ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

স্ত্রীলোক লইয়া সাধন – শ্রীরামকৃষ্ণের পুনঃ পুনঃ নিষেধ

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ প্রকৃতিভাবের কথা বলিতেছেন। শ্রীযুক্ত প্রিয় মুখুজ্জে, মাস্টার, আরও কয়েকটি ভক্ত বসিয়া আছেন। এমন সময় ঠাকুরদের বাড়ির একটি শিক্ষক ঠাকুরদের কয়েকটি ছেলে সঙ্গে করিয়া উপস্থিত হইলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) – শ্রীকৃষ্ণের শিরে ময়ূর পাখা, ময়ূর পাখাতে যোনি চিহ্ন আছে – অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ প্রকৃতিকে মাথায় রেখেছেন।

“কৃষ্ণ রাসমণ্ডলে গেলেন। কিন্তু সেখানে নিজে প্রকৃতি হলেন। তাই দেখ রাসমণ্ডলে তাঁর মেয়ের বেশ। নিজে প্রকৃতিভাব না হলে প্রকৃতির সঙ্গের অধিকারী হয় না। প্রকৃতিভাব হলে তবে রাস, তবে সম্ভোগ। কিন্তু সাধকের অবস্থায় খুব সাবধান হতে হয়! তখন মেয়ে মানুষ থেকে অনেক অন্তরে থাকতে হয়। এমন কি ভক্তিমতী হলেও বেশি কাছে যেতে নাই। ছাদে উঠবার সময় হেলতে দুলতে নাই। হেললে দুললে পড়বার খুব সম্ভাবনা। যারা দুর্বল, তাদের ধরে ধরে উঠতে হয়।

“সিদ্ধ অবস্থায় আলাদা কথা। ভগবানকে দর্শনের পর বেশি ভয় নাই; অনেকটা নির্ভয়। ছাদে একবার উঠতে পাল্লে হয়। উঠবার পর ছাদে নাচাও যায়। সিঁড়িতে কিন্তু নাচা যায় না। আবার দেখ – যা ত্যাগ করে গিছি, ছাদে উঠবার পর তা আর ত্যাগ করতে হয় না। ছাদও ইট, চুন, সুড়কির তৈয়ারী, আবার সিঁড়িও সেই জিনিসে তৈয়ারী। যে মেয়েমানুষের কাছে এত সাবধান হতে হয়, ভগবানদর্শনের পর বোধ হবে, সেই মেয়েমানুষ সাক্ষাৎ ভগবতী। তখন তাঁকে মাতৃজ্ঞানে পূজা করবে। আর তত ভয় নাই।

“কথাটা এই, বুড়ী ছুঁয়ে যা ইচ্ছা কর।”

ধ্যানযোগ ও শ্রীরামকৃষ্ণ – অন্তর্মুখ ও বহির্মুখ

“বহির্মুখ অবস্থায় স্থূল দেখে। অন্নময় কোষে মন থাকে। তারপর সূক্ষ্ম শরীর। লিঙ্গ শরীর। মনোময় ও বিজ্ঞানময় কোষে মন থাকে। তারপর কারণ শরীর; যখন মন কারণ শরীরে আসে, তখন আনন্দ, – আনন্দময় কোষে মন থাকে। এইটি চৈতন্যদেবের অর্ধবাহ্যদশা।

“তারপর মন লীন হয়ে যায়। মনের নাশ হয়। মহাকারণে নাশ হয়। মনের নাশ হলে আর খবর নাই। এইটি চৈতন্যদেবের অন্তর্দশা।

“অন্তর্মুখ অবস্থা কিরকম জানো? দয়ানন্দ বলেছিল, ‘অন্দরে এসো, কপাট বন্ধ করে! অন্দর বাড়িতে যে সে যেতে পারে না।’

“আমি দীপশিখাকে নিয়ে আরোপ করতুম। লালচে রঙটাকে বলতুম স্থূল, তার ভিতর সাদা সাদা ভাগটাকে বলতুম সূক্ষ্ম, সব ভিতরে কালো খড়কের মতো ভাগটাকে বলতুম কারণশরীর।

“ধ্যান যে ঠিক হচ্ছে, তার লক্ষণ আছে। একটি লক্ষণ – মাথায় পাখি বসবে জড় মনে করে।”

পূর্বকথা – কেশবকে প্রথম দর্শন ১৮৬৪, ধ্যানস্থ – চক্ষু চেয়েও ধ্যান হয়

“কেশব সেনকে প্রথম দেখি আদি সমাজে। তাকের (বেদীর) উপর কজন বসেছে, কেশব মাঝখানে বসেছে। দেখলাম যেন কাষ্ঠবৎ! সেজোবাবুকে বললুম দেখ ওর ফাতনায় মাছে খেয়েছে! ওই ধ্যানটুকু ছিল বলে ঈশ্বরের ইচ্ছায় যেগুনো মনে করেছিল (মান-টানগুলো) হয়ে গেল।

ঠাকুরদের শিক্ষক – আজ্ঞে, ওটি বেশ জানি। (হাস্য)

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – হ্যাঁগো, দাঁতের ব্যামো যদি থাকে, সব কর্ম করছে, কিন্তু দরদের দিকে মনটা আছে। তাহলে ধ্যান চোখ চেয়েও হয়, কথা কইতে কইতেও হয়।

শিক্ষক – পতিতপাবন নাম তাঁর আছে, তাই ভরসা। তিনি দয়াময়।

পূর্বকথা – শিখরা ও শ্রীযুক্ত কৃষ্ণদাসের সহিত কথা

শ্রীরামকৃষ্ণ – শিখরাও বলেছিল, তিনি দয়াময়। আমি বললুম, তিনি কেমন করে দয়াময়? তা তারা বললে, কেন মহারাজ! তিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন, আমাদের জন্য এত জিনিস তৈয়ারী করেছেন, আমাদের পদে পদে বিপদ থেকে রক্ষা করছেন। তা আমি বললুম, তিনি আমাদের জন্ম দিয়ে দেখছেন, খাওয়াচ্ছেন, তা কি এত বাহাদুরি? তোমার যদি ছেলে হয়, তাকে কি আবার বামুনপাড়ার লোক এসে মানুষ করবে?

শিক্ষক – আজ্ঞা, কারু ফস্‌ করে হয়, কারু হয় না, এর মানে কি?

লালাবাবু ও রানী ভবানীর বৈরাগ্য – সংস্কার থাকলে সত্ত্বগুণ

শ্রীরামকৃষ্ণ – কি জান? অনেকটা পূর্বজন্মের সংস্কারেতে হয়। লোকে মনে করে হঠাৎ হচ্ছে।

“একজন সকালে একপাত্র মদ খেয়েছিল, তাতেই বেজায় মাতাল, ঢলাঢলি আরম্ভ করলে – লোকে অবাক্‌। একপাত্রে এত মাতাল কি করে হল? একজন বললে, ওরে, সমস্ত রাত্রি মদ খেয়েছে।

“হনুমান সোনার লঙ্কা দগ্ধ করলে। লোকে অবাক্‌ একটা বানর এসে সব পুড়িয়ে দিলে। কিন্তু আবার বলেছে, আদত কথা এই – সীতার নিঃশ্বাসে আর রামের কোপে পুড়েছিল।

“আর দেখ লালাবাবু১ – এত ঐশ্বর্য; পূর্বজন্মের সংস্কার না থাকলে ফস্‌ করে কি বৈরাগ্য হয়? আর রানী ভবানী – মেয়েমানুষ হয়ে এত জ্ঞান ভক্তি!”

কৃষ্ণদাসের রজোগুণ – তাই জগতের উপকার

“শেষ জন্মে সত্ত্বগুণ থাকে, ভগবানে মন হয়; তাঁর জন্য মন ব্যাকুল হয়, নানা বিষয়কর্ম থেকে মন সরে আসে।

“কৃষ্ণদাস পাল এসেছিল। দেখলাম রজোগুণ! তবে হিন্দু, জুতো বাইরে রাখলে। একটু কথা কয় দেখলুম, ভিতরে কিছুই নাই। জিজ্ঞাসা করলুম, মানুষের কি কর্তব্য? তা বলে, ‘জগতের উপকার করব।’ আমি বললুম, হ্যাঁগা তুমি কে? আর কি উপকার করবে? আর জগৎ কতটুকু গা, যে তুমি উপকার করবে?”

নারান আসিয়াছেন। ঠাকুরের ভারী আনন্দ। নারায়ণকে ছোট খাটটির উপর পাশে বসাইলেন। গায়ে হাত দিয়ে আদর করিতে লাগিলেন। মিষ্টান্ন খাইতে দিলেন। আর সস্নেহে বললেন, জল খাবি? নারাণ মাস্টারের স্কুলে পড়েন। ঠাকুরের কাছে আসেন বলিয়া বাড়িতে মার খান। ঠাকুর সস্নেহে একটু হাসিতে হাসিতে নারায়ণকে বলছেন, তুই একটা চামড়ার জামা কর, তাহলে মারলে লাগবে না।

ঠাকুর হরিশকে বললেন, তামাক খাব।

স্ত্রীলোক লয়ে সাধন ঠাকুরের বারবার নিষেধ – ঘোষপাড়ার মত

আবার নারায়ণকে সম্বোধন করে বলছেন, “হরিপদের সেই পাতানো মা এসেছিল। আমি হরিপদকে খুব সাবধান করে দিয়েছি। ওদের ঘোষপাড়ার মত। আমি তাকে জিজ্ঞাসা কল্লুম, তোমার কেউ আশ্রয় আছে? তা বলে, হাঁ – অমুক চক্রবর্তী।”

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) – আহা নীলকণ্ঠ সেদিন এসেছিল। এমন ভাব! আর-একদিন আসবে বলে গেছে। গান শুনাবে। আজ ওদিকে নাচ হচ্ছে, দেখো গে যাও না। (রামলালকে) তেল নাই যে, (ভাঁড় দৃষ্টে) কই তেল ভাঁড়ে তো নাই।

……………………………….
১ লালাবাবু, বাঙালী জাতির গৌরব, পাইকপাড়ার কৃষ্ণচন্দ্র সিংহ – সাত লক্ষ বার্ষিক আয়ের সম্পত্তি ত্যাগ। মথুরাবাস – ত্রিশ বৎসর বয়সে। চল্লিশে মাধুকরী, ভিক্ষাজীবী। বিয়াল্লিশে ৺প্রাপ্তি। পত্নী “রানী কাত্যায়নী” নিঃসন্তান। গুরু কৃষ্ণদাস বাবাজী, ভক্তমালের (বাঙলা পদ্যে) অনুবাদক।

-১৮৮৪, ১১ই অক্টোবর-

…………….
রামকৃষ্ণ কথামৃত : দ্বাত্রিংশ অধ্যায় : সপ্তম পরিচ্ছেদ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!