ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

১৮৮৫, ২৮শে জুলাই
গুহ্যকথা – “তিনজনই এক”

বলরামের বাড়ির বৈঠকখানার পশ্চিমপার্শ্বের ঘরে ঠাকুর বিশ্রাম করিতেছেন, নিদ্রা জাইবেন। গণুর মার বাড়ি হইতে ফিরিতে অনেক রাত হইয়া গিয়াছে। রাত পৌনে এগারটা হইবে।

ঠাকুর বলিতেছেন, “যোগীন একটু পায়ে হাতটা বুলিয়ে দাও তো।”

কাছে মণি বসিয়া আছেন।

যোগীন পায়ে হাত বুলাইয়া দিতেছেন; এমন সময় ঠাকুর বলিতেছেন, আমার ক্ষিদে পেয়েছে, একটু সুজি খাব।

ব্রাহ্মণী সঙ্গ সঙ্গে এখানেও আসিয়াছেন। ব্রাহ্মণীর ভাইটি বেশ বাঁয়া তবলা বাজাইতে পারেন। ঠাকুর ব্রাহ্মণিকে আবার দেখিয়া বলিতেছেন, “এবার নরেন্দ্র এলে, কি আর কোনও গাইয়ে লোক এলে ওঁর ভাইকে ডেকে আনলেই হবে।”

ঠাকুর একটু সুজি খাইলেন। ক্রমে যোগীন ইত্যাদি ভক্তেরা ঘর হইতে চলিয়া গেলেন। মণি ঠাকুরের পায়ে হাত বুলাইতেছেন, ঠাকুর তাঁহার সহিত কথা কহিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – আহা, এদের (ব্রাহ্মণীদের) কি আহ্লাদ!

মণি – কি আশ্চর্য, যীশুকৃষ্টের সময় ঠিক এইরকম হয়েছিল! তারাও দুটি মেয়েমানুষ ভক্ত, দুই ভগ্নী। মার্থা আর মেরী।

শ্রীরামকৃষ্ণ (উৎসুক হইয়া) – তাদের গল্প কি বল তো।

মণি – যীশুকৃষ্ট তাঁদের বাড়িতে ভক্তসঙ্গে ঠিক এইরকম করে গিয়েছিলেন। একজন ভগ্নী তাঁকে দেখে ভাবোল্লাসে পরিপূর্ণ হয়েছিল। যেমন গৌরের গানে আছে, –

      ‘ডুবলো নয়ন ফিরে না এলো।

গৌর রূপসাগরে সাঁতার ভুলে, তলিয়ে গেল আমার মন।’

“আর-একটি বোন একলা খাবর-দাবার উদ্যোগ করছিল। সে ব্যতিব্যস্ত হয়ে যীশুর কাছে নালিশ করলে, প্রভু, দেখুন দেখি – দিদির কি অন্যায়! উনি এখানে একলা চুপ করে বসে আছেন, আর আমি একলা এই সব উদ্যোগ করছি?

“তখন যীশু বললেন, তোমার দিদিই ধন্য, কেন না মানুষ জীবনের যা প্রয়োজন (অর্থাৎ ঈশ্বরকে ভালবাসা – প্রেম) তা ওঁর হয়েছে।”

শ্রীরামকৃষ্ণ – আচ্ছা তোমার এ-সব দেখে কি বোধ হয়?

মণি – আমার বোধ হয়, তিনজনেই এক বস্তু! – যীশুখ্রীষ্ট, চৈতন্যদেব আর আপনি – একব্যক্তি!

শ্রীরামকৃষ্ণ – এক এক! এক বইকি। তিনি (ঈশ্বর), – দেখছ না, – যেন এর উপর এমন করে রয়েছে!

এই বলিয়া ঠাকুর নিজের শরীরের উপর অঙ্গুলি নির্দেশ করিলেন – যেন বলছেন, ঈশ্বর তাঁরই শরীরধারণ করে অবতীর্ণ হয়েই রয়েছেন।

মণি – সেদিন আপনি এই অবতীর্ণ হওয়ার ব্যাপারটি বেশ বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ – কি বল দেখি।

মণি – যেন দিগ্‌দিগন্তব্যাপী মাঠ পড়ে রয়েছে! ধু-ধু করছে! সম্মুখে পাঁচিল রয়েছে বলে আমি দেখতে পাচ্ছি না; – সেই পাঁচিলে কেবল একটি ফাঁক! – সেই ফাঁক দিয়ে অনন্ত মাঠের খানিকটা দেখা যায়!

শ্রীরামকৃষ্ণ – বল দেখি সে ফাঁকটি কি?

মণি – সে ফাঁকটি আপনি! আপনার ভিতর দিয়ে সব দেখা যায়; – সেই দিগ্‌দিগন্তব্যাপী মাঠ দেখা যায়!

শ্রীরামকৃষ্ণ অতিশয় সন্তুষ্ট, মণির গা চাপড়াতে লাগলেন। আর বললেন, “তুমি যে ওইটে বুঝে ফেলেছ। – বেশ হয়েছে।”

মণি – ওইটি শক্ত কি না; পূর্ণব্রহ্ম হয়ে ওইটুকুর ভিতর কেমন করে থাকেন, ওইটা বুঝা যায় না।

শ্রীরামকৃষ্ণ – ‘তারে কেউ চিনলি না রে! ও সে পাগলের বেশে (দীনহীন কাঙালের বেশে) ফিরছে জীবের ঘরে ঘরে!’

মণি – আর আপনি বলেছিলেন যীশুর কথা।

শ্রীরামকৃষ্ণ – কি, কি?

মণি – যদু মল্লিকের বাগানে যীশুর ছবি দেখে ভাবসমাধি হয়েছিল। আপনি দেখেছিলেন যে যীশুর মূর্তি ছবি থেকে এসে আপনার ভিতর মিশে গেল।

ঠাকুর কিয়ৎকাল চুপ করিয়া আছেন। তারপর আবার মণিকে বলিতেছেন, “এই যে গলায় এইটে হয়েছে, ওর হয়তো মানে আছে – সব লোকের কাছে পাছে হালকামি করি। – না হলে যেখানে সেখানে নাচা-গাওয়া তো হয়ে যেত।”

ঠাকুর দ্বিজর কথা কহিতেছেন। বলিতেছেন, “দ্বিজ এল না?”

মণি – বলেছিলাম আসতে। আজ আসবার কথা ছিল; কিন্তু কেন এল না, বলতে পারি না।

শ্রীরামকৃষ্ণ – তার খুব অনুরাগ। আচ্ছা, ও এখানকার একটা কেউ হবে (অর্থাৎ সাঙ্গোপাঙ্গের মধ্যে একজন হবে), না?

মণি – আজ্ঞা হাঁ, তাই হবে, তা না হলে এত অনুরাগ।

মণি মশারির ভিতর গিয়া ঠাকুরকে বাতাস করিতেছেন।

ঠাকুর একটু পাশ ফেরার পর আবার কথা কহিতেছেন। মানুষের ভিতর তিনি অবতীর্ণ হইয়া লীলা করেন, এই কথা হইতেছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ – তোমার ওই ঘর। আমার আগে রূপদর্শন হত না, এমন অবস্থা গিয়েছে। এখনও দেখছ না, আবার রূপ কম পড়ছে।

মণি – লীলার মধ্যে নরলীলা বেশ ভাল লাগে।

শ্রীরামকৃষ্ণ – তাহলেই হল; – আর আমাকে দেখছো!

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কি বলিতেছেন যে, আমার ভিতর ঈশ্বর নররূপে অবতির্ণ হইয়া লীলা করিতেছেন?

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!