ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

নরেন্দ্রাদির শিক্ষা – বেদ-বেদান্তে কেবল আভাস

নরেন্দ্র গান গাহিতেছেন।

গান – সুন্দর তোমার নাম দীনশরণ হে।
বহিছে অমৃতধার, জুড়ায় শ্রবণ ও প্রাণরমণ হে ৷৷
গভীর বিষাদরাশি নিমেষে বিনাশে যখনি তব নামসুধা শ্রবণে পরশে।
হৃদয় মধুময় তব নামগানে, হয় হে হৃদয়নাথ চিদানন্দ ঘন হে ৷৷

নরেন্দ্র যেই গাহিলেন – “হৃদয় মধুময় তব নামগানে”, ঠাকুর অমনি সমাধিস্থ। সমাধির প্রারম্ভে হস্তের অঙ্গুলি, বিশেষতঃ বৃদ্ধাঙ্গুলি, স্পন্দিত হইতেছে। কোন্নগরের ভক্তেরা ঠাকুরের সমাধি কখন দেখেন নাই। ঠাকুর চুপ করিলেন দেখিয়া তাঁহারা গাত্রোত্থান করিতেছেন।

ভবনাথ – আপনারা বসুন না। এঁর সমাধি অবস্থা।

কোন্নগরের ভক্তেরা আবার আসন গ্রহণ করিলেন। নরেন্দ্র গাহিতেছেন:

দিবানিশি করিয়া যতন হৃদয়েতে র’চেছি আসন,
জগৎপতি হে কৃপা করি, সেথা কি করিবে আগমন।

ঠাকুর ভাবাবেশে নিচে নামিয়া মেঝেতে নরেন্দ্রের কাছে বসিলেন।

চিদাকাশে হল পূর্ণ প্রেমচন্দ্রোদয় হে।
উথলিল প্রেমসিন্ধু কি আনন্দময় হে ৷৷
জয় দয়াময়! জয় দয়াময়! জয় দয়াময়!

‘জয় দয়াময়’ এই নাম শুনিয়া ঠাকুর দণ্ডায়মান, আবার সমাধিস্থ!

অনেকক্ষণ পরে কিঞ্চিৎ প্রকৃতিস্থ হইয়া আবার মেঝেতে মাদুরের উপর বসিলেন। নরেন্দ্র গান সমাপ্ত করিয়াছেন। তানপুরা যথাস্থানে রাখা হইয়াছে। ঠাকুরের এখনও ভাবাবেশ রহিয়াছে। ভাবাবস্থাতেই বলিতেছেন, “এ কি বল দেখি মা, মাখন তুলে কাছে ধরো! পুকুরে চার ফেলবে না – ছিপ নিয়ে বসে থাকবে না – মাছ ধরে ওঁর হাতে দাও! কি হাঙ্গাম! মা, বিচার আর শুনব না, শালারা ঢুকিয়ে দেয় – কি হাঙ্গাম! ঝেড়ে ফেলব!

“সে বেদ বিধির পার! – বেদ-বেদান্ত শাস্ত্র পড়ে কি তাঁকে পাওয়া যায়? (নরেন্দ্রের প্রতি) বুঝেছিস? বেদে কেবল আভাস!”

নরেন্দ্র আবার তানপুরা আনিতে বলিলেন। ঠাকুর বলিলেন, “আমি গাইব।” এখনও ভাবাবেশ রহিয়াছে – ঠাকুর গাহিতেছেন:

আমি ওই খেদে খেদ করি শ্যামা।
তুমি মাতা থাকতে আমার জাগা ঘরে চুরি গো মা।

“মা! বিচার কেন করাও?” আবার গাহিতেছেন-

এবার আমি ভাল ভেবেছি, ভাল ভাবীর কাছে ভাব শিখেছি।
ঘুম ভেঙেছে আর কি ঘুমাই যোগে যাগে জেগে আছি,
যোগনিদ্রা তোরে দিয়ে মা, ঘুমেরে ঘুম পাড়ায়েছি।

ঠাকুর বলিতেছেন – “আমি হুঁশে আছি।” এখনও ভাবাবস্থা।

সুরাপান করি না আমি, সুুধা খাই জয় কালী বলে।
মন-মাতালে মাতাল করে, মদ-মাতালে মাতাল বলে ৷৷

ঠাকুর বলিয়াছেন, ‘মা, বিচার আর শুনব না।’

নরেন্দ্র গাহিতেছেন-

(আমায়) দে মা পাগল করে, আর কাজ নাই জ্ঞানবিচারে।
তোমার প্রেমের সুরা পানে কর মাতোয়ারা,
ও মা ভক্ত-চিত্তহরা ডুবাও প্রেম-সাগরে।

ঠাকুর ঈষৎ হাসিতে হাসিতে বলিতেছেন – “দে মা পাগল করে! তাকে জ্ঞানবিচার করে – শাস্ত্রের বিচার করে পাওয়া যায় না।”

কোন্নগরের গায়কের কালোয়াতি গান ও রাগিণী আলাপ শুনিয়া প্রসন্ন হইয়াছেন। বিনীতভাবে গায়ককে বলিতেছেন, “বাবু, একটি আনন্দময়ির নাম!”

গায়ক – মহাশয়! মাপ করবেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (গায়ককে হাতজোড় করিয়া প্রণাম করিতে করিতে বলছেন) – “না বাপু! একটি, জোর করতে পারি!”

এই বলিয়া গোবিন্দ অধিকারীর যাত্রায় বৃন্দার উক্তি কীর্তন গান গাইয়া বলিতেছেন:

রাই বলিলে বলিতে পারে!
(কৃষ্ণের জন্য জেগে আছে।)
(সারা রাত জেগে আছে!)
(মান করিলে করিতে পারে।)

“বাপু! তুমি ব্রহ্মময়ীর ছেলে! তিনি ঘটে ঘটে আছেন! অবশ্য বলব। চাষা গুরুকে বলেছিল – ‘মেরে মন্ত্র লব!’

গায়ক (সহাস্য) – জুতো মেরে।

শ্রীরামকৃষ্ণ (শ্রীগুরুদেবকে উদ্দেশে প্রণাম করিতে করিতে সহাস্যে) – অত দূর নয়।

আবার ভাবাবিষ্ট হইয়া বলিতেছেন – “প্রবর্তক, সাধক, সিদ্ধ, সিদ্ধর সিদ্ধ; – তুমি কি সিদ্ধ, না সিদ্ধের সিদ্ধ? আচ্ছা গান কর।”

গায়ক রাগিণী আলাপ করিয়া গান গাহিতেছেন – মন বারণ!

শব্দব্রহ্মে আনন্দ – ‘মা, আমি না তুমি?’

শ্রীরামকৃষ্ণ (আলাপ শুনিয়া) – বাবু! এতেও আনন্দ হয়, বাবু!

গান সমাপ্ত হইল। কোন্নগরের ভক্তেরা প্রণাম করিয়া বিদায় লইলেন। সাধক জোড়হাতে প্রণামকরিয়া বলছেন, “গোঁসাইজী! – তবে আসি।” ঠাকুর এখনও ভাবাবিষ্ট। মার সঙ্গে কথা কহিতেছেন,

“মা! আমি না তুমি? আমি কি করি? – না, না, তুমি।

“তুমি বিচার শুনলে – না এতক্ষণ আমি শুনলাম? – না; আমি না; – তুমিই! (শুনলে)।”

পূর্বকথা – সাধুর ঠাকুরকে শিক্ষা – তমোগুণী সাধু

ঠাকুর প্রকৃতিস্থ হইয়াছেন। নরেনদ্র, ভবনাথ, মুখুজ্জে ভ্রাতৃদ্বয় প্রভৃতি ভক্তদের সহিত কথা কহিতেছেন। সাধকটির কথায় –

ভবনাথ (সহাস্যে) – কিরকমের লোক!

শ্রীরামকৃষ্ণ – তমোগুণী ভক্ত।

ভবনাথ – খুব শ্লোক বলতে পারে।

শ্রীরামকৃষ্ণ – আমি একজনকে বলেছিলাম – ‘ও রজোগুণী সাধু – ওকে সিধে-টিধে দেওয়া কেন?’ আর-একজন সাধু আমায় শিক্ষা দিলে – ‘অমন কথা বলো না! সাধু তিনপ্রকার – সত্ত্বগুণী, রজোগুণী, তমোগুণী।’ সেই দিন থেকে আমি সবরকম সাধুকে মানি।

নরেন্দ্র (সহাস্যে) – কি, হাতি নারায়ণ? সবই নারায়ণ।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – তিনিই বিদ্যা-অবিদ্যারূপে লীলা কচ্ছেন। দুই-ই আমি প্রণাম করি। চন্ডীতে আছে, তিনিই লক্ষ্মী। আবার হতভাগার ঘরে অলক্ষ্মী। (ভবনাথের প্রতি) এটা কি বিষ্ণুপুরাণে আছে?

ভবনাথ (সহাস্যে) – আজ্ঞা, তা জানি না। কোন্নগরের ভক্তেরা আপনার সমাধি অবস্থা আসছে বুঝতে না পেরে উঠে যাচ্ছিল।

শ্রীরামকৃষ্ণ – কে আবার বলছিল – তোমরা বসো।

ভবনাথ (সহাস্য) – সে আমি!

শ্রীরামকৃষ্ণ – তুমি বাছা ঘটাতেও যেমন, আবার তাড়াতেও তেমনি।

গায়কের সঙ্গে নরেন্দ্রের তর্ক হইয়াছিল, – সেই কথা হইতেছে।

[Doctrine of Non-resistance and Sri Ramakrishna –
নরেন্দ্রের প্রতি উপদেশ – সত্ত্বের তমঃ – হরিনাম-মাহাত্ম্য ]

মুখুজ্জে – নরেন্দ্রও ছাড়েন নাই।

শ্রীরামকৃষ্ণ – না, এরূপ রোখ চাই! একে বলে সত্ত্বের তমঃ। লোকে যা বলবে তাই কি শুনতে হবে? বেশ্যাকে কি বলবে, আচ্ছা যা হয় তুমি করো। তাহলে বেশ্যার কথা শুনতে হবে? মান করাতে একজন সখী বলেছিল, ‘শ্রীমতীর অহংকার হয়েছে।’ বৃন্দে বললে, এ ‘অহং’ কার? – এ তাঁরই অহং। কৃষ্ণের গরবে গরবিনী।

এইবার হরিনাম-মাহাত্ম্যের কথা হইতেছে।

ভবনাথ – হরিনামে আমার গা যেন খালি হয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ – যিনি পাপ হরণ করেন তিনিই হরি। হরি ত্রিতাপ হরণ করেন।

“আর চৈতন্যদেব হরিনাম প্রচার করেছিলেন – অতএব ভাল। দেখো চৈতন্যদেব কত বড় পণ্ডিত – আর তিনি অবতার – তিনি যেকালে এই নাম প্রচার করেছিলেন এ অবশ্য ভাল। (সহাস্যে) চাষারা নিমন্ত্রণ খাচ্ছে – তাদের জিজ্ঞাসা করা হল, তোমরা আমড়ার অম্বল খাবে? তারা বললে, ঝদি বাবুরা খেয়ে থাকেন তাহলে আমাদের দেবেন। তাঁরা যেকালে খেয়ে গেছেন সেকালে ভালই হয়েছে।” (সকলের হাস্য)

শিবনাথকে দেখিবার ইচ্ছা – মহেন্দ্রের তীর্থযাত্রার প্রস্তাব

ঠাকুর শিবনাথ (শাস্ত্রী)-কে দেখিতে যাইবেন ইচ্ছা হইয়াছে – তাই মুখুজ্জেকে বলিতেছেন, “একবার শিবনাথকে দেখতে যাবো – তোমাদের গাড়িতে গেলে আর ভাড়া লাগবে না!”

মুখুজ্জে – যে আজ্ঞা, তাই একদিন ঠিক করা যাবে।

শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) – আচ্ছা, আমাদের কি লাইক করবে? অত ওরা (ব্রাহ্মভক্তেরা), সাকারবাদীদের নিন্দা করে।

শ্রীযুক্ত মহেন্দ্র মুখুজ্জে তীর্থযাত্রা করিবেন – ঠাকুরকে জানাইতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) – সে কি গো! প্রেমের অঙ্কুর না হতে হতে যাচ্চো? অঙ্কুর হবে, তারপর গাছ হবে, তারপর ফল হবে। তোমার সঙ্গে বেশ কথাবার্তা চলছিল।

মহেন্দ্র – আজ্ঞা, একটু ইচ্ছা হয়েছে ঘুরে আসি। আবার শীঘ্র ফিরে আসব।

-১৮৮৪, ১৪ই সেপ্টেম্বর-

……………..
রামকৃষ্ণ কথামৃত : পঞ্চবিংশ অধ্যায় : অষ্টম পরিচ্ছেদ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!