ভবঘুরেকথা
যোগীবর শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী

-ড. সৌরভ মণ্ডল

• তৎকালীন সময়ে চট্টগ্রামের পার্বত্য প্রদেশের একটি গুহায় অবস্থান করিতেছিলেন ইসলাম ধর্মের এক সিদ্ধ ফকির রেওয়াজ উদ্দিন সাহেব। তিনি সদাই মৌন থাকিতেন এবং তাঁহার দেশ ও বিদেশে বহু অনুগামী ছিল। কিন্তু তিনি যখনই বালক অমলকে পাইতেন তখন সকল ভক্তকে উপেক্ষা করিয়া তাঁহাকে নিকটে ডাকিয়া আদর করিতেন এবং আশীর্বাদ করিতেন।

• পরবর্তী সময়ে যোগাচার্য শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী মহাশয় হাওড়ার চামাড়িয়া হাউসে যোগীরাজ শ্রী শ‍্যমাচরণ লাহিড়ী মহাশয়ের শিষ‍্য ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গুরুদেব পূজনীয় শ্রীশ্রী ভূপেন্দ্রনাথ সান‍্যাল মহাশয়ের কৃপাশীর্বাদ প্রাপ্ত হন।

সান‍্যাল মহাশয়ের সহিত তাঁহার ক্রিয়াযোগের অতি উচ্চতর সাধন পন্থা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় এবং সান‍্যাল মহাশয় যোগাচার্য শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী মহাশয়ের মস্তকের শীর্ষবিন্দুতে স্পর্শ করিয়া আশীর্বাদ করেন।

• লাহিড়ী মহাশয়ের শিষ‍্য শ্রীশ্রী প্রনবানন্দ গিরি মহারাজের (প্রণবগীতা প্রণেতা) শিষ‍‍্য পরম্পরায় বেনারসে সন্ন‍্যাসিনী মা ও কোলকাতায় শ্রীযুক্ত জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ‍্যায়ের সহিত তাহার সাক্ষাৎ হইয়াছিল এবং তিনি তাঁহাদের আশীর্বাদ লাভ করিয়াছিলেন।

• পুরীধামের কড়ার আশ্রমে পূজ‍্যপাদ যুক্তেশ্বর গিরি মহারাজের শিষ‍্য পরমহংস হরিহরানন্দ গিরি মহারাজ যেই দিন দীর্ঘ বারো বৎসর মৌনব্রত অবলম্বনের পর প্রথম মৌনব্রত ভঙ্গ করিয়াছিলেন সেই দিনই যোগাচার্য শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী মহাশয় তাঁহার সহিত সাক্ষাত করিয়াছিলেন।

• বেনারসে লাহিড়ী মহাশয়ের পৌত্র শ্রী সত‍্যচরণ লাহিড়ী মহাশয় অত‍্যন্ত স্নেহ করিতেন যোগাচার্য শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী মহাশয়কে। তিনি কোলকাতায় আসিলেই যোগাচার্যদেবের সংবাদ নিতেন।

• বেনারসে লাহিড়ী মহাশয়ের প্রপৌত্র শ্রীযুক্ত বনমালী লাহিড়ী মহাশয়ের সহিত যোগাচার্য দেবের ছিল এক মধুর সম্পর্ক। যখনই যোগাচার্য ডা. শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী মহাশয় বেনারসে যাইতেন তখনই তিনি যোগীরাজ শ‍্যামাচরণ লাহিড়ী মহাশয়ের পরম পবিত্র বাসভবনে দীর্ঘ সময় ধ‍্যানমগ্ন থাকিতেন। শ্রীযুক্ত বনমালী লাহিড়ী মহাশয়ও তাঁহাকে অত‍্যন্ত স্নেহ করিতেন।

• পরমহংস যোগানন্দজীর শিষ‍্যা শ্রীশ্রী দয়ামাতা ও শ্রীশ্রী মৃণালিনী মাতা যখন কোলকাতায় আসিয়াছিলেন তখন তাঁহাদের সহিত যোগাচার্য শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী মহাশয় সাক্ষাত করিয়াছিলেন।

• যোগাচার্য শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী মহাশয় যখনই দেওঘরে যাইতেন তখনই শ্রীশ্রী বালানন্দ ব্রহ্মচারীর শিষ‍্য শ্রীশ্রী মোহনানন্দ ব্রহ্মচারী মহাশয়ের সহিত সাক্ষাত করিতেন। শ্রীযুক্ত মোহনানন্দ ব্রহ্মচারী মহাশয় যোগাচার্য ডা. শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী মহাশয়ের প্রতি এতোটাই প্রীত ছিলেন যে তাঁহার কনিষ্ঠ পুত্রকে নিজের নিকটে রাখিতে চাহিয়াছিলেন।

• যোগাচার্য ডা. শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী মহাশয় কোলকাতায় পরম প্রেমময়ী শ্রীশ্রী আনন্দময়ী মায়ের দর্শনলাভ ও স্নেহাশীর্বাদ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন।

• শ্রীশ্রী ঠাকুর সীতারামদাস ওঁকারনাথ মহারাজের সাক্ষাৎ এবং আশীর্বাদ যোগাচার্য ডা. শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী মহাশয় প্রাপ্ত হইয়াছিলেন।

• পরমহংস স্বরূপানন্দজীর সাক্ষাৎ ও আশীর্বাদ যোগাচার্য ডা. শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী মহাশয় প্রাপ্ত হইয়াছিলেন।

• মহান সাধিকা শ্রীশ্রী শোভামায়ের স্নেহাশীর্বাদ যোগাচার্য ডা. শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী মহাশয় প্রাপ্ত হইয়াছিলেন।

এছাড়াও পরবর্তীকালে পূজনীয় স্বামী সত‍্যানন্দ গিরি মহারাজের শিষ‍্য স্বামী সত‍্যেশ্বরানন্দ গিরি মহারাজ, শ্রীশ্রী শ্রীশ মূখার্জীর শিষ‍্য শ্রীযুক্ত আদ‍্যনাথ রায় মহাশয়, শ্রীশ্রী পঞ্চানন ভট্টাচার্য মহাশয়ের পৌত্র শ্রী করুণাময় ভট্টাচার্য এবং শ্রী শিবময় ভট্টাচার্য মহাশয় প্রমূখ ব‍‍্যক্তিবর্গের সহিত তাঁহার বন্ধুত্বপূর্ণ সু-সম্পর্কও গড়িয়া উঠিয়াছিল।

তিনি নিজেকে কখনোই গুরু বলিয়া প্রকাশ করিতেন না। তিনি নিজেকে সদা সর্বদা অণুবোধ করিতেন এবং শ্রীগুরুর চরণাশ্রিত ভৃত্য বলিয়া পরিচয় দিতেন। যোগসাধনার চরম অবস্থা প্রাপ্ত হইয়াও এবং তাঁহার গুরুদেব কর্তৃক আদিষ্ট হইবার সত্ত্বেও তাঁহার এই গুরুভক্তির নিদর্শন বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিকট গুরুশিষ‍্যের সম্পর্কের চরম শিক্ষার সাক্ষ‍্য বহন করে।

যোগীবর শ্রীশ্রী নগেন্দ্রনাথ চৌধুরী মহাশয়ের শিষ‍্য শ্রীযুক্ত জ‍্যোতিষচন্দ্র সেন মহাশয়ের সহিত যোগাচার্য ডা. শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী মহাশয়ের ছিল অতি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। কারণ তাঁহারা দুইজনেই নগেন বাবার স্নেহাশীর্বাদ ধন‍্য। বেহালার পঞ্চাননধামে দুইজনে বহুবার বহু বিষয়ে আলোচনায় মগ্ন থাকিতেন।

শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরীর আচার্য ও দীক্ষাদান

তিনি ক্রিয়াযোগ প্রাপ্ত হইবার পর অতি অল্পদিনের মধ‍্যেই ক্রিয়াযোগের সকল সোপান অতিক্রম করিয়া যোগসাধনার চরম প্রাপ্তি লাভ করিয়াছিলেন এবং তাহার এই অবস্থা লক্ষ্য করিয়া তাঁহার গুরুদেব যোগীবর শ্রীশ্রী নিতাইচরণ বন্ধ‍্যোপাধ‍্যায় মহাশয় তাঁহাকে আপন প্রতিনিধি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করিয়া লাহিড়ী মহাশয়ের অমর ক্রিয়াযোগের গুরু পরম্পরার গুরু দায়িত্ব অর্পণ করিয়াছিলেন।

যোগাচার্য ডা. শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী মহাশয় যখন তাঁহার গুরুদেবের সহিত ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণে রত ছিলেন তখনই তাঁহার গুরুর নির্দেশে শত শত ব‍্যক্তিকে ক্রিয়াদান করিয়াছিলেন।

গুরুদেবের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও যে সকল ব্যক্তি তাঁহার নিকট হইতে ক্রিয়াযোগের দীক্ষা প্রার্থনা করিতেন তিনি তাহাদের উপযুক্ত বিবেচনা করিবার পর আপন গুরুদেবের নিকট লইয়া যাইতেন এবং গুরুদেবের সম্মুখেই ক্রিয়া প্রদান করিয়া তাঁহার গুরুদেবকেই গুরু বলিয়া পরিচয় করাইয়া দিতেন।

তিনি নিজেকে কখনোই গুরু বলিয়া প্রকাশ করিতেন না। তিনি নিজেকে সদা সর্বদা অণুবোধ করিতেন এবং শ্রীগুরুর চরণাশ্রিত ভৃত্য বলিয়া পরিচয় দিতেন। যোগসাধনার চরম অবস্থা প্রাপ্ত হইয়াও এবং তাঁহার গুরুদেব কর্তৃক আদিষ্ট হইবার সত্ত্বেও তাঁহার এই গুরুভক্তির নিদর্শন বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিকট গুরুশিষ‍্যের সম্পর্কের চরম শিক্ষার সাক্ষ‍্য বহন করে।

যোগীবর শ্রীশ্রী নিতাইচরণ বন্ধ‍্যোপাধ‍্যায় মহাশয় তাঁহার উন্নত শিষ‍্যগণের মধ‍্য হইতে ছয়জনকে আচার্য পদাভিশিক্ত করিয়াছিলেন। গুরুদেবের মহাপ্রয়াণের পর তাঁহারা সকলেই জ‍্যেষ্ঠ গুরুভ্রাতা যোগাচার্য ডা. শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী মহাশয়কেই গুরুর ন‍্যায় শ্রদ্ধা ও ভক্তি করিতেন এবং তাঁহাদের অনেকের উচ্চতর স্তরের উন্নতির ভার যোগাচার্য ডা. শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী মহাশয়কেই গ্রহণ করিতে হইয়াছিল।

পরবর্তী সময়ে বহুবার দেখা গিয়াছে যে, যোগীবর শ্রীশ্রী নিতাইচরণ বন্ধ‍্যোপাধ‍্যায় মহাশয়ের নিকট কেহ আসিয়া ক্রিয়াযোগের দীক্ষা প্রার্থনা করিলে তিনি প্রিয় শিষ‍্য অমলকেই ডাকিয়া পাঠাইতেন এবং পরবর্তীকালে তাঁহার বহু উন্নত শিষ‍্যের উন্নতির ভার যোগাচার্য ডা. শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী মহাশয়কেই গ্রহণ করিতে হইয়াছিল।

১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দের ৯ই ফেব্রুয়ারি (২৬শে মাঘ, ১৩৮৫ বঙ্গাব্দ) নিত‍্যানন্দ ত্রয়োদশীর শুভক্ষণে মহাযোগী শ্রীশ্রী নিতাইচরণ বন্ধ‍্যোপাধ‍্যায় মহাশয় তাঁহার নিজ ইচ্ছায় মহাসমাধি লাভ করেন। ওই দিনই রাত্রি দশ ঘটিকায় ব্রহ্মচারী নিরদানন্দজীর প্রতিষ্ঠিত হাওড়ার বকুলতলায় ‘নিত‍্যানন্দ যোগাশ্রমে’ পরমারাধ‍্য পূজ‍্যপাদ যোগীবর শ্রীশ্রী নিতাইচরণ বন্ধ‍্যোপাধ‍্যায় মহাশয়ের নশ্বর দেহ সযত্নে সমাধিস্থ করা হয়।

যোগীবর শ্রীশ্রী নিতাইচরণ বন্ধ‍্যোপাধ‍্যায় মহাশয়ের মহাপ্রয়াণের পর তাঁহার সমাধিস্থলের উপরে একটি সুন্দর মন্দির নির্মাণ করিয়া তাঁহার প্রতিমূর্তি স্থাপন করা হয়। এই মন্দির উদ্বোধন উৎসব উপলক্ষ্যে পুরুলিয়ার বলরামপুর, বান্দোয়ান, দেওঘরের বাহান্নবিঘা এবং পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার বহু ভক্ত উপস্থিত হন।

পরবর্তীকালে ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে যোগীবর শ্রীশ্রী নিতাইচরণ বন্ধ‍্যোপাধ‍্যায় মহাশয়ের ঔরসজাত পুত্র পরমশ্রদ্ধেয় শ্রীযুক্ত দণ্ডপাণী বন্ধ‍্যোপাধ‍্যায় মহাশয়ের তত্ত্বাবধানে মন্দিরসহ আশ্রমটি রেজিস্ট্রিকৃত করা হয় এবং সকল গুরুভ্রাতা ও ভগিনীগণের একান্ত অনুরোধে যোগাচার্য ডা. শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী মহাশয় আশ্রমের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

যোগাচার্য ডা. শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী মহাশয়ের জীবন ছিল তাঁহার গুরুপদে সমর্পিত। তিনি আজীবন গুরুগত প্রাণের পরিচয় দিয়াছিলেন। গুরুদেবের শ্রীতনুর অবর্তমানে তাঁহার গুরুদেবের সমাধিস্থল এই আশ্রমই ছিল তাঁহার প্রাণের প্রিয় স্থান।

যোগীবর শ্রীশ্রী নিতাইচরণ বন্ধ‍্যোপাধ‍্যায় মহাশয় তাঁহার উন্নত শিষ‍্যগণের মধ‍্য হইতে ছয়জনকে আচার্য পদাভিশিক্ত করিয়াছিলেন। গুরুদেবের মহাপ্রয়াণের পর তাঁহারা সকলেই জ‍্যেষ্ঠ গুরুভ্রাতা যোগাচার্য ডা. শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী মহাশয়কেই গুরুর ন‍্যায় শ্রদ্ধা ও ভক্তি করিতেন এবং তাঁহাদের অনেকের উচ্চতর স্তরের উন্নতির ভার যোগাচার্য ডা. শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী মহাশয়কেই গ্রহণ করিতে হইয়াছিল।

যোগীবর শ্রীশ্রী নিতাইচরণ বন্ধ‍্যোপাধ‍্যায় মহাশয়ের এক অন‍্যতম শিষ‍্য ছিলেন রাজস্থান নিবাসি যোগাচার্য শ্রীশ্রী রঙ্গনাথ তিওয়ারী মহাশয়। তিনি তাঁহার গুরুদেবের মহাপ্রয়াণের পর ক্রিয়াযোগের শেষের ক্রমগুলি যোগাচার্য ডা. শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী মহাশয়ের নিকট হইতে প্রাপ্ত হইয়াছিলেন।

(চলবে…)

………………………………
আরো পড়ুন:
যোগীবর শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী: এক

যোগীবর শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী: দুই
যোগীবর শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী: তিন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!