ভবঘুরেকথা
সীতারাম

দেশে যখন ধর্মের উপর অধর্মের শাসন শুরু হয়, তখন আপামর জনসাধারণের সামগ্রিক কল্যাণের জন্য লোকশিক্ষকগণের আবির্ভাব ঘটে। সেরকমই সময় ছিল উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ। ১২৯৮ সনের (১৮৯১ খ্রীঃ) ৬ ফাল্গুন, বুধবার, সকাল ৮টা ১ মিনিটে, এক দেবশিশুর আবির্ভাব হয়। স্থান হুগলি জেলার ডুমুরদহ।

পিতা প্রাণহরি চট্টোপাধ্যায় ছেলের নাম রাখেন প্রবোধচন্দ্র। তিথি ছিল কৃষ্ণপঞ্চমী। মাতা মালাবতী দেবীর কোলে সাধারণ আর পাঁচটা গ্রামের ছেলের মতই মানুষ হতে থাকে শিশু প্রবোধচন্দ্র।

ছোটবেলা থেকেই পড়াশুনায় খুব আগ্রহ ছিল প্রবোধচন্দ্রের। অজানাকে জানতে চাওয়ার এক অদম্য ইচ্ছা প্রশ্নবাণ হয়ে তাঁর আশেপাশের লোকজনকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলত। কালক্রমে স্মৃতিভূষণ দাশরথি মুখোপাধ্যায়ের চতুষ্পাঠীতে শাস্ত্রের বিভিন্ন শাখায় পাণ্ডিত্য অর্জন করলেন প্রবোধচন্দ্র।

শাস্ত্রের সাগরে অবগাহন করতে করতে যখন তিনি বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি রহস্য খুঁজে চলেছেন, তখন লোকান্তরিত হলেন পিতা প্রাণহরি। দিশাহারা প্রবোধচন্দ্র তাঁর শিক্ষাগুরু ও সাধক দাশরথি মুখোপাধ্যায়ের কাছে প্রাণের শান্তির জন্য হাজির হলেন।

১৩১৯ সালের (১৯১২ খ্রীঃ) ২৯ পৌষ, মকর সংক্রান্তি তিথিতে গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী নদীর সঙ্গমস্থল ত্রিবেনীতে সাধক দাশরথি প্রবোধকে ‘রামনাম’ মন্ত্রে দীক্ষা দিলেন। শিক্ষাগুরু হলেন দীক্ষাগুরু। প্রবোধচন্দ্রের নাম হলো ‘সীতারাম’।

সর্বক্ষণ রামনাম জপে মগ্ন থাকতেন প্রবোধচন্দ্র। রামনাম জপতে জপতে যখন ডুবে যেতেন ভাবসাগরে তখন প্রবোধচন্দ্রের কানে ভেসে আসত ওঙ্কারধ্বনি। আত্মীয়স্বজনরা প্রবোধচন্দ্রের এমন অবস্থা দেখে দিগসুই গ্রামের ঠাকুরচরণ ভট্টাচার্য্যের কন্যা সিদ্ধেশ্বরী দেবীর বিবাহ দিলেন।

কিন্তু যিনি ডুব দিয়েছেন ভক্তিসাগরে তাঁর সংসারে টান থাকবে কেন। স্ত্রীকে বললেন, “সংসার আর ভগবান, একসঙ্গে দুটো হয় না। একটা ছাড়তে হবে।” স্ত্রী সিদ্ধেশ্বরীকে দুই পুত্র রঘুনাথ ও রাধানাথ এবং কন্যা জানকীকে উপহার দিয়ে একদিন সত্যি সত্যিই সংসার থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলেন।

দেশজুড়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে নাম প্রচারে বেরিয়ে পড়লেন সাধক সীতারাম। চোখে অশ্রু, মুখে নাম-

হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।

লোকশ্রুতি, ধীরে ধীরে অলৌকিক শক্তির অধিকারী হয়ে উঠলেন সীতারাম। সারা ভারত পরিক্রমা করে ১৯৩৬ সালের পৌষ মাসে সীতারাম ফিরে এলেন তাঁর দীক্ষালাভের স্থান ত্রিবেণীতে। স্থাপন করলেন একটি মঙ্গলঘট। তারপর একটি বট পাতায় ওঙ্কারনাথ লিখে বহির্বাস ত্যাগ করে কৌপিন ধারণ করে ডুমুরদহের জন্মভিটেতে ফিরে এলেন। সেই দিন থেকে তাঁকে বিশ্ব চিনলো শ্রী শ্রী ঠাকুর সীতারাম দাস ওঙ্কারনাথ নামে।

দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল এক মহাপুরুষের আগমনবার্তা। ডুমুরদহ গ্রাম জনসমাগমে মুখরিত হতে লাগল। দলে দলে দুঃখপীড়িত মানুষ শ্রী শ্রী ঠাকুর সীতারাম দাস ওঙ্কারনাথের পদতলে বসে দীক্ষা গ্রহণ করতে লাগলেন। প্রেমময় ঠাকুর বললেন, “ঘরে বসেই নাম জপ করে সংসারটাকে আনন্দধামে পরিণত করো।”

শুধু ধর্মের বাণী মুখে প্রচার নয়, সুদীর্ঘ সময় ধরে তিনি লিখেছেন ১৫০টি গ্রন্থ ও প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন ভাষার ১৩টি পত্রপত্রিকা।

সারা ভারত ঘুরে শ্রী শ্রী ঠাকুর সীতারাম দাস ওঙ্কারনাথ যা দেখেছেন, দীর্ঘ জীবনে যা উপলব্ধি করেছেন তার নির্যাস বুঝি নিম্নের শব্ধবন্ধটি।

১৯৮২ সালের ৫ ডিসেম্বর, রবিবার, রাত্রি ১টা ২৫ মিনিটে, অগনিত ভক্তবৃন্দকে শোকসাগরে নিমজ্জিত করে ৯১ বছর বয়েসে শ্রী শ্রী ঠাকুর সীতারাম দাস ওঙ্কারনাথ চলে গেলেন চির আনন্দধামে। কিন্তু এই যুগপুরুষোত্তমের পার্থিব দেহাবসানের পরও তাঁর জীবন ও বাণী লোকশিক্ষার আকর রূপে আজও সমাদৃত।

“সূর্য, আগুন, গঙ্গাজল যেমন স্বাভাবিক ও পবিত্র, তেমনই আমাদের পুণ্যভূমি ভারতও স্বতঃই পবিত্র। কালক্রমে বিধির বিধানে ম্লেচ্ছ রাজা হলেও এর স্বাভাবিক পবিত্রতা নষ্ট হয়নি। ভারতে অত্যধিক সাত্ত্বিক পরমাণু আপনা আপনি জন্মায়, এ দেশকে অপবিত্র করে কার সাধ্য।

বিদেশি ম্লেচ্ছগণ রাজা হয়ে তাঁরাই পবিত্র হয়ে গেছেন। ভাসতে ভাসতে এসেছিলেন, ভাসতে ভাসতে চলে গেছেন। তোমায় আমি তার প্রমাণ দিচ্ছি- মহাপ্রভু ম্লেচ্ছ রাজ্যের ব্রাহ্মণ, তাঁর কৃপায় কত ম্লেচ্ছ উদ্ধার হয়ে গেছেন।

শ্রী ত্রৈলঙ্গ স্বামী, শ্রী ভাস্করানন্দ স্বামী, শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস- এঁরাও ম্লেচ্ছ রাজ্যের ব্রাহ্মণ, পরমহংস বাবার চরণ সেবা করে কায়স্থ শ্রী নরেন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ হয়ে ম্লেচ্ছ দেশ মাতিয়ে দিয়ে এসেছেন। কত বিধর্মী তাঁর সেবা করে কৃতার্থ হয়েছে। শ্রী বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামী, শ্রী বালানন্দ ব্রহ্মচারী, শ্রী নিগমানন্দ পরমহংস, শ্রী সন্তদাস বাবাজী মহারাজ প্রভৃতি শত শত ব্রাহ্মণ কোটি কোটি লোককে উদ্ধার করেছেন। এখনও করছেন।”

১৯৮২ সালের ৫ ডিসেম্বর, রবিবার, রাত্রি ১টা ২৫ মিনিটে, অগনিত ভক্তবৃন্দকে শোকসাগরে নিমজ্জিত করে ৯১ বছর বয়েসে শ্রী শ্রী ঠাকুর সীতারাম দাস ওঙ্কারনাথ চলে গেলেন চির আনন্দধামে। কিন্তু এই যুগপুরুষোত্তমের পার্থিব দেহাবসানের পরও তাঁর জীবন ও বাণী লোকশিক্ষার আকর রূপে আজও সমাদৃত। ধর্মের অতন্দ্র প্রহরী হয়ে জাতির মননে শ্রী শ্রী ঠাকুর সীতারাম দাস ওঙ্কারনাথ এখনও যেন নিরন্তর বলে চলেছেন-

হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।

………………………….
লেখক রামকৃষ্ণ মিশনের শিক্ষক এবং নদীয়া জেলার ধর্ম, স্বাস্থ্য,বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সাহিত্য সংকলন ‘স্বস্তিদীপ’ পত্রিকার সম্পাদক।
পুনপ্রচারে বিনীত: প্রণয় সেন

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

…………………………
আরও পড়ুন-
যোগীবর শ্যমাচরণ লাহিড়ী মহাশয়
মহাযোগী শ্রীশ্রী তৈলঙ্গস্বামী
ত্রৈলঙ্গ স্বামীর কিছু কথা
গাঁধীজিকে ক্রিয়াযোগে দীক্ষা দিয়েছিলেন তিনি
তারা মায়ের আদরের দুলাল ‘বামাক্ষেপা’
মহর্ষি মহেশ যোগীর কথা
স্বামী শ্রীযুক্তেশ্বরের দর্শনলাভ : যোগী-কথামৃত থেকে
‘বাবাজী’ আধুনিক ভারতের মহাযোগী
বিনিদ্র সাধু
রামদাস বাবাজী
সীতারাম
তারাপীঠের ‘বামদেব’
বহুবর্ষজীবি শ্রীশ্রী বরফানী দাদাজি
মহাবতার বাবাজীর দর্শন লাভ: এক
মহাবতার বাবাজীর দর্শন লাভ: দুই
যোগীবর শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী: এক
যোগীবর শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী: দুই
যোগীবর শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী: তিন

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!