ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

১৮৮৪, ১৪ই ডিসেম্বর
ভক্তসঙ্গে ঈশ্বরকথাপ্রসঙ্গে
[ঈশ্বরদর্শনের লক্ষণ ও উপায় – তিনপ্রকার ভক্ত ]

রঙ্গালয়ে গিরিশ যে ঘরে বসেন সেইখানে অভিনয়ান্তে ঠাকুরকে লইয়া গেলেন। গিরিশ বলিলেন, “বিবাহ বিভ্রাট” কি শুনবেন? ঠাকুর বলিলেন, “না, প্রহ্লাদ চরিত্রের পর ও-সব কি? আমি তাই গোপাল উড়ের দলকে বলেছিলাম, ‘তোমরা শেষে কিছু ঈশ্বরীয় কথা বলো।’ বেশ ঈশ্বরের কথা হচ্ছিল আবার বিবাহ বিভ্রাট – সংসারের কথা। ‘যা ছিলুম তাই হলুম।’ আবার সেই আগেকার ভাব এসে পড়ে।” ঠাকুর গিরিশাদির সহিত ঈশ্বরীয় কথা কহিতেছেন। গিরিশ বলিতেছেন, মহাশয়, কিরকম দেখলেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ – দেখলাম সাক্ষাৎ তিনিই সব হয়েছেন। যারা সেজেছে তাদের দেখলাম সাক্ষাৎ আনন্দময়ী মা! যারা গোলোকে রাখাল সেজেছে তাদের দেখলাম সাক্ষাৎ নারায়ণ। তিনিই সব হয়েছেন। তবে ঠিক ঈশ্বরদর্শন হচ্ছে কি না তার লক্ষণ আছে। একটি লক্ষণ আনন্দ। সঙ্কোচ থাকে না। যেমন সমুদ্র – উপরে হিল্লোল, কল্লোল – নিচে গভীর জল। যার ভগবানদর্শন হয়েছে সে কখনও পাগলের ন্যায়, কখনও পিশাচের ন্যায় – শুচি-অশুচি ভেদ জ্ঞান নেই। কখন বা জড়ের ন্যায়; কেননা অন্তরে-বাহিরে ঈশ্বরকে দর্শন করে অবাক্‌ হয়ে থাকে। কখন বালকের ন্যায়। আঁট নাই, বালক যেমন কাপড় বগলে করে বেড়ায়। এই অবস্থায় কখন বাল্যভাব, কখন পৌগণ্ডভাব – ফষ্টিনাষ্টি করে, কখন যুবার ভাব – যেমন কর্ম করে, লোকশিক্ষা দেয়, তখন সিংহতুল্য।

“জীবের অহংকার আছে বলে ঈশ্বরকে দেখতে পায় না। মেঘ উঠলে আর সূর্য দেখা যায় না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে না বলে কি সূর্য নাই? সূর্য ঠিক আছে।

“তবে ‘বালকের আমি’ এতে দোষ নাই, বরং উপকার আছে। শাক খেলে অসুখ হয়। কিন্তু হিঞ্চে শাক খেলে উপকার হয়। হিঞ্চে শাক শাকের মধ্যে নয়। মিছরি মিষ্টির মধ্যে নয়। অন্য মিষ্টিতে অসুখ করে, কিন্তু মিছরিতে কফ-দোষ করে না।

“তাই কেশব সেনকে বলেছিলাম, আর বেশি তোমায় বললে দলটল থাকবে না! কেশব ভয় পেয়ে গেল। আমি তখন বললাম, ‘বালকের আমি’ ‘দাস আমি’ এতে দোষ নাই।

“যিনি ঈশ্বরদর্শন করেছেন তিনি দেখেন যে ঈশ্বরই জীবজগৎ হয়ে আছেন। সবই তিনি। এরই নাম উত্তম ভক্ত।”

গিরিশ (সহাস্যে) – সবই তিনি, তবে একটু আমি থাকে – কফ-দোষ করে না।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্য) – হাঁ, ওতে হানি নাই। ও ‘আমি’টুকু সম্ভোগের জন্য। আমি একটি, তুমি একটি হলে আনন্দভোগ করা যায়। সেব্য-সেবকের ভাব।

“আবার মধ্যম থাকের ভক্ত আছে। সে দেখে যে, ঈশ্বর সর্বভূতে অন্তর্যামীরূপে আছেন। অধম থাকের ভক্ত বলে, – ঈশ্বর আছেন, ওই ঈশ্বর – অর্থাৎ আকাশের ওপারে। (সকলের হাস্য)

“গোলোকের রাখাল দেখে আমার কিন্তু বোধ হল, সেই (ঈশ্বরই) সব হয়েছে। যিনি ঈশ্বরদর্শন করেছেন, তাঁর বোধ হয় ঈশ্বরই কর্তা, তিনিই সব করছেন।”

গিরিশ – মহাশয়, আমি কিন্তু ঠিক বুঝেছি, তিনিই সব করছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – আমি বলি, “মা, আমি যন্ত্র, তুমি যন্ত্রী; আমি জড়, তুমি চেতয়িতা; যেমন করাও তেমনি করি, যেমন বলাও তেমনি বলি।” যারা অজ্ঞান তারা বলে, “কতক আমি করছি, কতক তিনি করছেন।”

[কর্মযোগে চিত্তশুদ্ধি হয় – সর্বদা পাপ পাপ কি – অহেতুকী ভক্তি ]

গিরিশ – মহাশয়, আমি আর কি করছি, আর কর্মই বা কেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ – না গো, কর্ম ভাল। জমি পাট করা হলে যা রুইবে, তাই জন্মাবে। তবে কর্ম নিষ্কামভাবে করতে হয়।

“পরমহংস দুই প্রকার। জ্ঞানী পরমহংস আর প্রেমী পরমহংস। যিনি জ্ঞানী তিনি আপ্তসার – ‘আমার হলেই হলঞ্চ। যিনি প্রেমী যেমন শুকদেবাদি, ঈশ্বরকে লাভ করে আবার লোকশিক্ষা দেন। কেউ আম খেয়ে মুখটি পুঁছে ফেলে, কেউ পাঁচজনকে দেয়। কেউ পাতকুয়া খুঁড়বার সময় – ঝুড়ি-কোদাল আনে, খোঁড়া হয়ে গেলে ঝুড়ি-কোদাল ওই পাতকোতেই ফেলে দেয়। কেউ ঝুড়ি-কোদাল রেখে দেয় যদি পাড়ার লোকের কারুর দরকার লাগে। শুকদেবাদি পরের জন্য ঝুড়ি-কোদাল তুলে রেখেছিলেন। (গিরিশের প্রতি) তুমি পরের জন্য রাখবে।”

গিরিশ – আপনি তবে আশীর্বদ করুন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – তুমি মার নামে বিশ্বাস করো, হয়ে যাবে!

গিরিশ – আমি যে পাপী!

শ্রীরামকৃষ্ণ – যে পাপ পাপ সর্বদা করে সে শালাই পাপী হয়ে যায়!

গিরিশ – মহাশয়, আমি যেখানে বসতাম সে মাটি অশুদ্ধ।

শ্রীরামকৃষ্ণ – সে কি! হাজার বছরের অন্ধকার ঘরে যদি আলো আসে, সে কি একটু একটু করে আলো হয়? না, একেবারে দপ্‌ করে আলো হয়?

গিরিশ – আপনি আশীর্বাদ করলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – তোমার যদি আন্তরিক হয়, – আমি কি বলব! আমি খাই-দাই তাঁর নাম করি।

গিরিশ – আন্তরিক নাই, কিন্তু ওইটুকু দিয়ে যাবেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – আমি কি? নারদ, শুকদেব এঁরা হতেন তো –

গিরিশ – নারদাদি তো দেখতে পাচ্চি না। সাক্ষাৎ যা পাচ্চি।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্য) – আচ্ছা, বিশ্বাস!

কিয়ৎক্ষণ সকলে চুপ করিয়া আছেন। আবার কথা হইতেছে।

গিরিশ – একটি সাধ, অহেতুকী ভক্তি।

শ্রীরামকৃষ্ণ – অহেতুকী ভক্তি ঈশ্বরকোটীর হয়। জীবকোটীর হয় না।

সকলে চুপ করিয়াছেন, ঠাকুর আনমনে গান ধরিলেন, দৃষ্টি ঊর্ধ্বদিকে –

শ্যামাধন কি সবাই পায় (কালীধন কি সবাই পায়)
অবোধ মন বোঝে না একি দায়।
শিবেরই অসাধ্য সাধন মনমজানো রাঙা পায়।।
ইন্দ্রাদি সম্পদ সুখ তুচ্ছ হয় যে ভাবে মায়।
সদানন্দ সুখে ভাসে, শ্যামা যদি ফিরে চায়।।
যোগীন্দ্র মুনীন্দ্র ইন্দ্র যে চরণ ধ্যানে না পায়।
নির্গুণে কমলাকান্ত তবু সে চরণ চায়।।

গিরিশ – নির্গুণে কমলাকান্ত তবু সে চরণ চায়!

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!