ভবঘুরেকথা
মতুয়া সংগীত

তীর্থমণির উপাখ্যান
পয়ার

রামকৃষ্ণ চারি পুত্র জ্যেষ্ঠ মহানন্দ।
শ্রীকুঞ্জবিহারী রাসবিহারী আনন্দ।।
রামকৃষ্ণ অনুজ শ্রীরামনারায়ণ।
তার হ’ল পঞ্চপুত্র হরি পরায়ণ।।
নামে মত্ত বালা বংশ কৃষ্ণপুর গ্রামে।
সাধু কোটিশ্বর আর ধনঞ্জয় নামে।।
মতুয়া হইল সবে বলে হরি বলা।
স্বজাতি সমাজে বাদ র’ল যত বালা।।
তাহারা বলেন মোরা শঙ্কা করি কায়।
হরিনাম ত্যজিব কি স্বজাতির ভয়।।
হরিবলে কেন হীনবীর্য হ’য়ে রব।
সমাজিতে ত্যজ্য করে হরিবোলা হ’ব।।
মাতিয়াছি মহাপ্রভু হরিচাঁদ নামে।
নমঃশূদ্র তুচ্ছ কথা ডরি না সে যমে।।
বাবা হরিচাঁদের করুণা যদি হয়।
বালাবংশ কুলমান কিছুই না চায়।।
হরি প্রেম বন্যা এসে কূল গেছে ভেসে।
জাতি মোরা হরিবোলা আর জাতি কিসে।।
সাধুর ভগিনী ধনী তীর্থমণি কয়।
তিনি কন হরিবোলা কারে করে ভয়।।
মাতিল পুরুষ নারী ভয় নাই মনে।
অভক্তের ভয় কিসে মানিনে শমনে।।
অন্যে বলে জাতিনাশা আরো দর্প করে।
পাষণ্ডীরা ম’তোদিগে যায় মারিবারে।।
তাহা শুনি তীর্থমণি রাগে হুতাশন।
বলে আমি দলিব সে পাষণ্ডীর গণ।।
একদিন বেকি দাও করেতে করিয়া।
বলে যে আসিবি তারে ফেলিব কাটিয়া।।
ক্রোধিতা হইল দেবী যেন উগ্রচণ্ডা।
বেকি দাও হাতে নিল যেন খর খাণ্ডা।।
তাহা দেখে ভয় পেল যত পাষণ্ডীরা।
ভীত হ’য়ে উত্তর না করিল তাহারা।।
মেয়ের স্বভাব নাই’ হ’য়ে হরিবোলা।
সে কারণে লোকে বলে তীর্থরাম বালা।।
আর শুন তাহার চরিত্র গুণধাম।
হরিপ্রেম রসে মেতে বলে হরিনাম।।
বিবাহিতা হ’য়েছিল বোড়াশী গ্রামেতে।
তার পতি মরিল সে অল্প বয়সেতে।।
রূপবতী অতিশয় যৌবন সময়।
ঠাকুর যাইত তথা সময় সময়।।
ঠাকুরে করিত তীর্থ পিতৃ সম্বোধন।
ঠাকুর জানিত তারে কন্যার মতন।।
ক্ষণে তীর্থ ক্ষণে মা! মা! বলিয়া ডাকিত।
মাঝে মাঝে বোড়াশী যাতায়াত করিত।।
একদিন তীর্থমণি পাকশাল ঘরে।
ঠাকুরকে মনে করি ভাসে অশ্রুনীরে।।
পায়স পিষ্টক রাঁধি পাকশালে বসি।
মনে ভাবে বাবা যদি আসিত বোড়াশী।।
স্বহস্তে তুলিয়া দিতাম শ্রীচন্দ্র বদনে।
এত ভাবি অশ্রুধারা বহিছে নয়নে।।
দিবা অবসান প্রায় এমন সময়।
সকলে খাইল তীর্থ কিছু নাহি খায়।।
বদন বিশ্বাস বলে বধূমার ঠাই।
খাও গিয়া, বধূ বলে ক্ষুধা লাগে নাই।।
মীরাবাঈ রাঁধিতেন খিচুড়ির ভাত।
প্রীত হ’য়ে খেত গিয়ে প্রভু জগন্নাথ।।
সেই মত মহাপ্রভু তীর্থমণি ঘরে।
চলিলেন ভক্তি অন্ন খাইবার তরে।।
তীর্থমণি গৃহে প্রভু গেলেন যখন।
জল আনি তীর্থমণি ধোয়ায় চরণ।।
কেশ মুক্ত করি পাদ পদ্ম মুছাইয়ে।
করিছেন পদ সেবা আসনে বসায়ে।।
পায়স পিষ্টক আদি ব্যঞ্জন শাল্যন্ন।
অগ্রে তুলে রেখেছিল ঠাকুরের জন্য।।
ঠাকুরের সেবা পরে প্রসাদান্ন যাহা।
তীর্থমণি যতনে ভোজন কৈল তাহা।।
তাহা দেখে সবে বলে বদনের কাছে।
দেখগে এখনে বৌর ক্ষুধা লাগিয়াছে।।
কেহ গিয়া জানাইল বদনের ঠাই।
দেখগে বধূর ঘরে নাগর কানাই।।
ইতি উতি বদন করে’ছে অনুমান।
ভাবে বধূ হ’তে বুঝি গেল কুলমান।।
বদন বিশ্বাস বলে ঠাকুরকে রুষি।
দেখ প্রভু আর তুমি এসনা বোড়াশী।।
চিরদিন জানি ম’তোদের ব্যবহার।
মানা করি মোর বাড়ী আসিওনা আর।।
শ্রীহরি গমন কৈল ওঢ়াকাঁদি যেতে।
কেঁদে কেঁদে তীর্থমণি আগুলিল পথে।।
মহাপ্রভু নিজধামে করিলে গমন।
বাবা! বাবা! বলে তীর্থ করিত ক্রন্দন।।
দিবানিশি অই চিন্তা মুদে দ্বি-নয়ন।
কিছুদিন পরে সিদ্ধ আরোপ সাধন।।
আরোপে প্রভুর রূপ যখনে দেখিত।
নয়ন মেলিলে রূপ দেখিবারে পেত।।
মহাপ্রভু থাকিতেন ওঢ়াকাঁদি বসি।
লোকে দেখে প্রভু যেন আছেন বোড়াশী।।
ষোড়শ হাজার একশত অষ্ট নারী।
প্রতি ঘরে এক কৃষ্ণ বাঞ্ছাপূর্ণকারী।।
যখন করিত তীর্থ দেখিবারে মন।
বাঞ্ছা-কল্পতরু হরি দিত দরশন।।
গৃহকার্য যখন করিত তীর্থমণি।
বাবা বলে ডাকিত যেমন উন্মাদিনী।।
সবে বলে বধূ গেল পাগল হইয়ে।
শিকল লাগায়ে পায় রাখিত বাঁধিয়ে।।
বদন বলিল আমি চিরদিন জানি।
সাধ্বী সতী পুত্র বধূ অব্যভিচারিণী।।
চেহারায় বাহিরায় সতীত্বের জ্যোতি।
তবে কেন বধূ হেন হ’ল ছন্নমতি।।
বাবা! বাবা! বাবা! বলে ডাক ছেড়ে উঠে।
ঝাড়া দিলে লোহার শিকল যেত কেটে।।
বদনের দর্প, দর্পহারী কৈল চুর।
এর মধ্যে তীর্থমণি এল কৃষ্ণপুর।।
ভ্রাতৃ অন্ন ভুক্তা অতি নির্ভয়া হৃদয়া।
মহাভাব অনুরাগে তেজময়ী কায়া।।
তীর্থমণি বালার সুকীর্তি চমৎকার।
কহে কবি রসরাজ রায় সরকার।।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!