ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

১৮৮৫, ১৩ই জুন
কাপ্তেন ছেলেদের সঙ্গে করিয়া আসিয়াছেন

ঠাকুর কিশোরীকে বলিলেন, “এদের সব দেখিয়ে এস তো, – ঠাকুরবাড়ি!”

ঠাকুর কাপ্তেনের সহিত কথা কহিতেছেন।

মাস্টার, দ্বিজ ইত্যাদি ভক্তেরা মেঝেতে বসিয়া আছেন। দমদমার মাস্টারও আসিয়াছেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ছোট খাটটিতে উত্তরাস্য হইয়া বসিয়া আছেন। তিনি কাপ্তেনকে ছোট খাটটির এক পার্শ্বে তাঁহার সম্মুখে বসিতে বলিলেন।

[পাকা-আমি বা দাস-আমি ]

শ্রীরামকৃষ্ণ – তোমার কথা এদের বলছিলাম, – কত ভক্ত, কত পূজা, কত রকম আরতি!

কাপ্তেন (সলজ্জভাবে) – আমি কি পূজা আরতি করব? আমি কি?

শ্রীরামকৃষ্ণ – যে ‘আমি’ কামিনী-কাঞ্চনে আসক্ত, সেই আমিতেই দোষ। আমি ঈশ্বরের দাস, এ আমিতে দোষ নাই। আর বালকের আমি, – বালক কোনও গুণের বশ নয়। এই ঝগড়া করছে, আবার ভাব! এই খেলাঘর করলে কত যত্ন করে, আবার তৎক্ষণাৎ ভেঙে ফেললে! দাস আমি – বালকের আমি, এতে কোনও দোষ নাই। এ আমি আমির মধ্যে নয়, যেমন মিছরি মিষ্টের মধ্যে নয়। অন্য মিষ্টতে অসুখ করে, কিন্তু মিছরিতে বরং অমলনাশ হয়। আর যেমন ওঁকার শব্দের মধ্যে নয়।

“এই অহং দিয়ে সচ্চিদানন্দকে ভালবাসা যায়। অহং তো যাবে না – তাই ‘দাস আমি’, ‘ভক্তের আমি’। তা না হলে মানুষ কি লয়ে থাকে। গোপীদের কি ভালবাসা! (কাপ্তেনের প্রতি) তুমি গোপীদের কথা কিছু বল। তুমি অত ভাগবত পড়।”

কাপ্তেন – যখন শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনে আছেন, কোন ঐশ্বর্য নাই, তখনও গোপীরা তাঁকে প্রাণাপেক্ষা ভালবেসেছিলেন। তাই কৃষ্ণ বলেছিলেন, আমি তাদের ঋণ কেমন করে শুধবো? যে গোপীরা আমার প্রতি সব সমর্পণ করেছে, – দেহ, – মন, – চিত্ত।

শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবে বিভোর হইতেছেন। ‘গোবিন্দ!’ ‘গোবিন্দ!’ ‘গোবিন্দ!’ এই কথা বলিতে বলিতে আবিষ্ট হইতেছেন! প্রায় বাহ্যশূন্য। কাপ্তেন সবিসময়ে বলিতেছেন, ‘ধন্য!’ ‘ধন্য!’

কাপ্তেন ও সমবেত ভক্তগণ ঠাকুরের এই অদ্ভুত প্রেমাবস্থা দেখিতেছেন। যতক্ষণ না তিনি প্রকৃতিস্থ হন, ততক্ষণ তাঁহারা চুপ করিয়া একদৃষ্টে দেখিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – তারপর?

কাপ্তেন – তিনি যোগীদিগের অগম্য – ‘যোগিভিরগম্যম্‌’ – আপনার ন্যায় যোগীদের অগম্য; কিন্তু গোপীদিগের গম্য। যোগীরা কত বৎসর যোগ করে যাঁকে পায় নাই; কিন্তু গোপীরা অনায়াসে তাঁকে পেয়েছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – গোপীদের কাছে খাওয়া, খেলা, কাঁদা, আব্দার করা, এ-সব হয়েছে।

[শ্রীযুক্ত বঙ্কিম ও শ্রীকৃষ্ণ-চরিত্র – অবতারবাদ ]

একজন ভক্ত বলিলেন, ‘শ্রীযুক্ত বঙ্কিম কৃষ্ণ-চরিত্র লিখেছেন।’

শ্রীরামকৃষ্ণ – বঙ্কিম শ্রীকৃষ্ণ মানে, শ্রীমতী মানে না।

কাপ্তেন – বুঝি লীলা মানেন না?

শ্রীরামকৃষ্ণ – আবার বলে নাকি কামাদি – এ-সব দরকার।

দমদম মাস্টার – নবজীবনে বঙ্কিম লিখেছেন – ধর্মের প্রয়োজন এই যে, শারীরিক, মনাসিক, আধ্যাত্মিক প্রভৃতি সব বৃত্তির স্ফূর্তি হয়।

কাপ্তেন – ‘কামাদি দরকার’, তবে লীলা মানেন না। ঈশ্বর মানুষ হয়ে বৃন্দাবনে এসেছিলেন, রাধাকৃষ্ণলীলা, তা মানেন না?

[পূর্ণব্রহ্মের অবতার – শুধু পাণ্ডিত্য ও প্রত্যক্ষের প্রভেদ –
Mere booklearning and Realisation ]

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – ও-সব কথা যে খবরের কাগজে নাই, কেমন করে মানা যায়!

“একজন তার বন্ধুকে এসে বললে, ‘ওহে! কাল ও-পাড়া দিয়ে যাচ্ছি, এমন সময় দেখলাম, সে-বাড়িটা হুড়মুড় করে পড়ে গেল।’ বন্ধু বললে, দাঁড়াও হে, একবার খবরের কাগজখানা দেখি। এখন বাড়ি হুড়মুড় করে পড়ার কথা খবরের কাগজে কিছুই নাই। তখন সে ব্যক্তি বললে, ‘কই খবরের কাগজে তো কিছুই নাই। – ও-সব কাজের কথা নয়।’ সে লোকটা বললে, ‘আমি যে দেখে এলাম।’ ও বললে, ‘তা হোক্‌ যেকালে খবরের কাগজে নাই, সেকালে ও-কথা বিশ্বাস করলুম না।’ ঈশ্বর মানুষ হয়ে লীলা করেন, এ-কথা কেমন করে বিশ্বাস করবে? এ-কথা যে ওদের ইংরাজী লেখাপড়ার ভিতর নাই! পূর্ণ অবতার বোঝানো বড় শক্ত, কি বল? চৌদ্দ পোয়ার ভিতর অনন্ত আসা!”

কাপ্তেন – ‘কৃষ্ণ ভগবান্‌ স্বয়ম্‌।’ বলবার সময় পূর্ণ ও অংশ বলতে হয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ – পূর্ণ ও অংশ, – যেমন অগ্নি ও তার স্ফুলিঙ্গ। অবতার ভক্তের জন্য, – জ্ঞানীর জন্য নয়। অধ্যাত্মরামায়ণে আছে – হে রাম! তুমিই ব্যাপ্য, তুমিই ব্যাপক, ‘বাচ্যবাচকভেদেন ত্বমেব পরমেশ্বর।’

কাপ্তেন – ‘বাচ্যবাচক’ অর্থাৎ ব্যাপ্য-ব্যাপক।

শ্রীরামকৃষ্ণ – ‘ব্যাপক’ অর্থাৎ যেমন ছোট একটি রূপ, যেমন অবতার মানুষরূপ হয়েছেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!