ভবঘুরেকথা
প্রজাপিতা ব্রহ্মা

পরমাত্মা যে সময়ে এই দিব্য কর্তব্যের কার্য করেন সেই সময়কে সঙ্গম যুগ বলা হয়। কারণ ঐ সময় কলিযুগের শেষ ও সঙ্গম যুগের আরম্ভের মিলন হয়। আজ মনুষ্যমাত্রই সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি এই চার যুগ সম্বন্ধে অবহিত। কিন্তু সর্বাপেক্ষা অধিক মহত্বপূর্ণ কল্যাণকারী যে যুগ, যখন পরমাত্মা এই সৃষ্টি মঞ্চে আসিয়া মনুষ্যের সহিত মিলিত হন, সেই সঙ্গমযুগকে জানে না। প্রকৃতপক্ষে এই সঙ্গম যুগের স্মরণার্থে কুম্ভের মেলা পালন করা হয়, কেন না ঐ সময় পরম পিতা পরমাত্মার সহিত মনুষ্যাত্মার মিলন হয় এবং পরমাত্মা মনুষ্যাত্মাকে দেবতায় পরিণত করিবার নিমিত্ত জ্ঞানামৃতের কুম্ভ বা কলস দান করেন। বস্তুত: এই সঙ্গম যুগই কল্পের অমৃতবেলা বা ব্রাহ্মমুর্হূূত, কারণ কলিযুগ রূপ রাত্রি এবং সত্যযুগ রূপ দিনের সঙ্গম সময়েই পরমাত্মা জ্ঞানামৃত পান করারন এবং আত্মাগণকে ব্রহ্মলোকে লইয়া যাইবার কর্তব্য করেন। এই জন্যই তিনি সকলের সৎগুরু। তিনি সৃষ্টির আদি, মধ্য অন্তের জ্ঞান শিক্ষা দেন। এই হিসাবে তিনি শিক্ষক।

সত্যযুগ ও ত্রেতাযুগে সত্যধর্ম বর্তমান থাকার জন্য এই দুই যুগে পরমাত্মার আসিবার প্রয়োজন হয় না। ধর্ম গ্লানি দ্বাপর যুগ হইতে শুরু হয়। কিন্তু তখনই যদি পরমাত্মা অবতীর্ণ হইয়া অধর্মের বিনাশ করিয়া সৎধর্মের স্থাপন করেন, তাহা হইলে দ্বাপর যুগের পরই সত্যযুগ শুরু হইয়া যায়। কিন্তু দ্বাপর যুগের পর কলিযুগ। সুতরাং ইহা স্পষ্ট যে কলিযুগের অন্তে যখন অতি ধর্ম গ্লানি হয় এবং মনুষ্য আসুরী স্বভাবযুক্ত হইয়া পরে তখনই পরমাত্মা অবতীর্ণ হন।

…আণবিক বিশ্বযুদ্ধ, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, ভারতে পারস্পরিক গৃহযুদ্ধ ইত্যাদির দ্বারা সৃষ্টির মহাবিনাশ কল্প কল্প ধরিয়া হইয়া আসিতেছে। এখন কল্পান্তে সৃষ্টির মহাবিনাশ আসন্ন। এখন যে সমস্ত বৈজ্ঞঅনিক ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্র

…রাত্রি শেষে দিন আসে। অতএব এখন কলিযুগে বিস্ফোরন। আর সত্যযুগে জনসংখ্যা সংকুলান মত হয়। লোকে জানে না, কলিরযুগের অন্তে এই সমস্ত আত্মাগণ যায় কোথায়? বস্তুত: মহাবিনাশের ফলে উহারা পরমধামে প্রত্যাবর্তন করে। মাত্র ৯১৬১০৮ পবিত্র দেবদেবীর আত্মা সত্যযুগী পবিত্র সৃষ্টিতে জন্মগ্রহণ করে। ইহা ছাড়া সমস্ত আত্মাই পরমধামে অবস্থান করে। পরে আপন আপন কর্ম অনুযায়ী ঐ সমস্ত আত্মাগণ অন্যান্য যুগে ক্রমশ: জন্মগ্রহণ করিয়া থাকে।

প্রজাপিতা ব্রহ্মা দ্বারা সৃষ্টির পুন:স্থাপন ও শঙ্কর দ্বারা বিনাশ ছাড়াও পরমাত্মা বিষ্ণুর দ্বারা সত্যযুগী ও ত্রেতাযুগী সৃষ্টির পালন কার্য করিয়া থাকেন। বিষ্ণুর দ্বারা পালন কেমন করিয়া হয় তাহা জানিবার পূর্বে বিষ্ণুর চতুর্ভুজ ও তাহার অলঙ্কারাদি সম্বন্ধে অবহিত হওয়া বিশেষ প্রয়োজন। বিষ্ণুর চতুর্ভুজের দুইভুজ শ্রীলক্ষ্মীর এবং দুইভুজ শ্রীনারায়নের, অথবা দুইভুজ শ্রীরামের এবং দুইভুজ শ্রীসীতার প্রতীক। বিষ্ণুর হাতে শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম নামে যে অলঙ্কার বর্তমান তাহা একে একটি দৈবী গুণের প্রতীক। যথা শঙ্খ- পবিত্র বচনের, সুদর্শন-চক্র – আত্মা, পরমাত্মা তথা সৃষ্টিচক্র জ্ঞানের, পদ্ম – পবিত্র কমল ফুলের ন্যায় সংসার জীবনের এবং গদা-পঞ্চ বিকারের উপর বিজয় প্রাপ্তির প্রতীক। বিষ্ণুর দুই মুকুট যথা প্রভাস-মণ্ডল ও স্বর্ণ-মুকুট যথাক্রমে পবিত্রতা ও ঐশ্বর্য্যের সূচক।

যে সকল নরনারী প্রজাপিতা ব্রহ্মাদ্বারা ঈশ্বরীয় জ্ঞান ও সহজ রাজযোগ শিক্ষালাভ করে তাহারা ভবিষ্যতে সত্য ও ত্রেতা যুগে ২১ জন্ম সুখ-শান্তিপূর্ণ দেবপদ লাভ করে। বিষ্ণুর প্রতিমা লক্ষ্মী-নারায়ণের যুগ্ম প্রতিমা। অর্থাৎ সত্য বা ত্রেতা যুগে শ্রীলক্ষ্মী ও শ্রীনারায়ণের অথবা শ্রীরাম ও শ্রীসতিার যুগ্ম জীবনকেই বিষ্ণুর প্রতিমা বলা হয়। বস্তুত: লক্ষ্মী-নারায়ণ বা রাম-সীতার যুগের জীবনই হইতেছে বিষ্ণু দ্বারা পালন অর্থাৎ বিষ্ণুর অলঙ্কারাদি যে দৈবী গুণগুলি সূচিত করে সেই গুণগুলি ধারণ করার নামই বিষ্ণুবংশী প্রকৃত বৈষ্ণব হওয়া বা বিষ্ণুর দ্বারা পালিত হওয়া।

সৃষ্টি চক্রের প্রতিটি খুঁটিনাটি ঘটনা হুবহু পুনরাবৃত্ত হয়। যেমন ধরুন আজ আপনাকে যে জ্ঞানের কথা শুনাইলাম, কল্প কল্প ধরিয়া ঠিক এই একই সময় একইভাবে এইরূপ জ্ঞান শুনাইতে থাকিব।

আত্মারূপ অভিনেতা একই থাকে। নূতন আত্মা সৃষ্টি হয় না। প্রত্যেক আত্মা বর্তমান কল্পে যে সকল কার্য করিয়া থাকে, আগামী কল্পে সে ঐ একই কার্য করিবে, কারণ প্রত্যেক আত্মার মধ্যে জন্ম-জন্মান্তরের কর্ম-সংস্কার বিদ্যমান। যেমন টেপ রেকর্ড বা গ্রামোফোনর রেকর্ডে কোন গীত বা নাটক লিপিবদ্ধ হইয়া থাকে তেমনি এই ছোট জ্যোতির্বিন্দু রূপ আত্মাতে জন্ম-জন্মান্তরের কর্ম-সংস্কার লিপিবদ্ধ হইয়া আছে। প্রতি পাঁচ হাজার বৎসর পর-পর এই কর্ম-সংস্কার পুনরাবৃত্ত হইয়া থাকে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!