ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

সচ্চিদানন্দলাভের উপায় – জ্ঞানী ও ভক্তদের প্রভেদ

সমাধি ভঙ্গ হইল। ইতিপূর্বে নরেন্দ্র শ্রীরামকৃষ্ণের সমাধি দৃষ্টে কক্ষ ত্যাগ করিয়া পূর্বদিকের বারান্দায় চলিয়া গিয়াছেন। সেখানে হাজরা মহাশয় কম্বলাসনে হরিনামের মালা হাতে করিয়া বসিয়া আছেন। তাঁহার সঙ্গে নরেন্দ্র আলাপ করিতেছেন। এদিকে ঘরে একঘর লোক। শ্রীরামকৃষ্ণ সমাধিভঙ্গের পর ভক্তদের মধ্যে দৃষ্টিপাত করিলেন। দেখেন যে, নরেন্দ্র নাই। শূন্য তানপুরা পড়িয়া রহিয়াছে। আর ভক্তগণ সকলে তাঁর দিকে ঔৎসুক্যের সহিত চাহিয়া রহিয়াছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – আগুন জ্বেলে গেছে, এখন থাকল আর গেল! (কাপ্তেন প্রভৃতির প্রতি) – চিদানন্দ আরোপ কর, তোমাদেরও আনন্দ হবে। চিদানন্দ আছেই; – কেবল আবরণ ও বিক্ষেপ; বিষয়াসক্তি যত কমবে, ইশ্বরের প্রতি মতি তত বাড়বে।

কাপ্তেন – কলিকাতার বাড়ির দিকে যত আসবে, কাশী থেকে তত তফাত হবে। কাশীর দিকে যত যাবে, বাড়ি থেকে তত তফাত হবে।

শ্রীরামকৃষ্ণ – শ্রীমতী যত কৃষ্ণের দিকে এগুচ্ছেন, ততই কৃষ্ণের দেহগন্ধ পাচ্ছিলেন। ইশ্বরের নিকট যত যাওয়া যায়, ততই তাতে ভাবভক্তি হয়। সাগরের নিকট নদী যতই যায়, ততই জোয়ার-ভাটা দেখা যায়।

“জ্ঞানীর ভিতর একটানা গঙ্গা বহিতে থাকে। তার পক্ষে সব স্বপ্নবৎ। সে সর্বদা স্ব-স্বরূপে থাকে। ভক্তের ভিতর একটানা নয়, জোয়ার-ভাটা হয়। হাসে-কাঁদে, নাচে গায়। ভক্ত তাঁর সঙ্গে বিলাস করতে ভালবাসে – কখন সাঁতার দেয়, কখন ডুবে, কখন উঠে – যেমন জলের ভিতর বরফ ‘টাপুর-টুপুর’ ‘টাপুর-টুপুর’ করে।” (হাস্য)

[সচ্চিদানন্দ ও সচ্চিদানন্দময়ী – ব্রহ্ম ও আদ্যা শক্তি অভেদ ]

“জ্ঞানী ব্রহ্মকে জানতে চায়। ভক্তের ভগবান, – ষড়ৈশ্বর্যপূর্ণ সর্বশক্তিমান ভগবান। কিন্তু বস্তুতঃ ব্রহ্ম আর শক্তি অভেদ – যিনি সচ্চিদানন্দ, তিনিই সচ্চিদানন্দময়ী। যেমন মণির জ্যোতিঃ ও মণি; মণির জ্যোতিঃ বললেই মণি বুঝায়, মণি বললেই জ্যোতিঃ বুঝায়। মণি না ভাবলে মণির জ্যোতিঃ ভাবতে পারা যায় না – মণির জ্যোতিঃ না ভাবলে মণি ভাবতে পারা যায় না।

“এক সচ্চিদানন্দ শক্তিভেদে উপাধি ভেদ – তাই নানারূপ – ‘সে তো তুমিই গো তারা!’ যেখানে কার্য (সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয়) সেইখানেই শক্তি। কিন্তু জল স্থির থাকলেও জল, তরঙ্গ, ভুড়ভুড়ি হলেও জল। সেই সচ্চিদানন্দই আদ্যাশক্তি – যিনি সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় করেন। যেমন কাপ্তেন যখন কোন কাজ করেন না তখনও যিনি, আর কাপ্তেন পূজা করছেন, তখনও তিনি; আর কাপ্তেন লাট সাহেবের কাছে যাচ্ছেন, তখনও তিনি; কেবল উপাধি বিশেষ।”

কাপ্তেন – আজ্ঞা হাঁ, মহাশয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ – আমি এই কথা কেশব সেনকে বলেছিলাম।

কাপ্তেন – কেশব সেন ভ্রষ্টাচার, স্বেচ্ছাচার, তিনি বাবু, সাধু নন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – (ভক্তদের প্রতি) – কাপ্তেন আমায় বারণ করে, কেশব সেনের ওখানে যেতে।

কাপ্তেন – মহাশয়, আপনি যাবেন, তা আর কি করব।

শ্রীরামকৃষ্ণ (বিরক্তভাবে) – তুমি লাট সাহেবের কাছে যেতে পার টাকার জন্য, আর আমি কেশব সেনের কাছে যেতে পারি না? সে ঈশ্বরচিন্তা করে, হরিনাম করে। তবে না তুমি বল ‘ঈশ্বর-মায়া-জীব-জগৎ’ – যিনি ঈশ্বর, তিনিই এই সব জীবজগৎ হয়েছেন।

-১৮৮৩, ১৯শে অগস্ট-

………………….
রামকৃষ্ণ কথামৃত : চর্তুদশ অধ্যায় : পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!