ভবঘুরেকথা

ভক্তালয় ভ্রমণ
(দ্বিতীয় পর্ব)

চাঁদকাঠি ভ্রমণ
বরিশাল জিলা মধ্যে চাঁদকাঠি গ্রাম।
গোপাল বিশ্বাস নামে ভক্ত গুণধাম।।

শ্রীউমাচরণ হয় তাঁর জ্যেষ্ঠ ভাই।
বইবুনে গ্রামে তিনি থাকে ভিন্ন ঠাঁই।।
এই বই বুনে ঘাটে গোলক পাগল।
হাঁড়ি ভেঙ্গে ঘাটে বসে বলে হরি বোল।।
বইবুনে ছাড়ি পরে গোপাল বিশ্বাস।
চাঁদকাঠি গ্রামে আসি করিলেন বাস।।
দুই পুত্র গোপালের সবে ইহাজানে।
গোপাল বিশ্বাস ধন্য ছিল ধনে মানে।।
ধন্য শ্রীগোপাল সাধু বাস লহ্মীখালী।
গোপালে গোপালে পরে হ’ল কোলাকুলী।।
গোপাল বিশ্বাস পরে নিজ পুত্র সনে।
সাধুর কন্যার বিবাহ দিল হৃষ্ট মনে।।
এ সব পরের কথা পশ্চাতে বলিব।
এবে শুন পূর্ব্ব কথা সংক্ষেপে কহিব।।
গোপাল বিশ্বাস সদা ওড়াকান্দী যায়।
দৃঢ় নিষ্ঠা আছে তার ঠাকুরের পায়।।
এক দিন সে গোপাল করে নিবেদন।
“দয়া করি চল প্রভু আমার ভবন।।”
অগ্রভাগে প্রভু তাতে না’হন স্বীকার।
গোপালের চক্ষে বারি ঝরে ঝর ঝর।।
ভক্তের ক্রন্দন দেখি প্রভু দয়া করে।
“চলহে গোপাল তবে যাই তব ঘরে।।”
পরে দিন স্থির করি দিলেন ঠাকুর।
গোপালের মনে শান্তি আসিল প্রচুর।।
দিন মত সে গোপাল উপস্থিত হল।
“পরদিন প্রাতেঃ ক’ব ঠাকুর কহিল।।
কৃষ্ণপুর বাসী ভক্ত শ্রীবিপিন বালা।
তারিণীর ভাই সেই বড় দেল-খোলা।।
ঠাকুর তাহারে কহে “শুনহে বিপিন।
কল্য যাব চাঁদকাঠী করিয়াছি দিন।।
তোমরা যতেক ভক্ত আছে কৃষ্ণপুরে।
আমার সঙ্গেতে যেতে হবে তথাকারে।।”
“যে-আজ্ঞা” বলিয়া তবে বিপিন ছুটিল।
অল্পক্ষণে নিজ দেশে উপস্থিত হল।।
চাঁদকাঠি হতে যেই নৌকা এসেছিল।
সেই নৌকা পরে প্রভু আপনি উঠিল।।
বিপিন দেশেতে গিয়া করে পরচার।
“চাঁদকাঠি চলিয়াছে প্রভুজী সুন্দর।।
মনে যদি বলে তবে এসো হে ছুটিয়া।
দিন গেল এই দিন পাবে না ফিরিয়া।।
বিপিনের ভীর শুনি ষষ্ঠীবাবু আসে।
লহ্মীকান্ত সোনাতন এল দীন বেশে।।
উমাচরণ রাজকুমার দুই জন।
এক সঙ্গে জুটি সবে করিল গমন।।
এ দিকেতে প্রভু চলি গেল পাটগাতী।
মন্ডল বাড়ীতে উঠে অতি হৃষ্ট মতি।।
প্রভু আগমনে তবে সেই মন্ডলেরা।
ত্রস্ত ব্যস্ত সবে যেন হল জ্ঞান-হারা।।
বহুৎ সম্মান করি কুলেতে উঠায়।
খাদ্য দ্রব্য আয়োজন বহু করে তায়।।
কৃষ্ণপুরবাসী সবে হইয়া সত্বর।
উপস্থিত জোয়ারিয়া অভয়ের ঘর।।
অভয়াচরণ নাম উপাধি শিকদার।
মতুয়ার গণে দিল উত্তর আহার।।
মতুয়ারা তথা হৈতে যবে যাত্রা করে।
দু’টী মাছ আনি দিল ঠাকুরের তরে।।
প্রচন্ড কবজী মাছ নধর গঠন।
মতুয়ারা তাহা নিয়া করিল গমন।।
মিত্র ডাঙ্গা বাসী সাধু শ্রীহাদান রায়।
ঠাকুরের পদে তাঁর নিষ্ঠা অতিশয়।।
সেই বাড়ী মতুয়ারা উপস্থিত হ’ল।
বহু যত্নে সে হাদান শুশ্রূষা করিল।।
হাদানের বৃদ্ধা মাতা অতি ভক্তিমতী।
মনোদুঃখে বলিতেছে মতো গণ প্রতি।।
“এতই অভাগী আমি ভক্তি শক্তি নাই।
কর্ম্মদোষে গুরুচাঁদে দেখা নাহি পাই।।”
এতেক বলিয়া বুড়ী কান্দিল প্রচুর।
কান্না তার দেখিলেন দয়াল ঠাকুর।।
মতুয়ারা বলে “মাগো! নাহি কান্দ’ আর।
মনের বাসনা পূর্ণ হইবে তোমার।।”
তথা হতে টুঙ্গীপাড়া হ’ল উপস্থিত।
শ্রীতপস্বী বালা গৃহে হল অধিষ্ঠিত।।
হেন কালে পাটগাতী বাসী একজন।
সেই বাটী উপস্থিত হইল তখন।।
সে বলে “এখানে বসে রহিয়াছে সবে।
পাটগাতী হতে প্রভু এখনি উঠিবে।।”
কথা শুনি কয়জনে শ্রীঘ্রগতি ধায়।
মনে ভাবে কোথা দেখা পাব দয়াময়।।”
এদিকে ঠাকুর তবে পাটগাতী ছাড়ি।
কিছুপরে ধরিলেন মধুমতী পাড়ি।।
মাশীখালী গ্রামে ঘর শ্রীবদন রায়।
তস্য গৃহে উপস্থিত প্রভু দয়াময়।।
কিছু পরে কৃষ্ণপুবাসী ভকতেরা।
উপস্থিত সেই বাড়ী চক্ষে জল ধারা।।
দয়া করি দয়াময় কহিল ডাকিয়া।
“কি বিপিন! ষষ্ঠিবাবু! এসেঝ ছুটিয়া?”
তাহার কান্দিয়া বলে “ওগো কৃপাময়।
তোমার ইচ্ছামতে ভবে সর্ব্ব কর্ম্ম হয়।।”
রজনী বঞ্চিল প্রভু বদনের বাড়ী।
ভক্তগণে বলে হরি সারারাত্রি ভরি।।”
যামিনী বিদায় হল প্রভাত আসিল।
প্রভু বলে “আর কেন শ্রীঘ্র শ্রীঘ্র চল।।
নামেতে অভয়চন্দ্র নাওটানা বাড়ী।
প্রভুর চরণে তলে পড়িলেন গড়ি।।
প্রভু কয় “কি অভয় কি ভাব অন্তরে?
শ্রীঘ্র করি রাঁধ ভাত যাব তব ঘরে।।”
আনন্দে অভয় তবে ছুটিয়া চলিল।
অল্পপরে নিজ গৃহে উপস্থিত হল।।
সুসংবাদ দিল যবে আপনার ঘরে।
নর নারী সবে কান্দে ব্যাকুল অন্তরে।।
অভয় বলিল “সবে স্থির কর মন।
শ্রীগুরু স্মরিয়া সবে করহ বন্ধন।।
আমাদের দেখ বটে কোন গুণ নাই।
দয়া করে আসে প্রভু তাই তাঁরে পাই।।
তাঁর দয়া মনে করে ভাব গো তাঁহারে।
রাঁধ গে সকল-কিছু তাঁরে চিন্তা করে।।”
মাতাগণে ব্যস্ত হয়ে করিছে রন্ধন।
প্রভুকে স্মরিয়া সদা ঝরিছে নয়ন।।
হেনকালে প্রভু আসি ঘাটেতে উদয়।
নারীগণে হুলুধ্বিনি করিছে সদায়।।
তাহাদের ভাব দেখি সুখী দয়াময়।
রজনী রঞ্চিল তথা হইয়া সদয়।।
আহারাদি আয়োজন হৈল বহুমতে।
সন্ধ্যাকালে মতুয়ারা মাতিল নামেতে।।
এই ভাবে রাত্রি শেষে প্রভাত সময়।
সাঙ্গ পাঙ্গ লয়ে প্রভু চাঁদকাঠি যায়।।
বহু ধনবান ছিল গোপাল বিশ্বাস।
মহাতেজে করিলেন সেই দেশে বাস।।
প্রভু আগমন জিন্য পুরী ধন্য হয়।
বহু ভক্তি দেখাইল সেই মহাশয়।।
প্রভু আগমন বার্ত্তা চারিদিকে ধায়।
দলে দলে ভক্ত আসি জুটিল তথায়।।
শ্রীনীলকমল বালা ডাকিতিয়া বাড়ী।
প্রভুর চরণে তাঁর নিষ্ঠা ছিল ভারী।।
তার ইচ্ছা ঠাকুরকে নিবে নিজ ঘরে।
করজোড়ে সেই ভাবে দরবার করে।।
গোপাল বিশ্বাস তাহে ভাবে মনে মন।
অপরের বাড়ী প্রভু যাবে কি কারণ?
এত ভাবি এক বুদ্ধি করে মহাশয়।
সকলেরে ডাকি কথা রটনা করয়।।
ঠাকুরে এনেছি মোরা আপন-নৌকায়।
প্রভুকে পাঠাব তাতে কহি পুনরায়।।
কেহ যদি নিজগৃহে প্রভুকে লইবে।
নিজ নিজ নৌকা তারা জোগাড় করিবে।।”
একথা শুনিল যবে নীলকমল বালা।
গোপালের পদে পড়ি কহে সেই বেলা।।
“কাঙ্গাল দেখিয়া মোরে হইলে বিমুখ।
এ কারণে মনে বড় পাইতেছি দুঃখ।।
দয়াকরে আজ্ঞা কর নিয়ে চলি তরী।
মম গৃহে যায় যদি অকুল কান্ডারী।।”
এই মত বহু কথা বলে সেই জন।
তাহাতে ভিজেনা তবু গোপালের মন।।
সে নীলকমল তবে নিরাশ হইয়া।
বদন রায়ের পদে পড়িল আসিয়া।।
বদনের শিষ্য বটে সেই মহাজন।
“করিব উপায়” বলে ভাবিয়া বদন।।
নৌকা দিল আর লোকে দিল কত জন।
বলে “এতে ঠাকুরকে কর আনয়ন।।”
বল পেয়ে তারা সবে তরণী ছুটাল।
অন্তর্য্যামী দয়াময় সব টের পেল।।
গোপালের বাড়ী হতে লইয়া বিদায়।
নড়াগ্রামে উপস্থিত হল দয়াময়।।
সেইখানে দেখা হয় বিপিনের সাথে।
অতঃপর দুই নৌকা চলে এক পথে।।
বেগবতী মধুমতী তরঙ্গেতে ভরা।
পাড়ি দিতে শঙ্কা করে সাথী সঙ্গী যারা।।
মহাপ্রভু বলে “তোরা কেন বসে রলি?
সিংহ-শিশু হয়ে শেষে শৃগাল সাজালি।।”
এই বাক্য বলে যদি প্রভু দয়াময়।
সঙ্গী সাথী দেহে যেন মহাবল পায়।।
জয় হরিচাঁদ জয় গুরুচাঁদ জয়।
ধ্বনি করে তরঙ্গেতে তরণী ভাসায়।।
পর্ব্বত প্রমাণ ঢেউ আসিছে ছুটিয়া।
ঠাকুরের তরী অগ্রে পড়িছে লুটিয়া।।
নৌকা স্পর্শ মাত্র তারা সবে শান্ত হয়।
ঠাকুরের তরী তাহে চলে নিরালায়।।
উচ্চ-ফণা ফণী যথা ধরে মহারোষে।
সাপুড়িয়া দেখে শির নত করে শেষে।।
সেই মত ঢেউগুলি তোলে উচ্চশির।
ঠাকুরের নৌকা দেখে হয় যায় স্থির।।
পরপারে এসে লাগে ঠাকুরের তরী।
বিপিনের নৌকা দূরে তরঙ্গ-উপরি।।
মনে হয় নৌকা বুঝি ডোবে সেই ক্ষণে।
বাহকেরা বাহে নৌকা শঙ্কাকুল মনে।।
ক্ষণে ক্ষণে ডাক দেয় “বাবা গুরুচাঁন।
দয়া করে রক্ষা কর আমাদের প্রাণ।।”
হেনকালে বজ্রকন্ঠে কহিল ঠাকুর।
‘বিপিন বিপিন তুই আর কত দূর।।”
বিপিন শুনিল ধ্বনি নদীর মাঝারে।
দেখিল তরঙ্গ থেমে গেছে একেবারে।।
দুই ঢেউ জলমাত্র উঠেছিল নায়।
প্রভুর ডাকের পরে সব থেমে যায়।।
কূলেতে পৌছিল যবে বিপিনের নাও।
প্রভু বলে “কি বিপিন কোন পথে যাও?
পাছে পাছে না থাকিলে দেখ কিবা ফল।
ফাঁক পেয়ে ঢেউ দেখ তুলিয়াছে জল।।
ভাত যদি ছাড় তবু সাথ ছেড় না রে।
সাথী ছাড়া হলে রক্ষা নাহি এ সংসারে।।”
প্রভুর বচনে তারা ভাবিছে হৃদয়।
এমন দয়াল বন্ধু আছে কে কোথায়?
দয়া করে নিজ হাতে ‘ডোবা’ টেনে তোলে।
দুঃখী তাপী পাপী সব লয় নিজ কোলে।।
এতেক ভাবিয়া চক্ষে বহে প্রেম বারি।
প্রভু কয় “নৌকা সবে খোল” ত্বরা করি।।
হেন কালে বদনের যত লোক জন।
প্রভুর নৌকার পাশে উদয় তখন।।
জিজ্ঞাসা করিল তারা “এই নৌকা কার?
প্রভুর সঙ্গীরা কহে “ওড়াকান্দী ঘর।।
মহাপ্রভু গুরুচাঁদ আছে নৌকা পরে।
তোমরা কাহারা তাহা বল ঠিক করে।।”
তারা কহে “এই নৌকা যাইবে কোথায়?
প্রভুর সঙ্গীরা কহে “ডাকাতিয়া গাঁয়।।”
এতেক বচন শনি তাহারা সকলে।
প্রভুর নৌকার কাছে আসে দ্রুত চলে।।
তারা বলে “মোরা আসি লইতে ঠাকুরে।
ঠাকুর বলিল “তবে বাও জোর করে।।”
বলামাত্র জোরে তবে তরণী বাহিল।
ডাকাতিয়া গ্রামে আসি উপস্থিত হল।।
সে নীলকমল তবে আনন্দিত মনে।
পাদ্যঅর্ঘ্য আনি দিল প্রভুর সদনে।।
প্রেমানন্দে নাম গান সবে সেথা করে।
রজনী বঞ্চিল সবে সেই ভাব ধরে।।
রজনী প্রভাতে প্রভু ডাকাতিয়া হতে।
উপনীত হল সেই কানারচরেতে।।
অশ্বিনী ঠাকুর বলি কহে পরিচয়।
তার গৃহে গুরুচাঁদ উপনীত হয়।।
আহারাদি শেষ করে চলিলেন পুনঃ।
পরে পরে কোথা গেল ক্রমে ক্রমে শুন।।
অশ্বিনী গোঁসাই ধন্য গঙ্গাচর্ণা গ্রামে।
“শ্রীহরি সঙ্গীত” রচে হরিগুরু নামে।।
পিককন্ঠ গোস্বামীজী মহাভাবময়।
যথা যান গুরুচাঁদ সঙ্গে সঙ্গে যায়।।
প্রেম মাখা সুরে তেঁহ সদা রাত্র দিনে।
সঙ্গীতের ডালি দেয় শ্রীগুরু-চরণে।।
তাঁর গৃহে উপনীত হন দয়াময়।
প্রেমানন্দে অশ্বিনীর চোখে ধারা বয়।।
দেশবাসী অশ্বিনীরে বহু ভালবাসে।
গুরুচাঁদে দেখিবারে তাঁর গৃহে আসে।।
ভক্ত বাঞ্ছা পুরাইয়া তবে দয়াময়।
রাজনগরেতে আসি হলেন উদয়।।
নামেতে প্রহলাদচন্দ্র হালদার গুণী।
তাঁর গৃহে উপস্থিত নিজ গুণমণি।।
মহাসংকীর্ত্তন হল সেই গৃহ পরে।
বাহ্যজ্ঞান হারা হল যত নারী নরে।।
কি এক ভাবের ঢেউ উঠিল কীর্ত্তনে।
মোর শক্তি নাহি তাহা করিতে বর্ণনে।।
দেশকাল পাত্রাপাত্র কোন জ্ঞান নাই।
নেচে নেচে হরি বলে সবে ছাড়ে হাই।।
মাতিয়াছে মতুয়ারা কীর্ত্তন মাঝারে।
দূরে থাকি দয়াময় কৃপানেত্রে হেরে।।
প্রভুর পলক পড়ে মতুয়ার গায়।
বিদ্যুতের স্পর্শে যেন প্রাণে নাড়া দেয়।।
ধন মান জাতি কুল মনে নাহি থাকে।
এক লক্ষ্যে সবে মিলে হরি বলে ডাকে।।
প্রথমতঃ দূরে যারা চুপ বসে ছিল।
নামের প্লাবন শেষে তাদের ডুবাল।।
ক্রমে ক্রমে নর নারী নাহি ভেদ জ্ঞান।
জ্ঞান হারা ধূলি পরে গড়াগড়ি যান।।
এমত প্রহর কাল কীর্ত্তন হইল।
শ্রীগুরু আদেশে পরে সকলে থামিল।।
নেশা ছেড়ে গেলে প্রাণে বিরহ আসিল।
শর-বদ্ধ পাখী সম তাহারা কান্দিল।।
কান্না দেখি গুরুচাঁদ কথা নাহি কয়।
ইঙ্গিতে নিবৃত্ত করে ভক্ত সমুদয়।।
মহাধনী পোদ্দারেরা সবে বড়বাড়ী।
শশী বাবু কন্যা বিয়া দিল সেই বাড়ী।।
সেই বাড়ী হতে আসি লোক একজন।
কাতরে প্রভুকে তবে করে আমন্ত্রণ।।
স্বীকার করিল প্রভু সেই গৃহে যেতে।
ভক্ত গণে সবে বলে “চল মোর সাথে।।
আমার কুটুম্ব এরা মহা ধনবান।
এই দেশে আছে জানি তাদের সম্মান।।
কুটুম্বেরে বাড়ী যাব কুটুম্ব আচারে।
চল সবে জামা জুতা পরিধান করে।।”
সর্ব্ব নীতি-দাতা জানি গুরুচাঁদ প্রভু।
কার কাছে কোন কাজে ঠকিবে না কভু।।
আপন আদর্শে গড়ে মতুয়া সমাজ।
তাই সর্ব্বনীতি জানে মতুয়ারা আজ।।
সে সব বৃত্তান্ত পরে করিব বর্ণন।
এবে শুন শুভ বার্ত্তা প্রভুর বচন।।
পোদ্দারের বাড়ী পরে গেল দয়াময়।
মহাসমারোহ হয় পোদ্দার-আলয়।।
সমাজের কথা বহু হয় আলাপন।
কোন ভাবে এ জাতির হবে জাগরণ।।
বহু বাক্যভাষী হয় বিহারী পোদ্দার।
শ্রীরাস বিহারী হয় অন্য নাম তাঁর।।
চারি দিকে যত সব প্রধানেরা ছিল।
পোদ্দার বাড়ীতে আসি উপস্থিত হল।।
তেঁহ সঙ্গে গুরুচাঁদ বহুনীতি কয়।
শুনিয়া সকল লোক মানিল বিষ্ময়।।
বেদাঙ্গ, পূরাণ কহে, গীতাধর্ম্ম কয়।
স্মৃতি, শ্রুতি, ভাগবত যত শাস্ত্র রয়।।
“সদ্ভাব শতক’ গ্রন্থ করিব রচনা।
ইতিহাসে বধ কাব্য” করে আলোচনা।।
ইতিহাসে কোন রাজা কি কি কার করে?
বর্ণে বর্ণে প্রভু কহে তাদের গোচরে।।
অশোকের কথা বলে বিবিধ প্রকারে।
আকবর, জাহাঙ্গীর মোগলের ঘরে।।
শাজাহান বাদশার কীর্ত্তিকথা যত।
তাজমহল হর্ম্ম্য যাহা পৃথিবী-বিখ্যাত।।
আধুনিক যুগে যত বড় বড় নেতা।
গুরুচাঁদ বলিলেন তাঁহাদের কথা।।
সে সব কাহিনী শুনি বিস্মিত সকলে।
তারা ভাবে প্রভু ইহা কি করিয়া বলে?
ইহার কারণ কিছু শুন বলি ভাই।
লোকাচার ধর্ম্মাচার দুইধারা পাই।।
লোকাচার গুরুচাঁদ বালক বয়সে।
বিদ্যাশিক্ষা করিলেন পাঠশালে বসে।।
পরে স্বীয় গৃহে করে শাস্ত্র অধ্যয়ন।
ভাগবত পুরাণাদি করিল পঠন।।
ইহ পরে রঘুনাথ পন্ডিত আসিল।
প্রভুর আজ্ঞাতে তেঁহ ওড়াকান্দী রল।।
তাঁর সাথে আলাপনে প্রভু পায় সুখ।
শাস্ত্র আলাপনে উভে বড়ই উন্মুখ।।
বহু বহু পুস্তকাদি রঘুনাথ পড়ে।
সকল শোনেন প্রভু বসি কিছু দূরে।।
এই ভাবে রঘুনাথ নিত্য আসে যায়।
যতেক সুন্দর গ্রন্থ প্রভুকে শুনায়।।
পরে যবে বড়বাবু শ্রীশশীভূষণ।
পাঠ শেষ করি গৃহে করে আগমন।।
প্রভু তারে কাছে ডাকি বলে ক্ষণে ক্ষণে।
সংবাদ পত্রিকা তুমি পড় মোর স্থাণে।।
ইতিহাস, পত্রিকাদি পড়িতেন শশী।
গুরুচাঁদ শুনিতেন একমনে বসি।।
শুনিবার, জানিবার ইচ্ছাই প্রবল।
আলোচনা করে প্রভু হাসে খল খল।।
শাস্ত্র গ্রন্থ যত কেন ইউক কঠিন।
সিদ্ধান্ত জিজ্ঞাসা নাহি করে কোনদিন।।
এক মনে বসে শোনে আসন উপর।
শ্রুতমাত্র জানা সব যেন শ্রুতি ধর।।
এ সব কেনবা নাহি হবে তাই বল
মহা প্রভু গুরুচাঁদ নিজে মহাকাল।।
আগম নিগম কথা পঞ্চমুখে যাঁর।
নরাকারে অবতীর্ণ হলেন এবার।।
কেবা তারে কি শিখায় সব তার জানা।
মানবীয় ধর্ম্মে শুধু করে আলোচনা।।
খৃষ্ঠানের ধর্ম্মকথা মীড তারে কয়।
ভক্ত সঙ্গে প্রভু তারে মিমাংসা করয়।।
কোন গুণে খৃষ্ঠ হল জগতে পূজিত।
প্রকৃত মিমাংসা প্রভু তাহার করিত।।
মীড নাহি জানে কভু সে সব বন্ধান।
উঘারিয়া বলে তাহা প্রভু গুরুচান।।
সময়ে সময়ে প্রভু তাহারে কহিত।
প্রভুর বচন শুনি মীড স্তব্ধ হত।।
কিছু কিছু সে প্রমাণ প্রভু বলে সেথা।
শুনিয়া বিস্মিত সবে নোয়াইল মাথা।।
এই ভাবে একত্রিত সেখানে কাটায়।
প্রভুর বচনে সবে মহা শান্তি পায়।।
রজনী প্রভাতে প্রভু সাঙ্গ পাঙ্গ লয়ে।
টুঙ্গীপাড়া পানে চলে অতি ব্যস্ত হয়ে।।
বিপিন কবজী মাছ রেখেছে তথায়।
অভয়ের প্রেম-ভক্তি যার সঙ্গে রয়।।
কি ধন্য প্রভুর খেলা দেখি সর্ব্বদায়।
এক কার্য্য উপলক্ষ্যে বহু কার্য্য হয়।।
তপস্বী নৈষ্ঠিক ভক্ত আশা করে মনে।
প্রভু যদি দয়া করে নামে তার স্থানে।।
অভয় পাঠায় মাছ প্রভু সেবায়।
আশা আর ভক্তি মেশে টুঙ্গীপাড়া গাঁয়।।
এক কার্য্যে দুই কাজ তৃতীয় টীবাকী।
হাদান রায়ের মাতা যাহা বলে ডাকি।।
ভক্তের ভাবনা সিদ্ধ করে ভাবময়।
শ্রীঘ্রগতি টুঙ্গীপাড়া হলেন উদয়।।
তপস্বীর মনোবাঞ্ছা পরিপূর্ণ হয়।
অভয়ের মাছ লাগে প্রভুর সেবায়।।
হাদান বসিয়া কান্দে কথা নাহি কয়।
তারে কাছে ডাকি তবে বলে দয়াময়।।
“শুনহে হাদান তুমি বাড়ী চলে যাও।
তোমার দেশের পথে যাবে মোর নাও।।”
এ বাক্য শুনিয়া সবে বুঝিল তখনে।
অন্তর্য্যামী গুরুচাঁদ সব কথা জানে।।
পরে মিত্রডাঙ্গা আসি উঠে দয়াময়।
হাদানের জননীর বাঞ্ছা পূর্ণ হয়।।
তথা হতে যাত্রা করি নিজ গৃহে আসে।
আনন্দে ভকত দলে প্রেমানন্দে ভাসে।।
যে যে দেশে গুরুচাঁদ করিলেন গতি।
সর্ব্বখানে সর্ব্বলোক আনন্দিত অতি।।
পরম পবিত্র কথা গুরুচাঁদ কয়।
তাহা শুনি দলে দলে তাঁর ভক্ত হয়।।
জীবেরে তরিতে প্রভু কত কষ্ট সয়।
তবু দেখ মহানন্দ অন্ধ সেজে রয়।।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!