ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

১৮৮৬, ২২শে এপ্রিল

ঠাকুরের আত্মপূজা – গুহ্যকথা – মাস্টার, হীরানন্দ প্রভৃতি সঙ্গে
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ অন্তর্মুখ। কাছে হীরানন্দ ও মাস্টার বসিয়া আছেন। ঘর নিস্তব্ধ। ঠাকুরের শরীরে অশ্রুতপূর্ব যন্ত্রণা; ভক্তেরা যখন এক-একবার দেখেন, তখন তাঁহাদের হৃদয় বিদীর্ণ হয়। ঠাকুর কিন্তু সকলকেই ভুলাইয়া রাখিয়াছেন। বসিয়া আছেন সহাস্যবদন!

ভক্তেরা ফুল ও মালা আনিয়া দিয়াছেন। ঠাকুরের হৃদয়মধ্যে নারায়ণ, তাঁহারই বুঝি পূজা করিতেছেন। এই যে ফুল লইয়া মাথায় দিতেছেন। কণ্ঠে, হৃদয়ে, নাভিদেশে। একটি বালক ফুল লইয়া খেলা করিতেছে।

ঠাকুরের যখন ঈশ্বরীয়ভাব উপস্থিত হয়, তখন বলেন যে, শরীরের মধ্যে মহাবায়ু ঊর্ধ্বগামী হইয়াছে। মহাবায়ু উঠিলে ঈশ্বরের অনুভূতি হয়, – সর্বদা বলেন। এইবার মাস্টারের সহিত কথা কহিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) – বায়ু কখন উঠেছে জানি না।

“এখন বালকভাব। তাই ফুল নিয়ে এই রকম কচ্ছি। কি দেখছি জানো? শরীরটা যেন বাঁখারিসাজানো কাপড়মোড়া, সেইটে নরছে। ভিতরে একজন আছে বলে তাই নড়ছে।

“যেন কুমড়ো-শাঁসবিচি ফেলা। ভিতরে কামাদি-আসক্তি কিছুই নাই। ভিতর সব পরিষ্কার। আর -”

ঠাকুরের বলিতে কষ্ট হইতেছে। বড় দুর্বল। মাস্টার তাড়াতাড়ি ঠাকুর কি বলিতে যাইতেছেন একটা আন্দাজ করিয়া বলিতেছেন, “আর অন্তরে ভগবান দেখছেন।”

শ্রীরামকৃষ্ণ – অন্তরে বাহিরে, দুই দেখছি। অখণ্ড সচ্চিদানন্দ! সচ্চিদানন্দ কেবল একটা খোল আশ্রয় করে এই খোলের অন্তরে-বাহিরে রয়েছেন! এইটি দেখছি।

মাস্টার ও হীরানন্দ এই ব্রহ্মদর্শনকথা শুনিতেছেন। কিয়ৎক্ষণ পরে ঠাকুর তাঁহাদের দিকে দৃষ্টি করিয়া কথা কহিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টার ও হীরানন্দের প্রতি) – তোমাদের সব আত্মীয়বোধ হয়। কেউ পর বোধ হয় না।

[শ্রীরামকৃষ্ণ ও যোগাবস্থা – অখণ্ডদর্শন ]

“সব দেখছি একটা খোল নিয়ে মাথা নাড়ছে।

“দেখছি, যখন তাঁতে মনের যোগ হয়, তখন কষ্ট একধারে পড়ে থাকে।১

“এখন কেবল দেখছি একটা চামড়া ঢাকা অখণ্ড, আর-একপাশে গলার ঘা-টা পড়ে রয়েছে।”

ঠাকুর আবার চুপ করিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে আবার বলিতেছেন, জড়ের সত্তা চৈতন্য লয়, আর চৈতন্যের সত্তা জড় লয়। শরীরের রোগ হলে বোধ হয় আমার রোগ হয়েছে।

হীরানন্দ ওই কথাটি বুঝিবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করিলেন। তাই মাস্টার বলিতেছেন – “গরম জলে হাত পুড়ে গেলে বলে, জলে হাত পুড়ে গেল। কিন্তু তা নয়, হীট (Heat)-এতে হাত পুড়ে গেছে।

হীরানন্দ (ঠাকুরের প্রতি) – আপনি বলুন, কেন ভক্ত কষ্ট পায়?

শ্রীরামকৃষ্ণ – দেহের কষ্ট।

ঠাকুর আবার কি বলিবেন। উভয়ে অপেক্ষা করিতেছেন।

ঠাকুর বলিতেছেন – “বুঝতে পারলে?”

মাস্টার আস্তে আস্তে হীরানন্দকে কি বলিতেছেন –

মাস্টার – লোকশিক্ষার জন্য। নজির। এত দেহের কষ্টমধ্যে ঈশ্বরে মনের ষোল আনা যোগ!

হীরানন্দ – হাঁ, যেমন Christ-এর Crucifixion। তবে এই Mystery, এঁকে কেন যন্ত্রণা?

মাস্টার – ঠাকুর যেমন বলেন, মার ইচ্ছা। এখানে তাঁর এইরূপই খেলা।

ইঁহারা দুজন আস্তে আস্তে কথা কহিতেছেন। ঠাকুর ইশারা করিয়া হীরানন্দকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন। হীরানন্দ ইশারা বুঝিতে না পারাতে ঠাকুর আবার ইশারা করিয়া জিজ্ঞাসা করিতেছেন, “ও কি বলছে?”

হীরানন্দ – ইনি লোকশিক্ষার কথা বলছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – ও-কথা অনুমানের বই তো নয়। (মাস্টার ও হীরানন্দের প্রতি) – অবস্থা বদলাচ্ছে, মনে করিছি চৈতন্য হউক, সকলেকে বলব না। কলিতে পাপ বেশি, সেই সব পাপ এসে পড়ে।

মাস্টার (হীরানন্দের প্রতি) – সময় না দেখে বলবেন না। যার চৈতন্য হবার সময় হবে, তাকে বলবেন।

…………………………….
১ যং লব্‌ধ্বা চাপরং লাভং মন্যতে নাধিকং ততঃ।
যস্মিন্‌ স্থিতো ন দুঃখেন গুরুণাপি বিচাল্যতে ৷৷ [গীতা, ৬।২২]

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!