজির দোলপূর্ণিমা
লালন ফকির ও একটি আক্ষেপের আখ্যান
লালন আখড়ায় মেলা নয় হোক সাধুসঙ্গ
লালন অক্ষ কিংবা দ্রাঘিমা বিচ্ছিন্ন এক নক্ষত্র!
লালনের গান কেন শুনতে হবে? কেন শোনাতে হবে?
লালন গানের ‘বাজার বেড়েছে গুরুবাদ গুরুত্ব পায়নি’
‘গুরু দোহাই তোমার মনকে আমার লওগো সুপথে’
মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজির স্মরণে বিশ্ব লালন দিবস

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!