ভবঘুরেকথা
ফকির লালন সাঁই

-মূর্শেদূল মেরাজ

-হ্যালো। জীবন দা’র কি কোনো খোঁজ আছে?

-না, কোনো খোঁজ নাই। আপনেরে তো বলছিই বাবজি আমার কাছে আসলে আপনারে ফোন দিয়া জানামু। তিনি আসেন নাই। আমি ডিউটিতে আছি। আসল ফোন দিমুনে… রাখি।

এই মধ্যরাতে শীতের তীব্রতা যেনো আরো বেড়েছে শহরে। হাত পা যেন ঠাণ্ডা হয়ে উঠছে এতোকিছু গায়ে জড়িয়ে রাখার পরও। ঘরের দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিয়ে দুইবারের চেষ্টায় সিগারেটটা ধরালো অগ্নি। সিগারেট ধরালেও টানতে ইচ্ছে করছে না। এক হাতে বারান্দার গ্রিলটা ধরে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলো। কেমন যেন অসহায় অসহায় লাগছে।

জীবন দা’র সাথে সেই যে দেখা হয়েছিল তারপর একে একে কেটে গেছে গোটা একটা বছর। এর মাঝে কয়েকবার বিদেশের সফর সারা হয়েছে। বৌ-বাচ্চা নিয়ে ঘুরে আসা হয়েছে সমুদ্রে-পাহাড়ে। একটা-দুইটা পদোন্নতেও হয়েছে কর্মক্ষেত্রে। কিন্তু কোথায় যেন একটা শূন্যতা দিনদিনই বাড়ছে। সেটা কিছুতেই মোচন করা যাচ্ছে না।

বহু বহুবার ভেবেছে জীবন দা’র কথা ভাববে না। জীবন দা’র বলা কথাগুলোও ভাববে না। কিন্তু দিনদিনই যেন তার কথাগুলো আরো গভীরভাবে দাগ কাটতে শুরু করেছে। পুরো বিষয়টাই সকলের কাছে চেপে যাওয়ায় বিষয়টা কেউ আঁচ করতে পারে নি বটে কিন্তু তার আচরণে যে একটা সূক্ষ্ম পরিবর্তণ হয়েছে তা সকলের চোখেই পরেছে।

যখন যখন সে ভাবতে শুরু করে। তখন আশপাশের মানুষগুলো ভাবে নিশ্চয়ই মার্কেটিং-এর নতুন কোনো আইডিয়া ডেভেলাপ করছে সে মাথার ভেতর। অফিসের ব্যস্ততার বিষয়গুলো বৌ-বাচ্চাও আজকাল বোঝে। তারাও কিছুটা সময় দেয় তাকে। কিন্তু তার এই মাঝে মাঝে কথার ভেতর… বা কিছু বলতে বলতে… কিছু শুনতে শুনতে… হঠাৎ হারিয়ে যাওয়াকে সহজে কেউ মানতে পারছে না।

সে নিজেও কি ভাবতে পারছে? অফিস থেকেও তাকে বেশ কয়েকবার ছুটি দেয়া হয়েছে। হাওয়া বদলের তাগিদ দেয়া হয়েছে। শ্বশুর মশাই তো তালবাহানা করে তার এক ডাক্তার বন্ধুর কাছেও নিয়ে গিয়েছিল। ডাক্তার একগাদা ওষুধ ধরিয়ে দিয়েছে। খুবই বিরক্তকর ছিল বিষয়টা। শেষটায় তাকে জোর করে পাগলের ডক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো?

তবে সব কিছুরই একটা ভালো দিক আছে। ডাক্তার বলেছে যেহেতু আর অন্য কোনো প্রকার সমস্যা ধরা পরেনি। তাই তাকে কিছু একা সময় দিতে। সে যখন একা থাকতে চায় তখন তাকে বিরক্ত না করতে। কাজের চাপে তার এমন হয়েছে। নিজের সাথে একটু একা সময় কাটাতে পারলে এর থেকে বের হয়ে আসতে পারবে। এতে গত কয়েক মাস সে শান্তিতে আছে।

আর কয়েক ঘণ্টা পরই ভোরের আলো ফুঁটবে। নতুন একটা দিনের সূচনা হবে। অন্য দিন থেকে এই দিনটি অনেক বেশি কাঙ্খিত অগ্নির কাছে। শেষ কয়েকটা মাস এই একটা দিনের অপেক্ষায় তাকে কত বিনিদ্র রজনী যে কাটাতে হয়েছে তার শেষ নেই।

এই যে মধ্যরাতে বারান্দায় আছে সে। আগে হলে বৌ প্রতি মিনিট পাঁচেক পর পর এসে খোঁজ নিতো। ঘরে গিয়ে ঘুমাতে বলতো। এখন তা করছে না। তবে সে জেগে আছে এটা অগ্নি টের পায়। যাক সে সব কথা।

জীবন দা’র মতো একটা ফালতু মানুষকে নিয়ে সে কেনো এতো ভাবছে? তাকে খোঁজার জন্য কত লোক যে লাগিয়েছে। কতবার যে রমনার পার্কে গিয়ে বসেছিল তার কোনো হিসেব সে জানে না। সেই যে একটা না্ম্বার দিয়ে গিয়েছিল জীবন দা’। সেই নাম্বারে ফোন করতে করতে বিরক্ত করে ফেলেছে। সেই লোক এখন তার ফোন ধরতেও চায় না।

কিন্তু তার হাতে যেন কিছুই নেই। জীবন দা’র সাথে একবার কথা বলতে না পারলে সে যেন মরে যাবে। এমনটাও মনে হয় মাঝে মাঝে। গভীর একটা নি:শ্বাস ফেলে অগ্নি বিরবির করে বলেই ফেললো-

-দেখা দেও জীবন দা’ একবার দেখা দাও।

আর কয়েক ঘণ্টা পরই ভোরের আলো ফুঁটবে। নতুন একটা দিনের সূচনা হবে। অন্য দিন থেকে এই দিনটি অনেক বেশি কাঙ্খিত অগ্নির কাছে। শেষ কয়েকটা মাস এই একটা দিনের অপেক্ষায় তাকে কত বিনিদ্র রজনী যে কাটাতে হয়েছে তার শেষ নেই।

নাহ্ কাল জীবন দা’র সাথে দেখা হবেই এমন কোনো সম্ভবনা নেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জীবন দা’কে খুঁজতে তার পথচলা শুরু হবে। অনেক অনেক মিথ্যার ঝুলি সাজিয়ে মুখে হাসি হাসি ভাব করে সপ্তাহ খানেকের একান্ত একটা ছুটি সে ম্যানেজ করেছে। এর জন্য ডাক্তারকে পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়েছে।

অফিস-বাড়ি-শ্বশুরবাড়ি-বন্ধুবান্ধব-স্বজন সকলকে ম্যানেজ করে একান্তে কাটানোর জন্য দেশের মধ্যে থাকার একটা ছুটি ম্যানেজ করা মোটেও সহজ কাজ ছিল না। তার উপর তার ভেতরে নাকি বৈরাগ্য ভাব জন্মেছে বলে সকলে সন্দেহ করছে; এমন একটা মুর্হূতে।

না চাইতেও যে বৈরাগ্য ভাবটা স্বভাবে প্রকাশ পেয়েছিল তা গত কয়েকটা মাস জান-পরান দিয়ে ঢেকে রেখে হাসি মুখে থাকার প্র্যাকটিস করে সকলের কাছে নিজেকে শান্ত প্রমাণ করতে হয়েছে।

ইচ্ছে করেই নিজের গাড়ি নেয় নি অগ্নি। দামী গাড়ির টিকেটও কাটে নি। বহুদিন পর এমন সাধারণ মানের বাসের সীটে বসে বেশ আরাম লাগছে। নিজের মেকি জীবনটাকে যেন পেছনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছে নিজেরই কাছে। উদ্দেশ্য কুষ্টিয়ার লালন ফকিরের আখড়া। আজ রাতেই পূর্ণিমা। আর এই দোল পূর্ণিমাকে কেন্দ্র করে হবে লালন উৎসব-সাধুসঙ্গ।

অগ্নির দৃঢ় বিশ্বাস জীবন দা’কে লালনের আখড়ায় সে ঠিকই খুঁজে পাবে। অন্য কিছু না জীবন দা’কে কয়েকটা প্রশ্ন করার আছে তার। মানুষটার সাথে কথা বলার যে পিপাসা তার মধ্যে তৈরি হয়েছে তা কিছুটা মিটিয়ে নিতে হবে। এমন একটা ব্যবস্থা করতে হবে যাতে তার সাথে নিয়মিত একটা যোগাযোগ রাখা যায়।

অগ্নি চমকে উঠায় চায়ের অনেকটা ছিটকে পরে জুতার মাথাটা ভিজিয়ে দিলো। সেদিকে দৃষ্টি না দিয়েই দোকানীর কথাটা আবারও শোনার চেষ্টা করলো। ‘বাপ’ শব্দটায় যেন জীবন দা’ জীবন্ত হয়ে উঠলো। আচ্ছা কুষ্টিয়ার সবাই কি এই শব্দটা ব্যবহার করে? জীবন দা’র বাড়ি কি কুষ্টিয়াতে?

আসলেই জীবনে এমন অন্তত একটা মানুষ দরকার যার সাথে নির্ভয়ে উজার করে দিয়ে মনের কথাগুলো বলা যায়। যে না বলা কথাগুলোও বুঝতে পারে। মনের কথাগুলো বলতে পারে। যার সামনে নিজেকে খুলে দিতে ভয় করে না।

থেকে থেকেই একটা বিষয়ও মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, আচ্ছা যদি জীবন দা’র সাথে সাক্ষাৎ না হয় তাহলে কি হবে? এই আশঙ্কা নিয়েই শেষ বিকেলে অগ্নি বাসের দরজা গলে নেমে আসলো কুষ্টিয়ার ভূমিতে। একটা শীত শীত আবহাওয়া। গায়ের উপর এসে পরা রিকসাগুলোকে পাশ কাটিয়ে রেললাইনটা পেরিয়ে সিগারেটটা ধরিয়ে মাথা ঘুরিয়ে চায়ের দোকান খুঁজতে লাগলো।

পথের পাশের খুপড়ি চায়ের দোকানী চায়ের কাপটা এগিয়ে দিয়ে মোলায়েম গলায় বললো- বাপ! লালনে যাইবেন নাকি?

অগ্নি চমকে উঠায় চায়ের অনেকটা ছিটকে পরে জুতার মাথাটা ভিজিয়ে দিলো। সেদিকে দৃষ্টি না দিয়েই দোকানীর কথাটা আবারও শোনার চেষ্টা করলো। ‘বাপ’ শব্দটায় যেন জীবন দা’ জীবন্ত হয়ে উঠলো। আচ্ছা কুষ্টিয়ার সবাই কি এই শব্দটা ব্যবহার করে? জীবন দা’র বাড়ি কি কুষ্টিয়াতে?

-লালন… লালন… লালন…

অগ্নি অটোর সামনের সীটে ড্রাইভারের পাশেই বসে পরলো কোলের উপর ব্যাগটা রেখে। আর চেপে রাখতে না পেরে ড্রাইভারকে বলেই ফেললো- লালন সাঁইজির ধামকে লালন লালন বলছেন কেন? অল্প বয়সী ড্রাইভার কোনো সদুত্তর না দিয়ে একটু হাসি দিয়ে ডাকতে লাগলো- লালন… লালন… লালন…

বিশ্বাস করাটা বেশ মুশকিল আমি সত্যি সত্যি কুষ্টিয়ার মাটিতে। আমার গণ্ডি ছেড়ে আমি খুব সাধারণভাবেই পথে নেমেছি। এয়ারকন্ডিশন জীবনের ছকটাকে একটু ছুটি দিয়ে এই যে বেরিয়ে পরার গল্প। সেটা আমার জীবনে নতুন।

আমি ভালো করেই জানি এই জীবনটাকে আমি কখনোই নিজের করে নিতে পারবো না। আমি এখনো সাচ্ছন্দবোধ করি সেই সাজুগুজুর জীবনটাকেই। তারপরও কোথাও যে হাফিয়ে উঠা আছে সেই জীবনটায়। তাই হয়তো এই বেরিয়ে পরা।

কি জানি ভাবতে গেলে তল খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবে আমি আমার ভাবনাগুলো আমার নিজের মতো করেই বলতে চাই এইখান থেকে। আমি জানি আমি গুছিয়ে বলতে পারি না। তবে আমি আমার নিজের কথাগুলো নিজের মতো করেই বলতে চাই।

অনেকটা দূর থেকেই উচ্চস্বরে মাইকে ভাষণ শোনা যাচ্ছে। তবে আধা অন্ধকার রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে অগ্নি ঠিক বুঝতে পারছে না লালন আখড়াটা ঠিক কতটা দূরে। ভিড়ের কারণে মাঝরাস্তাতেই অটো থেকে নামতে হয়েছে। পুলিশ আর এগুতে দিচ্ছিল না যানবাহন। অগত্যা সকলের সাথে অগ্নিও কাঁধে বেগ ঝুলিয়ে রওনা দিয়েছে। আশপাশের প্রায় সকলেই লালন আখড়ায় চলছে তাই পথ হারাবার ভয় নেই।

অগ্নি অনুভব করছে উত্তেজনের বশে শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে তার। আর কয়েক কদম গেলেই হয়তো দেখা মিলবে জীবন দা’র। মনে একটা ভাবনা কিছুক্ষণ ধরে বাসা বাঁধতে শুরু করেছে। সে কি লালন সাঁইজিকে দর্শন করতে চলেছে নাকি খুঁজতে চলেছে জীবন দা’কে?

‘হাজার হাজার ডক্টর হাজরা’ সোনার কেল্লার এই লাইনটা বারবার মনে পরছে গতরাত থেকে। এক জীবনদা’কে খুঁজতে আমি কুষ্টিয়ায় এসেছিলাম। এখানে এসে যার সাথে কথা বলছি তাকেই জীবন দা বলে ভুল হচ্ছে। আসলে মানুষগুলো কত জানে।

কাল যখন অটো একটা ধুলো উড়া রাস্তার মোড়ে নামিয়ে দিয়ে বললো নামেই চলে আইসেছি। তারপর মানুষের ভিড়ের মধ্যে চলতে চলতে কখন লালন সাঁইজির ধামের সামনে চলে এসেছি বুঝি নাই। একটা মোড় মতো জায়গায় আসার পর ভিড় মনে হলো আরো বেশি।

একটু সম্মানপূর্বক তাদের সাথে কথা বললে কত কিছু জানা যায়। যা হয়তো আমি সারাজীবনেও ভাবতে পারিনি। তা এইসব আপাত সাধারণ মানুষ বহুআগেই ভেবে বসে আছে। আসলেই কি মাটির গুণ আছে? যে মাটিতে স্বয়ং লালন সাঁইজি হেঁটেছেন সেই মাটির গুণ? নাকি অন্য কিছু।

আমি এখন কুষ্টিয়া শহরের সস্তাদরের একটা হোটেলের কামড়ায় পরিস্কার সাদা ধবধবে চাদরের উপর উপুড় হয়ে বুকের নিচে বালিশ দিয়ে ল্যাপটপে লিখছি। সারারাত ধামেই কাটিয়েছি। ভোরের দিকে হোটেলে চেকইন করেছি। তারপর টানা ঘুম দিয়েছি দুপুর পর্যন্ত। হোটেল রুমেই খাবার এনে খেয়ে নিয়েছি। তারপর আরেক প্রস্থ গড়াগড়ি করে। এখন লিখতে শুরু করেছি।

অভিজ্ঞতাগুলো লিখে রাখতে চাই। যতটা মনে থাকে আরকি। আমি আমার প্রতিটা অনুভতিকে ধরে রাখতে চাই। আসলে আমি কিসের পেছনে ছুটছি আমি নিজেই তা জানি না। সেটা পরিস্কার হওয়া দরকার নিজের জন্যই। তাই প্রস্তুতি নিয়েই এসেছি। ভেবেছি প্রতিদিন কিছু সময় অবশ্যই বের করবো আর লিখে রাখবো খুঁটিনাটি বিষয়গুলো।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমি তো লেখক নই। গুছিয়ে যেমন লিখতে পারি না। তেমন সব কিছু মনেও থাকছে না। কিন্তু অসিফের কাজকর্ম কিন্তু সবই মনে থাকে। ভাবছি কাল থেকে কারো সাথে কথা বলার সময় গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে রেকর্ড করে নিবো তাহলে লিখার সময় সুবিধা হবে। যাক সে কথা এখন কাজের কথায় আসা যাক।

কাল যখন অটো একটা ধুলো উড়া রাস্তার মোড়ে নামিয়ে দিয়ে বললো নামেই চলে আইসেছি। তারপর মানুষের ভিড়ের মধ্যে চলতে চলতে কখন লালন সাঁইজির ধামের সামনে চলে এসেছি বুঝি নাই। একটা মোড় মতো জায়গায় আসার পর ভিড় মনে হলো আরো বেশি।

মানুষ স্রোতের মতো বড় একটা গেট ধরে ঢুকছে। আমিও ঢুকে পরলাম সকলের সাথে। লালন সাঁইজির রওজা দরশন ও সেই অনুভূতি অন্য সময় লিখবো। আজ একটু অন্য কথা বলতে চাই। এই যেমন রাসু পাগলার কথা।

হ্যা রাত একটা পর্যন্ত আমি কেবল মানুষের ভীড়ে ঘুরে ঘুরে ঘুরেই গেলাম। কখনো মূল স্টেজের সামনে, পাগালপাড়ায়, ভোটনগুরুর আয়নামহলে, ভাবনগরে, মাঠে, মেলায়। অবশ্য সব নামগুলো তখনই জানতে পারিনি। বারবার ঘুরতে ঘুরতে জেনেছি এসব নাম। আজব সব অভিজ্ঞতা হলো।

ঘুরছি তো ঘুরছি কিছুই বুঝতে পারছি না। কেবল ঘুরে যাচ্ছি। কোনো কোনো জায়গায় ঘুরতে হচ্ছে না, মানুষ ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে কখন জানি রাসু পাগলার সাথে ঘুরতে শুরু করেছি সেটা খেয়াল করিনি।

হাতে বিশাল একটা বাকানো লাঠির মধ্যে রাজ্যের সুতা-দড়ি বাঁধা। সেটা এক হাতে বাগিয়ে সে এগিয়ে চলে। কয়েক প্রস্থ বস্তার উপর একটা সোনালী রঙের নানা কারুকাজ করা সিল্কের চাদর জড়িয়ে নিয়েছে। যতদূর মনে হয় এটা কোনো রওজার গিলাপ হবে। সে টানা কথা বলেই যায় থামে না।

প্রথম যখন খেয়াল করলাম সে আমার সাথে সাথে হাঁটছে তখন আৎকে উঠেছিলাম। পাগল দেখলেই আমার কলিজা শুকিয়ে আসে। প্রচণ্ড ভয় জাগে মনে। কিন্তু কিছু সময় নিরবে হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম এ প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে সে আমাকে রক্ষা করে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টা বেশ লাগলো। এমন একজন সঙ্গীই এসময় বড় দরকার। হাঁটতে হাঁটতে পুরো শরীর ব্যাথা করতে শুরু করেছে।

একটু ফাঁকা রাস্তা পেয়ে পাগলকে বললাম, একটু চা খাবে নাকি?

পাগল উদাস চোখে তাকিয়ে বলবো, তাইলে এক রুটিও খাওয়াবি… একটা বন রুটি… একটা কলা… দুইটা টোস বিস্কুট… একটা পান… হাকিমপুরি জর্দ্দা দিয়া…

তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ঠিক আছে সব হবে। চলো আগে কোথাও বসি।

পাগল ফিক করে হেসে বললো, চল শ্মশানে গিয়া খামু। এইখানে বেশি মানুষ। শ্মশানে তো মরা মানুষ থাকে। মরা মানুষ ত্যক্ত করে না। সেইখানে বইস্যা খামু… পাঁপড়ভাজা খামু… বাদাম খামু… পরাটা খামু… ডিম খামু…

শ্মশানে খেতে যাবো বিষয়টা শুনলে ভিমড়ি খাওয়ার অবস্থা হওয়ার কথা। কিন্তু আমার সেসব মনে হচ্ছে না। তবে ব্যাগে ল্যাপটপ, ক্যামেরা, দামী মোবাইল, পকেটে টাকা, কার্ড সেগুলো নিয়ে একটা টেনশন যে হচ্ছিল না তা না। কিন্তু কোথাও একটু নিরিবিল বসা দরকার। কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামানো দরকার সবার আগে। কিছু খেতে পারলে আরো ভালো।

ভেবেছিলাম নদীর পাড়ে ঘুটঘুটে অন্ধকারে বিশাল বিশাল চিতায় লাশ পুড়ছে। অঘোরী-কাপালিকরা বিচিত্র সব ভঙ্গীতে বসে আছে। কিন্তু তেমন কিছু না। বিশাল বিশাল বট-অশ্বত্থের নিচে মানুষজন দল বেধে নিজের নিজের আসন সাজিয়ে বসে আছে। গান-বাজনা হচ্ছে বেশ কয়েকটা জটলায়। কিছু মানুষ ঘুমিয়ে কাঁদা হয়েছে। চারপাশে বেশকিছু দোকানপাটও আছে। একপাশে অল্প পরিসরে মেলার পসরা বসেছে।

রাসু আমাকে টানতে টানতে ছোট্ট একটা খাবারের দোকানে নিয়ে গেলো। সে নিজেই অর্ডার দিলো- পরটা, ডিমভাজি, সবজি, গরম গরম দুধ চা। বেশ একটা জোশ আছে রাসুর ভঙ্গিতে। খেতে খেতে রাসু পাগলার সাথে আলাপ জমানোর চেষ্টা চালালাম। সে নিজেই বললো তার নাম রাসু পাগলা। তারপর প্রায় পরটার প্লেট উল্টে দিয়ে বিকট শব্দে হাসতে হাসতে বললো, পাগলের আবার নাম…

-শোন! সবকিছুর দুইটা জিনিস আছে। একটা হইলো ভালো একটা হইলো খারাপ। মাছ-মাংস, খাবার-দাবার, চন্দ্র-সূর্য, বাঘ-সিংহ, নদী-নালা, খাল-বিল, ছোট-বড়, কালো-সাদা, গ্রহ-নক্ষত্র, ডান-বাম, উঁচু-নিচু, রাজা-রাণী, জামা-কাপড়…

রাসুকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, এর কোনটা ভালো কোনটা খারাপ?

রাসু ডিমভাজাটা নাড়তে নাড়তে বললো, শোন! সুখ-দু:খ-কষ্ট এসব নিয়া ভাববি না। যা হবে তাতেই সুখ খুঁজবি তাইলেই হিসাব সহজ। আগে থেইক্ক্যা যদি সুখ-দু:খের কাহিনী মনে বাইন্ধ্যা রাখিস তাইলে বিপদ। সামনে যা পাবি তার মাঝেই তারে খুঁজবি। দেখবি কত্ত সোজা।

রাসু উদাস নয়নে বললো, এইটাই তো খেলারে পাগল। এটাইটা তো খেলা। এই ভেদ বুঝতে পারলে সব পাবি। ভেদ না ভাঙ্গতে পারলে সবই বৃথা… বুঝলি…

রাসু খাওয়া বন্ধ করে কোথায় যেন দৃষ্টি দিয়ে চেয়ে রইলো। আমার অবশ্য প্রচণ্ড খিদা পেয়েছে। আমি সমানে খেয়ে যাচ্ছি। দোকানি গরম গরম পরটা ভেজে দিচ্ছে। আমি গোগ্রাসে গিলে যাচ্ছি। আরেকখানা পরটা পাতে দিতে দিতে দোকানি বললো, বুঝলেন বাপ! লালন কোনো কিছুই না বইলা যায় নাই।

কিন্তু আমরা অজ্ঞানী তাই ধরতে পারি না। লালনরে বুঝতে গেলে, লালনের কথা বুঝতে গেলে জ্ঞানের প্রয়োজন। গভীর জ্ঞান। তাইলেই দেখবেন সব সোজা। ভাবতে হইবো সহজ কইরা। কঠিন কইরা ভাবতে গেলে প্যাঁচে পইরা যাইবেন। তাঁর গান গুলান শুনছেন? একটু খেয়াল নিয়া শুনবেন। তাইলে সে ধরা দিবো।

ছোট্ট দোকানের পাশেই যে লোকটা মাটিতে চট বিছিয়ে বসে এই মধ্যরাতে পাঁপড় ভাজছে সে বলে উঠলো, প্রত্থমে লালনের গানরে ভালোবাসতে হইবো। মনে ধরতে হইবো। তারপর একটা একটা কইরা পর্দা সরায়া দেখন লাগবো। নইলে অধরধরা ধরা দিবো কেন? যত যত্নে পর্দা সরাইবেন তত বেশি আলো চোখে পরবো। তাড়াহুড়া করার জায়গা না এটা।

রাসু ডিমভাজাটা নাড়তে নাড়তে বললো, শোন! সুখ-দু:খ-কষ্ট এসব নিয়া ভাববি না। যা হবে তাতেই সুখ খুঁজবি তাইলেই হিসাব সহজ। আগে থেইক্ক্যা যদি সুখ-দু:খের কাহিনী মনে বাইন্ধ্যা রাখিস তাইলে বিপদ। সামনে যা পাবি তার মাঝেই তারে খুঁজবি। দেখবি কত্ত সোজা।

উল্টো দিকের বেঞ্চিতে যে কৃষকায় পেটানো শরীরের জটাধারী যুবক ঠাণ্ডা পুরি তরকারির ঝোলে ডুবিয়ে ডুবিয়ে খাচ্ছিল গভীর মগ্ন হয়ে সে বললো, দেশ-বিদেশের হাজার হাজার মাজারে ঘুরলাম। লালনের কাছে আইসা সব ঠাণ্ডা। আজমির যায়া শান্তি পাইছিলাম, ঐখানের এক পাগল কইলো ঘরের মধ্যে পাগল থুইয়্যা এত্তোদূরে পইরা থাকলে কাম হইবো না। ফিরা যা।

দেখে ফিরা সারাদেশ ঘুরছি। ৩৬০ আউলিয়ার মাজার ঘুরলাম। কত্ত মহতের দরবারে যে গেছি-থাকছি-খাইছি হিসাব নাই। কত্ত শান-শওকত। লালনে কিচ্ছু নাই। বসনের জায়গা পর্যন্ত পাই না সময় সময়। কিন্তু দিলে যে শান্তি পাই আর কোনো জায়গায় পাই না।

প্রত্থম প্রত্থম এসব খালি হয় গান। পরে দেখি না সবই তো জ্ঞান। আর এই জ্ঞানের পানি যে খাইছে সে শেষ। তার আর বাঁচন নাই বুঝলেন। তারে মাথা মুড়াইতেই হইবো লালনের চরণে। কিসের মায়ায় যে পইরা আছি কে জানে। কোনোদিন মাথায় একটু হাতও রাখলো না সাইজি। আর পাপীকে দেখা দেওয়া তো দূরের কথা।

কিন্তু মায়াজ্বালে ঠিকই বাইন্ধ্যা রাখছে। ছাড়ে না। এই জ্বাল ছিড়নের সাধ্য কারো নাই। চরণ দাও সাঁইজি চরণ দাও। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ রেখে একসময় আনমনেই যুবক গাইতে শুরু করলো-

সে কি আমার কবার কথা
আপন বেগে আপনি মরি,
গৌর এসে হৃদে বসে
করলো আমার মন-চুরি।।

কিবা গৌর রূপ লম্পটে
ধৈর্যের ডুরি দেয় গো কেটে,
লজ্জা ভয় সব যায় গো ছুটে
যখন ওই রূপ মনে করি।।

গৌর দেখা দিয়ে ঘুমের ঘোরে
চেতন হয়ে পাই নে তারে,
লুকাইল কোন শহরে
নব রূপের রসবিহারী।।

মেঘে যেমন চাতকেরে
দেখা দিয়ে ফাঁকে ফেলে,
লালন বলে তাই আমারে
করলো গৌর বরাবরই।।

রাসু পাগলা টেবিল বাজিয়ে তাল দিচ্ছে। কোথা থেকে একটা বাচ্চা ছেলে এসে মন্দিরা বাজাতে বসেছে। শ্মশানের অন্ধকার ভেদ কর দোলের পূর্ণ চাঁদ, বিভিন্ন জটলা থেকে ভেসে আসা গানের সাথে এই নাম না জানা যুবকের ভেজা চোখের দরাজ গলার গানে লালন সাঁইজির ভূমিতে বসে চারপাশে যাদের দেখছি তাদের সবাইকেই আমার জীবন দা মনে হচ্ছে।

মনে পরছে সোনার কেল্লার সেই সংলাপ, ‘হাজার হাজার ডক্টর হাজরা।’ আমারো মনে হচ্ছে হাজার হাজার জীবন দা। জীবন দা তোমাকে ভীষণ মিস করছি। কিন্তু তুমি আমাকে যে জায়গায় এনে ফেলছো তার জন্য তুমি মহান। তুমি না থেকেও এই জায়গায় তোমার উপস্থিতির কোনো কমতি নেই।

চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে জীবন দা- জয়গুরু। আমি জানি না জয়গুরু কেনো বলে। কাদের বলে। তবে আমি এটুকু জানি। জয়গুরু পেতেও একটা যোগ্যতা লাগে। তেমন দিতেও লাগে। বন্ধু তোমাকে এই যাত্রায় আমি খুঁজে পাবো কিনা জানি না। তবে তোমাকে খোঁজা আমার কখনো শেষ হবে বলে মনে হচ্ছে না।

বিগত দিনগুলোতে লালন ফকিরের গানের বইগুলোর পাতা উল্টাতে উল্টাতে বেশকিছু গান মনের মধ্যে বাসা বেধেছে। শিল্পী হলে গেয়ে উঠতাম। শিল্পী নই তাতে ক্ষতি কি। মনে মনে তো গাইতেই পাই। এই সময় ঘটনা-কালের সাথে যায় কিনা বুঝতেছি না কিন্তু সাঁইজির এই পদটাই মাথার মধ্যে ক্রিয়া করছে-

তোমার মতো দয়াল বন্ধু আর পাব না।
দেখা দিয়ে ওহে রাসুল ছেড়ে যেও না।।

তুমি হও খোদার দোস্ত
অপারের কাণ্ডারী সত্য,
তোমা বিনে পারের লক্ষ্য
আর দেখা যায় না।।

আসমানি আইন দিয়ে
আমাদের সব আনলে রাহে,
এখন মোদের ফাঁকি দিয়ে
ছেড়ে যেও না।।

আমরা সব মদিনাবাসী
ছিলাম যেমন বনবাসী,
তোমা হতে জ্ঞান পেয়েছি
আছি সান্ত্বনা।।

তোমা বিনে এরূপ শাসন
কে করবে আর দীনের কারণ,
লালন বলে আর তো এমন
বাতি জ্বলবে না।।

(চলবে…)

লালন বলে কুল পাবি না: দুই>>

.…………………………………………..
আরো পড়ুন:
সিজন : এক
লালন বলে কুল পাবি না: এক
লালন বলে কুল পাবি না: দুই
লালন বলে কুল পাবি না: তিন
লালন বলে কুল পাবি না: চার
লালন বলে কুল পাবি না: পাঁচ
লালন বলে কুল পাবি না: ছয়
লালন বলে কুল পাবি না: সাত
লালন বলে কুল পাবি না: আট

সিজন : দুই
লালন বলে কুল পাবি না: এক
লালন বলে কুল পাবি না: দুই

লালন বলে কুল পাবি না: তিন
লালন বলে কুল পাবি না: চার
লালন বলে কুল পাবি না: পাঁচ
লালন বলে কুল পাবি না: ছয়
লালন বলে কুল পাবি না: সাত
লালন বলে কুল পাবি না: আট

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!