ভবঘুরেকথা
মাওলানা রুমি

মাওলানা রুমির বাণী: চার

৯১.
আমাকে দেখতে অস্থির মনে হতে পারে, কিন্তু আমার গভীরে আমি শান্ত ও স্থির। গাছের শাখারা দুলতে থাকে কিন্তু তার শেকড় থাকে দৃঢ়।

৯২.
অনেক মানুষ দেখেছি যাদের জড়িয়ে রাখার মতন কোন কাপড় ছিল না, অনেক কাপড় দেখেছি যা যাদের জড়িয়ে রেখেছিলো তারা মানুষ ছিল না।

৯৩.
নিরবতা হলো মহাসাগর। কথা হলো নদী। যখন মহাসাগর তোমাকে খুঁজছে তখন নদীর মাঝে হেঁটোনা। মহাসাগরের ডাকে সাড়া দাও।

৯৪.
দুনিয়াদারীর কথাবার্তা ধুলাবালির ন্যায় মানুষের হৃদয়কে ময়লা করে দেয়। যে যত বেশি চুপ থাকবে, তার আধ্যাত্মিক উন্নতি তত বেশি হবে।

৯৫.
তোমার কিছু চিন্তাকে ঘুম পাড়াও! ওদের ছায়া হতে দিও না, তোমার অন্তরের চাঁদটাকে ঢেকে ফেলে যে ছায়া। ছায়ারূপী ভাবনায় নিমগ্ন থেকো না।

৯৬.
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কে?’ সে বলল, সমস্ত কিছুর নকশা, আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাহলে আমি কে?’ সে বলল, সেই নকশার ইচ্ছাই হচ্ছো তুমি।

৯৭.
নবী মোস্তফা(স) হচ্ছেন আল্লাহর নূরানী-তাজাল্লী দর্শনের আয়না স্বরূপ। ঐ আয়নাতেই আল্লাহ্’র পবিত্র জাতের সব কিছু প্রতিবিম্বিত ও প্রতিফলিত হয়।

৯৮.
তরীকতের পথে পরিপক্ব না হওয়া পর্যন্ত মুর্শিদের সম্পর্ক ত্যাগ করিও না। যতক্ষণ পর্যন্ত বারি বিন্দু হইতে মুক্তা না উৎপন্ন হইবে, ঝিনুক হইতে পৃথক হইও না।

৯৯.
অন্যদের জীবনের ঘটনাগুলো কেমন করে ঘটেছে, অন্যদের গল্প শুনে সন্তুষ্ট হয়ে যেয়ো না। নিজ জীবনের লুকিয়ে থাকা কল্পকাহিনীর পর্দা উন্মোচিত করো।

১০০.
অর্ধেকটা জীবন হারিয়ে যায় অন্যদের খুশি করতে গিয়ে! বাকি অর্ধেকটা হারায় অন্যদের কারণে তৈরি হওয়া দুশ্চিন্তা ও উৎকন্ঠায়! এই খেলা ছাড়ো, যথেষ্ট খেলেছো তুমি।

১০১.
তুমি ভালোবাসা খুঁজতে যেয়ো না, ও তোমার কাজ নয়। বরং খেয়াল করে দেখো তোমার ভিতরে কী কী প্রাচীর তুমি গড়ে তুলেছ যা তোমাকে ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করছে।

১০২.
সমস্ত উদ্বেগ মুছে ফেলে একদম মুক্ত হয়ে যাও, চিন্তা করো তার কথা যিনি সকল চিন্তাকে সৃষ্টি করেছেন। যখন সমস্ত দ্বার এখনো এত অবারিত কেন তুমি তবু বন্দীশালাতেই বাস করো?

১০৩.
হতাশ হয়ো না! কেননা সবচেয়ে তীব্র হতাশার মূহুর্তগুলোতে আল্লাহ আশার আলো পাঠিয়ে দেন। ভুলে যেয়ো না, চারপাশ আঁধার করে আসা ঘনকালো মেঘ থেকেই তুমুল বৃষ্টিটা হয়ে থাকে।

১০৪.
মানুষ হচ্ছে কথা বলার প্রাণী। তোমার ভিতরের প্রাণীটি যেমন সবসময় তোমার সাথে থাকে, তেমনি কথাও সারাক্ষণ সেখানে থাকে। মানুষ তিনটি আধ্যাত্মিক পর্যায়ের মধ্যে বাস করে!!!

১০৫.
এখন তুমি চুপ করে থাকো! ভেতরে যে কথা বলতে চায়, তাকে কথা বলতে দাও। তিনি দরজা সৃষ্টি করেছেন, দরজার তালাও তৈরি করেছেন এবং এটা খোলার চাবিও তিনিই তৈরি করেছেন।

১০৬.
তুমি যদি আমার মাজার জিয়ারতে আস, আমি হাত জোড় করে অনুরোধ করছি, নাচতে থেকো, ঢোল ছাড়া আমার মাজারে এসোনা, কেননা আল্লাহ্’র ভোজ সভায় নিরানন্দ শোভা পায় না।

১০৭.
তুমি এখন চুপ করো। যিনি পৃথিবীর সকল শব্দগুলোকে সৃষ্টি করেছেন তাকেই কথা বলতে দাও। তিনিই দরজা সৃষ্টি করেছেন, তিনি তালা সৃষ্টি করেছেন এবং তার চাবিও তিনিই সৃষ্টি করেছেন।

১০৮.
যদি তুমি চাঁদের প্রত্যাশা কর, তবে রাত থেকে লুকিয়োনা। যদি তুমি একটি গোলাপ আশা কর, তবে তার কাঁটা থেকে পালিয়োনা, যদি তুমি প্রেমের প্রত্যাশা করো, তবে আপন সত্তা থেকে হারিওনা।

১০৯.
ভক্তি ও মোহব্বতের সাথে একজন কামেল গুরুর হৃদয়ের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারলে, হজ্জে আকবরের সওয়াব পাওয়া যায়। কারণ, হাজার হাজার কাবার চাইতে এরূপ একটি হৃদয় শ্রেষ্ঠ।

১১০.
যে পর্যন্ত তুমি কোন পীরের শরণাপন্ন না হবে। তাঁর গৃহের চৌকাঠকে নিজের বালিশ না বানাবে এবং তাঁর নির্দেশ অনুসারে কঠোর সাধনায় লিপ্ত না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি অন্তর দৃষ্টি লাভ করতে পারবে না।

১১১.
কড়া নাড়ো, তিনি তোমায় দরজা খুলে দেবেন বিলীন হয়ে যাও, তিনি তোমায় সূর্যের মত উজ্জ্বল করবেন লুটিয়ে পড়ো, তিনি তোমায় বেহেশতে তুলে নেবেন নিজেকে রিক্ত করো, তিনি তোমায় সবকিছু দিয়ে পূর্ণ করবেন।

১১২.
পেছন ফিরে দেখিয়ো না। কেউ জানে না ঠিক কেমন অবস্থায় পৃথিবী শুরু হয়েছিলো। ভবিষ্যত নিয়ে ভয় করো না, কোনকিছুই চিরকাল থাকবে না। তুমি যদি অতীত আর ভবিষ্যতেই ডুবে থাকো, তুমি বর্তমানকে হারিয়ে ফেলবে।

১১৩.
স্বর্ণ ও রৌপ্য এমন কী বস্তু যার জন্য তুমি পাগল হয়ে যাচ্ছো? এই দুনিয়া এমন কী জিনিস যার জন্য তুমি মজনু হয়ে যাও? তোমার এ ঘর-বাড়ি, বাগবাগিচা এ সবই তোমার কারাগার। তুমি সাময়িক এসবের মহব্বতে আবদ্ধ আছ মাত্র!

১১৪.
যখন অন্যকে অনুকরণ করলাম, তখন আমি অন্ধ ছিলাম। যখন অন্যের ডাকে সারা দিয়ে এলাম, তখন আমি পথভ্রষ্ট ছিলাম। এরপর আমি সবাইকে বিসর্জন দিলাম, নিজেকেসহ। এরপর আমি সবাইকে খুঁজে পেলাম, নিজেকেসহ।

১১৫.
তুমি যদি মারেফাতের নূর চাও, তবে মুর্শিদে কামেলের সাহর্চাযে থাকিয়া নূরের প্রতিভা ও যোগ্যতা অর্জন কর। আর যদি আল্লাহর রহমত থেকে দূরে থাকিতে চাও, তবে অহংকার ও খোদপছন্দী কর এবং অলীর দরবার থেকে দূর হয়ে যাও।

১১৬.
সঙ্গীত হল সকল প্রকার ভালবাসার মূল উপাদান। এটাকে অন্তরে তুলে নাও, তাহলে মনের বিশাল রাজ্যের ধুলিকনাগুলো চমকাতে শুরু করবে। সুপ্ত প্রতিভা জেগে উঠবে। সঙ্গীত শোনো, তাহলে মনে আনন্দ ও স্বর্গীয় প্রশান্তি লাভ করতে পারবে।

১১৭.
প্রথম পর্যায়ে আমরা আল্লাহর প্রতি কোন মনোযোগ দেই না। আমরা শুধু পৃথিবীর আবর্জনা, সম্পদ, শিশু, পুরুষ ও নারীকে লক্ষ্য করি!!! দ্বিতীয় পর্যায়ে আমরা ইবাদত ছাড়া আর কিছু করি না। তৃতীয় এবং সবচেয়ে অগ্রসর পর্যায়ে আমরা নিরব হয়ে যাই!!!

১১৮.
সূর্যের মতন হও মানুষকে অনুগ্রহ ও দয়া করায়। রাতের মতন হও অন্যদের ভুলগুলো ঢেকে দেয়ায়। বয়ে চলা স্রোতধারার মতন হও উদারতায়। মৃত্যুর মতন হয়ে যাও রাগ ও ক্ষুব্ধতায়, মাটির মতন হও বিনম্রতায়, তুমি যেমন তেমন করেই নিজেকে প্রকাশ করো। যেমন করে নিজেকে প্রকাশ করো, তেমনটিই হও।

১১৯.
আমার হৃদয়ের আকার তো ক্ষুদ্র, এতটাই ছোট যে তা প্রায় দেখাই যায় না। এত বিশাল পরিমাণ দুঃখ-বেদনা আমি কীভাবে ধারণ করবো এতে?
তিনি উত্তর দিলেন, “খেয়াল করে দেখো, তোমার চোখটাও তো অনেক ক্ষুদ্র। কিন্তু এই চোখে তো তুমি গোটা বিশ্বজগতকেই ধারণ করো।”

১২০.
আমি বললাম: আমার চোখ দুটোর কী হবে?
তিনি বললেন: পথের উপর তাদের স্থির রাখো।
আমি বললাম: আমার কামনার কী হবে?
তিনি বললেন: ওদের পুড়তে দাও।
আমি বললাম: আমার হৃদয়ের ব্যাপারে বলুন?
তিনি বললেন: এর মাঝে কী আছে তা আমাকে বলো।
আমি বললাম: কষ্ট আর ব্যথা।
তিনি বললেন: এগুলো থাকুক তোমার হৃদয়েই।
ক্ষতগুলো তো এমনই স্থান যার ভেতর দিয়ে তোমার মাঝে আলো প্রবেশ করে।

মাওলানা রুমির বাণী: প্রসঙ্গ প্রেম>>

………………………
আরো পড়ুন:
মাওলানা রুমির বাণী: এক
মাওলানা রুমির বাণী: দুই
মাওলানা রুমির বাণী: তিন
মাওলানা রুমির বাণী: চার
মাওলানা রুমির বাণী: প্রসঙ্গ প্রেম

…………………….
আপনার গুরুবাড়ির সাধুসঙ্গ, আখড়া, আশ্রম, দরবার শরীফ, অসাম্প্রদায়িক ওরশের তথ্য প্রদান করে এই দিনপঞ্জিকে আরো সমৃদ্ধ করুন- voboghurekotha@gmail.com

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!