ভবঘুরেকথা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব

শ্রীরামকৃষ্ণদেবের বাণী: দুই

৩১.
মনের গুণে হনুমান সমুদ্র পার হয়ে গেল। আমি রামের দাস আমি রামনাম করেছি আমি কি না পারি! এই বিশ্বাস।

 

৩২.
তুমি যদি তত্ত্বানুসন্ধিৎসু হও, তাহা হইলে শ্রীরামকৃষ্ণের সর্ব্বলোকপাবন নিখিল সন্তাপহর চরিত্র সাগরে অবগাহন কর।

 

৩৩.
সত্যি কথা বলার সময় খুবই নম্র এবং একাগ্র হওয়া উচিত কারণ সত্যের মাধ্যমে ভগবানকে অনুভব করা যেতে পারে।

 

৩৪.
দুনিয়া বাস্তবে সত্য ও বিশ্বাসের একটি মিশ্রণ, বিশ্বাস তৈরি করে এমন জিনিসকে ত্যাগ করুন এবং সত্যকে গ্রহণ করুন।

 

৩৫.
আমার দেহের মধ্যে মা-কালী ও সমস্ত দেবদেবী আছেন। তাই আমার মূর্তি ধ্যান করলেই সকল দেব দেবীর ধ্যান করা হবে।

 

৩৬.
তিনি চিৎসমুদ্রস্বরূপ, শিব শুক সনক নারদাদি সেই সমুদ্রের এক এক ফোঁটা জল পান করিয়া আনন্দে বিভোর হইয়া গিয়েছেন।

 

৩৭.
বিশ্বজনীন লীলাময়ী কালীই শ্রীরামকৃষ্ণ বিগ্রহ ধারণ করিয়া তাঁহার অসংখ্য পুত্রকন্যাগণকে জ্ঞান ভক্তি দিবার জন্য অবতীর্ণ হইয়াছেন।

 

৩৮.
সেদ্ধ ধানে গাছ হয় না। অসেদ্ধ ধানে হয়। সিদ্ধ হয়ে মানুষ মরলে আর জন্ম হয় না, কিন্তু অসিদ্ধ অবস্থায় মরলে আবার জন্ম নিতে হয়।

 

৩৯.
স্বাধীনতাই সুখের মূল। স্বাধীনতাই মানবকে অমিততেজঃসম্পন্ন করিয়া থাকে। শ্রীরামকৃষ্ণ এই স্বাধীনতা ধন কখনও নষ্ট করেন নাই।

 

৪০.
তাঁহার নিজের আমিত্ব তাঁহার ভিতর ছিল না বলিয়া জগৎ প্রসূতি কালীর আমিত্বই তাঁহার ভিতর দিয়া সর্ব্বতো ভাবে প্রকাশ পাইত।

 

৪১.
ঈশ্বর এক, তাঁর অনন্ত নাম ও অনন্ত ভাব। যার যে নামে ও যে ভাবে ডাকতে ভাল লাগে, সে সেই নামে ও সেই ভাবে ডাকলে দেখা পায়।

 

৪২.
পবিত্র গ্রন্থের মধ্যে অনেক ভালো কথাই পড়া যেতে পারে কিন্তু এইরকম হয়ত কোনো গ্রন্থই নেই যেটা পড়ে ধর্মকে গড়ে তোলা সম্ভব।

 

৪৩.
শুদ্ধ জ্ঞান এবং শুদ্ধ প্রেম একই জিনিস। জ্ঞান আর প্রেমের মাধ্যমেই লক্ষ্যকে পূরণ করা যেতে পারে, আর এখানে প্রেম নামক রাস্তাটি বেশি সহজ।

 

৪৪.
যদি একবার তীব্র বৈরাগ্য লাভ হয়ে ঈশ্বর লাভ হয়, তাহলে আর মেয়েমানুষে আসক্তি থাকে না। ঘরে থাকলেও, মেয়েমানুষে আসক্তি থাকে না, তাদের ভয় থাকে না।

 

৪৫.
একটি নৌকা জলে থাকতে পারে, তবে জলের নৌকায় থাকা উচিত নয়। একজন আধ্যাত্মিক উচ্চাকাঙ্ক্ষী বিশ্বে বাস করতে পারে, কিন্তু বিশ্বের তার মধ্যে থাকা উচিত নয়।

 

৪৬.
যখন হাওয়া চলতে থাকবে তখন পাখা চালানো বন্ধ করে দেওয়া উচিত কিন্তু যখন ঈশ্বরের কৃপা দৃষ্টি বজায় থাকবে তখন প্রার্থনা আর তপস্যা কখনই বন্ধ করা উচিত নয়।

 

৪৭.
যিনি ঈশ্বর লাভ করেছেন, তিনি কামিনীকে আর অন্য চোখে দেখেন না যে ভয় হবে। তিনি ঠিক দেখেন যে মেয়েরা মা ব্রহ্মময়ীর অংশ আর মা বলে তাই সকলকে পূজা করেন।

 

৪৮.
যদি একটা চুম্বক পাথর খুব বড় হয়, আর একটা সামান্য হয়, তাহলে লোহাকে কোনটা টেনে লবে। ঈশ্বর বড় চুম্বক পাথর, তাঁর কাছে কামিনী ছোট চুম্বক পাথর! কামিনী কি করবে?

 

৪৯.
ভগবান সর্বত্র আছেন এবং প্রত্যেক কণায় আছেন। কিন্তু তিনি একটি মানুষের মধ্যে সবচেয়ে অধিক থাকেন। তাই এইজন্যই ভগবানরূপী মানুষের সেবা করাই ভগবানের আসল সেবা।

 

৫০.
কোনও রূপ বন্ধন তাঁহাকে সংকীর্ণ করিতে পারে নাই। তাঁহার হৃদয় অনন্ত আকাশের ন্যায় বিশাল ছিল। এই হেতুই তিনি পৃথিবীর যাবতীয় ধর্ম্মসম্প্রদায়ের সহিত সহানুভূতি করিতে পারিতেন।

 

৫১.
কিন্তু তিনি যতক্ষণ না তাঁর দুয়ার খুলে দেন ততক্ষণ তিনি আমাদের কাছে অধরা… তাঁর দুয়ার খোলার, তার অঙ্গনে ঢোকার একটিই শর্ত… শরনাগত… শরণাগত… শরণাগত থাকা তাঁর শ্রীচরণে।

 

৫২.
কোন কামনা-বাসনা রাখতে নাই। কামনা-বাসনা থাকলে সকাম ভক্তি বলে! নিষ্কাম ভক্তিকে বলে অহেতুকী ভক্তি। তুমি ভালবাসো আর নাই বাসো, তবু তোমাকে ভালবাসি। এর নাম অহেতুকী।

 

৫৩.
পৃথিবীতে যত ধর্ম্মমত আছে, তৎসমস্তই তাঁহার শ্রীপাদমূলে যাইবার একটি পথ। তুমি যে পথে আজন্ম স্থাপিত হইয়াছ, সেই পথ দিয়াই অগ্রসর হও, কালক্রমে চির শান্তিনিকেতনে বিভুপাদপদ্ম আশ্রয় করিতে সমর্থ হইবে।

 

৫৪.
যে স্থলে সচরাচর লোকে আমার শব্দ ব্যবহার করিয়া থাকে, তিনি সেই স্থলে নিজ হৃদয়ে হস্ত স্থাপন পূর্ব্বক এখানকার শব্দ প্রয়োগ করিতেন যথা আমার ভাব এরূপ নয় বলিতে হইলে তিনি এখানকার ভাব এরূপ নয় ইহা বলিতেন।

 

৫৫.
ভগবানের অনেক নাম আছে এবং তাঁকে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রাপ্ত করা যেতে পারে। তুমি তাঁকে কি নাম ডাকো এবং কিভাবে তাঁর পুজো করো এটা কোনো বড় বিষয় নয়, গুরুত্বপূর্ণ এটাই যে তুমি তাঁকে নিজের ভিতর কতটা অনুভব করো।

 

৫৬.
তুমি রাত্রে আকাশে অনেক তারা দেখতে পাও কিন্তু যখন সূর্য ওঠে তখন সেই তারাদের আর দেখা যায় না। ঠিক এই ভাবেই, অজ্ঞানতার কারণে যদি তুমি ভগবানকে প্রাপ্ত করতে না পারো, তাহলে এর মানে এটা মোটেই নয় যে ভগবান নেই।

 

৫৭.
যদি আপনি বিশুদ্ধ হতে চান, দৃঢ় বিশ্বাস থাকুন এবং ধীরে ধীরে আপনার ভক্তিমূলক অভ্যাসগুলির সাথে নিরর্থক শাস্ত্রীয় আলোচনা এবং তর্কবিতর্ক-এর মধ্যে আপনার শক্তি নষ্ট না করেই চলুন। আপনার সামান্য মস্তিষ্ক অন্যথায় চটকদার করা হবে।

 

৫৮.
যে ঠিক ভক্ত, তার কাছে হাজার বেদান্ত বিচার কর, আর স্বপ্নবৎ বল তার ভক্তি যাবার নয়। ফিরে ঘুরে একটু খানি থাকবেই…। জ্ঞান বিচারের পর এই প্রেম ভক্তি যদি কমে যায়, আবার এক সময় হু হু করে বেড়ে যায়; যদুবংশ ধ্বংস করেছিল মুষল, তারই মতো।

 

৫৯.
কারুকে, কোন মতকে বিদ্বেষ করতে নাই। নিরাকারাবাদী, সাকারবাদী সকলেই তাঁর দিকে যাচ্ছে, জ্ঞানী, যোগী, ভক্ত সকলেই তাঁকে খুঁজছে, জ্ঞানপথের লোক তাঁকে বলে ব্রহ্ম, যোগীরা বলে আত্মা, পরমাত্মা। ভক্তরা বলে ভগবান, আবার আছে যে, নিত্য ঠাকুর, নিত্য দাস।

 

৬০.
একটা পথ দিয়ে ঠিক যেতে পারলে তাঁর খাছে পৌঁছানো যায়। তখন সব পথের খবর জানতে পারে। যেমন একবার কোন উপায়ে ছাদে উঠতে পারলে, কাঠের সিঁড়ি দিয়াও নামা যায়; পাকা সিঁড়ি দিয়াও নামা যায়; একটা বাঁশ দিয়াও নামা যায়; একটা দড়ি দিয়াও নামা যায়।

 

৬১.
একমাত্র ভক্তির দ্বারা জাতিভেদ উঠে যেতে পারে। ভক্তের জাতি নাই। ভক্তের থাক আলাদা। তাদের মধ্যে জাতি বিচারের কোন দরকার নাই। ভক্তি হলেই দেহ-মন-আত্মা সব শুদ্ধ হয়। …ঈশ্বরের নামে মানুষ পবিত্র হয়। অস্পৃশ্য জাতি ভক্তি থাকলে শুদ্ধ, পবিত্র হয়। ভক্তি থাকলে চণ্ডাল, চণ্ডাল নয়। ভক্তি হলে চন্ডালেরও অন্ন খাওয়া যায়।

 

৬২.
আমার ধর্ম ঠিক, আর অপরের ধর্ম ভুল-এ মত ভাল না। ঈশ্বর এক বই দুই নাই। তাঁকে ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন লোকে ডাকে। কেউ বলে গড, কেউ বলে আল্লাহ, কেউ বলে কৃষ্ণ, কেউ বলে শিব, কেউ বলে ব্রহ্ম। যেমন পুকুরে জল আছে -একঘাটের লোক বলছে জল, আর একঘাটের লোক বলছে ওয়াটার, আর একঘাটের লোক বলছে পানি-হিন্দু বলছে জল, খ্রীষ্টান বলছে ওয়াটার, মুসলমান বলছে পানি, কিন্তু বস্তু এক। মত-পথ। এক-একটি ধর্মের মত এক-একটি পথ, ঈশ্বরের দিকে লয়ে যায়। যেমন নদী নানাদিক থেকে এসে সাগরসঙ্গমে মিলিত হয়।

৬৩.
হ্যাঁ, আমি শুনেছি জন্মান্তর আছে। ঈশ্বরের কার্য আমরা ক্ষুদ্রবুদ্ধিতে কি বুঝব? অনেকে বলে গেছে, তাই অবিশ্বাস করতে পারি না। ভীষ্মদেব দেহত্যাগ করবেন, শরশয্যায় শুয়ে আছেন, পাণ্ডবেরা শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে সব দাঁড়িয়ে। তাঁরা দেখলেন যে, ভীষ্মদেবের চক্ষু দিয়ে জল পড়ছে। অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে বললেন, ‘ভাই, কি অশ্চর্য! পিতামহ, যিনি স্বয়ং ভীষ্মদেব, সত্যবাদী, জিতেন্দ্রিয়, জ্ঞানী, অষ্টবসুর এক বসু, তিনিও দেহত্যাগের সময় মায়াতে কাঁদছেন।’

শ্রীকৃষ্ণ ভীষ্মদেবকে এ-কথা বলাতে তিনি বললেন, ‘কৃষ্ণ, তুমি বেশ জানো, আমি সেজন্য কাঁদছি না! যখন ভাবছি যে, যে পাণ্ডবদের স্বয়ং ভগবান নিজে সারথি, তাদেরও দুঃখ-বিপদের শেষ নাই, তখন এই মনে করে কাঁদছি যে, ভগবানের কার্য কিছুই বুঝতে পারলাম না।’

 

৬৪.
ত্বন্নামে অরুচি! বিকারে যদি অরুচি হল, তা হলে বাঁচবার পথ থাকে না। যদি একটু রুচি থাকে,তবে বাঁচার আশা খুব। তাই নামে রুচি। ঈশ্বরের নাম কর্তে হয়; দূর্গা নাম, কৃষ্ণ নাম, শিব নাম, যে নাম বলে ঈশ্বরকে ডাক না কেন। যদি নাম করতে অনুরাগ দিন দিন বাড়ে, যদি আনন্দ হয় তা হলে আর কোন ভয় নেই, বিকার কাটবেই কাটবে।তাঁর কৃপা হবেই হবে। যেমন ভাব তেমনি লাভ। দুজন বন্ধু পথে যাচ্ছে। এক জায়গায় ভাগবত পাঠ হচ্ছে।

একজন বলল ‘এসো ভাই একটু ভাগবত শুনি।’ আর একজন উঁকি মেরে দেখে বেশ্যালয়ে চলে গেল। সেখানে খানিকক্ষণ পরে মনে বিরক্তি এল। সে আপনা আপনি বলতে লাগল ‘ধিক আমাকে! বন্ধু আমার হরি কথা শুনছে,আর আমি কোথায় পড়ে আছি! এদিকে যে ভাগবত শুনছে তারও ধিক্কার হয়েছে। সে ভাবছে ‘আমি কি বোকা! কি ব্যাড় ব্যাড় করে বকছে, আমি এখানে বসে আছি।বন্ধু আমার কত আমোদ আহ্লাদ করছে।’ এরা যখন মরে গেল ভাগবত শোনা বন্ধুটিকে যমদূত নিয়ে গেল; যে বেশ্যালয়ে গেছিল, তাকে বিষ্ণুদূত বৈকুণ্ঠে নিয়ে গেল।

<<শ্রীরামকৃষ্ণদেবের বাণী: এক

…………………
আরও পড়ুন-
শ্রীরামকৃষ্ণদেবের বাণী: এক
শ্রীরামকৃষ্ণদেবের বাণী: দুই
মা সারদা দেবীর বাণী

…………………….
আপনার গুরুবাড়ির সাধুসঙ্গ, আখড়া, আশ্রম, দরবার শরীফ, অসাম্প্রদায়িক ওরশের তথ্য প্রদান করে এই দিনপঞ্জিকে আরো সমৃদ্ধ করুন- voboghurekotha@gmail.com

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!