ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

১৮৮৫, ১২ই এপ্রিল
পূর্বকথা – শ্রীরামকৃষ্ণের মহাভাব – ব্রাহ্মণীর সেবা

গিরিশ, মাস্টার প্রভৃতিকে সম্বোধন করিয়া ঠাকুর নিজের মহাভাবের অবস্থা বর্ণনা করিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) – সে অবস্থার পরে আনন্দও যেমন, আগে যন্ত্রণাও তেমনি। মহাভাব ঈশ্বরের ভাব – এই দেহ-মনকে তোলপাড় করে দেয়! যেন একটা বড় হাতি কুঁড়ে ঘরে ঢুকেছে। ঘর তোলপাড়! হয়তো ভেঙেচুড়ে যায়!

“ঈশ্বরের বিরহ-অগ্নি সামান্য নয়। রূপসনাতন যে গাছের তলায় বসে থাকতেন ওই অবস্থা হলে এইরকম আছে যে, গাছের পাতা ঝলসা-পোড়া হয়ে যেত! আমি এই অবস্থায় তিনদিন অজ্ঞান হয়ে ছিলাম। নড়তে-চড়তে পারতাম না, এক জায়গায় পড়েছিলাম। হুঁশ হলে বামনী আমায় ঘরে স্নান করাতে নিয়ে গেল। কিন্তু হাত দিয়ে গা ছোঁবার জো ছিল না। গা মোটা চাদর দিয়ে ঢাকা। বামনী সেই চাদরের উপর হাত দিয়ে আমায় ধরে নিয়ে গিছল। গায়ে যে সব মাটি লেগেছিল, পুড়ে গিছল!

“যখন সেই অবস্থা আসত শিরদাঁড়ার ভিতর দিয়ে যেন ফাল চালিয়ে যেত! ‘প্রাণ যায়, প্রাণ যায়’ এই করতাম। কিন্তু তারপরে খুব আনন্দ!”

ভক্তেরা এই মহাভাবের অবস্থা বর্ণনা অবাক্‌ হইয়া শুনিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (গিরিশের প্রতি) – এতদুর তোমাদের দরকার নাই। আমার ভাব কেবল নজিরের জন্য। তোমরা পাঁচটা নিয়ে আছ, আমি একটা নিয়ে আছি। আমার ঈশ্বর বই কিছু ভাল লাগে না। তাঁর ইচ্ছে। (সহাস্যে) একডেলে গাছও আছে আবার পাঁচডেলে গাছও আছে। (সহলের হাস্য)

“আমার অবস্থা নজিরের জন্য। তোমরা সংসার করো, অনাসক্ত হয়ে। গায়ে কাদা লাগবে কিন্তু ঝেড়ে ফেলবে, পাঁকাল মাছের মতো। কলঙ্কসাগরে সাঁতার দেবে – তবু গায়ে কলঙ্ক লাগবে না।”

গিরিশ (সহাস্যে) – আপনারও তো বিয়ে আছে। (হাস্য)

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্য) – সংস্কারের জন্য বিয়ে করতে হয়, কিন্তু সংসার আর কেমন করে হবে! গলায় পৈতে পরিয়ে দেয় আবার খুলে খুলে পড়ে যায় – সামলাতে পারি নাই। একমতে আছে, শুকদেবের বিয়ে হয়েছিল – সংস্কারের জন্য। একটি কন্যাও নাকি হয়েছিল। (সকলের হাস্য)

“কামিনী-কাঞ্চনই সংসার – ঈশ্বরকে ভুলিয়ে দেয়।”

গিরিশ – কামিনী-কাঞ্চন ছাড়ে কই?

শ্রীরামকৃষ্ণ – তাঁকে ব্যাকুল হয়ে প্রার্থনা কর, বিবেকের জন্য প্রার্থনা কর। ঈশ্বরই সত্য আর সব অনিত্য – এরই নাম বিবেক! জল-ছাঁকা দিয়ে জল ছেঁকে নিতে হয়। ময়লাটা একদিকে পড়ে – ভাল জল একদিকে পড়ে, বিবেকরূপ জল-ছাঁকা আরোপ করো। তোমরা তাঁকে জেনে সংসার করো। এরই নাম বিদ্যার সংসার।

“দেখ না, মেয়ে-মানুষের কি মোহিনী শক্তি, অবিদ্যারূপিণী মেয়েদের। পুরুষগুলোকে যেন বোকা অপদার্থ করে রেখে দেয়। যখনই দেখি স্ত্রী-পুরুষ একসঙ্গে বসে আছে, তখন বলি, আহা! এরা গেছে। (মাস্টারের দিকে তাকাইয়া) – হারু এমন সুন্দর ছেলে, তাকে পেতনীতে পেয়েছে! – ‘ওরে হারু কোথা গেল’, ‘ওরে হারু কোথা গেল’। সব্বাই গিয়ে দেখে হারু বটতলায় চুপ করে বসে আছে। সে রূপ নাই, সে তেজ নাই, সে আনন্দ নাই! বটগাছের পেতনীতে হারুকে পেয়েছে।

“স্ত্রী যদি বলে ‘যাও তো একবার’ – অমনি উঠে দাঁড়ায়, ‘বসো তো’ – আমনি বসে পড়ে।


আমি আজই বড়বাবুকে বলে ঠিক করে রাখব। তার পরদিন সকালে উমেদারের কাছে একটি লোক গিয়ে উপস্থিত; সে বললে, তুমি আজ থেকেই বড়বাবুর আফিসে বেরুবে। বড়বাবু সাহেবকে বললে, ‘এ ব্যক্তি বড় উপযুক্ত লোক। একে নিযুক্ত করা হয়েছে, এর দ্বারা আফিসের বিশেষ উপকার হবে।’

“একজন উমেদার বড়বাবুর কাছে আনাগোনা করে হায়রান হয়েছে। কর্ম আর হয় না। আফিসের বড়বাবু। তিনি বলেন, এখন খালি নাই, মাঝে মাঝে এসে দেখা করো। এইরূপে কতকাল কেটে গেল – উমেদার হতাশ হয়ে গেল। সে একজন বন্ধুর কাছে দুঃখ করছে। বন্ধু বললে তোর যেমন বুদ্ধি। – ওটার কাছে আনাগোনা করে পায়ের বাঁধন ছেঁড়া কেন? তুই গোলাপকে ধর, কালই তোর কর্ম হবে। উমেদার বললে, বটে! – আমি এক্ষণি চললুম। গোলাপ বড়বাবুর রাঁড়। উমেদার দেখা করে বললে, মা, তুমি এটি না করলে হবে না – আমি মহাবিপদে পড়েছি। ব্রাহ্মণের ছেলে আর কোথায় যাই! মা, অনেকদিন কাজকর্ম নাই, ছেলেপুলে না খেতে পেয়ে মারা যায়। তুমি একটি কথা বলে দিলেই আমার একটি কাজ হয়। গোলাপ ব্রাহ্মণের ছেলেকে বললে, বাছা, কাকে বললে হয়? আর ভাবতে লাগল, আহা, ব্রাহ্মণের ছেলে বড় কষ্ট পাচ্ছে! উমেদার বললে, বড়বাবুকে একটি কথা বললে আমার নিশ্চয় একটা কর্ম হয়। গোলাপ বললে, আমি আজই বড়বাবুকে বলে ঠিক করে রাখব। তার পরদিন সকালে উমেদারের কাছে একটি লোক গিয়ে উপস্থিত; সে বললে, তুমি আজ থেকেই বড়বাবুর আফিসে বেরুবে। বড়বাবু সাহেবকে বললে, ‘এ ব্যক্তি বড় উপযুক্ত লোক। একে নিযুক্ত করা হয়েছে, এর দ্বারা আফিসের বিশেষ উপকার হবে।’

“এই কামিনী-কাঞ্চন নিয়ে সকলে ভুলে আছে। আমার কিন্তু ও-সব ভাল লাগে না – মাইরি বলছি, ঈশ্বর বই আর কিছুই জানি না।”

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!