ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

রথযাত্রা

আজ রথযাত্রা। বুধবার, ২৫শে জুন, ১৮৮৪; আষাঢ় শুক্লা দ্বিতীয়া। সকালে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কলিকাতায় ঈশানের বাড়ি নিমন্ত্রণে আসিয়াছেন। ঠনঠনিয়ায় ঈশানের ভদ্রাসনবাটী। সেখানে আসিয়া ঠাকুর শুনিলেন যে, পণ্ডিত শশধর অনতিদূরে কলেজ স্ট্রীটে, চাটুজ্যেদের বাড়ি রহিয়াছেন। পণ্ডিতকে দেখিবার তাঁহার ভারী ইচ্ছা। বৈকালে পণ্ডিতের বাড়ি যাইবেন, স্থির হইল।

বেলা প্রায় দশটা। শ্রীরামকৃষ্ণ ঈশানের নিচের বৈঠকখানায় ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। ঈশানের পরিচিত ভাটপাড়ার দুই-একটি ব্রাহ্মণ, তাহাদের মধ্যে একজন ভাগবতের পণ্ডিত। ঠাকুরের সঙ্গে হাজরা ও আরও দুই-একটি ভক্ত আসিয়াছেন। শ্রীশ প্রভৃতি ঈশানের ছেলেরাও উপস্থিত। একজন ভক্ত, শক্তির উপাসক, আসিয়াছেন। কপালে সিন্দূরের ফোঁটা। ঠাকুর আনন্দময়, সিন্দূরের টিপ দেখিয়া হাসিতে হাসিতে বলিতেছেন, “উনি তো মার্কামারা।”

কিয়ৎক্ষণ পরে নরেন্দ্র ও মাস্টার তাঁহাদের কলিকাতার বাটী হইতে আসিলেন। তাঁহারা ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া তাঁহার কাছে উপবিষ্ট হইলেন। ঠাকুর মাস্টারকে বলিয়াছিলেন, “আমি অমুক দিন ঈশানের বাড়ি যাইতেছি, তুমিও যাইবে ও নরেন্দ্রকে সঙ্গে করিয়া আনিবে।”

ঠাকুর মাস্টারকে বলিতেছেন, “সেদিন তোমার বাড়ি যাচ্ছিলাম – আড্ডাটা কোন্‌ ঠিকানায়?”

মাস্টার – আজ্ঞা, এখন শ্যামপুকুর তেলিপাড়ায়, স্কুলের কাছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ – আজ স্কুলে যাও নাই?

মাস্টার – আজ্ঞা, আজ রথের ছুটি।

নরেন্দ্রের পিতৃবিয়োগের পর বাড়িতে অত্যন্ত কষ্ট। তিনি পিতার জেষ্ঠপুত্র – ছোট ছোট ভাই-ভগ্নী আছে। পিতা উকিল ছিলেন, কিছু রাখিয়া যাইতে পারেন নাই। সংসার প্রতিপালনের জন্য নরেন্দ্র কাজকর্ম চেষ্টা করিতেছেন। ঠাকুর নরেন্দ্রের কর্মের জন্য ঈশান প্রভৃতি ভক্তদের বলিয়া রাখিয়াছেন। ঈশান কম্পট্রোলার জেনার‌্যালের আফিসে কর্মচারিদিগের একজন অধ্যক্ষ ছিলেন। নরেন্দ্রের বাটীর কষ্ট শুনিয়া সর্বদা চিন্তিত থাকেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (নরেন্দ্রের প্রতি) – আমি ঈশানকে তোর কথা বলেছি। ঈশান ওখানে (দক্ষিণেশ্বর-কালীমন্দিরে) একদিন ছিল কি না – তাই বলেছিলাম। তার অনেকের সঙ্গে আলাপ আছে।

ঈশান ঠাকুরকে নিমন্ত্রণ করিয়া আনিয়াছেন। সেই উপলক্ষে কতকগুলি বন্ধুদেরও নিমন্ত্রণ করিয়াছেন। গান হইবে। পাখোয়াজ, বাঁয়া তবলা ও তানপুরার আয়োজন হইয়াছে। বাড়ির একজন একটি পাত্র করিয়া পাখোয়াজের জন্য ময়দা আনিয়া দিল। বেলা ১১টা হইবে। ঈশানের ইচ্ছা নরেন্দ্র গান করেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (ঈশানের প্রতি) – এখনও ময়দা! তবে বুঝি (খাবার) অনেক দেরি!

ঈশান (সহাস্যে) – আজ্ঞে না, তত দেরি নাই।

ভক্তেরা কেহ কেহ হাসিতেছেন। ভাগবতের পণ্ডিতও হাসিয়া একটি উদ্ভট শ্লোক বলিতেছেন। শ্লোক আবৃত্তির পর পণ্ডিত ব্যাখ্যা করিতেছেন। “দর্শনাদি শাস্ত্র অপেক্ষা কাব্য মনোহর। যখন কাব্য পাঠ হয় বা লোকে শ্রবণ করে তখন বেদান্ত, সাংখ্য, ন্যায়, পাতঞ্জল – এই সব দর্শন শুষ্ক বোধ হয়। কাব্য অপেক্ষা গীত মনোহর।

সঙ্গীতে পাষাণহৃদয় লোকও গলে যায়; কিন্তু যদিও গীতের এত আকর্ষণ, যদি সুন্দরী নারী কাছ দিয়ে চলে যায়, কাব্যও পড়ে থাকে, গীত পর্যন্ত ভাল লাগে না। সব মন ওই নারীর দিকে চলে যায়। আবার যখণ বুভুক্ষা হয়, ক্ষুধা পায়, কাব্য, গীত, নারী কিছুই ভাল লাগে না। অন্নচিন্তা চমৎকারা!”

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্য) – ইনি রসিক।

পাখোয়াজ বাঁধা হইল। নরেন্দ্র গান গাহিতেছেন।

গান একটু আরম্ভ হইতে না হইতে ঠাকুর উপরের বৈঠকখানাঘরে বিশ্রাম করিবার জন্য চলিয়া আসিলেন। সঙ্গে মাস্টার ও শ্রীশ। বৈঠকখানাঘর রাস্তার উপর। ঈশানের শ্বশুর ৺ক্ষেত্রনাথ চাটুজ্যে মহাশয় এই বৈঠকখানা ঘর করিয়াছেন।

মাস্টার শ্রীশের পরিচয় দিলেন। বলিলেন, “ইনি পণ্ডিত ও অতিশয় শান্ত প্রকৃতি। শিশুকাল হইতে ইনি আমার সঙ্গে বরাবর পড়িয়াছিলেন। ইনি ওকালতি করেন।”

শ্রীরামকৃষ্ণ – এরকম লোকের উকিল হওয়া!

মাস্টার – ভুলে ওঁর ও-পথে যাওয়া হয়েছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ – আমি গণেশ উকিলকে দেখেছি। ওখানে (দক্ষিণেশ্বর-কালীবাটীতে) বাবুদের সঙ্গে মাঝে মাঝে যায়। পান্নাও যায় – সুন্দর নয়, তবে গান ভাল। আমায় কিন্তু বড় মানে; সরল।

(শ্রীশের প্রতি) – “আপনি কি সার মনে করেছো?”

শ্রীশ – ঈশ্বর আছেন আর তিনিই সব করেছেন। তবে তাঁর গুণ (Attributes) আমরা যা ধারণা করি তা ঠিক নয়। মানুষ তাঁর বিষয় কি ধারণা করবে; অনন্ত কাণ্ড!

শ্রীরামকৃষ্ণ – বাগানে কত গাছ, গাছে কত ডাল – এ-সব হিসাবে তোমার কাজ কি? তুমি বাগানে আম খেতে এসেছ, আম খেয়ে যাও। তাঁতে ভক্তি প্রেম হবার জন্যই মানুষ জন্ম। তুমি আম খেয়ে চলে যাও।

“তুমি মদ খেতে এসেছ, শুঁড়ির দোকানে কত মন মদ এ খপরে তোমার কাজ কি! এক গেলাস হলেই তোমার হয়ে যায়।

“তোমার অনন্ত কাণ্ড জানবার কি দরকার।

“তাঁর গুণ কোটি বৎসর বিচার করলেও কিছু জানতে পারবে না।”

ঠাকুর একটু চুপ করিয়া আছেন। আবার কথা কহিতেছেন। ভাটপাড়ার একটি ব্রাহ্মণও বসিয়া আছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – (মাস্টারের প্রতি) – সংসারে কিছুই নাই। এঁর (ঈশানের) সংসার ভাল তাই, – তা না হলে যদি ছেলেরা রাঁড়খোর, গাঁজাখোর, মাতাল, অবাধ্য এই সব হত, কষ্টের একশেষ হত। সকলের ঈশ্বরের দিকে মন – বিদ্যার সংসার, এরূপ প্রায় দেখা যায় না। এরূপ দু-চারটে বাড়ি দেখলাম। কেবল ঝগড়া, কোঁদল, হিংসা, তারপর রোগ, শোক, দারিদ্র্য।

দেখে বললাম – মা; এই বেলা মোড় ফিরিয়ে দাও। দেখ না, নরেন্দ্র কি মুশকিলেই পড়েছে। বাপ মারা গেছে, বাড়িতে খেতে পাচ্ছে না – কাজকর্মের এত চেষ্টা করছে জুটছে না – এখন কি করে বেড়াচ্ছে দেখো।

“মাস্টার, তুমি আগে অত যেতে, এখন তত যাও না কেন? বুঝি পরিবারের সঙ্গে বেশি ভাব হয়েছে?

“তা দোষই বা কি, চারিদিকে কামিনী-কাঞ্চন! তাই বলি, মা, যদি কখনও শরীরধারণ হয়, যেন সংসারী করো না।”

ভাটপাড়ার ব্রাহ্মণ – কি! গৃহস্থধর্মের সুখ্যাতি আছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ – হাঁ, কিন্তু বড় কঠিন।

ঠাকুর অন্য কথা পাড়িতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি) – আমরা কি অন্যায় করলাম? ওরা গাচ্ছে – নরেন্দ্র গাচ্ছে – আর – আমরা সব পালিয়ে এলাম।

-১৮৮৪, ২৫শে জুন-

………………….
রামকৃষ্ণ কথামৃত : বিংশ অধ্যায় : ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের পণ্ডিতদর্শন

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!