ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

কলিতে ভক্তিযোগ – কর্মযোগ নহে

প্রায় বেলা চারিটার সময় ঠাকুর গাড়িতে উঠিলেন। অতি কোমলাঙ্গ, অতি সন্তর্পণে তাঁহার দেহরক্ষা হয়। তাই পথে যাইতে কষ্ট হয় – প্রায় গাড়ি না হলে অল্প দূরও যাইতে পারেন না। গাড়িতে উঠিয়া ভাবসমাধিতে মগ্ন হলেন! তখন টিপ-টিপ করিয়া বৃষ্টি পড়িতেছে। বর্ষাকাল – আকাশে মেঘ, পথে কাদা। ভক্তেরা গাড়ির পশ্চাৎ পশ্চাৎ পদব্রজে যাইতেছেন। তাঁহারা দেখিলেন, রথযাত্রা উপলক্ষে ছেলেরা তালপাতার ভেঁপু বাজাইতেছে।

গাড়ি বাটীর সম্মুখে উপনীত হইল। দ্বারদেশে গৃহস্বামী ও তাঁহার আত্মীয়গণ আসিয়া অভ্যর্থনা করিলেন।

উপরে যাইবার সিঁড়ি। তৎপরে বৈঠকখানা। উপরে উঠিয়াই শ্রীরামকৃষ্ণ দেখিলেন যে শশধর তাঁহাকে অভ্যর্থনা করিতে আসিতেছেন। পণ্ডিতকে দেখিয়া বোধ হইল যে তিনি যৌবন অতিক্রম করিয়া প্রৌঢ়াবস্থা প্রাপ্ত হইয়াছেন। বর্ণ উজ্জ্বল, গৌর বলিলে বলা যায়। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। তিনি অতি বিনীতভাবে ভক্তিভরে ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন। তৎপরে সঙ্গে করিয়া ঘরে লইয়া বসাইলেন। ভক্তগণ পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাইয়া আসন গ্রহণ করিলেন।

সকলেই উৎসুক যে, তাঁহার নিকটে বসেন ও তাঁহার শ্রীমুখনিঃসৃত কথামৃত পান করেন। নরেন্দ্র, রাখাল, রাম, মাস্টার ও অন্যান্য অনেক ভক্তেরা উপস্থিত আছেন। হাজরাও শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরের কালীবাড়ি হইতে আসিয়াছেন।

ঠাকুর পণ্ডিতকে দেখিতে দেখিতে ভাবাবিষ্ট হইলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে সেই অবস্থায় হাসিতে হাসিতে পণ্ডিতের দিকে তাকাইয়া বলিতেছেন, “বেশ! বেশ!” পরে বলিতেছেন, “আচ্ছা, তুমি কিরকম লেকচার দাও?”

শশিধর – মহাশয়, আমি শাস্ত্রের কথা বুঝাইতে চেষ্টা করি।

শ্রীরামকৃষ্ণ – কলিযুগের পক্ষে নারদীয় ভক্তি। – শাস্ত্রে যে সকল কর্মের কথা আছে, তার সময় কি? আজকালকার জ্বরে দশমূল পাঁচন চলে না। দশমূল পাঁচন দিতে গেলে রোগীর এদিকে হয়ে যায়। আজকাল ফিবার মিক্‌শ্চার। কর্ম করতে যদি বল, – তো নেজামুড়া বাদ দিয়ে বলবে। আমি লোকদের বলি, তোমাদের ‘আপোধন্যন্যা’ – ও-সব অত বলতে হবে না। তোমাদের গায়ত্রী জপলেই হবে। কর্মের কথা যদি একান্ত বল তবে ঈশানের মতো কর্মী দুই-একজনকে বলতে পার।”

বিষয়ী লোক ও লেকচার

“হাজার লেকচার দাও বিষয়ী লোকদের কিছু করতে পারবে না। পাথরের দেওয়ালে কি পেরেক মারা যায়? পেরেকের মাথা ভেঙে যাবে তো দেওয়ালের কিছু হবে না। তরোয়ালের চোট মারলে কুমীরের কি হবে? সাধুর কমণ্ডুল (তুম্বা) চারধাম করে আসে কিন্তু যেমন তেঁতো তেমনি তেঁতো। তোমার লেকচারে বিষয়ী লোকদের বড় কিছু হচ্ছে না। তবে তুমি ক্রমে ক্রমে জানতে পারবে। বাছুর একবারে দাঁড়াতে পারে না। মাঝে মাঝে পড়ে যায়, আবার দাঁড়ায়; তবেতো দাঁড়াতে ও চলতে শিখে।”

নবানুরাগ ও বিচার – ঈশ্বরলাভ হলে কর্মত্যাগ – যোগ ও সমাধি

কে ভক্ত, কে বিষয়ী চিনতে পার না। তা সে তোমার দোষ নয়। প্রথম ঝড় উঠলে কোন্‌টা তেঁতুলগাছ, কোন্‌টা আমগাছ বুঝা যায় না।

ঈশ্বরলাভ না হলে কেউ একবারে কর্মত্যাগ করতে পারে না। সন্ধ্যাদি কর্ম কতদিন? যতদিন না ইশ্বরের নামে অশ্রু আর পুলক হয়। একবার ‘ওঁ রাম’ বলতে যদি চোখে জল আসে, নিশ্চয় জেনো তোমার কর্ম শেষ হয়েছে। আর সন্ধ্যাদি কর্ম করতে হবে না।

“ফল হলেই ফুল পড়ে যায়। ভক্তি – ফল; কর্ম – ফুল। গৃহস্থের বউ পেটে ছেলে হলে বেশি কর্ম করতে পারে না। শাশুড়ী দিন দিন তার কর্ম কমিয়ে দেয়। দশমাস পড়লে শাশুড়ী প্রায় কর্ম করতে দেয় না। ছেলে হলে সে ওইটিকে নিয়ে কেবল নাড়াচাড়া করে, আর কর্ম করতে হয় না। সন্ধ্যা গায়ত্রীতে লয় হয়। গায়ত্রী প্রণবে লয় হয়। প্রণব সমাধিতে লয় হয়। যেমন ঘন্টার শব্দ – টং – ট – অ-ম্‌। যোগী নাদ ভেদ করে পরব্রহ্মে লয় হন। সমাধি মধ্যে সন্ধ্যাদি কর্মের লয় হয়। এইরকমে জ্ঞানীদের কর্মত্যাগ হয়।”

-১৮৮৪, ২৫শে জুন-

……………………….
রামকৃষ্ণ কথামৃত : বিংশ অধ্যায় : দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!