ভবঘুরেকথা
মতুয়া সংগীত

কুঠিতে নাম সংকীর্তন
পয়ার

ভক্তবৃন্দ সঙ্গে ল’য়ে দয়াল ঠাকুর।
চলিলেন সাহেবের কুঠি জোনাসুর।।
মৃদ্ধৌত-মার্জিত কেশ বেঁধে রেখেছিল।
অর্ধ পথে গিয়া সবে চুল ছেড়ে দিল।।
উড়িছে চিকুর যেন ঠিক ব্যোমকেশ।
চলিল কবরী ছাড়ি বিশে দরবেশ।।
আগে যায় বিশ্বনাথ নাচিয়া নাচিয়া।
তার পিছে নেচে যায় গোবিন্দ মতুয়া।।
মাঝে মাঝে গোবিন্দ মতুয়া দেয় লম্ফ।
জ্ঞান হয় তাহাতে হ’তেছে ভূমিকম্প।।
পাগলের দল যায় তার আগে আগে।
হীরামন যায় ঠাকুরের অগ্রভাগে।।
ঠাকুরের পিছে পিছে যায় দশরথ।
পিছেতে মতুয়া জুড়ে ঘাট মাঠ পথ।।
দশরথ গান করে নিজকৃত পদ।
সবে গায় তাহা প্রেমে হয়ে গদগদ।।
মহাপ্রভু পিছে যত ভক্তগণ ধায়।
ঠাকুরের সম্মুখেতে কেহ নাহি যায়।।
আগ্নেয় মেঘেতে যেন উল্কার পতন।
সবাকার কণ্ঠস্বর হ’তেছে তেমন।।
আগে পাছে ঠাকুরের বহুলোক ধায়।
জড়াজড়ি ধরাধরি ধরাতে লোটায়।।
রক্তজবা সম চক্ষু কাল মণি ঘেরা।
তার মধ্যে জ্যোতি যেন আকাশের তারা।।
ঠাকুরের আগে আগে হীরামন ধায়।
ঠিক যেন বীরভদ্র যায় দক্ষালয়।।
ঠাকুরের পিছে চারিখানা খোল বাজে।
অষ্টজোড়া করতাল বাজে তার মাঝে।।
পশ্চিম দিকেতে প্রভু করেছে গমন।
মুখপদ্ম ঝলসিছে সূর্যের কিরণ।।
রক্তবর্ণ চক্ষু কালফণী মণি ঘেরা।
ভুরুধনু মণি র’ক্ষে দিতেছে পাহারা।।
ভালে কোটা শশীছটা হ’য়েছে সংযোগ।
তাহাতে ঘটেছে যেন পুষ্পবন্ত যোগ।।
দূর হতে সাহেব ক’রেছে দরশন।
রামতনু অগ্রে গেল সাহেব সদন।।
সাহেব জিজ্ঞাসা করে রামতনু ঠাই।
ঘোর শব্দ ভীম মূর্তি কি দেখিতে পাই।।
বাজে খোল করতাল হুংকারের রোল।
এতলোক কোথা হতে আসিল সকল।।
রামতনু বিশ্বাস কহিছে সাহেবেরে।
ইচ্ছা করিলেন যে ঠাকুর দেখিবারে।।
সেই প্রভু এসেছেন ল’য়ে ভক্তগণ।
মহাসংকীর্তন যেন ভীষণ গর্জন।।
সাহেব কহিছে তনু এত ভক্ত যার।
সামান্য মানুষ নহে বুঝিলাম সার।।
রাজা রামরত্ন রায় আমি কর্মচারী।
এত লোক একত্রিত করিতে না পারি।।
যদি একত্রিত হয় রাজদণ্ড ভয়।
হেতু বিনা এত লোক ভীর কেন হয়।।
ভক্তবৃন্দ সঙ্গে দেখি চা’র পাঁচ শত।
হেলে দুলে নাচে গায় যেন মদ মত্ত।।
লোকে অসম্ভব এই অলৌকিক কার্য।
ক্ষণ জন্মা লোক ইনি করিলাম ধার্য।।
সাহেবের মাতা ছিল খট্টায় শয়ন।
ডিক কহে মাদার করহ দরশন।।
দেখ মা ঠাকুর এল কামরা বাহিরে।
মতুয়রা উপস্থিত কুঠির উপরে।।
বিশ্বনাথ দরবেশ প্রেমে মত্ত হ’য়ে।
ধরণী পতিত হয় নাচিয়ে নাচিয়ে।।
দাঁড়াইয়া কামরার দরজা সম্মুখে।
সাহেবেরা মাতা পুত্রে ম’তোদিগে দেখে।।
সাহেবের মাতা যবে করিয়া দরশন।
এমন সময় ক্ষান্ত করিল কীর্তন।।
একে একে সাহেব করিয়া দরশন।
বলে তনু কহত’ ঠাকুর কোন জন।।
সাহেবের মাতা কহে শুন বাছা ডিক।
ঠাকুরে দেখিয়া কি করিতে নার ঠিক।।
আজানুলম্বিত ভুজ চৌরাশ কপাল।
উর্দ্ধরেখা করে চক্ষু কর্ণায়ত লাল।।
চুল ছেড়ে দাঁড়িয়েছে ঠাকুর ঐ জন।
স্বভাবত রূপ যেন ভুবন মোহন।।
ভালমত ঠাকুরকে দেখ হ’য়ে স্থির।
দেখেছ কাঙ্গালী মাকে এই তার পীর।।
মনুষ্যের শরীরে কি এত হয় জ্যোতি।
পবিত্র চরিত্র যেন ঈশ্বর মূরতি।।
আমাদের অধিকারে হেন লোক আছে।
এ ঠাকুর দেখিলে মনের দুঃখ ঘুচে।।
সাহেব কহিছে তনু ঠাকুরকে আন।
নিকটে আসুন উনি দূরে র’ন কেন।।
মাদার চিনেছে ভাব ভঙ্গিতে নিশ্চিতে।
আমিও ঠাকুর চিনে লই ভালমতে।।
ঠাকুর বুঝিয়া সাহেবের অভিপ্রায়।
আগু হ’য়ে সাহেবের নিকটে দাঁড়ায়।।
সাহেবের মাতা দেখে হ’য়ে অনিমিখ।
সাহাবেরে বলে তোম দেখ দেখ ডিক।।
হিন্দু বলে শ্রীহরি যবনে বলে আল্লা।
দরবেশ ফকিরে যারে বলে হেলেল্লা।।
বৌদ্ধ যারে বুদ্ধ কহে খ্রিষ্টে বলে যিশু।
এই তিন নবরূপে উদ্ধারিতে বসু।।
সাহেব আনিয়া দিল চেয়ার পাতিয়া।
ঠাকুরকে বলিলেন বৈঠহ আসিয়া।।
ঠাকুর কহেন একি কহ অসম্ভব।
চেয়ারে কি বৈসে কভু ঠাকুর বৈষ্ণব।।
সাহেব কহে ঠাকুর যে ইচ্ছা তোমার।
যথা ইচ্ছা তথা বৈঠ হাম পরিহার।।
গান ক্ষান্ত দেহ কেন গাও গাও গাও।
নাচিয়া গাহিয়া সবে মেরা পাছ আও।।
কামরার বাহিরেতে সকলে বসিয়া।
পদ ধরি কেহ কেহ উঠিছে নাচিয়া।।
নাচিয়া নাচিয়া করে হরি সংকীর্তন।
কেহ কেহ শিব নেত্র ধরায় পতন।।
নাচে গায় দশরথ দিতেছে চিৎকার।
সিঙ্গাস্বরে বারে বারে করে হুহুঙ্কার।।
লোমকূপ কুণ্ডুলোম কণ্টক আকার।
মস্তকে চৈতন্য শিখা উর্দ্ধ হয় তার।।
ক্ষণে ক্ষণে ধরাতলে পড়ে দশা হ’য়ে।
গোবিন্দ মতুয়া উঠে ফিকিয়ে ফিকিয়ে।।
শয়নে স্বপনে কিংবা মলমূত্র ত্যাগে।
উচ্চৈঃস্বরে হরিনাম যার মুখে জাগে।।
সে বদন হরি হরি হরি বলে মুখে।
বিকারের রোগী যেন উঠে কালহিক্কে।।
কাঁদে আর নাচে মাথা স্কন্ধে ঘুরাইয়া।
ফিরিয়া ঘুরিয়া নাচে বিমুখ হইয়া।।
উলটিয়ে মাথা নিয়ে পায়ের নিকটে।
সেইভাবে হরি বলি পালটীয়ে উঠে।।
নাচিতে নাচিতে যায় কামরা ভিতর।
শতধারে চক্ষে বারি সাহেবের মার।।
কুবের বৈরাগী নাচে মুখ ফুলাইয়া।
অলাবুর পাত্র দেয় পেটে ঠেকাইয়া।।
গোপীযন্ত্র পরে অম্নি মারিয়া থাপড়।
নাচিতে নাচিতে যায় কামরা ভিতর।।
গোঁসাই গোলোক যেন বাণ বেড়পাক।
ফিরে ঘুরে নাচে যেন কুম্ভাকার চাক।।
দরবেশ বিশ্বনাথ চুল ছেড়ে দিয়ে।
উগ্রচণ্ডা নাচে যেন হাতে খাণ্ডা ল’য়ে।।
নাচিতে নাচিতে যায় পুলকে পূর্ণিত।
অনিমিষ রক্ত চক্ষু করয় ঘূর্ণিত।।
নেচে নেচে যায় সাহেবের মার ঠাই।
ফিরে ঘুরে নাচে যেন দিল্লীর সুবাঈ।।
নেচে নেচে লেংটি খ’সে হইল উলঙ্গ।
মেম আছে কাছে তাতে নাহি ভুরুভঙ্গ।।
অশ্রুপূর্ণ নেত্র সাহেবের মা দেখিয়া।
সাহেবের স্কন্ধ পরে বাহুখানি দিয়া।।
বাম হস্তে সাহেবের গলায় গ্রন্থিক।
ডান হাতে তুলে বলে চেয়ে দেখ ডিক।।
ইহারা নাচিছে সবে হ’য়ে জ্ঞান শূন্য।
বাহ্যজ্ঞান নাহি এরা রহিত চৈতন্য।।
একে রাজবংশ তুমি তাতে জমিদার।
রাজা প্রজা এই ভয় থাকেত’ প্রজার।।
আরো আমি বামালোক আছি সম্মুখেতে।
উলঙ্গ হইতে নারে বিকার থাকিতে।।
নির্বিকার দেহ ঈশ্বরেতে প্রাণ দান।
লজ্জা ঘৃণা মরা বাঁচা একই সমান।।
বেলা অপরাহ্ণ হ’ল যেতে কহ দেশে।
এইসব সাধুদিগে পাষণ্ডীরা দোষে।।
অধীনস্থ মধ্যাগাতি তুমি হও রাজা।
পাষণ্ডী প্রজাকে এনে তুমি দেও সাজা।।
অগ্রভাগে ডেকে এনে করহ বারণ।
আর যেন সাধু হিংসা না করে কখন।।
সাহেবের মাতা বলে ওরে ডিক আয়।
সেলাম করহ সবে ঠাকুরের পায়।।
সেলাম করিল যদি সাহেবের মাতা।
পরিবারসহ ডিক নোয়াইল মাথা।।
ঠাকুরের সম্মুখেতে সাহেব দাঁড়ায়।
সেলাম করিয়া সবে করিল বিদায়।।
সাহেবের মাতা কহে শুনহ ঠাকুর।
সুখে যেন থাকে ডিক কুঠি জোনাসুর।।
কুঠি হ’তে ম’তো সব হইল বিদায়।
চতুর্গুণ স্ফূর্তি হ’ল হরি গুণ গায়।।
নাচে গায় সব সাধু হীরামন হাসে।
সবে সম সম ভাব একই উল্লাসে।।
হীরামনে দেখি ডিক সাহেবের মায়।
বলে ডিক এই লোক সামান্য ত’ নয়।।
ঠাকুরে দেখিয়ে মম জীবন প্রফুল্ল।
ইহাকেও দেখা যায় ঠাকুরের তুল্য।।
যারে দেখে সেই যেন ভাবের পাগল।
নাচে গায় ঢ’লে পড়ে প্রেমেতে বিভোল।।
এক বস্ত্র পরিধান নহে ধৌত কাঁচা।
অর্দ্ধবাস গলে বেড়া নাহি দেয় কোচা।।
পিছু হ’তে বোধ হয় বাঙ্গালী প্রকৃতি।
সম্মুখে দেখায় যেন পুরুষ আকৃতি।।
ক্ষণে নারী ক্ষণে নর বলে বোধ হয়।
গভীর চরিত্র যেন চেনা নাহি যায়।।
দয়াল শ্রীহরি সাহেবেরে দিল চিনা।
হরিগুণ গাও সদা তারক রসনা।।
শেষ লীলা লীলার প্রধান সর্বসার।
হরি হরি বল কহে কবি সরকার।।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!