ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

প্রবৃত্তি না নিবৃত্তি – অধরের কর্ম – বিষয়ীর উপাসনা ও চাকরি

সন্ধ্যা হইল। ফরাশ দক্ষিণের লম্বা বারান্দায় ও পশ্চিমের গোল বারান্দায় আলো জ্বালিয়া দিয়া গেল। ঠাকুরের ঘরে প্রদীপ জ্বালা হইল ও ধুনা দেওয়া হইল। কিয়ৎক্ষণ পরে চাঁদ উঠিলেন। মন্দিরপ্রাঙ্গণ, উদ্যানপথ, গঙ্গাতীর, পঞ্চবটী, বৃক্ষশীর্ষ, জ্যোৎস্নায় হাসিতে লাগিল।

ঠাকুর নিজাসনে বসিয়া আবিষ্ট হইয়া মার নাম ও চিন্তা করিতেছেন।

অধর আসিয়া বসিয়াছেন। ঘরে মাস্টার ও নিরঞ্জনও আছেন। ঠাকুর অধরের সহিত কথা কহিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – কি গো তুমি এখন এলে! কত কীর্তন নাচ হয়ে গেল। শ্যামদাসের কীর্তন – রামের ওস্তাদ। কিন্তু আমার তত ভাল লাগল না, উঠতে ইচ্ছা হল না। ও লোকটার কথা তারপর শুনলাম। গোপীদাসের বদলী বলেছে – আমার মাথায় যত চুল তত উপপত্নী করেছে। (সকলের হাস্য) তোমার কর্ম হল না?

অধর ডেপুটি, তিন শত টাকা বেতন পান। কলিকাতা মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস-চেয়ারম্যান-এর কর্মের জন্য দরখাস্ত করিয়াছিলেন – মাহিনা হাজার টাকা। কর্মের জন্য অধর কলিকাতার অনেক বড় বড় লোকের সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছিলেন।

নিবৃত্তিই ভাল – চাকরির জন্য হীনবুদ্ধি বিষয়ীর উপাসনা

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টার ও নিরঞ্জনের প্রতি) – হাজরা বলেছিল – অধরের কর্ম হবে, তুমি একটু মাকে বল। অধরও বলেছিল। আমি মাকে একটু বলেছিলাম – ‘মা, এ তোমার কাছে আনাগোনা কচ্ছে, যদি হয় তো হোক না।’ কিন্তু সেই সঙ্গে মাকে বলেছিলাম – ‘মা, কি হীনবুদ্ধি! জ্ঞান, ভক্তি না চেয়ে তোমার কাছে এই সব চাচ্ছে!’

(অধরের প্রতি) – “কেন হীনবুদ্ধি লোকগুনোর কাছে অত আনাগোনা করলে? এত দেখলে শুনলে! – সাতকাণ্ড রামায়ণ, সীতা কার ভার্যে! অমুক মল্লিক হীনবুদ্ধি। আমার মাহেশে যাবার কথায় চলতি নৌকা বন্দোবস্ত করেছিল, – আর বাড়িতে গেলেই হৃদুকে বলত – হৃদু, গাড়ি রেখেছ?”

অধর – সংসার করতে গেলে এ-সব না করলে চলে না। আপনি তো বারণ করেন নাই?

উন্মাদের পর মাহিনা সই করণার্থ খাজাঞ্চীর আহ্বান-কথা

শ্রীরামকৃষ্ণ – নিবৃত্তিই ভাল – প্রবৃত্তি ভাল নয়। এই অবস্থার পর আমার মাইনে সই করাতে ডেকেছিল – যেমন সবাই খাজাঞ্চীর কাছে সই করে। আমি বললাম – তা আমি পারব না। আমি তো চাচ্ছি না। তোমাদের ইচ্ছা হয় আর কারুকে দাও।

“এক ঈশ্বরের দাস। আবার কার দাস হব?

“ – মল্লিক, আমার খেতে বেলা হয় বলে, রাঁধবার বামুন ঠিক করে দিছল। একমাস একটাকা দিছল। তখন লজ্জা হল। ডেকে পাঠালেই ছুটতে হত। – আপনি যাই, সে এক।

“হীনবুদ্ধি লোকের উপাসনা। সংসারে এই সব – আরও কত কি?”

পূর্বকথা – উন্মাদের পর ঠাকুরের প্রার্থনা – সন্তোষ – Contentment

“এই অবস্থা যাই হলো, রকম-সকম দেখে অমনি মাকে বললাম – মা, ওইখানেই মোড় ফিরিয়ে দাও! – সুধামুখীর রান্না – আর না, আর না – খেয়ে পায় কান্না!” (সকলের হাস্য)

বাল্য – কামারপুকুরে ঈশ্বর ঘোষাল ডিপুটি দর্শন কথা

“যার কর্ম কচ্ছ, তারই করো। লোকে পঞ্চাশ টাকা একশ টাকা মাইনের জন্য লালায়িত! তুমি তিনশ টাকা পাচ্ছ। ও-দেশে ডিপুটি আমি দেখেছিলাম। ঈশ্বর ঘোষাল। মাথায় তাজ – সব হাড়ে কাঁপে! ছেলেবেলায় দেখেছিলাম। ডিপুটি কি কম গা!

“যার কর্ম কচ্ছ, তারই করো। একজনের চাকরি কল্লেই মন খারাপ হয়ে যায়, আবার পাঁচজনের।”

চাকরির নিন্দা, শম্ভু ও মথুরের আদর – নরেন্দ্র হেডমাস্টার

“একজন স্ত্রীলোক একজন মুছলমানের উপর আসক্ত হয়ে, তার সঙ্গে আলাপ করবার জন্য ডেকেছিল। মুছলমানটি সাধুলোক ছিল, সে বললে – আমি প্রস্রাব করব, আমার বদনা আনতে যাই। স্ত্রীলোকটি বললে – তা এইখানেই হবে, আমি বদনা দিব এখন। সে বললে – তা হবে না। আমি যে বদনার কাছে একবার লজ্জা ত্যাগ করেছি, সেই বদনাই ব্যবহার করব, – আবার নূতন বদনার কাছে নির্লজ্জ হব না। এই বলে সে চলে গেল। মাগীটারও আক্কেল হল। সে বদনার মানে বুঝলে উপপতি।”

নরেন্দ্র পিতৃবিয়োগের পর বড়ই কষ্টে পড়িয়াছেন। মা ও ভাইদের ভরণপোষণের জন্য তিনি কাজকর্ম খুঁজিতেছেন। বিদ্যাসাগরের বউবাজার স্কুলে দিন কতক হেডমাস্টারের কর্ম করিয়াছিলেন।

অধর – আচ্ছা, নরেন্দ্র কর্ম করবে কি না?

শ্রীরামকৃষ্ণ – হাঁ – সে করবে। মা ও ভাইরা আছে।

অধর – আচ্ছা, নরেন্দ্রের পঞ্চাশ টাকায়ও চলে, একশ টাকায়ও চলে। নরেন্দ্র একশ টাকার জন্য চেষ্টা করবে কি না?

শ্রীরামকৃষ্ণ – বিষয়ীরা ধনের আদর করে, মনে করে, এমন জিনিস আর হবে না।

শম্ভু বললে – ‘এই সমস্ত বিষয় তাঁর পাদপদ্মে দিয়ে যাব, এইটি ইচ্ছা’ তিনি কি বিষয় চান? তিনি চান ভক্তি, বিবেক, বৈরাগ্য।

“গয়না চুরির সময় সেজোবাবু বললে – ‘ও ঠাকুর! তুমি গয়না রক্ষা করতে পারলে না? হংসেশ্বরী কেমন রক্ষা করেছিল!”

সন্ন্যাসীর কঠিন নিয়ম – মথুরের তালুক লিখে দিবার পরামর্শ

“একখানা তালুক আমার নামে লিখে দেবে (সেজোবাবু) বলেছিল। আমি কালীঘর থেকে শুনলাম। সেজোবাবু আর হৃদে একসঙ্গে পরামর্শ কচ্ছিল। আমি এসে সেজোবাবুকে বললাম, – দেখো, অমন বুদ্ধি করো না! – এতে আমার ভারী হানি হবে!”

অধর – যা বলেছেন, সৃষ্টির পর থেকে ছটি-সাতটি হদ্দ ওরূপ হয়েছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ – কেন, ত্যাগী আছে বইকি? ঐশ্বর্য ত্যাগ করলেই লোকে জানতে পারে। এমনি আছে – লোকে জানে না। পশ্চিমে নাই?

অধর – কলকাতার মধ্যে একটি জানি – দেবেন্দ্র ঠাকুর।

শ্রীরামকৃষ্ণ – কি বল! ও যা ভোগ করেছে, অমন কে করেছে! – যখন সেজোবাবু সঙ্গে ওর বাড়িতে গেলাম, দেখলাম, ছোট ছোট ছেলে অনেক – ডাক্তার এসেছে, ঔষধ লিখে দিচ্ছে। যার আট ছেলে আবার মেয়ে, সে ঈশ্বরচিন্তা করবে না তো কে করবে, এত ঐশ্বর্য ভোগ করার পর যদি ঈশ্বরচিন্তা না করত, লোকে বলত ধিক্‌!

নিরঞ্জন – দ্বারকানাথ ঠাকুরের ধার উনি সব শোধ করেছিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – রেখে দে ও-সব কথা! আর জ্বালাস নে! ক্ষমতা থেকেও যে বাপের ধার শোধ করে না, সে কি আর মানুষ?

“তবে সংসারীরা একেবারে ডুবে থাকে, তাদের তুলনায় খুব ভাল – তাদের শিক্ষা হবে।

“ঠিক ঠিক ত্যাগীভক্ত আর সংসারীভক্ত অনেক তফাত। ঠিক ঠিক সন্ন্যাসী – ঠিক ঠিক ত্যাগীভক্ত – মৌমাছির মতো। মৌমাছি ফুল বই আর কিছুতে বসবে না। মধুপান বই আর কিছু পান করবে না। সংসারীভক্ত অন্য মাছির মতো, সন্দেশেও বসছে, আবার পচা ঘায়েও বসছে। বেশ ঈশ্বরের ভাবেতে রয়েছে, আবার কামিনী-কাঞ্চন লয়ে মত্ত হয়।

“ঠিক ঠিক ত্যাগীভক্ত চাতকের মতো। চাতক স্বাতী নক্ষত্রের মেঘের জল বই আর কিছু খাবে না! সাত সমুদ্র নদী ভরপুর! সে অন্য জল খাবে না! কামিনী-কাঞ্চন স্পর্শ করবে না! কামিনী-কাঞ্চন কাছে রাখবে না, পাছে আসক্তি হয়।”

-১৮৮৪, ৭ই সেপ্টেম্বর-

………………..
রামকৃষ্ণ কথামৃত : পঞ্চবিংশ অধ্যায় : চতুর্থ পরিচ্ছেদ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!