ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

কর্মত্যাগ কখন? ভক্তের নিকট ঠাকুরের অঙ্গীকার

সন্ধ্যা হইল। দক্ষিণের বারান্দা ও পশ্চিমের গোল বারান্দায় ফরাশ আলো জ্বালিয়া দিয়া গেল। ঠাকুরের ঘরে প্রদীপ জ্বালা হইল ও ধুনা দেওয়া হইল।

ঠাকুর নিজের আসনে বসিয়া মার নাম করিতেছেন ও মার চিন্তা করিতেছেন। ঘরে মাস্টার, শ্রীযুক্ত প্রিয় মুখুজ্জে, তাঁহার আত্মীয় হরি মেঝেতে বসিয়া আছেন।

কিয়ৎক্ষণ ধ্যান চিন্তার পর ঠাকুর আবার ভক্তদের সহিত কথা কহিতেছেন। এখনও ঠাকুরবাড়ির আরতির দেরি আছে।

বেদান্ত ও শ্রীরামকৃষ্ণ – ওঁকার ও সমাধি – “তত্ত্বমসি” – ওঁ তৎ সৎ

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) – যে নিশিদিন তাঁর চিন্তা করছে, তার সন্ধ্যার কি দরকার!

ত্রিসন্ধ্যা যে বলে কালী, পূজা-সন্ধ্যা সে কি চায়।
সন্ধ্যা তার সন্ধানে ফেরে, কভু সন্ধি নাহি পায় ৷৷
দয়া ব্রত, দান আদি আর কিছু না মনে লয়।
মদনেরই যাগযজ্ঞ ব্রহ্মময়ীর রাঙা পায় ৷৷

“সন্ধ্যা গায়ত্রীতে লয় হয়, গায়ত্রী ওঁকারে জয়হয়।

“একবার ওঁ বললে যখন সমাধি হয় তখন পাকা।

“হৃষীকেশে একজন সাধু সকালবেলায় উঠে ভারী একটা ঝরনা তার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। সমস্ত দিন সেই ঝরনা দেখে আর ঈশ্বরকে বলে – ‘বাঃ বেশ করেছ! বাঃ বেশ করেছ! কি আশ্চর্য!’ তার অন্য জপতপ নাই। আবার রাত্রি হলে কুটিরে ফিরে যায়।

“তিনি নিরাকার কি সাকার সে-সব কথা ভাববারই বা কি দরকার? নির্জনে গোপনে ব্যাকুল হয়ে কেঁদে কেঁদে তাঁকে বললেই হয় – হে ঈশ্বর, তুমি যে কেমন, তাই আমায় দেখাদাও!

“তিনি অন্তরে বাহিরে আছেন।

“অন্তরে তিনিই আছেন। তাই বেদে বলে ‘তত্ত্বমসি’ (সেই তুমি)। আর বাহিরেও তিনি। মায়াতে দেখাচ্ছে, নানা রূপ; কিন্তু বস্তুত তিনিই রয়েছেন।

“তাই সব নাম রূপ বর্ণনা করবার আগে, বলতে হয় ওঁ তৎ সৎ।

“দর্শন করলে একরকম, শাস্ত্র পড়ে আর-একরকম। শাস্ত্রে আভাস মাত্র পাওয়া যায়। তাই কতকগুলো শাস্ত্র পড়বার কোন প্রয়োজন নাই। তার চেয়ে নির্জনে তাঁকে ডাকা ভাল।

“গীতা সমস্ত না পড়লেও হয়। দশবার গীতা গীতা বললে যা হয় তাই গীতার সার। অর্থাৎ ‘ত্যাগী’। হে জীব, সব ত্যাগ করে ঈশ্বরের আরাধনা কর – এই গীতার সার কথা।”

শ্রীরামকৃষ্ণের ৺ভবতারিণীর আরতিদর্শন ও ভাবাবেশ

ঠাকুর ভক্তসঙ্গে মা-কালীর আরতি দেখিতে দেখিতে ভাবাবিষ্ট হইয়াছেন। আর ঠাকুর-প্রতিমা সম্মুখে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিতে পারিতেছেন না।

অতি সন্তর্পণে ভক্তসঙ্গে নিজের ঘরে ফিরিয়া আসনে উপবিষ্ট হইলেন। এখনও ভাবাবিষ্ট। ভাবাবস্থায় কথা কহিতেছেন।

মুখুজ্জের আত্মীয় হরির বয়ঃক্রম আঠার-কুড়ি হইবে। তাঁহার বিবাহ হইয়াছে। আপাততঃ মুখুজ্জেদের বাড়িতেই থাকেন – কর্মকাজ করিবেন। ঠাকুরের উপর খুব ভক্তি।

শ্রীরামকৃষ্ণ ও মন্ত্রগ্রহণ – ভক্তের নিকট শ্রীরামকৃষ্ণের অঙ্গীকার

শ্রীরামকৃষ্ণ (ভাবাবেশে, হরির প্রতি) – তুমি তোমার মাকে জিজ্ঞাসা করে মন্ত্র নিও। (শ্রীযুক্ত প্রিয়কে) – এঁকে (হরিকে) বলেও দিতে পারলাম না, মন্ত্র তো দিই না।

“তুমি যা ধ্যান-জপ কর তাই করো।

প্রিয় – যে আজ্ঞা।

শ্রীরামকৃষ্ণ – আর আমি এই অবস্থায় বলছি – কথায় বিশ্বাস করো। দেখো, এখানে ঢঙ-ফঙ নাই।

“আমি ভাবে বলেছি, – মা, এখানে যারা আন্তরিক টানে আসবে; তারা যেন সিদ্ধ হয়।

সিঁথির মহেন্দ্র কবিরাজ বারান্দায় বসিয়া আছেন। শ্রীযুক্ত রামলাল হাজরা প্রভৃতির সঙ্গে কথা কহিতেছেন। ঠাকুর নিজের আসন হইতে তাঁহাকে ডাকিতেছেন – “মহিন্দর!” “মহিন্দর!”

মাস্টার তাড়াতাড়ি গিয়া কবিরাজকে ডাকিয়া আনিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (কবিরাজের প্রতি) – বোসো না – একটু শোনো।

কবিরাজ কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হইয়া উপবেশন করিলেন ও ঠাকুরের অমৃতোপম কথা শ্রবণ করিতে লাগিলেন।

নানা ছাঁদে সেবা – বলরামের ভাব – গৌরাঙ্গের তিন অবস্থা

শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) – তাঁকে নানা ছাঁদে সেবা করা যায়।

“প্রেমিক ভক্ত তাঁকে নানারূপে সম্ভোগ করে। কখনও মনে করে ‘তুমি পদ্ম, আমি অলি’। কখনও ‘তুমি সচ্চিদানন্দ, আমি মীন!’

“প্রেমিক ভক্ত আবার ভাবে ‘আমি তোমার নৃত্যকী!’ – আর তাঁর সম্মুখে নৃত্যগীত করে। কখনও বা দাসীভাব। কখনও তাঁর উপর বাৎসল্যভাব – যেমন যশোদার। কখনও বা পতিভাব – মধুরভাব – যেমন গোপীদের।

“বলরাম কখনও সখার ভাবে থাকতেন, কখনও বা মনে করতেন, আমি কৃষ্ণের ছাতা বা আসন হয়েছি। সবরকমে তাঁর সেবা করতেন।”

ঠাকুর প্রেমিক ভক্তের অবস্থা বর্ণনা করিয়া কি নিজের অবস্থা বলিতেছেন? আবার চৈতন্যদেবের তিনটি অবস্থা বর্ণনা করিয়া ইঙ্গিত করিয়া বুঝি নিজের অবস্থা বুঝাইতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – চৈতন্যদেবের তিনটি অবস্থা ছিল। অন্তর্দশায় সমাধিস্থ – বাহ্যশূন্য। অর্ধবাহ্যদশায় আবিষ্ট হইয়া নৃত্য করতে পারতেন, কিন্তু কথা কইতে পারতেন না। বাহ্যদশায় সংকীর্তন।

(ভক্তদের প্রতি) – তোমরা এই সব কথা শুনছো – ধারণার চেষ্টা করবে। বিষয়ীরা সাধুর কাছে যখন আসে তখন বিষয়কথা, বিষয়চিন্তা, একেবারে লুকিয়ে রেখে দেয়। তারপর চলে গেলে সেই গুলি বার করে। পায়রা মটর খেলে; মনে হল যে ওর হজম হয়ে গেল। কিন্তু গলার ভিতর সব রেখে দেয়। গলায় মটর গিড়গিড় করে।

সন্ধ্যাকালীন উপাসনা – শ্রীরামকৃষ্ণ ও মুসলমানধর্ম – জপ ও ধ্যান

“সব কাজ ফেলে সন্ধ্যার সময় তোমরা তাঁকে ডাকবে।

“অন্ধকারে ঈশ্বরকে মনে পড়ে; সব এই দেখা যাচ্ছিল! – কে এমন করলে! মোসলমানেরা দেখো সব কাজ ফেলে ঠিক সময়ে নমাজটি পড়বে।

মুখুজ্জে – আজ্ঞা, জপ করা ভাল?

শ্রীরামকৃষ্ণ – হাঁ, জপ থেকে ঈশ্বরলাভ হয়। নির্জনে গোপনে তাঁর নাম করতে করতে তাঁর কৃপা হয়। তারপর দর্শন।

“যেমন জলের ভিতর ডুবানো বাহাদুরী কাঠ আছে – তীরেতে শিকল দিয়ে বাঁধা; সেই শিকলের এক এক পাপ ধরে ধরে গেলে, শেষে বাহাদুরী কাঠকে স্পর্শ করা যায়।

“পূজার চেয়ে জপ বড়। জপের চেয়ে ধ্যান বড়। ধ্যানের চেয়ে ভাব বড়। ভাবের চেয়ে মহাভাব প্রেম বড়। চৈতন্যদেবের প্রেম হয়েছিল। প্রেম হলে ঈশ্বরকে বাঁধবার দড়ি পাওয়া গেল।

হাজরা আসিয়া বসিয়াছেন।

রাগভক্তি, মালাজপা ও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ – নারাণ

শ্রীরামকৃষ্ণ (হাজরাকে) – তাঁর উপর ভালবাসা যদি আসে তার নাম রাগভক্তি। বৈধী ভক্তি আসতেও যতক্ষণ, যেতেও ততক্ষণ। রাগভক্তি স্বয়ম্ভূ লিঙ্গের মতো। তার জড় খুঁজে পাওয়া যায় না। স্বয়ম্ভূ লিঙ্গের জড় কাশী পর্যন্ত। রাগভক্তি, অবতার আর তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গের হয়।

হাজরা – আহা!

শ্রীরামকৃষ্ণ – তুমি যখন জপ একদিন কচ্ছিলে – বাহ্যে থেকে এসে বললাম মা, একি হীনবুদ্ধি, এখানে এসে মালা নিয়ে জপ কচ্ছে! – যে এখানে আসবে তার একেবারে চৈতন্য হবে। তার মালা জপা অত করতে হবে না। তুমি কলকাতায় যাও না – দেখবে হাজার হাজার মালা জপ করছে – খানকী পর্যন্ত।

ঠাকুর মাস্টারকে বলিতেছেন, “তুমি নারাণকে গাড়ি করে এনো। এঁকে (মুখুজ্জেকে) ও বলে রাখলুম – নারাণের কথা। সে এলে কিছু খাওয়াব। ওদের খাওয়ানোর অনেক মানে আছে।”

-১৮৮৪, ২রা অক্টোবর-

………………..
রামকৃষ্ণ কথামৃত : একত্রিংশ অধ্যায় : পঞ্চম পরিচ্ছেদ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!