ভবঘুরেকথা
মুক্তির প্রত্যাশা আত্মদর্শন স্বরূপদর্শন ত্যাগ

-মূর্শেদূল মেরাজ

ইসলাম ধর্মে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু দিবসের কথা উল্লেখ করা আছে যা সর্বজন বিদিত। তারসাথে এমন অন্তত তিনটি বিশেষ রজনীর কথাও ব্যক্ত করা আছে। যে রজনীগুলোকে ঘিরে তৈরি হয়েছে নানা জল্পনাকল্পনা-রহস্য।

এই রহস্যে ঘেরা রজনীগুলোকে অনেকে আমলেই নিতে চান না। অনেকে বলেন ইসলামের মূল দলিলে এমন কোনো রজনীর কথা সরাসরি বলাই হয়নি। আবার কেউ কেউ বলেন এসব রাতের আভাস দেয়া থাকলেও এগুলো ধুমধামের সহিত পালন করা যথাযথ নয়।

তবে এই বিশেষ রজনীগুলো বিশ্বাসীদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। এর প্রথমটি শবে মেরাজ, দ্বিতীয়টি শবে বরাত আর তৃতীয়টি শবে কদর। যারা ইসলামের অন্তনির্হিত অর্থ খোঁজেন সাধনায় লিপ্ত হতে বা অন্তনির্হিত অর্থ খুঁজতে খুঁজতে যারা এর দিশা পেয়েছেন। তাদের কাছে এই রজনীগুলো অত্যন্ত মহিমান্বিত ও তাৎপর্যপূর্ণ। তবে যারা মানেন না তারাও অবশ্য অসম্মান করেন না; তবে উৎযাপনের বারাবারি নিয়ে তাদের মতোভেদ আছে।

এই তিন বিশেষ রজনী যে কোন্ কোন্ রজনী, তা সুনির্দিষ্ট করে সেভাবে কোনো দলিলে উল্লেখ নেই বলেই বেশিভাগ সূত্র থেকে জানা যায়। তবে বেশ কিছু ইশারা দেয়া আছে। ইসলামের সাধক সম্প্রদায় আপন আপন সাধন বলে এই রজনীগুলোকে নির্দিষ্ট করেন।

তাদের অনুসারীরা সেই মতেই সেই রজনীকে পালন করে থাকে। আবার রাষ্ট্রিয় হিসেব মতে বা চাঁদের হিসেবেও নির্দিষ্ট করা হয়। তবে এটা সকল দেশে সকল সম্প্রদায় একই দিনে পালন করে না। তবে অন্য দুটি রজনী সুনির্দিষ্টভাবে কবে তা নিয়ে সংশয় থাকলেও শবে বরাত মূলত শাবান মাসের মাঝামাঝি রজনী অর্থাৎ ১৪ তারিখ দিবাগত রজনীতে পালন করা হয়ে থাকে।

হযরত আলী (রা) থেকে বর্ণিত- মহানবী বলেন, যখন শা’বানের ১৫ তারিখ রাত্রি উপস্থিত হবে তখন তোমরা উক্ত রাতে নামায আদায় করবে এবং দিনে রোযা রাখবে। কেননা নিশ্চয়ই আল্লাহ উক্ত রাত্রিতে সূর্যাস্তের সময় পৃথিবীর আকাশে আসেন অর্থাৎ রহমতে খাছ নাযিল করেন।

মূল কথায় আসা যাক। এই আলোচনা মূলত শবে বরাতকে কেন্দ্র করে। শবে বরাতকে আরবিতে ‘লাইলাতুল বারাআত’ নামে অভিহিত করা হয়। ফারসি শব্দ ‘শব’ অর্থ রজনী বা রাত, আরবিতে একে ‘লাইলাতুন’ বলা হয়। আর ‘বারাআত’ শব্দের অর্থ মুক্তি, নাজাত, নিষ্কৃতি, বিমুক্ত, মুক্ত হওয়া ইত্যাদি।

বাংলায় ‘বরাত’ শব্দটি ‘ভাগ্য’ বা ‘সৌভাগ্য’ অর্থে ব্যবহৃত হলেও আরবী ভাষায় এর অর্থ ভিন্ন। আরবী ‘লাইলাতুল বারাআত’ মানে মুক্তি বা নিষ্কৃতির রজনী। হিজরী সনের শাবান মাসের মধ্যবর্তী রজনীকে এই মহামান্বিত রজনী বলে চিহ্নিত করা হয়।

যতদূর জানা যায়, কুরান ও হাদীসে কোথাও ‘লাইলাতুল বারাআত’ শব্দটি ব্যবহার করা হয় নি। সাহাবী-তাবেয়ীগণের যুগেও এর ব্যবহার পাওয়া যায় না। বিশুদ্ধতার দিক থেকে প্রথম শ্রেণীর চার হাদিস গ্রন্থ- বোখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসায়ী কিতাবে ১৫ শা’বানের রাত সম্পর্কে কোন বর্ণনা খুঁজে পাওয়া যায় না।

তবে তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ শরীফে এ রাত সম্পর্কে উল্লেখ আছে। চারজন বিখ্যাত ফেকাহর ইমামদের মধ্যে ইমাম আহমদ (রহ) সঙ্কলিত ‘মুসনদ’ সেই কিতাবে এ রাত সম্পর্কে হাদীসে এসেছে। এই রজনীকে কোনো কোনো হাদীসে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বা ‘মধ্য শাবানের রজনী’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

আয়েশা (রা) বর্ণনা করেন, আমি একদা রাত্রিবেলায় নবীজিকে খুঁজতে ঘর থেকে বের হতে দেখলাম নবীজি জান্নাতুল বাকীতে আকাশের দিকে মাথা তুলে তাকিয়ে আছেন।

নবীজি বললেন, হে আয়েশা! নিশ্চয়ই এটি শাবান মাসের পনেরই রাত। এই রাতে আল্লাহ এক বিশেষ শানের সাথে দুনিয়ার আকাশের দিকে অবতরণ করেন এবং বনী কলব গোত্রের ছাগলগুলোর গায়ে যত সংখ্যক লোম আছে এর থেকে বেশি সংখ্যক গুনাহগার বান্দাহগণকে ক্ষমা করে দেন। (মুসনাদে আহমদ)

মহানবীর উল্লেখিত অর্ধ শাবানের রাত অর্থাৎ শাবান মাসের ১৪ তারিখের দিবাগত রজনী মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত বরকতময় ও মহিমান্বিত বলে বিবেচিত। বিশ্বাসীরা বলেন, আল্লাহ মানবজাতির জন্য তাঁর অসীম রহমতের দরজা এ রজনীতে উন্মুক্ত করে দেন। স্রষ্টার দরবারে সমগ্র জীবনের দোষ-ত্রুটি, পাপচার ও অন্যায়ের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনার রাত।

বিশ্বাসীরা আরো বলেন, এই রজনীতে স্রষ্টা পরবর্তী বছরের জন্য বান্দার রিজিক নির্ধারণ করে সবার ভাগ্যলিপি লেখেন এবং বান্দার গুনাহ মাফ করেন।

হযরত আলী (রা) থেকে বর্ণিত- মহানবী বলেন, যখন শা’বানের ১৫ তারিখ রাত্রি উপস্থিত হবে তখন তোমরা উক্ত রাতে নামায আদায় করবে এবং দিনে রোযা রাখবে। কেননা নিশ্চয়ই আল্লাহ উক্ত রাত্রিতে সূর্যাস্তের সময় পৃথিবীর আকাশে আসেন অর্থাৎ রহমতে খাছ নাযিল করেন।

তবে এসব রীতিনিতি ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বাসীদের কাছে বা ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায় বা রাস্ট্রের প্রেক্ষিতে ভিন্নতা পাওয়া যায়। তবে নিয়মনীতিকে কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও প্রায় সকল বিশ্বাসীই এই মহিমান্বিত রজনীতে নিজের সকল গুনাহ্-পাপ থেকে মুক্তির জন্য ইবাদত করেন রাতব্যাপী।

অতঃপর ঘোষণা করেন, ‘কোনো ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছো কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দিব।’ ‘কোনো রিযিক প্রার্থনাকারী আছো কি? আমি তাকে রিযিক দান করব।’ ‘কোনো মুছিবতগ্রস্ত ব্যক্তি আছো কি? আমি তার মুছিবত দূর করে দিব।’ এভাবে ফজর পর্যন্ত ঘোষণা করতে থাকেন।’ (ইবনে মাজাহ, মিশকাত)

আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত, আমি মহানবীকে রমজান মাস ব্যতীত অন্য কোনো মাসে পূর্ণ রোযা রাখতে দেখিনি এবং শাবান মাসের চেয়ে অন্য কোনো মাসে এতো বেশি রোযা রাখতে দেখিনি। (বুখারি, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসায়ী)।

হযরত আবদুল কাদের জিলানী গুনিয়াতুত্ ত্বালেবীনে উল্লেখ করেন, এ রাতকে লায়লাতুল বরাত বলা হয় এ জন্য যে, কেননা এ রাতে দু’ধরনের বরাত হাছিল হয়। একটি হলো: হতভাগাদের আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হওয়া, অপরটি হলো: আল্লাহর প্রিয়জনদের অপমান থেকে মুক্তি ও নিরাপদ থাকা। (গুনিয়াতুত্ ত্বালেবীন)

এই রজনী উৎযাপনের থেকে এর ইবাদত পদ্ধতি নিয়ে বেশিভাগ ফিকাহগণের মধ্যে মতপার্থক্য দেখতে পাওয়া যায়। কেউ কেউ বলেন, সম্মিলিতভাবে মসজিদে নামাজ পড়া মাকরুহ, আর কেউ কেউ বলেন, সম্মিলিতভাবে মসজিদে নামাজ পড়া মুস্তাহাব। এ মতপার্থক্য সমাধানে ‘ফতোয়ায়ে আযহার’ এ উল্লেখ আছে, ‘যেহেতু এ মতপার্থক্য তাবেয়ীনদের মধ্যে হয়েছে, সেহেতু যে কোন একটি মতের ওপর আমল করা যাবে।’

এই রজনী নিয়ে নানা মতোভেদ থাকলেও যেহেতু কিছু হাদিসে এর উল্লেখ পাওয়া যায় তাই বিশ্বাসীদের কাছে এই রজনী পালিত হয়ে আসছে বহুকাল ধরেই। নানাবিধ নিয়মনীতি-বিধিবিধামের মধ্যে দিয়ে বিশ্বাসীরা ইবাদত বন্দেগীর সাথে বিশেষ বিশেষ খাবার-দাবারের আয়োজনও করে থাকে।

এই রজনীতে বিশ্বাসীরা নানাবিধ ইবাদত করে থাকেন। স্রষ্টার কাছে কান্নাকাটি করে নিজ পাপকর্মের নাজাত চান। রোজা রাখেন। দান খয়রাত করেন। কবর-সমাধি-মাজার-রওজা জিয়ারতসহ নানা ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকেন।

তবে এসব রীতিনিতি ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বাসীদের কাছে বা ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায় বা রাস্ট্রের প্রেক্ষিতে ভিন্নতা পাওয়া যায়। তবে নিয়মনীতিকে কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও প্রায় সকল বিশ্বাসীই এই মহিমান্বিত রজনীতে নিজের সকল গুনাহ্-পাপ থেকে মুক্তির জন্য ইবাদত করেন রাতব্যাপী।

ধর্মে যেমন স্রষ্টার কাছে চাইবার বিশেষ বিশেষ রজনী-প্রার্থনা-রীতিনীতি-আচার থাকে। ঠিক তেমনি সাধকের মাঝেও গুরুর কাছে-পরমের কাছে-নিজের কাছে চাইবার বেশকিছু লগ্ন থাকে-দিনক্ষণ থাকে। ঠিক ঠিক লগ্নে ঠিক ঠিক আচার মেনে চাইলেই নাকি তা মেলে। বিশ্বাসীরা তেমনি বলে। তবে সকলে তা মানতে নারাজ। আর সকলে সকল বিষয়ে একমত হবে এটাও কোনো কাজের কথা না।

স্রষ্টার কাছে পাপকার্যের মুক্তির জন্য বিশেষ বিশেষ রাতে যে ইবাদত-বন্দেগী-এই যে আরজি তা কেবলমাত্র ইসলাম ধর্মেই সীমাবদ্ধ নেই। প্রায় সকল ধর্ম-মত-বিশ্বাসেই নির্দিষ্ট রজনী-লগ্ন-বিধিবিধান আছে যাতে অনুসারীরা স্রষ্টার কাছে আকুল হলে নিজেকে উজার করে দিয়ে নিজের সকল দোষ স্বীকার করে নিয়ে মুক্তি চায়। পাপ থেকে মুক্তির পথ খোঁজে। বিশ্বাসীরা বলেন মুক্ত-শুদ্ধ-পবিত্র মনে যখন কোনো ভক্ত স্রষ্টার কাছে আকুতি করে স্রষ্টা তাকে ফিরিয়ে দিতে পারে না।

নিজের কৃত পাপ থেকে বাঁচতে ভারতবর্ষে পুন্যস্থান সবচেয়ে বহুল প্রচলিত বিধান বলা যায়। এছাড়া নানাবিধ পুজা-অর্চনা-প্রার্থনা-মানত-তীর্থ দশন তো রয়েছেই। খ্রিস্টানদের মাঝে গির্জায় কনফেশন বক্সে পাপ স্বীকারও একটা উজ্জ্বল উদাহরণ। এছাড়াও বিভিন্ন মত-পথ-বিশ্বাস-ধর্মে পাপ থেকে নিষ্কৃতির বিভিন্ন লগ্ন-রজনী-বিধিবিধান প্রণয়ন করা আছে। যে দিন স্রষ্টা তার সৃষ্টিকে, গুরু তার শিষ্যকে, অবতার তার অনুসারীদের জন্য রহমতের বিশেষ উপহার নিয়ে আসেন।

পরমাত্মা আর জীবাত্মার এই এক আজব লীলা। কেউ কাউকে চিনে না, অথচ জনম জনমের প্রেম। আর সেই প্রেম শুদ্ধ হলেই-সহজ হলেই যোগ-লগ্নে মিলে গেলে সকল মুশকিলই আসান হয়ে যায়। দুই মনে অনন্তের প্রেমভাব মিলে গেলেই লীল হয়ে যায় একে অন্যের উপর। প্রস্ফুটিত হয় নবচেতনার।

তবে অবিশ্বাসীরাও কিন্তু পিছিয়ে নেই। প্রচলিত ভাষায় যাদের অনেক রাষ্ট্র নাস্তিক বলে চিহ্নিত করে তারাও ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকৃত পাপ কর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়। তারাও নিষ্কৃতি চায়। তা হয়তো স্রষ্টার কাছে নয়। তা হয়তো কোনো দিবস-লগ্ন-দিনক্ষণ মেনে নয়।

কিন্তু বোধের উদয় হলে তারাও নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় পাপচার থেকে মুক্ত থাকার এবং পূর্বে হয়ে যাওয়া বা কর ফেলা পাপ থেকে মুক্তির প্রত্যাশা করে। জগতকে ভালোবাসতে পারলেই যে মনের ময়লা দূর হবে এ কথা আর কে অস্বীকার করতে পারে।

ধর্মে যেমন স্রষ্টার কাছে চাইবার বিশেষ বিশেষ রজনী-প্রার্থনা-রীতিনীতি-আচার থাকে। ঠিক তেমনি সাধকের মাঝেও গুরুর কাছে-পরমের কাছে-নিজের কাছে চাইবার বেশকিছু লগ্ন থাকে-দিনক্ষণ থাকে। ঠিক ঠিক লগ্নে ঠিক ঠিক আচার মেনে চাইলেই নাকি তা মেলে। বিশ্বাসীরা তেমনি বলে। তবে সকলে তা মানতে নারাজ। আর সকলে সকল বিষয়ে একমত হবে এটাও কোনো কাজের কথা না।

নবীজি যেমন নির্দিষ্ট মাসের ১৫ তারিখকে বিশেষ দিন হিসেবে উল্লেখ করেছেন রহমতের রজনীরূপে। তেমনি ফকির লালন সাঁইজিও অমবস্যা-পূর্ণিমার পনের দিনের চক্র কষে পর্দার আড়ালে বলছেন-

সেই কথা কী কবার কথা
জানতে হয় ভাবাবেশে,
অমাবস্যায় পূর্ণিমা সে
পূর্ণিমায় অমাবস্যে।।

অমাবস্যায় পূর্ণিমার যোগ
আজব সম্ভব সম্ভোগ,
জানলে খণ্ডে এ ভবরোগ
গতিহয় অখণ্ড দেশে।।

রবিশশী রয় বিমুখা
মাসান্তে হয় একদিন দেখা,
সেই যোগের যোগ লেখাজোখা
সাধলে সিদ্ধি হয় অনা’সে।।

দিবাকর নিশাকর সদাই
উভয় অঙ্গে উভায় লুকায়,
ইশারাতে সিরাজ শাঁই কয়
লালনরে তোর হয়না দিশে।।

একই ধারার অন্য পদে বলছেন-

সময় গেলে সাধন হবে না।
দিন থাকিতে তিনের সাধন কেন করলে না।।

জানো না মন খালে বিলে
থাকে না মীন জল শুকালে।
কি হবে আর বাঁধাল দিলে, মোহনা শুকনা।।

অসময়ে কৃষি করে
মিছামিছি খেটে মরে।
গাছ যদিও হয় বীজের জোরে, ফল ধরে না।।

অমাবস্যায় পূর্ণিমা হয়
মহাযোগ সেই দিনে উদয়।
লালন বলে তাহার সময় দণ্ড রয় না।।

পরমাত্মার সাথে জীবাত্মার এই যে পূর্বপাপ নাশ করে নতুন করে যাত্রার শুরু, পূর্বের যে সকল দোষক্রটিকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে চলা এটাই ভজন। সাধক সাধন কর্ম সেরে ভজন পর্বে প্রবেশ করে। স্রষ্টার কাছে চাইবার অধিকার অর্জন করে। লালন সাঁইজি ভক্তের মাঝে সেই প্রেমের জাগরণ নিয়ে লিখছেন-

ধন্য আশেকিজনা এ দীন দুনিয়ায়
আশেক জোরে গগণের চাঁদ পাতালে নামায়।।

সুঁইছিদ্রে চালায় হাতি
বিনা তেলে জ্বালায় বাতি,
কখন হয় নিষ্ঠারতি
ঠাঁই অঠাঁই রয়।।

কাম করে না নাম জপে না
শুদ্ধ দেল আশেক দেওয়ানা,
তাইতে আমার সাঁই রব্বানা
মদদ সদাই।।

আশেকের মাশুকি নামাজ
তাইতে রাজি সাঁই বেনিয়াজ,
লালন করে শৃগালের কাজ
দিয়ে সিংহের দায়।।

প্রেমের প্রেমিক হলেই-ইসকের আশিক হলেই তবেই কেউ আসমানের চাঁদ অর্থাৎ সেই অদর ধরাকে ভূমিতে নামিয়ে আনতে পারে। তবে তা হয় বহু ভাগ্যের ফলে। এজন্য সাধককে গুরুর তত্ত্বাবধানে নিজেকে নির্মাণ করতে হয়ে সমগ্র জীবন দিয়ে। শুদ্ধা-ভক্তি-বিনয়-আদব দিয়ে। তবেই না সেই রজনীতে স্রষ্টা নামেন সৃষ্টির কাছে। স্রষ্টা আসেন সৃষ্টিকে তার পুরস্কার দিতে-তার প্রাপ্যতা দিতে। সাঁইজি বলছেন-

অনেক ভাগ্যের ফলে সে চাঁদ কেউ দেখিতে পায়।
অমাবস্যা নাই সে চাঁদে দ্বিদলে আর কিরণ উদয়।।

যেথা রে সেই চন্দ্রের ভুবন
দিবারাত্রি নাই অন্বেষণ,
কোটি চন্দ্র জিনি কিরন
বিজলী সঞ্চারে সদাই।।

বিন্দু মাঝে সিন্দুবারি
মাঝখানে তার স্বর্ণগিরি,
অধরচাঁদের স্বর্গপুরী
সেহি তো তিল প্রমাণ জাগায়।।

দরশনে দুঃখ হরে
পরশনে সোনা করে,
এমনি সে চাঁদের মহিমে
লালন ডুবে ডোবে না তায়।।

প্রত্যেক মত-পথ-বিশ্বাসে বিশ্বাসীদের স্রষ্টার কাছে চাইবার ভঙ্গি ভিন্ন। প্রাপ্তির ধরণটাও তেমনি ভিন্ন। তাই কে কি উপায়ে পায়। আর কে কোন উপায় চায় তার ভিন্নতা থাকবেই। ঠিক যেমন ছোটবেলায় বাচ্চারা ভেবে নেয় যত কাঁদবে-যত জেদ দেখাবে ততই তার কাঙ্খিত জিনিস প্রাপ্তির সম্ভবনা বৃদ্ধি পাবে। তারপর ধীরে ধীরে বড় হতে হতে সে শিখতে শুরু করে কার কাছ থেকে কি উপায়ে, কোন সময়ে কি চাইলে কি পাওয়া যাবে। যে কোনো সময় চাইলেই সব কিছু মেলে না।

আবার চাইবার পরিমাপ এবং চাইবার সঠিক ভঙ্গি অনেক সময় প্রিয়জনদের বা গুরুজনদের কাছ থেকে সহজেই আদায় করে নেয়া যায়। এতো গেলো জাগতিক-সাংসারিক চাওয়া-পাওয়ার ক্ষুদ্র হিসেব-নিকেষ। কিন্তু বিশ্বাসীরা বলেন, এই জগত-সংসারের যিনি রাজা তার কাছে চাইতে গেলে তো আর চালাকি চলে না। তার জন্য চাই শুদ্ধতা-পবিত্রতা-বিশ্বস্ততা-প্রেম।

আর কাদের মধ্যে এইসব গুণ কতটা রয়েছে সেটাই বড় প্রশ্ন এবং এই রজনীর পরীক্ষা। যেখানে শুদ্ধতা নেই সেখানে পরম নেই-গুরু নেই-ঈশ্বর নেই-ভগবান নেই-আল্লাহ নেই এমনকি নিজেও নেই। আস্তিক-নাস্তিকসহ সকল দর্শন মত-পথ-বিশ্বাস-বিজ্ঞানের একটাই লক্ষ্য। একটাই মিলনকেন্দ্র।

আর সেই মিলনকেন্দ্রে লীন হতে চাইলে হতে হয় শুদ্ধ। সর্বদেহে-সর্বমনে-সর্বক্ষণে। এর মাঝে কোনোরূপ ফাঁকিঝুঁকি চলে না। আর এই শুদ্ধতার জন্য চাই অনন্ত প্রেম। সর্বজীবে প্রেম। গুরুভক্তি। সাধুসেবা। বিনয়-আদব-কায়দা। নয়তো বিশেষ রাত জীবনে বহুবার আসতেই পারে কিন্তু তাকে ছুঁয়ে দেয়া যায় না।

জয়গুরু
।। আলেকসাঁই ।।

……………………
আরো পড়ুন:
মেরাজতত্ত্ব
শবে মেরাজ : ঊর্দ্ধোলোকের রহস্য যাত্রা

মেরাজ
শবে বরাত: নাজাতের ফিকির

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!