ভবঘুরেকথা
তিনকড়ি মিয়া

-সাগর

পূর্বজন্ম গৌরাঙ্গ লীলায় তিনকড়ি মিয়া গোস্বামী ছিলেন, হবিবুল্লাহ কাজির পুত্র হারিস। যিনি শত অন্যায় অবিচার, অত্যাচার সহ্য করেও ‘হরিনাম’ ত্যাগ করেন নি, পরে তার নাম হয় ব্রহ্ম হরিদাস।

আজ হতে প্রায় ১৫০ বছর আগের কথা, খুলনা জেলার তেরখাদা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত ধনী মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনকড়ি মিয়া। বয়সকালে জন্মসূত্রে প্রাপ্ত বেশকিছু ফসলি জমির মালিকানাও চলে আসে তার হাতে। এজন্য একটু অহংকারও ছিল তার মনে।

ফাল্গুন মাসের মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীর বারুণী তিথিতে তেরখাদার আশেপাশের মতুয়া দল শ্রীধাম ওড়াকান্দি যেতেন তিনকড়ি মিয়ার বাঙ্গি খেতের উপর দিয়ে। একবার তার ক্ষেতের বাঙ্গি গাছ প্রায় মরে যাচ্ছিল। তাই তিনকড়ি মিয়ার মনটা খুব খারাপ ছিল। সেসময় একদল মতুয়া ডাংকা-কাশি বাজিয়া নিশান উড়িয়ে ‘হরি নাম’ করতে করতে তার ওই বাঙ্গি ক্ষেতের উপর দিয়ে যাচ্ছিল।

কথা মতো তিনি ওটাকে কাঁধে করে নিয়ে ওড়াকান্দি গেলেন। দূর থেকেই তাকে দেখে শিবাবতার গুরুচাঁদ ঠাকুর ডাক দিয়ে বললেন, আয় তিনকড়ি আমি তোর অপেক্ষায় বসে আছি। এ কথা শুনে তিনকড়ি আরো অবাক হলেন। ভাবলেন আমি তো কোনোদিন এখানে আসিনি। আমাকে কিভাবে চিনলেন এই ঠাকুর?

এই দেখে তিনকড়ি মিয়া মতুয়াদের গালি-গালাজ শুরু করেন। এমন কি তাদের আটকে রাখেন পর্যন্ত। ভক্তরা অনেক কাকুতিমিনতি করে বলে তাদের ছেড়ে দিতে। কিন্তু তিনকড়ি মিয়া আনড়। উপায়ান্তর না দেখে দলের দলপতি তিনকড়ি মিয়াকে বলেন যে, যখন তারা পুনরায় এ পথ দিয়ে ফিরে আসবেন তখন তাদের আটকে রাখতে।

এ কথা শুনে তিনকড়ি মিয়া তাদের ছেড়ে দেয়। ভক্তরা বারুণী স্নান শেষে ওই পথেই ফিরে আসেন। তখন তিনকড়ি মিয়াকে বলেন যে, ‘তুমি হরি বোল বলে যদি এই বাঙ্গি গাছে হাত বুলাও তাহলে তোমার বাঙ্গি গাছ বেঁচে উঠবে। আর সবচেয়ে বড় যে বাঙ্গিটা হবে, সেটা নিয়ে শ্রীধাম ওড়াকান্দি দিয়ে আসবে, এই বলে ভক্তরা চলে যায।’

তিনকড়ি মিয়া ভাবলেন, আমি মুসলমানের ছেলে হয়ে যদি ‘হরি নাম’ করি তাহলে লোকে কি বলবে। তখন তিনি মনে মনে ‘হরি নাম’ করে বাঙ্গি গাছে হাত বুলাতে লাগলেন। আশ্চর্যের বিষয় মাত্র তিনবার হাত বুলানোর পরই দেখলেন বাঙ্গি গাছগুলো বেঁচে উঠছে। তিনি আশ্চর্যচকিত হলেন। কয়দিন পর ক্ষেতে এসে দেখেন ক্ষেতের এক কোনায় প্রায় ২০ কেজি ওজনের একটা বাঙ্গি পেকে পড়ে আছে।

কথা মতো তিনি ওটাকে কাঁধে করে নিয়ে ওড়াকান্দি গেলেন। দূর থেকেই তাকে দেখে শিবাবতার গুরুচাঁদ ঠাকুর ডাক দিয়ে বললেন, আয় তিনকড়ি আমি তোর অপেক্ষায় বসে আছি। এ কথা শুনে তিনকড়ি আরো অবাক হলেন। ভাবলেন আমি তো কোনোদিন এখানে আসিনি। আমাকে কিভাবে চিনলেন এই ঠাকুর?

গুরুচাঁদ ঠাকুরের নির্দেশে অর্ধেক বাঙ্গি কেটে ঠাকুর বাড়ি দিলেন আর অর্ধেক রাস্তায় বিলাতে বিলাতে বাড়ি ফিরে আসলেন। বাড়ি এসে মেপে দেখেন সেই অর্ধেক বাঙ্গিই আছে। তখন তিনকড়ি মিয়ার মনে ভক্তির উদয় হলো। তিনি হরিচাঁদ ঠাকুরকে পরীক্ষা করার জন্য হাঁড়ি ভরে গোমাংস নিয়ে গুরুচাঁদ ঠাকুরকে দিয়ে বললেন, বাবা এতে গরম গরম বাতাসা আছে। হরিচাঁদ ঠাকুরের ভোগের জন্য এনেছি।

সমাজের লোক এসব দেখে অনেক হুমকিধমকি দিল। কিন্তু দিনদিন হরি নামের মাত্রা বেড়েই যাচ্ছিল তার মুখে। ওদিকে গুরুচাঁদ ঠাকুর এক হরিভক্ত মালঞ্চ সাহা দেবীর সাথে তিনকড়ি মিয়াকে বিয়েও দিলেন। দুজনে মিলে সারাদিন ‘হরি বল’ ‘হরি বল’ বলতেন। আর হরি-গুরু চাঁদ বলে কাঁদতেন।

গুরুচাঁদ ঠাকুর অন্তরে সব জানতে পেরে বললেন, ‘ওহ্ তিনকড়ি তুই নিজ হাতেই ‘হরি বোল’ বলে এটা খুলে হরিকে ভোগ দে।’ তিনকড়ি মিয়া হাঁড়ি খুলে দেখেন সেই গোমাংস সত্যি গরম বাতাসা হয়ে গেছে। তিনকড়ি মিয়া তখন নিজের ভুল বুঝতে পেরে গুরুচাঁদ ঠাকুরের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন।

গুরুচাঁদ ঠাকুর তিনকড়ি মিয়াকে হরি রূপ দর্শন করান। তখন তিনকড়ি মিয়া ইশ্বরের নিরাকার রূপ দেখতে চান। গুরুচাঁদ ঠাকুর নিরাকারে কিছুক্ষণ বিরাজ করে তিনকড়ি মিয়াকে দেখান। তখন তিনকড়ি মিয়া মহাভাবে বিভোবিত হয়ে ভগবান শ্রী হরির গুণকীর্তন শুরু করেন।

তিনি বললেন, ‘যে খোদা-সেই হরি, বলে গেলাম আমি তিনকড়ি। তিনকড়ি মিয়া হরি বল, হরি বল বলতে বলতে বাড়ি ফিরলেন। মুখ থেকে হরি নাম যাচ্ছিলই না। সারাদিন কাজ, কাম ফেলে মুখে হরির নাম করতে লাগলেন। দু’চোখের জলে ভেসে যেত বুক।

সমাজের লোক এসব দেখে অনেক হুমকিধমকি দিল। কিন্তু দিনদিন হরি নামের মাত্রা বেড়েই যাচ্ছিল তার মুখে। ওদিকে গুরুচাঁদ ঠাকুর এক হরিভক্ত মালঞ্চ সাহা দেবীর সাথে তিনকড়ি মিয়াকে বিয়েও দিলেন। দুজনে মিলে সারাদিন ‘হরি বল’ ‘হরি বল’ বলতেন। আর হরি-গুরু চাঁদ বলে কাঁদতেন।

একদিন সমাজপতিরা এসে বললেন আমাদের সমাজের ছেলে হয়ে যদি হরি নাম করিস তাহলে তোদের মেরে ফেলব। তিনকড়ি মিয়া বললেন, ‘এই হরিনাম আমি ছাড়তে পারব না।’ তখন সমাজপতিরা তিনকড়ি মিয়াকে প্রচুর মারধর শুরু করলো। এক সময় তারা ভাবল তিনকড়ি বোধহয় মরে গেছে।

তখন তারা তিনকড়ি মিয়াকে বস্তায় ভরে নদীতে ফেলে দিলো। অন্যদিকে মালঞ্চ সাহা দেবী দু’হাত তুলে হরি গুরু বলে ডাক ছেড়ে বললেন, ‘হে হরি, তুমি যদি সত্যি হও আমার সিঁথির সিঁদুর রক্ষা করো। আমার স্বামীকে ফিরিয়ে দাও।’

তখন ভক্তের ভগবান তিনকড়ি মিয়া গোস্বামীকে রক্ষা করেন। কিছুদিন পর সমাজে মড়ক লাগলো, শয়ে শয়ে মানুষ মরতে লাগলো। তখন এলাকার মৌলবীকে শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেন, ‘শোনো তুমি তিনকড়ি মিয়া গোস্বামীর কাছে যাও, সে যে বিধান দেবে তাই পালন করো তাতেই মুক্তি মিলবে।’

এই বিশ্বে অনেক মত বা ধর্ম প্রচলিত আছে। কিন্তু এই একটা মত বা ধর্ম অর্থাৎ মতুয়া মত। যাতে নেই কোন জাতপাতের বাঁধা। কে হিন্দু, কে মুসলমান, কে ব্রাহ্মণ, কে শূদ্র এসকল বাছবিচার নাই। শুধু আছে প্রাণ ভরা ভালবাসা। আর সাম্য, আছে ঈশ্বর। জয় হোক এই মতুয়া মতের।

সকালে মৌলবী সাহেব দৌঁড়ে গিয়ে তিনকড়ি মিয়া গোস্বামীর বাড়ি গিয়ে জড়িয়ে ধরে বললেন, বাবা তুমি যে বিধান দিবে সেটাই আমরা মানবো, রক্ষা করো আমাদের। তখন তিনকড়ি মিয়া গোস্বামী বলেন, ‘আমি বিধান দেবার কে? তিনিই তো বিধান দিয়েছেন, যাও আমি তোদের ক্ষমা করে দিলাম। সকলে হরি নাম কর, ডাংকা বাজা, সাধুসেবা কর, এতেই শ্রী হরি তুষ্ট হবেন।’

তখন তিনকড়ি মিয়া গোস্বামী সকলকে নিয়ে বিশাল এক মতুয়া দল গড়লেন। পাড়ার উপাসনালয়ে হরি-গুরুচাঁদকে বসালেন। আস্তে আস্তে অনেকেই তার সাথে যোগ দিলো।

গুরুচাঁদ ঠাকুরের আদেশে তিনকড়ি মিয়া গোস্বামীর মতুয়া দল সর্বপ্রথম শ্রীধাম ওড়াকান্দিতে প্রবেশের অধিকার এবং মর্যাদা পান। সেই সাথে তিনকড়ি মিয়া গোস্বামী পান মতুয়া ধর্মের শ্রেষ্ঠ আসন।

এখনো সেই ধারা বজায় রেখে শ্রীধাম ওড়াকান্দিতে তিনকড়ি মিয়া গোস্বামীর বংশধররা বারুণীতে সবার আগে ধামে প্রবেশ করে, এভাবেই তিনি হরি গুরুচাঁদের প্রিয় ভক্ত হয়ে আছেন।

এই বিশ্বে অনেক মত বা ধর্ম প্রচলিত আছে। কিন্তু এই একটা মত বা ধর্ম অর্থাৎ মতুয়া মত। যাতে নেই কোন জাতপাতের বাঁধা। কে হিন্দু, কে মুসলমান, কে ব্রাহ্মণ, কে শূদ্র এসকল বাছবিচার নাই। শুধু আছে প্রাণ ভরা ভালবাসা। আর সাম্য, আছে ঈশ্বর। জয় হোক এই মতুয়া মতের।

জয় জয় শান্তি হরি, তিনকড়ি মিয়া গোস্বামী প্রীতি প্রেমানন্দে হরি হরি বল।

………………………………………..
তিনকড়ি মিয়ার চিত্র ও লেখা
সাগর

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………………………
আরো পড়ুন:
গুরুচাঁদের বারো গোঁসাই: এক
গুরুচাঁদের বারো গোঁসাই: দুই
গুরুচাঁদের বারো গোঁসাই: তিন

শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর ও নবযুগের যাত্রা: এক
শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর ও নবযুগের যাত্রা: দুই
শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর ও নবযুগের যাত্রা: তিন

তারকচাঁদের চরিত্রসুধা
অশ্বিনী চরিত্রসুধা
গুরুচাঁদ চরিত
মহান ধর্মগুরু হরিচাঁদ নিয়ে প্রাথমিক পাঠ
হরিলীলামৃত
তিনকড়ি মিয়া গোস্বামী
শ্রী ব্রজমোহন ঠাকুর

……………………………
আরো পড়ুন:

মতুয়া ধর্ম দর্শনের সারমর্ম
মতুয়া মতাদর্শে বিবাহ ও শ্রদ্ধানুষ্ঠান
মতুয়াদের ভগবান কে?
নম:শূদ্রদের পূর্ব পরিচয়: এক
নম:শূদ্রদের পূর্ব পরিচয়: দুই
মতুয়া মতাদর্শে সামাজিক ক্রিয়া

বিধবাবিবাহ প্রচলন ও বর্ণবাদীদের গাত্রদাহ
ঈশ্বরের ব্যাখ্যা ও গুরুচাঁদ ঠাকুর
বিধবাবিবাহের প্রচলন ও গুরুচাঁদ ঠাকুর

Related Articles

2 Comments

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • Kamalesh Howladar , সোমবার ২৭ ডিসেম্বর ২০২১ @ ১০:৪৯ অপরাহ্ণ

    জয়ঁহরিবোল। আপনার প্রতিবেদনটা,অনেক ধর্মগ্রন্থের অংশের উদধৃতি দিয়ে বর্ননা দেয়া হয়েছে।

  • Kamalesh Howladar , সোমবার ২৭ ডিসেম্বর ২০২১ @ ১০:৫৩ অপরাহ্ণ

    এ ভাবে সনাতন ধর্ম নিয়ে প্রতিবেদনপ্রকাশ করা খু্বই গুরুত্বপূর্ণ। বাস্তব সমাজের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে এবং তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা উচিৎ বলে আমি মনে করি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!