ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

১৮৮৫, ১৪ই জুলাই
শ্রীশ্রীরথযাত্রা দিবসে বলরাম-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে

আজ শ্রীশ্রীরথযাত্রা। মঙ্গলবার (৩১শে আষাঢ়, ১২৯২, শুক্লা দ্বিতীয়া, ১৪ই জুলাই, ১৮৮৫)। অতি প্রতূষ্যে ঠাকুর উঠিয়া একাকী নৃত্য করিতেছেন ও মধুর কণ্ঠে নাম করিতেছেন।

মাস্টার আসিয়া প্রণাম করিলেন। ক্রমে ভক্তেরা আসিয়া প্রণাম করিয়া ঠাকুরের কাছে উপবিষ্ট হইলেন। ঠাকুর পূর্ণর জন্য বড় ব্যাকুল। মাস্টারকে দেখিয়া তাঁরই কথা কহিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – তুমি পূর্ণকে দেখে কিছু উপদেশ দিতে?

মাস্টার – আজ্ঞা, চৈতন্যচরিত পড়তে বলেছিলাম, – তা সে সব কথা বেশ বলতে পারে। আর আপনি বলেছিলেন, সত্য ধরে রাখতে, সেই কথাও বলেছিলাম।

শ্রীরামকৃষ্ণ – আচ্ছা ‘ইনি অবতার’ এ-সব কথা জিজ্ঞাসা করলে কি বলত।

মাস্টার – আমি বলেছিলাম, চৈতন্যদেবের মতো একজনকে দেখবে তো চল।

শ্রীরামকৃষ্ণ – আর কিছু?

মাস্টার – আপনার সেই কথা। ডোবাতে হাতি নামলে জল তোলপাড় হয়ে যায়, – ক্ষুদ্র আধার হলেই ভাব উপছে পড়ে।

“মাছ ছাড়ার কথায় বলেছিলাম, কেন অমন করলে। হইচই হবে।”

শ্রীরামকৃষ্ণ – তাই ভাল। নিজের ভাব ভিতরে ভিতরে থাকাই ভাল।

[ভূমিকম্প ও শ্রীরামকৃষ্ণ – জ্ঞানীর দেহ ও দেহনাশ সমান ]

প্রায় সাড়ে ছয়টা বাজে। বলরামের বাটী হইতে মাস্টার গঙ্গাস্নানে যাইতেছেন। পথে হঠাৎ ভূমিকম্প। তিনি তৎক্ষণাৎ ঠাকুরের ঘরে ফিরিয়া আসিলেন। ঠাকুর বৈঠকখানা ঘরে দাঁড়াইয়া আছেন। ভক্তেরাও দাঁড়াইয়া আছেন। ভূমিকম্পের কথা হইতেছে। কম্প কিছু বেশি হইয়াছিল। ভক্তেরা অনেকে ভয় পাইয়াছেন।

মাস্টার – আমাদের সব নিচে যাওয়া উচিত ছিল।

[পূর্বকথা – আশ্বিনের ঝড়ে শ্রীরামকৃষ্ণ – ৫ই অক্টোবর, ১৮৬৪ খ্রী: ]

শ্রীরামকৃষ্ণ – যে ঘরে বাস, তারই এই দশা! এতে আবার লোকে অহংকার। (মাস্টারকে) তোমার আশ্বিনের ঝড় মনে আছে?

মাস্টার – আজ্ঞা, হাঁ। তখন খুব কম বয়স – নয়-দশ বছর বয়স – একঘরে একলা ঠাকুরদের ডাকছিলাম!

মাস্টার বিস্মিত হইয়া ভাবিতেছেন – ঠাকুর হঠাৎ আশ্বিনের ঝড়ের দিনের কথা জিজ্ঞাসা করিলেন কেন? আমি যে ব্যাকুল হয়ে কেঁদে একাকী একঘরে বসে ঈশ্বরকে প্রার্থনা করেছিলাম, ঠাকুর কি সব জানেন ও আমাকে মনে করাইয়া দিতেছেন? উনি কি জন্মাবধি আমাকে গুরুরূপে রক্ষা করিতেছেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ – দক্ষিণেশ্বরে অনেক বেলায় – তবে কি কি রান্না হল। গাছ সব উলটে পড়েছিল! দেখ যে ঘরে বাস, তারই এ-দশা!

“তবে পূর্ণজ্ঞান হলে মরা মারা একবোধ হয়। মলেও কিছু মরে না – মেরে ফেল্লেও কিছু মরে না১ যাঁরই লীলা তাঁরই নিত্য। সেই একরূপে নিত্য, একরুপে লীলা। লীলারূপ ভেঙে গেলেও নিত্য আছেই। জল স্থির থাকলেও জল, – হেললে দুললেও জল। হেলা দোলা থেমে গেলেও সেই জল।”

ঠাকুর বৈঠকখানা ঘরে ভক্তসঙ্গে আবার বসিয়াছেন। মহেন্দ্র মুখুজ্জে, হরিবাবু, ছোট নরেন ও অন্যান্য অনেকগুলি ছোকরা ভক্ত বসিয়া আছেন। হরিবাবু একলা একলা থাকেন ও বেদান্তচর্চা করেন। বয়স ২৩।২৮ হবে। বিবাহ করেন নাই। ঠাকুর তাহাকে বড় ভালবাসেন। সর্বদা তাঁহার কাছে যাইতে বলেন। তিনি একলা একলা থাকতে চান বলিয়া হরিবাবু ঠাকুরের কাছে অধিক যাইতে পারেন না।

শ্রীরামকৃষ্ণ (হরিবাবুকে) – কি গো, তুমি অনেকদিন আস নাই।

[হরিবাবুকে উপদেশ – অদ্বৈতবাদ ও বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ – বিজ্ঞান ]

“তিনি একরূপে নিত্য, একরূপে লীলা। বেদান্তে কি আছে? – ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা। কিন্তু যতক্ষণ ‘ভক্তের আমি’ রেখে দিয়েছে, ততক্ষণ লীলাও সত্য। ‘আমি’ যখন তিনি পুছে ফেলবেন, তখন যা আছে তাই আছে। মুখে বলা যায় না। যতক্ষণ ‘আমি’ রেখে দিয়েছেন, ততক্ষণ সবই নিতে হবে। কলাগাছের খোল ছাড়িয়া ছাড়িয়া মাজ পাওয়া যায়। কিন্তু খোল থাকলেই মাজ আছে। মাজ থাকলেই খোল আছে। খোলেরই মাজ, মাজেরই খোল। নিত্য বললেই লীলা আছে বুঝায়। লীলা বললেই নিত্য আছে বুঝায়।

“তিনি জীবজগৎ হয়েছেন, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব হয়েছেন। যখন নিষ্ক্রিয় তখন তাঁহাকে ব্রহ্ম বলি। যখন সৃষ্টি করছেন, পালন করছেন, সংহার করছেন, – তখন তাঁকে শক্তি বলি। ব্রহ্ম আর শক্তি অভেদ, জল স্থির থাকলেও জল, হেললে দুললেও জল।

“আমিবোধ যায় না। যতক্ষণ ‘আমি’বোধ থাকে, ততক্ষণ জীবজগৎ মিথ্যা বলবার জো নাই! বেলের খোলটা আর বিচিগুলো ফেলে দিলে সমস্ত বেলটার ওজন পাওয়া যায় না।

“যে ইট, চুন, সুরকি থেকে ছাদ, সেই ইট, চুন, সুরকি থেকেই সিঁড়ি। যিনি ব্রহ্ম, তাঁর সত্তাতেই জীবজগৎ।

“ভক্তেরা – বিজ্ঞানীরা – নিরাকার-সাকার দুইই লয়, অরূপ-রূপ দুইই গ্রহণ করে। ভক্তি হিমে ওই জলেরই খানিকটা বরফ হয়ে যায়। আবার জ্ঞান-সূর্য উদয় হলে ওই বরফ গলে আবার যেমন জন তেমনি হয়।”

[বিচারান্তে মনের নাশ ও ব্রহ্মজ্ঞান ]

“যতক্ষণ মনের দ্বারা বিচার ততক্ষণ নিত্যেতে পৌঁছানো যায় না। মনের দ্বারা বিচার করতে গেলেই জগৎকে ছাড়বার জো নাই, – রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ, শব্দ, – ইন্দ্রিয়ের এই সকল বিষয়কে ছাড়বার জো নাই। বিচার বন্ধ হলে তবে ব্রহ্মজ্ঞান। এ মনের দ্বারা আত্মাকে জানা যায় না। আত্মার দ্বারাই আত্মাকে জানা যায়। শুদ্ধমন, শুদ্ধবুদ্ধি, শুদ্ধ-আত্মা, একই।

“দেখ না, একটা জিনিস দেখতেই কতকগুলো দরকার – চক্ষু দরকার, আলো দরকার, আবার মনের দরকার। এই তিনটার মধ্যে একটা বাদ দিলে তার দর্শন হয় না। এই মনের কাজ যতক্ষণ চলছে, ততক্ষণ কেমন করে বলবে যে, জগৎ নাই, কি আমি নাই?

“মনের নাশ হলে, সঙ্কল্প-বিকল্প চলে গেলে, সমাধি হয়, ব্রহ্মজ্ঞান হয়। কিন্তু সা রে গা মা পা ধা নি – নি-তে অনেকক্ষণ থাকা যায় না।”

[ছোট নরেনকে উপদেশ – ঈশ্বরদর্শনের পর তাঁর সঙ্গে আলাপ ]

ছোট নরেনের দিকে তাকাইয়া ঠাকুর বলিতেছেন, “শুধু ঈশ্বর আছেন, বোধে বোধ করলে কি হবে? ঈশ্বরদর্শন হলেই যে সব হয়ে গেল, তা নয়।

“তাঁকে ঘরে আনতে হয় – আলাপ করতে হয়।

“কেউ দুধ শুনেছে, কেউ দুধ দেখেছে, কেউ দুধ খেয়েছে।

“রাজাকে কেউ কেউ দেখেছে। কিন্তু দু-একজন বাড়িতে আনতে পারে, আর খাওয়াতে-দাওয়াতে পারে।”

মাস্টার গঙ্গাস্নান করিতে গেলেন।

…………………………..
১ … ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে। … নায়ং হন্তি ন হন্যতে। [গীতা, ২।১৯, ২০]

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!