ভবঘুরেকথা
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব

নিজের উপর শ্রদ্ধার মূল ঈশ্বরে বিশ্বাস

শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি, সহাস্যে) – আচ্ছা, নরেন্দ্র কেমন!

মণি – আজ্ঞা, খুব ভাল।

শ্রীরামকৃষ্ণ – দেখ, তার যেমন বিদ্যে তেমনি বুদ্ধি! আবার গাইতে বাজাতে। এদিকে জিতেন্দ্রিয়, বলেছে বিয়ে করবে না!

মণি – আপনি বলেছেন, যে পাপ পাপ মনে করে সেই পাপী হয়ে যায়। আর উঠতে পারে না। আমি ঈশ্বরের ছেলে – এ-বিশ্বাস থাকলে শীঘ্র শীঘ্র উন্নতি হয়।

[পূর্বকথা – কৃষ্ণকিশোরের বিশ্বাস – হলধারীর পিতার বিশ্বাস। ]

শ্রীরামকৃষ্ণ – হাঁ, বিশ্বাস!

“কৃষ্ণকিশোরের কি বিশ্বাস! বলত, একবার তাঁর নাম করেছি আমার আবার পাপ কি? আমি শুদ্ধ নির্মল হয়ে গেছি। হলধারী বলেছিল, ‘অজামিল আবার নারায়ণের তপস্যায় গিছিল, তপস্যা না করলে কি তাঁর কৃপা পাওয়া যায়! শুধু একবার নারায়ণ বললে কি হবে!’ ওই কথা শুনে কৃষ্ণকিশোরের যে রাগ! এই বাগানে ফুল তুলতে এসেছিল, হলধারীর মুখের দিকে চেয়ে দেখলে না!

“হলধারীর বাপ ভারী ভক্ত ছিল। স্নানের সময় কোমর জলে গিয়ে যখন মন্ত্র উচ্চারণ করত, – ‘রক্তবর্ণং চতুর্মুখম্‌’ এই সব ধ্যান যখন করত, – তখন চক্ষু দিয়ে প্রেমাশ্রু পড়ত।

“একদিন এঁড়েদার ঘাটে একটি সাধু এসেছে। আমরা দেখতে যাব কথা হল। হলধারী বললে, সেই পঞ্চভূতের খোলটা দেখতে গিয়ে কি হবে? তারপরে সেই কথা কৃষ্ণকিশোর শুনে কি বলেছিল, কি! সাধুকে দর্শন করে কি হবে, এই কথা বললে!

– যে কৃষ্ণনাম করে, বা রামনাম করে, তার চিন্ময় দেহ হয়। আর সে সব চিন্ময় দেখে – ‘চিন্ময় শ্যাম’, ‘চিন্ময় ধাম’। বলেছিল, একবার কৃষ্ণনাম কি একবার রামনাম করলে শতবার সন্ধ্যার ফল পাওয়া যায়। তার একটি ছেলে যখন মারা গেল, প্রাণ যাবার সময় রামনাম বলেছিল। কৃষ্ণকিশোর বলেছিল, ও রাম বলেছে, ওর আর ভাবনা কি! তবে মাঝে মাঝে এক-একবার কাঁদত। পুত্রশোক!

“বৃন্দাবনে জলতৃষ্ণা পেয়েছে, মুচিকে বললে, তুই বল শিব। সে শিবনাম করে জল তুলে দিলে – অমন আচারী ব্রাহ্মণ সেই জল খেলে! কি বিশ্বাস!

“বিশ্বাস নাই, অথচ পূজা, জপ, সন্ধ্যাদি কর্ম করছে – তাতে কিছুই হয় না! কি বল?”

মণি – আজ্ঞা হাঁ।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – গঙ্গার ঘাটে নাইতে এসেছে দেখেছি। যত রাজ্যের কথা! বিধবা পিসি বলছে, মা, দুর্গাপূজা আমি না হলে হয় না – শ্রীটি গড়া পর্যন্ত! বাটীতে বিয়ে-থাওয়া হলে সব আমায় করতে হবে মা – তবে হবে। এই ফুলশয্যের যোগাড়, খয়েরের বাগানটি পর্যন্ত!

মণি – আজ্ঞে, এদেরই বা দোষ কি, কি নিয়ে থাকে!

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – ছাদের উপর ঠাকুরঘর, নারায়ণপূজা হচ্ছে। পূজার নৈবেদ্য, চন্দন ঘষা – এই সব হচ্ছে। কিন্তু ঈশ্বরের কথা একটি নাই। কি রাঁধতে হবে, – আজ বাজারে কিছু ভাল পেলে না, – কাল অমুক ব্যঞ্জনটি বেশ হয়েছিল! ও ছেলেটি আমার খুড়তুত ভাই হয়, – হাঁরে তোর সে কর্মটি আছে? – আর আমি কেমন আছি! – আমার হরি নাই! এই সব কথা।

“দেখ দেখি, ঠাকুরঘরে পূজার সময় এই সব রাজ্যের কথাবার্তা!”

মণি – আজ্ঞে, বেশির ভাগই এইরূপ। আপনি যেমন বলেন, ঈশ্বরে যার অনুরাগ তার অধিক দিন কি পূজা-সন্ধ্যা করতে হয়!

-১৮৮৩, ৯ই সেপ্টম্বর-

…………………….
রামকৃষ্ণ কথামৃত : চর্তুদশ অধ্যায় : দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!