ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে ভক্তমন্দিরে – রামের বাড়িতে
১৮৮৫, ২৩শে মে

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ রামের বাটীতে আসিয়াছেন। তাহার নিচের বৈঠকখানার ঘরে ঠাকুর ভক্ত পরিবৃত হইয়া বসিয়া আছেন। সহাস্যবদন। ঠাকুর ভক্তদের সহিত আনন্দে কথা কহিতেছেন।

আজ শনিবার (১১ই জ্যৈষ্ঠ, ১২৯২), জ্যৈষ্ঠ শুক্লাদশমী তিথি। ২৩শে মে, ১৮৮৫, বেলা প্রায় ৫টা। ঠাকুরের সম্মুখে শ্রীযুক্ত মহিমা বসিয়া আছেন। বামপার্শ্বে মাস্টার, চারিপার্শ্বে – পল্টু, ভবনাথ, নিত্যগোপাল, হরমোহন। শ্রীরামকৃষ্ণ আসিয়াই ভক্তগণের খবর লইতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) – ছোট নরেন আসে নাই?

ছোট নরেন কিয়ৎক্ষণ পরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – সে আসে নাই?

মাস্টার – আজ্ঞা?

শ্রীরামকৃষ্ণ – কিশোরী? – গিরিশ ঘোষ আসবে না? নরেন্দ্র আসবে না?

নরেন্দ্র কিয়ৎ পরে আসিয়া প্রণাম করিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) – কেদার (চাটুজ্যে) থাকলে বেশ হত! গিরিশ ঘোষের সঙ্গে খুব মিল। (মহিমার প্রতি, সহাস্যে) সেও ওই বলে (অবতার বলে)।

ঘরে কীর্তন গাহিবার আয়োজন হইয়াছে। কীর্তনিয়া বদ্ধাজলি হইয়া ঠাকুরকে বলিতেছেন, আজ্ঞা করেন তো গান আরম্ভ হয়।

ঠাকুর বলিতেছেন, একটু জল খাব।

জলপান করিয়া মশলার বটুয়া হইতে কিছু মশলা লইলেন। মাস্টারকে বটুয়াটি বন্ধ করিতে বলিলেন।

কীর্তন হইতেছে। খোলের আওয়াজে ঠাকুরের ভাব হইতেছে। গৌরচন্দ্রিকা শুনিতে শুনিতে একেবারে সমাধিস্থ। কাছে নিত্যগোপাল ছিলেন, তাঁহার কোলে পা ছড়াইয়া দিলেন। নিত্যগোপালও ভাবে কাঁদিতেছেন। ভক্তেরা সকলে অবাক্‌ হইয়া সেই সমাধি-অবস্থা একদৃষ্টে দেখিতেছেন।

[Yoga, Subjective and Objective, Identity of God (the Absolute) the soul and the
Cosmos (জগৎ) ]

ঠাকুর একটু প্রকৃতিস্থ হইয়া কথা কহিতেছেন – “নিত্য থেকে লীলা, লীলা থেকে নিত্য। (নিত্যগোপালের প্রতি) তোর কি?

নিত্য (বিনীত ভাবে) – দুইই ভালো।

শ্রীরামকৃষ্ণ চোখ বুজিয়া বলিতেছেন, – কেবল এমনটা কি? চোখ বুজলেই তিনি আছেন, আর চোখ চাইলেই নাই! যাঁরই নিত্য, তাঁরই লীলা; যাঁরই লীলা তাঁরই নিত্য।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মহিমার প্রতি) – তোমায় বাপু একবার বলি –

মহিমাচরণ – আজ্ঞা, দুইই ঈশ্বরের ইচ্ছা।

শ্রীরামকৃষ্ণ – কেউ সাততলার উপরে উঠে আর নামতে পারে না, আবার কেউ উঠে নিচে আনাগোনা করতে পারে।

“উদ্ধব গোপীদের বলেছিলেন, তোমরা যাকে কৃষ্ণ বলছ, তিনি সর্বভূতে আছেন, তিনিই জীবজগৎ হয়ে রয়েছেন।

“তাই বলি চোখ বুজলেই ধ্যান, চোখ খুললে আর কিছু নাই?”

মহিমা – একটা জিজ্ঞাস্য আছে। ভক্ত – এর এককালে তো নির্বাণ চাই?

[পূর্বকথা – তোতার ক্রন্দন – Is Nirvana the End of Life? ]

শ্রীরামকৃষ্ণ – নির্বাণ যে চাই এমন কিছু না। এইরকম আছে যে, নিত্যকৃষ্ণ তাঁর নিত্যভক্ত! চিন্ময় শ্যাম, চিন্ময় ধাম!

“যেমন চন্দ্র যেখানে, তারাগণও সেখানে। নিত্যকৃষ্ণ, নিত্যভক্ত! তুমিই তো বল গো, অন্তর্বহির্যদিহরিস্তপসা ততঃ কিম্‌১ – আর তোমায় তো বলেছি যে বিষ্ণু অংশে ভক্তির বীজ যায় না। আমি এক জ্ঞানীর পাল্লায় পড়েছিলুম, এগার মাস বেদান্ত শুনালে। কিন্তু ভক্তীর বীজ আর যায় না। ফিরে ঘুরে সেই ‘মা মা’! যখন গান করতুম ন্যাংটা কাঁদত – বলত, ‘আরে কেয়া রে!’ দেখ, অত বড় জ্ঞানী কেঁদে ফেলত! (ছোট নরেন ইত্যাদির প্রতি) এইটে জেনে রেখো – আলেখ লতার জল পেটে গেলে গাছ হয়। ভক্তির বীজ একবার পড়লে অব্যর্থ হয়, ক্রমে গাছ, ফল, ফুল, দেখা দিবে।

“মুষলং কুলনাশনম্‌’। মুষল যত ঘষেছিল, ক্ষয় হয়ে হয়ে একটু সামান্য ছিল। সেই সামান্যতেই যদুবংশ ধ্বংস হয়েছিল। হাজার জ্ঞান বিচার কর, ভিতরে ভক্তির বীজ থাকলে, আবার ফিরে ঘুরে – হরি হরি হরিবোল।”

ভক্তেরা চুপ করিয়া শুনিতেছেন। ঠাকুর হাসিতে হাসিতে মহিমাচরণকে বলিতেছেন, – আপনার কি ভাল লাগে?

মহিমা (সহাস্যে) – কিছুই না, আম ভাল লাগে।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – কি একলা একলা? না, আপনিও খাবে সব্বাইকেও একটু একটু দেবে?

মহিমা (সহাস্য) – এতো দেবার ইচ্ছা নাই, একলা হলেও হয়।

[ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ঠিক ভাব ]

শ্রীরামকৃষ্ণ – কিন্তু আমার ভাব কি জানো? চোখ চাইলেই কি তিনি আর নাই? আমি নিত্য লীলা দুইই লই।

“তাঁকে লাভ করলে জানতে পারা যায়; তিনিই স্বরাট, তিনিই বিরাট। তিনিই অখণ্ড-সচ্চিদানন্দ, তিনিই আবার জীবজগৎ হয়েছেন।”

[শুধু শাস্ত্রজ্ঞান মিথ্যা – সাধনা করিলে প্রত্যক্ষ জ্ঞান হয় ]

“সাধনা চাই – শুধু শাস্ত্র পড়লে হয় না। দেখলাম বিদ্যাসাগরকে – অনেক পড়া আছে, কিন্তু অন্তরে কি আছে দেখে নাই। ছেলেদের পড়া শিখিয়ে আনন্দ। ভগবানের আনন্দের আস্বাদ পায় নাই। শুধু পড়লে কি হবে? ধারণা কই? পাঁজিতে লিখেছে, বিশ আড়া জল, কিন্তু পাঁজি টিপলে এক ফোঁটাও পড়ে না!”

মহিমা – সংসারে অনেক কাজ, সাধনার অবসর কই?

শ্রীরামকৃষ্ণ – কেন তুমি তো বল সব স্বপ্নবৎ?

“সম্মুখে সমুদ্র দেখে লক্ষ্মণ ধনুর্বাণ হাতে করে ক্রুদ্ধ হয়ে বলেছিলেন, আমি বরুণকে বধ করব, এই সমুদ্র আমাদের লঙ্কায় যেতে দিচ্ছে না; রাম বুঝালেন, লক্ষ্মণ, এ যা-কিছু দেখছো এসব তো স্বপ্নবৎ, অনিত্য – সমুদ্রও অনিত্য – তোমার রাগও অনিত্য। মিথ্যাকে মিথ্যা দ্বারা বধ করা সেটাও মিথ্যা।”

মহিমাচরণ চুপ করিয়া রহিলেন।

[কর্মযোগ না ভক্তিযোগ – সৎগুরু কে? ]

মহিমাচরণের সংসারে অনেক কাজ। আর তিনি একটি নূতন স্কুল করিয়াছেন, – পরোপকারের জন্য।

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আবার কথা কহিতেছেন –

শ্রীরামকৃষ্ণ (মহিমার প্রতি) – শম্ভু বললে – আমার ইচ্ছা যে এই টাকাগুলো সৎকর্মে ব্যয় করি, স্কুল ডিস্পেনসারি করে দি, রাস্তাঘাট করে দি। আমি বললাম, নিষ্কামভাবে করতে পার সে ভাল, কিন্তু নিষ্কামকর্ম করা বড় কঠিন, – কোন্‌ দিক দিয়া কামনা এসে পড়ে! আর একটা কথা তোমায় জিজ্ঞাসা করি, যদি ঈশ্বর সাক্ষাৎকার হন, তাহলে তাঁর কাছে তুমি কি কতকগুলি স্কুল, ডিস্পেনসারি, হাসপাতাল এই সব চাইবে?

একজন ভক্ত – মহাশয়! সংসারীদের উপায় কি?

শ্রীরামকৃষ্ণ – সাধুসঙ্গ; ঈশ্বরীয় কথা শোনা।

“সংসারীরা মাতাল হয়ে আছে, কামিনী-কাঞ্চনে মত্ত। মাতালকে চালিনির জল একটু একটু খাওয়াতে খাওয়াতে ক্রমে ক্রমে হুঁশ হয়।

“আর সৎগুরুর কাছে উপদেশ লতে হয়। সৎগুরুর লক্ষণ আছে। যে কাশী গিয়েছে আর দেখেছে, তার কাছেই কাশীর কথা শুনতে হয়। শুধু পণ্ডিত হলে হয় না। যার সংসার অনিত্য বলে বোধ নাই, সে পণ্ডিতের কাছে উপদেশ লওয়া উচিত নয়। পণ্ডিতের বিবেক-বৈরাগ্য থাকলে তবে উপদেশ দিতে পারে।

“সামাধ্যয়ী বলেছিল, ঈশ্বর নীরস। যিনি রসস্বরূপ, তাঁকে নীরস বলেছিল! যেমন একজন বলেছিল, আমার মামার বাটীতে একগোয়াল ঘোড়া আছে!” (সকলের হাস্য)

[অজ্ঞান – আমি ও আমার – জ্ঞান ও বিজ্ঞান ]

“সংসারীরা মাতাল হয়ে আছে। সর্বদাই মনে করে, আমিই এই সব করছি। আর গৃহ, পরিবার এ-সব আমার। দাঁত ছরকুটে বলে। ‘এদের (মাগছেলেদের) কি হবে! আমি না থাকলে এদের কি করে চলবে? আমার স্ত্রী, পরিবার কে দেখবে?’ রাখাল বললে, আমার স্ত্রীর কি হবে!”

হরমোহন – রাখাল এই কথা বললে?

শ্রীরামকৃষ্ণ – তা বলবে না তো কি করবে? যার আছে জ্ঞান তার আছে অজ্ঞান। লক্ষ্মণ রামকে বললেন, রাম একি আশ্চর্য? সাক্ষাৎ বশিষ্ঠদেব – তাঁর পুত্রশোক হল? রাম বললেন, ভাই, যার আছে জ্ঞান, তার আছে অজ্ঞান। ভাই! জ্ঞান-অজ্ঞানের পারে যাও।

“যেমন কারু পায়ে একটি কাঁটা ফুটেছে, সে ওই কাঁটাটি তোলবার জন্য আর একটি কাঁটা যোগাড় করে আনে। তারপর কাঁটা দিয়া কাঁটাটি তুলবার পর, দুটি কাঁটাই ফেলে দেয়! অজ্ঞান-কাঁটা তুলবার জন্য জ্ঞান-কাঁটা আহরণ করতে হয়। তারপর জ্ঞান-অজ্ঞান দুই কাঁটা ফেলে দিলে হয় বিজ্ঞান। ঈশ্বর আছেন এইটি বোধে বোধ করে তাঁকে বিশেষরূপে জানতে হয়, তাঁর সঙ্গে বিশেষরূপে আলাপ করতে হয়, – এরই নাম বিজ্ঞান। তাই ঠাকুর (শ্রীকৃষ্ণ) অর্জুনকে বলেছিলেন – তুমি ত্রিগুণাতীত হও।

“এই বিজ্ঞান লাভ করবার জন্য বিদ্যামায়া আশ্রয় করতে হয়। ঈশ্বর সত্য, জগৎ অনিত্য, এই বিচার, – অর্থাৎ বিবেক-বৈরাগ্য। আবার তাঁর নামগুণকীর্তন, ধ্যান, সাধুসঙ্গ, প্রার্থনা – এ-সব বিদ্যামায়ার ভিতর। বিদ্যামায়া যেন ছাদে উঠবার শেষ কয় পইঠা, আর-একধাপ উঠলেই ছাদ। ছাদে উঠা অর্থাৎ ঈশ্বরলাভ।”

[সংসারী লোক ও কামিনী-কাঞ্চনত্যাগী ছোকরা ]

“বিষয়ীরা মাতাল হয়ে আছে, – কামিনী-কাঞ্চনে মত্ত, হুঁশ নাই, – তাইতো ছোকরাদের ভালবাসি। তাদের ভিতর কামিনী-কাঞ্চন এখনও ঢোকে নাই। আধার ভাল, ঈশ্বরের কাজে আসতে পারে।

“সংসারীদের ভিতর কাঁটা বাছতে বাছতে সব যায়, – মাছ পাওয়া যায় না! “যেমন শিলে খেকো আম – গঙ্গাজল দিয়ে লতে হয়। ঠাকুর সেবায় প্রায় দেওয়া হয় না; ব্রহ্মজ্ঞান করে তবে কাটতে হয়, – অর্থাৎ তিনি সব হয়েছেন এইরূপ মনকে বুঝিয়ে।”

শ্রীযুক্ত অশ্বিনীকুমার দত্ত ও শ্রীযুক্ত বিহারী ভাদুড়ীর পুত্রের সঙ্গে একটি থিয়জফিস্ট্‌ আসিয়াছেন। মুখুজ্জেরা আসিয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন। উঠানে সংকীর্তনের আয়োজন হইয়াছে। যাই খোল বাজিল ঠাকুর ঘর ত্যাগ করিয়া উঠানে গিয়া বসিলেন।

ভবনাথ অশ্বিনীর পরিচয় দিতেছেন। ঠাকুর মাস্টারকে অশ্বিণীকে দেখাইয়া দিলেন। দুইজনে কথা কহিতেছেন, নরেন্দ্র উঠানে আসিলেন। ঠাকুর অশ্বিনীকে বলিতেছেন, “এরই নাম নরেন্দ্র।”

…………………………………
১ অন্তর্বহির্যদি হরিস্তপসা ততঃ কিম্‌, নান্তর্বহির্যদি হরিস্তপসা ততঃ কিম্‌ ৷৷
আরাধিতো যদি হরিস্তপসা ততঃ কিম্‌, নারাধিতো যদি হরিস্তপসা ততঃ কিম্‌ ৷৷
বিরম বিরম ব্রহ্মণ্‌ কিং তপস্যসু বৎস, ব্রজ ব্রজ দ্বিজ শীঘ্রং শঙ্করং ঞ্চানসিন্ধুম্‌ ৷৷
লভ লভ হরিভক্তিং বৈষ্ণবোক্তাং সুপক্কাম্‌, ভব নিগড়নিবন্ধচ্ছেদনীং কর্ত্তরীঞ্চ ৷৷

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!