ভবঘুরেকথা
শ্রী শ্রী রাম ঠাকুর

“মাধব, বহুত মিনতি করি তোয়।
দেই তুলসী তিল দেহ সমর্পিণু
দয়া জনু না ছাড়বি মোয়।।”

এ কথা বিদ্যাপতির। কথা নয় কবিতা। বহুকাল আগে ভক্তকবি বিদ্যাপতি অকুণ্ঠ আত্মসমর্পণের সকরুণ সুরে প্রার্থনা করেছিলেন মাধবের কাছে। মিনতি করে বলেছিলেন, হে মাধব, যে দেহ তিল তুলসী সহযোগে সমর্পণ করেছি তোমার কাছে, সে দেহে আমার কোন দাবী নেই। আমার বলতে আমার মধ্যে কিছুই নেই আর।

আমার চরণ যাবে তোমারই মন্দিরের পথে, আমার নয়ন শুধু চেয়ে রবে তোমারই দিকে; তোমাকেই খুঁজে ফিরবে সর্বত্র, আমার মন তোমার ধ্যান করবে সদাসর্বদা, তোমারই নাম জপ করবে আমার জিহ্বা। তোমার পূজার ফুল চয়ন করবে আমার হাত।

বহুকাল পরে পূর্ববাংলার এক মহান বৈষ্ণব সাধক তাঁর সমগ্র দেহমন ঠিক এমনি করে নিঃশ্বেষে সমর্পণ করেছিলেন শ্রীহরির চরণে। এমনি করে নিজের বলতে কিছু না রেখে সব বিলিয়ে দিয়ে শ্রীহরির কাছ থেকে চেয়েছিলেন শুধু শুদ্ধ মুক্তি আর পরাভক্তি। তিনি হলেন শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্র দেব।

ভক্তদের প্রিয় রাম ঠাকুর। অগণিত ভক্তের মুখে আজও একই কথা শোনা যায়, দয়াল ঠাকুরের দয়ার শেষ নেই, স্নেহের সীমা পরিসীমা নেই। কেউ কেউ বলত, রামঠাকুর মানুষ নয়, দেবতা।

ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত ডিঙ্গামানিক নামক গাঁয়ে ১৮৬০ সালে জন্মগ্রহণ করেন ঠাকুর রামচন্দ্র। বাবা মাধব চক্রবর্তী পরম নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ ছিলেন। মা কমলা দেবীও বড় ভক্তিমতী নারী ছিলেন। যে কোন দেবদেবীর প্রতি তাঁদের ভক্তি ছিল যেমন প্রগাঢ় তেমনি অপরিসীম। রামচন্দ্র ছিলেন বাপ মার দুটি সন্তানের প্রথম। ছোট ভাই লক্ষ্মণ অকালে মারা যান।

ছোট থেকেই অত্যন্ত শান্তশিষ্ট ও ভাবুক প্রকৃতির ছিলেন রামচন্দ্র। এত বড় বিনয়ী ছেলে সচরাচর দেখা যায় না। জাতি ধর্ম ও বর্ণের কোন বাছবিচার নেই। সকল লোককেই ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করেন এবং গভীরভাবে শ্রদ্ধা করেন। রামচন্দ্রের ডাকনাম ছিল সোনা। লোকে বলাবলি করত, নামেও সোনা, কাজেও সোনা। রামচন্দ্র ছেলেবেলায় খেলাধুলা করতেন না বললেই চলে।

মাঠের ধারে বা গাছতলায় একা একা বসে থাকতে ভালবাসতেন তিনি। বসে বসে কী যেন ভাবতেন আপন মনে। কী যেন খুঁজে বেড়াতেন বাইরের অজস্র দৃশ্যমান বস্তুর মধ্যে। কোন সুখাদ্যের প্রতি বালসুলভ লোভ বা লালসা নেই। খাবার সময় ডাকাডাকি করতে হয়। খাবার সময় হুঁশ থাকে না কিছুই। পড়াশুনোর থেকে হরিনামের প্রতিই ঝোঁক বেশি ছিল রামচন্দ্রের।

কোথাও হরিনাম সংকীর্তন হলেই পাগলের মতো ছুটে যেতেন। নিজেও যোগ দিতেন তাতে সক্রিয়ভাবে। অনেকে বলেন, কৈশোর পার হতেই ঠাকুরকে সংসারের অভাব অনটনের জন্য চাকরির খোঁজে বাড়ি হতে বেরিয়ে পরতে হয়। তাদের মতে ঠাকুর নাকি নোয়াখালি শহরের একটি ব্রাহ্মণ বাড়িতে রাঁধুনির কাজ করে মাসে যা মাইনে পেতেন তা ডাকযোগে নিয়মিত মাকে পাঠিয়ে দিতেন।

যার বাড়ি থাকতেন তার নাম সদানন্দ গাঙ্গুলী। তিনি নোয়াখালির আদালতে কাজ করতেন। কিন্তু পরবর্তীকালে জানা যায়, এ ধারণা ভুল। কারণ ১৯৫৮ সালে স্বর্গীয় সদানন্দবাবুর পুত্র অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ক্ষিতীশচন্দ্র মহাশয় ঠাকুরের পরম ভক্ত সুশীলচন্দ্র দত্তের কাছে এই আসল কথাটি বলে সব সন্দেহ দূর করেন। বহরমপুরে তার বাসায় ক্ষিতীশবাবুর সঙ্গে দেখা হলে তিনি তাকে পুরনো দিনের অভিজ্ঞতার কথা বলেন। তিনি বলেন, আমার বাবা যখন নোয়াখালি শহরে আদালতে চাকরি করতেন তখন রামভাই আমাদের বাসায় থাকতেন।

আমার বাবা মা দুজনেই তাঁকে স্নেহ করতেন। তিনি আমাদের বাসায় রাঁধুনির কাজ করতেন না এবং তাঁকে কোন মাইনেও দেওয়া হত না। তবে সময়ে সময়ে তিনি বাড়ির নিজের লোকের মত ঘরসংসারের অনেক কাজ করে দিতেন। বিশেষ করে আমার মার অসুখ হলে রান্নার কাজে তিনি সাহায্য করতেন। বাবা অনেকবার তামাক খেতেন, রামভাই অনেক সময় বাবাকে তামাক সেজে দিতেন। আমি তখন ছোট ছিলাম। রামভাই আমাকে খুব আদর করতেন।

কিন্তু যৌবনে পা দিতে না দিতেই কিভাবে ঠাকুর যোগবিদ্যা আয়ত্ত করে ফেলেন তা কেউ বলতে পারেন না। কোন গুরুকরণ হয়নি, কারও কাছে কোন শিক্ষা পাননি। তবু এই সুকঠিন বিদ্যাটি আপন সাধনার বলে সবার অলক্ষ্যে অগোচরে আয়ত্ত করে ফেলেন ঠাকুর।

ঠাকুরের মনপ্রাণ ও আত্মা কিন্তু ছোট থেকেই মুক্ত। সেই সুদূর বাল্য ও কৈশোর হতেই সর্বত্যাগী বৈরাগী। খাওয়া পরা, থাকা প্রভৃতি যে সব সমস্যাগুলোর জন্য সব সময়ই বিব্রত থাকে মানুষ, সে সমস্যা যেন সমস্যাই নয় তাঁর জীবনে। বেদান্তের ব্রহ্মলাভের জন্য যে সাধন চতুষ্টয়ের কথা উল্লেখ আছে তাতে দ্বিতীয় সাধন হচ্ছে বৈরাগ্য।

যে বাড়িতে তিনি থাকতেন সে বাড়ির কেউ কখনও তাঁকে ধ্যান বা সাধনা করতে দেখেনি। তবু যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধ্যান, ধারণা ও সমাধি- এই আটটি যোগপদ্ধতির প্রত্যেকটি গোপনে সাধনা করে এক আশ্চর্য যোগশক্তি লাভ করেন ঠাকুর।

একবার বাড়ির দুটি ছেলে ঠাকুরের এই যোগশক্তির কিছুটা পরিচয় পেয়ে আশ্চর্য হয়ে যায়। ক্ষিতীশবাবুর অল্পবয়সী দুই মামা তাদের বাড়িতে থেকে স্কুলে পড়ত। তারা প্রায়ই খুব দুষ্টুমি করত এবং ঠাকুরকে বিরক্ত করত। রাত্রিতে তারা ঠাকুরের কাছেই একঘরে শুত। একদিন গভীর রাত্রিতে হঠাৎ তারা ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখে, ঠাকুর পদ্মাসনে বসে ধ্যান করতে করতে মাটি থেকে কড়িকাঠ পর্যন্ত উঠে শূন্যে ভাসছেন।

এই অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে ছেলে দুটি প্রথমে স্তম্ভিত হয়ে যায়। পরে চেঁচামেচি শুরু করে দেয়। তাদের চীৎকারে বাড়ির সব লোক ঘুম থেকে জেগে ছুটে আসেন। সব কথা শুনে তারা আশ্চর্য হয়ে একথা সত্য কিনা ঠাকুরকে প্রশ্ন করেন।

তারা জানেন ঠাকুর কখনো মিথ্যা বলবেন না। ঠাকুর তখন নির্বিকারভাবে বিছানায় বসে আছেন। সমস্ত প্রশ্নের উত্তরে শুধু হুঁ হাঁ করে আসল ঘটনাকে এড়িয়ে গেলেন। স্পষ্ট করে কিছু বললেন না। কিন্তু সদানন্দবাবু ও তার স্ত্রীর কেমন যেন খটকা লেগে গেল। তারা স্পষ্ট বুঝলেন, রামচন্দ্র সাধারণ ছেলে নয়। বাইরে সে অত্যন্ত দীনহীনভাবে থাকলেও অন্তরে এক বিরাট অধ্যাত্ম সম্পদের অধিকারী হয়ে উঠেছে সকলের অলক্ষ্যে।

তারা লক্ষ্য করে দেখলেন এক অপার্থিব ঐশ্বর্যের আশ্চর্য আভাস ফুটে উঠতে শুরু করেছে তাঁর চোখে মুখে। সদানন্দবাবু নোয়াখালি থেকে অন্য কোথাও চলে গেলে ঠাকুরও সেখান থেকে চলে যান। আঠাকাঠির ফাঁদ পেতে পাখি ধরে অনেকে। কোনরকমে একবার সেই আঠায় পাখির পাটা জড়িয়ে গেলেই হলো। আর উপায় নেই‌। ছটফট করবে উড়বার জন্য। কিন্তু মুক্তির আকাশে আর পাখা মেলে উড়তে পারবে না কখনো।

তেমনি ভোগবাসনার অজস্র ফাঁদ পাতা রয়েছে পৃথিবীর চারিদিকে। আসক্তিই সেখানে আঠাকাঠি। একবার এই আঠায় মনটা জড়িয়ে গেলেই হলো, আর উপায় নেই। মানুষের প্রাণপাখি মুক্তির আকাশে উড়তে পারবে না আর কখনো।

ঠাকুরের মনপ্রাণ ও আত্মা কিন্তু ছোট থেকেই মুক্ত। সেই সুদূর বাল্য ও কৈশোর হতেই সর্বত্যাগী বৈরাগী। খাওয়া পরা, থাকা প্রভৃতি যে সব সমস্যাগুলোর জন্য সব সময়ই বিব্রত থাকে মানুষ, সে সমস্যা যেন সমস্যাই নয় তাঁর জীবনে। বেদান্তের ব্রহ্মলাভের জন্য যে সাধন চতুষ্টয়ের কথা উল্লেখ আছে তাতে দ্বিতীয় সাধন হচ্ছে বৈরাগ্য।

শাস্ত্রে বলে ইহামূত্রফলভোগবিরাগ অর্থ্যাৎ ইহলৌকিক ও পারলৌকিক শব্দ, গন্ধ, রূপ, রস, স্পর্শ, প্রভৃতি পঞ্চ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ের ভোগজনিত যে সুখবোধ তাকে তুচ্ছ জ্ঞান করা। এই আসক্তিশূন্যতাকেই বলে বৈরাগ্য-

তিদ্বৈরাগ্যং জুগুপ্সা যা দর্শনশ্রবণাদিভিঃ
দেহাদিব্রহ্মপর্যন্তে হ্যানিত্যে ভোগবস্তুনি ।
শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্র দেব ( প্রথম খণ্ড )

দর্শন, শ্রবণ প্রভৃতি কর্মেন্দ্রিয়গুলি দ্বারা দেহ হতে ব্রহ্মলোক পর্যন্ত যে অনিত্য বস্তুগুলিকে ভোগ করা হয় সেই সব ভোগ্যপদার্থগুলিতে যে অনাসক্তি ও তুচ্ছতাবোধ তাই হচ্ছে বৈরাগ্য।

এই বৈরাগ্য কঠোর সাধনার দ্বারা আয়ত্ত করতে হয়। কিন্তু ঠাকুর রামচন্দ্রের জীবনে ত্যাগ ও বৈরাগ্য ব্যাপারটি অত্যন্ত সহজ ও অনায়াসলব্ধ সত্য। স্বাভাবিক জীবনযাত্রার মধ্যেই ছোট থেকে এটিকে সহজভাবে আয়ত্ত করে ফেলেন তিনি।

যখন জানলেন যা জুটল খেলেন, না জুটলে না খেলেন। পরনে আধ-ময়লা একখানি কাপড় আর গায়ে সাধারণ একটি খদ্দরের চাদর বা নিমা। জীবনে কোন কিছু সঞ্চয় নেই, থাকবার কোন নির্দিষ্ট ঘর নেই। যদি কোন ভক্ত ঠাকুরকে একখানি নতুন কাপড় দান করতেন তাহলে ঠাকুর সেখানে পরে পরনের কাপড়খানি পরক্ষণেই অন্য কাউকে দান করে দিতেন। সেটিকে রেখে দিতেন না।

দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় ভোগ্যবস্তুর রক্ষণাবেক্ষণের কাজ থেকে মানুষের মনে আসে সঞ্চয়ের প্রবৃত্তি। এই প্রবৃত্তিকে এইভাবে জয় করেছিলেন ঠাকুর। কিন্তু সঞ্চয়ের প্রবৃত্তিকে জয় করলেই হবে না। প্রকৃত বৈরাগীর কোন কিছুর প্রতি আসক্তি বা মায়া থাকলে চলবে না।

একবার ঠাকুরের কি সখ হলো, সিগারেট খাবেন। সারাদিন অনেক সিগারেট খেলেন কিন্তু পরদিন থেকে আর একটাও খেলেন না। ভক্তদের অপরিসীম আদরযত্ন, গভীর শ্রদ্ধাভক্তি ও সনির্বন্ধ প্রার্থনা সত্ত্বেও ঠাকুর কোথাও কারো বাড়িতে বেশিদিন থাকতেন না। একবার ১৯২৮ সালে ঢাকায় ভক্তপ্রবর প্রফুল্ল চক্রবর্তীর বাড়িতে ঠাকুরের জন্মতিথি বিশেষ উৎসাহের সঙ্গে পালিত হয়।

সাধারণতঃ দেখা যায়, সাধু সন্ন্যাসীরা ঘরসংসার ত্যাগ করলেও শেষ জীবনে একটি আশ্রমে ভক্তশিষ্য পরিবৃত হয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। কিন্তু কোন ঘরে ও জায়গায় বেশিদিন বাস করলে সেখানকার প্রতি আসক্তি জন্মায়। মানুষ মাটির ঘর আর তার পরিবেশটাকেই ভালোবেসে ফেলে।

যে-সব ভক্তরা দীর্ঘদিন কাছে থাকে তাদের প্রতি সন্তানস্নেহ জন্মে। তাই বোধ হয় নোয়াখালির সদানন্দবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পর থেকে তাঁর দীর্ঘ সাধকজীবনের মধ্যে কোথাও কোন বাড়িতে বা আশ্রমে তিন দিনের বেশি বাস করেননি ঠাকুর। ভারতে ও ভারতের বাইরে দীন হীন পরিব্রাজকের বেশে বহু তীর্থ পর্যটন করেছেন ঠাকুর, বহু দীক্ষার্থীকে দীক্ষা দান করেছেন, কিন্তু ভক্তদের কাতর অনুনয়-বিনয় সত্বেও কোথাও দুই একদিনের বেশি থাকেননি।

মনে-প্রাণে ও আচার ব্যবহারে এমন বিশুদ্ধ বৈরাগ্যজীবন যাপন করতে খুব কম সাধককেই দেখা যায়। এই মহান সাধকের জীবনযাত্রার প্রকৃত রহস্য আজও পর্যন্ত কেউ উদঘাটিত করতে পারেননি।

ঠাকুরকে কেউ কোনদিন স্নান করতে দেখেনি। কাপড় বদলাতেও দেখা যায়নি। একখানি মাত্র কাপড় দিনরাত পড়ে থাকতেন। সেটি ময়লা হলে হয়ে গেলেও দুর্গন্ধ বার হতো না কখনো তার থেকে। সারাদিনের পর কোন ভক্তের বাড়িতে বা আশ্রমে সামান্য কিছু ফল-মূল বা অন্ন আহার করতেন। কিন্তু তা এতই সামান্য যে আমরা তা দুই-এক গ্রাসেই খেয়ে ফেলি।

অথচ এই অল্পাহারেও তাঁর অঙ্গকান্তি ম্লান হত না কখনো। একবার কোন এক মহিলা ভক্ত ঠাকুরকে একখানি গরদের চাদর দান করেন। ঠাকুরের গায়ে চাদরখানি খুব মানায়। তা দেখে তিনি খুব খুশি হন। কিন্তু পরদিনই দেখা যায় চাদরখানি ঠাকুর কাকে দিয়ে দিয়েছেন। শীতকালে অনেক সময় অনেক ভক্ত ঠাকুরকে দামী আলোয়ান দিতেন। কিন্তু তা নিজে গায়ে না দিয়ে পরকে বিলিয়ে দিতেন।

পরার মত খাওয়ার প্রতিও ঠাকুর ছিলেন সমান উদাসীন। ঠাকুর কি খেতে ভালোবাসেন তা জানবার জন্য ভক্তরা উদগ্রীব। ঠাকুর কখনো কোন ভক্তের কাছে হঠাৎ বলেন, আমার ওই জিনিসটা খেতে ভালো লাগে। ভক্তরা তা প্রাণপণ চেষ্টায় যোগাড় করে আনল। কিন্তু পরদিন দেখা গেল সে জিনিসটির প্রতি আর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই ঠাকুরের।

একবার ঠাকুরের কি সখ হলো, সিগারেট খাবেন। সারাদিন অনেক সিগারেট খেলেন কিন্তু পরদিন থেকে আর একটাও খেলেন না। ভক্তদের অপরিসীম আদরযত্ন, গভীর শ্রদ্ধাভক্তি ও সনির্বন্ধ প্রার্থনা সত্ত্বেও ঠাকুর কোথাও কারো বাড়িতে বেশিদিন থাকতেন না। একবার ১৯২৮ সালে ঢাকায় ভক্তপ্রবর প্রফুল্ল চক্রবর্তীর বাড়িতে ঠাকুরের জন্মতিথি বিশেষ উৎসাহের সঙ্গে পালিত হয়।

তাঁর মহিমা বা সিদ্ধি ঋদ্ধির কোন পরিচয় দিতেন না। কিন্তু তাঁর লীলারহস্যের কিছুটা পরিচয় পেয়ে ধন্য হয়ে যান উপস্থিত ভক্ত শিষ্যরা। ঐদিনই আর একটি আশ্চর্য ঘটনা ঘটে এবং তাতেও ঠাকুরের অলৌকিক যোগশক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। সেদিন পূজোর পর রাত্রি ন’টা পর্যন্ত প্রসাদ বিতরণ হয়। বহু নরনারী প্রসাদ পায়।

সে উৎসবে ঠাকুর শিষ্যদের অনুরোধে উপস্থিত থেকে সকলের আনন্দ বৃদ্ধি করেন। কিন্তু একদিনের বেশি সে বাড়িতে থাকেননি ঠাকুর। সেবার ঠাকুরের অনুরোধে ভক্ত সুশীলচন্দ্র দত্তের বাড়িতে পঞ্চম দোল অনুষ্ঠিত হয়। এই উপলক্ষে সেখানে সারাদিন ধরে পূজো এবং অতিথিসেবা চলে।

ঠাকুর তার আগের দিন বীরেন্দ্র মজুমদারের বাসায় ছিলেন। দোলের দিন সকালে সুশীলবাবুর বাসায় এসে নিজের হাতে পূজোর উপকরণ যোগাড় করতে শুরু করেন। পূজোর সময় নিজে এক কোণে একটি ছোট আসনের উপর নিশ্চল নিস্পন্দ হয়ে চোখ বন্ধ করে পূজো, ভোগ, আরতি ও কীর্তনের শেষ পর্যন্ত একভাবে বসে থাকেন।

তাঁর মুখের উপর তখন এক অপূর্ব দিব্যজ্যোতি ফুটে ওঠে। সমস্তক্ষণ এক অদ্ভুত আবেশে বিভোর হয়ে ছিলেন। দেখে মনে হচ্ছিল, কায়াটি তাঁর এখানে অসাড় হয়ে পড়ে আছে শুধু, আত্মা তাঁর চলে গেছে দূর দেবলোকে। অথচ আশ্চর্য !

পূজো শেষ হতেই আপনা থেকে উঠে পড়লেন ঠাকুর। ঠিক যেন ঘুম থেকে হঠাৎ উঠে এলেন। ধ্যান শেষে সালোক্য ও সামীপ্য মুক্তির পরমানন্দে অভিস্নাত হয়ে তাঁর আত্মা যেন শুচিশুদ্ধ হয়ে এইমাত্র নেমে এল এই মর্ত্য-লোকে।

ভক্ত শিষ্যরা সকলে ঠাকুরকে ভিড় করে দাঁড়াল। ঠাকুর তখন গম্ভীরভাবে বলতে লাগলেন, তোমরা দেখতে পাওনি, নাম কীর্তনের সময় নিতাই-গৌড় এসে ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

গদাধর মনের আনন্দে গড়াগড়ি দিচ্ছিলেন। ঠাকুরের কথা শুনে শিষ্যরা অবাক হয়ে ঠাকুরের মুখপানে চেয়ে রইল। একমাত্র মন্ত্রসিদ্ধ ও যোগসিদ্ধ সাধকদেরই ইষ্টদর্শন ও দেবদর্শন হয়। সাধারণ মানুষের পক্ষে তা সম্ভব নয়। ঠাকুর সব সময় দিনহীনভাবে থাকতেন।

তাঁর মহিমা বা সিদ্ধি ঋদ্ধির কোন পরিচয় দিতেন না। কিন্তু তাঁর লীলারহস্যের কিছুটা পরিচয় পেয়ে ধন্য হয়ে যান উপস্থিত ভক্ত শিষ্যরা। ঐদিনই আর একটি আশ্চর্য ঘটনা ঘটে এবং তাতেও ঠাকুরের অলৌকিক যোগশক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। সেদিন পূজোর পর রাত্রি ন’টা পর্যন্ত প্রসাদ বিতরণ হয়। বহু নরনারী প্রসাদ পায়।

ঠাকুর এত রাত্রিতে সারাদিনের এত ক্লান্তির পর কোথায় যাবেন, একথা ভেবে ভক্তরা চিন্তিত হলেন। সুশীল বাবু দুঃখিত হলেন। কিন্তু উপায় নেই। ঠাকুর একবার যাব বললে আর কিছুতেই থাকবেন না। একবার ঢাকায় বীরেনবাবুর বাড়িতে ঠাকুর হঠাৎ বাতরোগে আক্রান্ত হন। তাঁর একখানি পা ফুলে যায় এবং অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকেন।

প্রসাদ বিতরণের কাজ একেবারে শেষ হয়ে গেলে কর্মীরা ঠাকুরের জন্য কিছু ফলমূলের যোগাড় করলেন। সারাদিন ঠাকুর মুখে জল দেননি। কিন্তু খাবার আয়োজন করে ঠাকুরকে ডাকতেই ঠাকুর বললেন, কেউ কোথাও অভূক্ত নেই ত?

সকলেই একবাক্যে উত্তর করলেন, না সকলেই প্রসাদ পেয়েছেন, কেউ অভুক্ত নেই। আপনি নিশ্চিন্তে জলযোগ করতে পারেন। কিন্তু ঠাকুর বললেন, না। এখনো একজন অভুক্ত আছে। সকলে খোঁজাখুঁজি করতে লাগলেন।

সারা বাড়ির ভেতরে ও আশেপাশে কাউকে কোথাও অভুক্ত পাওয়া গেল না। ঠাকুর আর কোন কথা না বলে চুপ করে বসে রইলেন। অনেকক্ষণ পর হঠাৎ ছাদের উপর লাফালাফির শব্দ শোনা গেল। তখন সকলে সেখানে গিয়ে দেখে এক পাগল নাচছে। তখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, এই পাগলা প্রসাদ খাবি? পাগল আনন্দে হেসে অধীর হয়ে বলল হাঁ হাঁ। সঙ্গে সঙ্গে ছাদ থেকে নেমে এল এবং তাকে প্রসাদ দেওয়া হলো।

প্রসাদ খাওয়ার পর ঠাকুর যে-ঘরে ছিলেন সেই ঘরের দরজার সামনে এসে ঠাকুরের দিকে চেয়ে বিকট শব্দে হেসে সিঁড়ি বেয়ে ঝড়ের বেগে নিচে নেমে গেল‌। তারপর কোথায় কোন্ দিকে চলে গেল কেউ বুঝতে পারল না। সকলে আশ্চর্য হয়ে ভাবতে লাগল। সারাদিনের মধ্যে ওই পাগল কখন কোথা থেকে এলো এবং কিভাবে ছাদে গিয়ে এক কোণে চুপ করে বসে থাকে তা কেউ টের পায় নি এবং সেই সময় নাচানাচি শুরু না করলে কেউ বুঝতেও পারত না।

কিন্তু লীলাময় ঠাকুর একটি ঘরের মধ্যে বসে তা যোগশক্তিবলে টের পেয়েছিলেন। ঠাকুরের প্রসাদ গ্রহণ যখন শেষ হলো, রাত্রি তখন এগারটা। বাইরে থেকে যেসব ভক্তরা এসেছেন তারা ঠাকুরকে প্রণাম করে বিদায় নিচ্ছেন। এমন সময় চাদরটি গায়ে দিয়ে ঠাকুর বললেন, তাহলে আমি আসি।

ঠাকুর এত রাত্রিতে সারাদিনের এত ক্লান্তির পর কোথায় যাবেন, একথা ভেবে ভক্তরা চিন্তিত হলেন। সুশীল বাবু দুঃখিত হলেন। কিন্তু উপায় নেই। ঠাকুর একবার যাব বললে আর কিছুতেই থাকবেন না। একবার ঢাকায় বীরেনবাবুর বাড়িতে ঠাকুর হঠাৎ বাতরোগে আক্রান্ত হন। তাঁর একখানি পা ফুলে যায় এবং অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকেন।

যেদিন রোগটি দেখা দেয় সেদিন রাত্রে একবারও ঘুমোতে পারেননি। তার পরের দিন ডাক্তার ডাকা হলো। পায়ে মালিশ করা হলো। কিন্তু যন্ত্রণার কোন উপশম হলো না। অথচ সেই রাতের শেষের দিকে দেড় মাইল পথ হেঁটে স্টেশনে গিয়ে ট্রেন ধরে ময়মনসিংহ চলে যান ঠাকুর।

যে পা নিয়ে বিছানা হতে উঠতে পারছিলেন না ঠাকুর, যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে থাকতে পারছিল না এক মুহূর্ত, সেই ফুলো পা আর রোগযন্ত্রণা নিয়ে ঠাকুর শেষ রাতে কি করে এতখানি পথ হেঁটে গেলেন তা সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে কেউ বুঝতে পারল না।

(চলবে…)

………………………………………..
ভারতের সাধক ও সাধিকা
লেখক : সুধাংশুরঞ্জন ঘোষ

………………….
পুনপ্রচারে বিনীত: প্রণয় সেন

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

………………….
আরও পড়ুন-
স্বামী অড়গড়ানন্দজী
ভোলানাথ চট্টোপাধ্যায়
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেব
শিরডি সাই বাবা
পণ্ডিত মিশ্রীলাল মিশ্র
নীলাচলে মহাপ্রভুর অন্ত্যলীলার অন্যতম পার্ষদ ছিলেন রায় রামানন্দ
ভক্তজ্ঞানী ধর্মপ্রচারক দার্শনিক রামানুজ
সাধক ভোলানন্দ গিরি
ভক্ত লালাবাবু
লাটু মহারাজ শ্রীরামকৃষ্ণের অদ্ভুত সৃষ্টি
কমলাকান্ত ভট্টাচার্য
ব্রাহ্মনেতা কেশবচন্দ্র সেন
পরিব্রাজকাচার্য্যবর শ্রীশ্রীমৎ দূর্গাপ্রসন্ন পরমহংসদেব
আর্যভট্ট কাহিনী – এক অজানা কথা
গিরিশচন্দ্র ঘোষ
কঠিয়াবাবা রামদাস
সাধু নাগ মহাশয়
লঘিমাসিদ্ধ সাধু’র কথা
ঋষি অরবিন্দ’র কথা
অরবিন্দ ঘোষ
মহাত্মাজির পুণ্যব্রত
দুই দেহধারী সাধু
যুগজাগরণে যুগাচার্য স্বামী প্রণবানন্দজি মহারাজ
শ্রী শ্রী রাম ঠাকুর
বাচস্পতি অশোক কুমার চট্টোপাধ্যায়ের লেখা থেকে
মুসলমানে রহিম বলে হিন্দু পড়ে রামনাম
শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্র দেব : প্রথম খণ্ড
শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্র দেব: দ্বিতীয় খণ্ড
শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্র দেব : অন্তিম খণ্ড
মহামহোপাধ্যায় কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ
শ্রী শ্রী রবিশঙ্কর
শ্রীশ্রী ঠাকুর সত্যানন্দদেব
মহাতাপস বালানন্দ ব্রহ্মচারী: এক
মহাতাপস বালানন্দ ব্রহ্মচারী: দুই
মহাতাপস বালানন্দ ব্রহ্মচারী: তিন
সাধক তুকারাম
সাধক তুলসীদাস: এক
সাধক তুলসীদাস: দুই
সাধক তুলসীদাস: তিন
শ্রীশ্রী মোহনানন্দ স্বামী: এক
শ্রীশ্রী মোহনানন্দ স্বামী: দুই
শ্রীশ্রী মোহনানন্দ স্বামী: তিন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!