ভবঘুরেকথা
শ্রীকৃষ্ণ কালা দোল উৎসব

শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে আমরা যেটুকু দেখতে পাই, তাতে বুঝতে পারি যে তিনি একজন প্রজ্ঞাবান পুরুষ ছিলেন এবং তাঁর আশেপাশের সকলে তাঁর কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণ করে লক্ষ্য স্থির করতেন। তাই অর্জুন যে তাঁকে পথপ্রদর্শন করতে অনুরোধ করবেন তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই।

আমি অনেকবার বলেছি, কৃষ্ণ সবসময় অনাসক্ত থাকতেন; সবকিছুর গভীরে অবস্থান করেও নিজের মনকে তার থেকে তুলে ধরে রাখতেন। আদর্শ জীবন কী, সে আলোচনা করতে গিয়ে এমার্সন গীতার একটি বিখ্যাত শ্লোকের সূত্র ধরে বলছেন, ভিড়ের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলা বা একাকী শান্ত হয়ে থাকা সোজা; কিন্তু তিনিই আদর্শ মানুষ যিনি সমাজের মধ্যে থেকে ও সমাজের মধ্যে কাজ করেও তাঁর মস্তিষ্কটি ধীর স্থির রাখতে পারেন।

জগৎ যখন হাসতে বলবে তখন যদি আমরা হাসি, আর জগৎ যখন কাঁদতে বলবে তখনই যদি আমরা কাঁদি, তবে সেটা অতি সাধারণ ব্যাপার হবে। পূর্ণতা তখনই এসেছে বলে বোঝা যাবে যখন প্রচণ্ড হৈচৈ তথা বাজারের মধ্যেও আমরা আমাদের মন শান্ত রাখতে পারব। তা না হলে আমাদের উন্নতি একপেশে হয়েছে বলতে হবে।

অর্জুন যখন বিভ্রান্তিতে পড়েছেন, তখন কৃষ্ণ প্রশান্ত, মৃদু হাসির সঙ্গে কথা বলেছেন- তিনি ভালমতই জানেন যে ঐ বিভ্রান্তি তিনি অপনয়ন করতে পারেন। তাই, এমন মানুষের কাছে আত্মসমর্পণ করার মানে আমাদের উন্নতি নিশ্চিত করা।

এখানে শিষ্য মহৎ, গুরুও তাই। যখন একজন মহৎ শিষ্য একজন মহৎ গুরুর সম্মুখীন, তখন সেই সংস্পর্শে একটি জীবনদায়ী ভাবের জন্ম হবে, আমরা এমন আশা করে থাকি। এ বিষয়ে কঠোপনিষদে আছে(১/২/৭):

আশ্চর্যো বক্তা কুশলোহস্য লব্ধা আশ্চর্যো জ্ঞাতা কুশলানুশিষ্ট- “নিপুণ আচার্য এবং বিরল ও সুনিপুণ শিষ্যের সম্মিলনেই মহৎ প্রজ্ঞার জন্ম হয়।”

অতএব অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে তাঁর পথপ্রদর্শকরূপে গ্রহণ করলেন। আমরা যদি একজন মানুষের পরিচয়কে সবদিক দিয়ে যাচাই করে নিয়ে তাঁকে উপযুক্ত বলে বুঝে তারপর তাঁর হাতে নিজেকে সমর্পণ করি, তবে আমরা তাঁর আশ্রয়ে নিরাপদে অবস্থান করি।

বিপরীত দিক দিয়ে, আমরা যদি নির্বিচারে যেকোন কারও কাছে আমাদের স্বাতন্ত্র্য বিকিয়ে দিই, তবে তাতে আমাদের ভ্রষ্ট হয়ে যাবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা থাকে। আমাদের এই দেশে এবিষয়টি বিশেষভাবে মাথায় রাখতে হবে। যেখানে গুরু অনেক, শিষ্য অল্প, আপনি সেখানে জানেন না কার কাছে নিজেকে সমর্পণ করবেন। এই অবস্থা সম্বন্ধে ব্যঙ্গাত্মক একটি সুন্দর শ্লোক আছে:

গুরবো বহবঃ সন্তি শিষ্য-বিত্তাপহারিণঃ
তম্‌ একং শঙ্করং বন্দে শিষ্য-সন্তাপহারিণম্‌।।

একবার আমরা এইরকম একজন আচার্যের সান্নিধ্য পেলে তাঁর কাছে নিজেদের সঁপে দিতে কোন বাঁধা নেই, কারণ তখন আমরা কোন বিশেষ ব্যক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করছি না, আমরা আত্মসমর্পণ করছি তাঁর মধ্যে যে-পরম্পরা প্রতিমূর্ত হয়ে আছে- তার প্রতি। অন্যপক্ষে, আমরা যদি যেকোন মানুষের কাছে আত্মসমর্পণ করি, তবে তাতে গুরু-শিষ্য উভয়েরই ক্ষতি। শ্রীরামকৃষ্ণ যেমন বলেছেন:

গুরু যদি প্রজ্ঞাবান না হন, তবে তাতে গুরু ও শিষ্য দুজনেরই যন্ত্রণা। গুরুর থাকতে হবে অসামান্য শক্তি যাতে তিনি নিজের ও শিষ্যের- উভয়েরই দুঃখ উপশম করতে পারেন। তিনি যেন শিষ্যকে উত্থিত করতে ও তাকে উদ্ধার করতে সক্ষম হন।

একজন প্রকৃত গুরুর গুণাবলীর বর্ণনা দিয়েছেন শ্রীশঙ্করাচার্য তাঁর বিবেকচূড়ামণি গ্রন্থে(৩৩):

শ্রোত্রিয়োহবৃজিনো অকামহতো যো ব্রহ্মবিত্তমঃ।
ব্রহ্মণ্যুপরতঃ শান্তো নিরিন্ধন ইবানলঃ।
অহেতুকদয়াসিন্ধুঃ বন্ধুরামতাং সতাম্‌।।

“বেদজ্ঞ, নিষ্পাপ, কামনাশূন্য যে ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ বাহ্যবিষয় ত্যাগ করে ব্রহ্মচিন্তায় মগ্ন, শান্ত, জ্বলিতিকাষ্ঠ ধূমশূন্য অগ্নির মতো তেজস্বী, অহেতুকদয়াসিন্ধু (তিনি) প্রণত সৎ ব্যক্তিগণের বন্ধুস্বরূপ।’

……………………………………..
স্বামী রঙ্গনাথানন্দের ‘শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতার রূপরেখা’
আরও আধ্যাত্মিক তথ্য পেতে ও জানতে : ভারতের সাধক-সাধিকা
পুণঃপ্রচারে বিনীত-প্রণয় সেন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!