ভবঘুরেকথা
প্রজাপিতা ব্রহ্মা

সিকন্দর যখন মারা গেলেন তখন তাঁর হাত কফিনের বাইরে বের করে দেখানো হয়েছিল তাঁর হাতে কিছু নেই, হাত শূন্য কেন না মানুষ বিশ্বাস করে মৃত্যুর পর ব্যক্তি খালি হাতে যায়। এর ব্যতিক্রম সিকন্দরও ছিলেন না।

কিন্তু বাস্তব ঘটনা হল প্রত্যেকটি মানুষের মৃত্যুর পর তার সাথে একটি বাক্স ও একটি বিছানা যায়। একথা শুনে অনেকে আশ্চর্য হয়ে যাবেন। জীবনে তো অনেককে মরতে দেখেছি কখনো তো মৃত মানুষের সাথে বাক্স ও বিছানা যেতে দেখিনি। এতো আজব কথা!

আমরা তো সকলেই জানি এই সংসার এক পর্যটন কেন্দ্র কোন ব্যক্তির মৃত্যু হলে সকলে বলে ওঠে, সে ফিরে গেছে (He has departed)। আমরা যখন রেল যাত্রা করি এক স্থান থেকে অন্য কোন দূরদূরান্তে, তখন সাথে ব্যবহারের আবশ্যিক জিনিসপত্রের এবং একটি বিছানা নিই।

এইরূপ মনুষ্যাত্মা রূপী মুসাফির যখন নিজের দেহ এবং দেহের সাথে সম্পর্কযুক্ত সবকিছু ছেড়ে রওনা দেয় তখনও নিজের সাথে একটি বাক্স ও একটি বিছানা নিতে ভুল করে না। মৃত্যুর পর মানুষ বাক্সের মধ্যে ভরে নিয়ে যায় নিজের মনের বৃত্তি বা বুদ্ধির বিস্তার।

মানুষের বিছানায় যেমন বালিশ থাকে যার উপর মাথা রেখে সে স্বস্তি পায়, এইরূপ মনুষ্যাত্মা পরের জন্মের জন্য নিজের স্বভাব সংস্কারের বালিশ সাথে নিয়ে যায়। অর্থাৎ বুদ্ধির প্রকৃতি, মনের গতি বা মতি আর স্বভাবের বালিশ নিয়ে যায় যার উপর ভিত্তি করে পরের জন্মে তার বচন তথা ব্যবহার এমন থাকে যেমন ভাবে বালিশের উপর মাথা থাকে।

কোন কোন মুসাফিরের বালিশ স্বচ্ছ সুন্দর ও সুকোমল হয় আবার কারোর দুর্গন্ধযুক্ত ছেঁড়াফাটা, শক্ত ও নোংরা হয় তেমনই কোন আত্মার ব্যবহার এবং বচনের আধার কোমল, পবিত্র ও সুন্দর হয়, কারো বা রুক্ষ হয়। প্রত্যেকের বুদ্ধির কোন বালিশ, কোন আধার বা ভিত্তি অবশ্যই থাকে।

ভ্রমণকারী বা মুসাফিরের বিছানারও রকমফের হয়ে থাকে- নরম গদি, শক্ত মাদুর বা গামছা যার উপর সে শয়ন করে বা বসে, তেমনি মানুষের মৃত্যুর পর কর্মের হিসাব-কিতাব সাথে নিয়ে যায় যার উপর দাঁড়িয়ে থাকে তার পরবর্তী জন্মের জীবনধারা তার ভাগ্য এবং ভোগ্য।

আজও মানুষ প্রায়শঃই বলে থাকে এই সংসার তো বেড়ানোর জায়গা। বেড়ানো সমাপ্ত হলে তো ফিরে যেতেই হবে। কোথায় যেতে হবে এবং কখন যেতে হবে এ বিষয়ে তার কোনরূপ ধারণা নেই। যদি কারো যেতে হয় তাহলে তার তো একটা প্রস্তুতি চাই।

তাকে বাক্স-বিছানা তো গুছিয়ে নিতে হবে। চাদর-বালিশ ইত্যাদির তো গোছ-গাছ চাই। কিন্তু আজকাল মানুষের ভাবখানা এরকম মনে হয়, তার যেন যেতেই হবে না। সেতো শুধু বলার জন্য বলে যে বেড়ানো শেষ করে ফিরে যেতে হবে। বাস্তবে তো সে বাক্স বিছানা গোটানোর সংকল্পই করে না।

এখন বিশ্বসংসারের যে সার্বিক পরিস্থিতি তাতে পরমধামে ফিরে যাওয়ার সবুজ সংকেত দেখা যাচ্ছে। এই সংসারে বাকিই বা আছে কী? এই সৃষ্টিরূপী মুসাফিরখানা তো বিনাশ হওয়ার পথে। যেমন বিশাল পাহাড়কে ভাঙ্গার জন্য হাতুড়ি ব্যবহারের পরিবর্তে ডিনামাইট ব্যবহার করা হয়।

ঠিক তেমনি এই বিশাল সৃষ্টির মহাবিনাশের জন্য হাইড্রোজেন বোমা, এ্যাটাম্ বোমা ইত্যাদি তৈরি হয়ে রয়েছে তার কারণ এই জর্জরীভূত সৃষ্টির বিনাশের পরেই সত্যযুগী সুখধামের আগমন হবে। সুতরাং যেতে তো হবে সবাইকেই।

এজন্য প্রত্যেকের উচিত নিজ নিজ বাক্স-বিছানা সামলানো। তাই বুদ্ধিযোগ চারিদিক থেকে গুটিয়ে একমুখী করা বাঞ্ছনীয়। তার সাথে অবশ্যই বাক্সের মধ্যে পবিত্র দৈবীসংস্কার ভরে নিতে হবে। যদি এর ব্যতিক্রম হয় তার ফলও বিরূপ হবে।

যেমন কোন ব্যক্তি যদি তার সাথে নিষিদ্ধ বস্তু আফিম, কোকেন, ব্রাউন সুগার, গাঁজা, মদ, হেরোইন ইত্যাদি রাখে এবং রাস্তায় খানাতল্লাশীতে ধরা পরে তাহলে তাকে শাস্তি ভোগ করতে হয়। ঠিক তেমনি দৈবীগুণের পরিবর্তে কাম-ক্রোধাদি বিকারী সংস্কার যদি কোন ব্যক্তি সাথে নিয়ে যায় তাহলে ‘ধর্মরাজপুরী’ নামক চেকপোস্টে তাকে দণ্ডভোগ করতে হবে। নীটফল দাঁড়াবে ‘কাল’ এখানেই তাকে গ্রাস করবে এবং যমের ভয়ে ওখানে সে সিটিয়ে যাবে। পরিণামে লাভ কী হবে?

অতএব এখনই সেই শ্রেষ্ঠ সময় চলছে যখন মানুষকে পবিত্র উত্তম সংস্কারে বাক্স পূর্ণ করে এবং কর্মযোগের বিছানা বেঁধে প্রস্তুত থাকা উচিত। ইহাই সুখ প্রদানকারী সামগ্রী যাত্রাপথে তাঁকে সাহায্য করবে এবং আগামী সময়ের জন্যও মূল সাধন রূপে গণ্য হবে।

মানুষ মৃত্যুর অন্তিমশয্যায় শায়িত হলে তার নিকট আত্মীয় পরিজন তার মুখে গঙ্গাজল ঢালে এবং গীতা পাঠ করে শোনায়। তাদের বিশ্বাস ইহাতে তার স্বর্গপ্রাপ্তি হবে। কিন্তু ভাববার বিষয়, ওই সময়তো মরণাপন্ন ব্যক্তির সমস্ত ইন্দ্রিয় শিথিল হয়ে যায় এবং তার বিচারশক্তিও অত্যন্ত দুর্বল হয়ে যায়।

সুতরাং ওইরূপ অন্তিম সময়ে তাকে গীতা শুনিয়ে বা তার কানে ওম্ ধ্বনি দিয়ে কিংবা শিব, শ্রীকৃষ্ণ বা শ্রীনারায়ণের চিত্র দেখিয়ে কী লাভ হবে? কারণ ওইরূপ অন্তিমাবস্থায় তার বিকারী সংস্কার পরিবর্তন হওয়া অসম্ভব।

শুধু তাই নয় পরমপিতা পরমাত্মার প্রতি তার স্মৃতি স্থির করাও সম্ভব নয়, কারণ তার যেরকম পূর্বের অভ্যাস ঠিক সেরূপই মনের চঞ্চলতা থেকেই যায়। অতএব মানুষের মৃত্যুর পূর্বে যখন তার অবস্থা স্বাভাবিক ও ভাল থাকে তখনি উচিত পরমপিতা পরমাত্মা ঈশ্বরের পরিচয় এবং আত্মার পরিচয় যথার্থরূপে প্রাপ্ত করে ঈশ্বরের সাথে যোগ যুক্ত হওয়ার সহজ উপায় আয়ত্ত করে অভ্যাসে রত হওয়া।

প্রত্যেকটি মানুষের প্রকৃত সত্যকে জানা উচিত যে বাস্তবে স্থূল গঙ্গাজলে আত্মা পবিত্র হয় না, প্রকৃত সত্য হলো কল্পের অন্তিমে অর্থাৎ কলিযুগের শেষে পরমপিতা পরমাত্মা তাঁর নিজধাম ব্রহ্মমহাতত্ত্ব বা শান্তিধাম থেকে অবতরণ করে এক সাধারণ বৃদ্ধের (ব্রহ্মা) তনুতে প্রবিষ্ট হয়ে যে সব মাতাগণকে ঈশ্বরীয় জ্ঞান এবং রাজযোগের শিক্ষা দান করেন তাঁরাই হলেন ‘জ্ঞানগঙ্গা’।

এই জ্ঞানগঙ্গা থেকেই জ্ঞান ধারণ করে পতিত থেকে পাবন বা পবিত্র হওয়ার সাধনা করতে হবে। এই ঈশ্বরীয় জ্ঞানের আধারে পরমপিতা পরমাত্মা শিবের স্মৃতিতে মগ্ন হয়ে নিত্য-প্রতি অভ্যাস করে নর থেকে শ্রীনারায়ণ এবং নারী থেকে শ্রীলক্ষ্মী হওয়ার লক্ষ্য সামনে রেখে দিব্যগুণসমূহ ধারণ করতে হবে তবেই মানুষের মুক্তি তথা স্বর্গ প্রাপ্তি সম্ভব।

জীবিতকালেই পবিত্র হলে এবং দিব্যগুণ ধারণ ও যোগাভ্যাস করলেই মানুষের অন্তিম সময়ে বৃত্তি ও মতি সম্পন্ন ও সম্পূর্ণ হওয়ার মুক্তিধাম ও স্বর্গধাম প্রাপ্তি হয়ে থাকে।

আমরা সাধারণত এও দেখে থাকি কোন মানুষ যখন মারা যায় তখন তার নিকট আত্মীয়-পরিজন প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখে কারণ তার আত্মা যেন প্রেতলোক বা অন্য কোথাও গিয়ে ধাক্কা না খায়। ভেবে দেখা জরুরী সত্যিই কি এই সাধারণ প্রদীপ দেহ ছেড়ে যাওয়া আত্মাকে স্বর্গ বা পরলোকে যাওয়ার পথে দেখাতে সক্ষম?

কখনই না। এজন্য একান্ত জরুরী হল জীবিত কালে নিত্য আত্মারূপী দীপককে জ্ঞান-যোগ সাধন দ্বারা জাগ্রত করা। আজও বহু মানুষ হরিদ্বারে যায় কলাগাছের খোলায় প্রদীপ জ্বালিয়ে ভাসিয়ে দেয়। যদি কোন প্রদীপ নিভে যায় তার উদ্দেশ্যে লোকজন বলে থাকে- এ আত্মা স্বর্গে যাবে না।

আর যে প্রদীপ জ্বলতে জ্বলতে ভেসে চলে তার সম্বন্ধে বলে- এ সোজা স্বর্গে চলে যাবে। এর পিছনে এক রহস্য আছে। যদি কেউ নিজের জীবনরূপী নৌকাকে এই বিকার ও অবগুণে পূর্ণ সংসারে থেকেও দিব্যগুণ রূপী পুষ্প দিয়ে সাজায় এবং আত্মারূপী দীপককে জাগিয়ে তোলে উপরন্তু প্রলোভন ও সংকট রূপী বায়ুর থেকে বাঁচিয়ে রাখে তাহলে অবশ্যই তিনি সংসার সমুদ্র সাঁতরে স্বর্গে যাবেন। বিপরীত ভাবে, যার আত্মারূপী দীপক নিভে যাবে সত্যি সত্যিই তার জীবনতরীও এই ভবসাগরে ডুবে গিয়ে নরকগামীই হবে‌‌।

আর একটি দৃশ্য আমরা সচরাচর দেখি শবযাত্রীরা শবদেহকে শ্মশানের নিকট এনে শবদেহের দিশা পাল্টে দেন। শবদেহের পদযুগল লোকালয়ের দিক এবং মাথা শ্মশানের দিক ঘুরিয়ে দেন। অর্থাৎ দেখানো হয় মৃত ব্যক্তির এই দুনিয়ার প্রতি মোহ নাশ হয়েছে এবং তীব্র বৈরাগ্য এসেছে।

বাস্তবে মৃত্যুর পূর্বেই ইহা ধারণ করা কর্তব্য। ‘রাম (রমণীয় ঈশ্বর) নাম’ ‘শিবই সত্য এবং তিনি সুন্দর’ হরি নাম ইত্যাদি আগে স্মৃতিতে রাখা উচিত। কিন্তু মানুষ ওই সময়ে এর বিপরীত কর্ম করে তনু-মন-ধন এবং বিকারের প্রতি আরো বেশি আকৃষ্ট হয়ে ঢুবে থাকে।

তাই মানুষ যখন মৃত্যুর কবলে পড়ে তখন তার কানে শেষ সময়ের বাণী যতই শোনানো হোক না কেন। তার কানে কিন্তু পৌঁছায় না। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার মানুষ অন্যকে মরতে দেখেও নিজের মৃত্যুর কথা বেমালুম ভুলে যায়, নিজের প্রকৃত পথ থেকে ভ্রষ্ট হয়ে বিষয়-বিকারে মত্ত হয়ে ওঠে।

তাই আমরা যে বহুল প্রচলিত বিষয়গুলো শুনে থাকি যেমন ‘রাম নাম সত্যের ধ্বনি করা, গীতা জ্ঞান শ্রবণ, জ্ঞান গঙ্গা রূপ অমৃত পান করা, আত্মারূপী দীপককে জাগ্রত করা, লোকালয়ের দিকে পা রাখা ইহা বাস্তবে মৃত্যুর পূর্বেই নিজের জীবনে ধারণ করা একান্ত জরুরি। কিন্তু কি আজব এই সংসার! মৃত্যুর পরই এই উল্টো কর্ম করা হয়ে থাকে।

……………………………………..
মৃত্যুর পরে কী ও পূর্বে কী? -প্রজাপিতা ব্রহ্মাকুমারী ঈশ্বরীয় বিশ্ববিদ্যালয়

আরও আধ্যাত্মিক তথ্য পেতে ও জানতে : ভারতের সাধক-সাধিকা

পুণঃপ্রচারে বিনীত-প্রণয় সেন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!