ভবঘুরেকথা

চন্দ্রকান্তের গুরু ভক্তি
হরিচাঁদ গুরুচাঁদ করিয়া স্মরণ।
হরিভক্ত গুণ কথা করিব বর্ণন।।
নলিয়ারচর গ্রাম খুলনা জেলায়।
তেরখাদা থানা মধ্যে সেই গ্রাম হয়।।
সেই গ্রামে বাস করে চন্দ্রকান্ত নাম।
তারকের প্রীয় শিষ্য ভক্ত গুণধাম।।
কি ভাবেতে তারকের সঙ্গেতে মিলন।
তার কিছু তত্ব কথা শুন দিয়া মন।।
কালিয়া থানার মধ্যে চালনা গ্রামেতে।
কবিগান হবে সেথা শুনিয়া কর্ণেতে।।
কবিগান শুনিবার করিল গমন।
পথে যেতে কত কিছু ভাবে মনে মন।।
কবিগান গাবে সেথা তারক গোঁসাই।
নাম শুনে ভাল লাগে চোখে দেখি তাই।।
এই ভাবে কত কিছু ভাবিতে ভাবিতে।
উদয় হইল গিয়া চালনা গ্রামেতে।।
বিপক্ষের সরকার আনন্দ নামেতে।
দূর্গাপুর তার বাড়ী বিখ্যাত কবিতে।।
দুই দল উঠিলেন কবির খেলায়।
শত শত শ্রোতাগণ হয়েছে উদয়।।
দুই দল সমকক্ষ গান করিতেছে।
গান শুনে শ্রোতাগণে আনন্দে ভেসেছে।।
আনন্দ নামেতে সেই সরকার ছিল।
গান করি সে আনন্দ বাহিরেতে এল।।
তারক উঠিল যবে কবির খেলায়।
হেন কালে দিনমণি অস্তাচলে যায়।।
সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসিল গগনে।
তারক গাহিছে গান শ্রোতাগণ শোনে।।
হেন কালে মশকেরা দলে দলে এল।
মশার কামড়ে সবে অস্থির হইল।।
হাতের চাপড়ে সবে মশা মারিতেছে।
চট পট আসরেতে শব্দ হইতেছে।।
তাই শুনে শ্রী তারক কহিল তখন।
নাড়াচাড়া কর সবে কিসের কারণ।।
আসেরেতে যত লোক কহিল তখন।
মশার কামড়ে মোরা কি করি এখন।।
তাই শুনে সে তারক উচ্চস্বরে কয়।
শুন শুন মশাগণ থেক না হেথায়।।
হরিচাঁদের দোহাই শুন মশাগণ।
এ আসরে কোন দিন এস না কখন।।
তাই শুনে সেই মশা কোথায় লুকাল।
শ্রোতাগণ তাই দেখে আশ্চর্য্য হইল।।
তার পরে সে তারক ধরে ধুয়া গান।
ধুয়া গানে হরে নিল সবাকার প্রাণ।।
প্রমের তরঙ্গ ওঠে আকাশ ভেদিয়া।
তার মধ্যে শ্রোতাগণ বেড়ায় ভাসিয়া।।
কেহ এসে পড়িলেন তারকের পায়।
নয়ন জলেতে ভেসে গড়াগড়ি যায়।।
কেহ কেহ বলিতেছে তারকের জয়।
কেহ বলে হরিচাঁদ গুরুচাঁদ জয়।।
জয় জয় ধ্বনি ওঠে আকাশ ভেদিয়া।
হরি বলে নাচে কেহ দুবাহু তুলিয়া।।
এই ভাবে বহুপরে গান ক্ষান্ত হল।
যার যার গৃহে সবে গমন করিল।।
শুধু একা বসে আছে চন্দ্রকান্ত হীরা।
জ্ঞানহারা প্রায় তার বহে অশ্রুধারা।।
কি করিবে কোথা যাবে ভাবিয়া না পায়।
অন্ধাকার রাত্রি দেখে রহিল তথায়।।
চাদোয়ার তলে সে যে শয়ন করিল।
একটি মশায় তারে কামড় নাই দিল।।
সেই হতে সেই মাঠে মশা নাহি হয়।
প্রত্যক্ষ দেখিছি আমি থাকিয়া তথায়।।
তারকের গুণ কথা বলি কি ভাষায়।
স্মরণ করিলে হয় প্রেমের উদয়।।
তারপর চন্দ্রকান্ত প্রভাতে জাগিয়া।
ছল ছল আখি দু’টি কান্দিয়া কান্দিয়া।।
তারক যে বাড়ি ছিল সে বাড়ীতে গিয়ে।
তারকের পদে পড়ে কহিছে কান্দিয়ে।।
আজ হতে তব পায়ে নিলাম শরণ।
দয়া করে চল বাবা আমার ভবন।।
তারক বলেছে বাছা কোথা বাড়ী ঘর।
চন্দ্রকান্ত বলে বাড়ী ললিয়ার চর।।
চন্দ্রকান্ত নাম মম হীরা বংশ হয়।
যুধিষ্ঠির পুত্র আমি দিনু পরিচয়।।
তারক বলেছে তবে মনে যদি চায়।
কিছু দিন পরে যাব তোমার আলয়।।
কবির বায়না মোর আছে কত ঠাই।
এর মধ্যে যেতে মোর সময় তো নাই।।
বৈশাখ মাসেতে যাব তোমার বাড়ী।
এত বলি সে তারক দিল ধার্য্য করি।।
তাই শুনি চন্দ্রকান্ত প্রণাম করিল।
পদধুলি লয়ে শিরে গৃহেতে আসিল।।
তারকের ছবিখানি হৃদয় ধরিয়া।
আশা পথ পানে থাকে সতত চাহিয়া।।
এই ভাবে কত দিন গত হয়ে গেল।
বৈশাখ মাসেতে সেই তারক আসিল।।
সঙ্গে ভক্ত আসিলেন আর কয়জন।
কাঙ্গালী বেপারী আর সূর্য্যনারায়ণ।।
ব্রাহ্মণ সে জগদিশ পবিত্র ছিঁড়িয়া।
তারকেরে গুরু করি আসিল মিশিয়া।।
যাদব মল্লিক আর শ্রী যাদব ঢালী।
শ্রী নবীন রাধাক্ষেপা আর বনমালী।।
হরি হরি বলে সবে বাড়ীতে উঠিল।
দেখিয়া সে চন্দ্রকান্ত চরণে পড়িল।।
পরিবারসহ এসে চরণে লুটায়।
মেয়েরা আসিয়া সেথা উলুধ্বনি দেয়।।
প্রণাম করিয়া সবে চরণ ধোঁয়ায়ে।
বসিবারে দিল সবে আসন পাতিয়ে।।
তারপর চন্দ্রকান্ত মনেতে ভাবিয়া।
এ পাড়ায় ও পাড়ায় বেড়ায় ঘুরিয়া।।
ডাব খাওয়াবে বলে গাছারু সন্ধানে।
কাহারে না পেয়ে শেষে দুঃখ পায় মনে।।
তাই জেনে কহিলেন তারক গোঁসাই।
শুন বলি চন্দ্রকান্ত তোমাকে জানাই।।
বৃথা কেন ঘোরা ফেরা কর মহাশয়।
দাও নিয়ে চলে যাও গাছের গোড়ায়।।
হরিচাঁদ গুরচাঁদ স্মরণ করিয়া।
শিকড়েতে কোপ দাও নয়ন মুদিয়া।।
তাই শুনে চন্দ্রকান্ত কান্দিয়া ভাসায়।
দাও নিয়ে চলিলেন গাছের গোড়ায়।।
হরিচাঁদ গুরুচাঁদ তারকে স্মরিয়া।
শিকড়তে কোপ দিল নয়ন মুদিয়া।।
এক কোপে তিন খনি শিকড় কাটিল।
তিন ছড়া নারিকেল মাটিতে পড়িল।।
তাই দেখে সবে মিলে মানিল বিস্ময়।
তারকের পদে পড়ে কান্দিযা ভাসায়।।
কেহ কেহ কেন্দে কেন্দে ধরণী লুটায়।
কেহ কারে বক্ষে ধরি আলিঙ্গন দেয়।।
কেহ এসে তারকের চরণে পড়িল।
চরণ ধরিয়া শেষে কান্দিয়া কহিল।।
তোমার চরণে বাবা এই ভিক্ষা চাই।
জীবনে মরণে যেন ভুলিয়া না যাই।।
পুরুষ রমণী যারা ছিল সেই খানে।
কেন্দে কেন্দে অচৈতন্য হল সর্বজনে।
তাই দেখে সে তারক সবাকে সান্তায়।
চেতনা করায় সবে হস্ত দিয়া গায়।।
তারপর চন্দ্রকান্ত কান্দিয়া কান্দিয়া।
সেই ডাব খেতে দেয় কাটিয়া কাটিয়া।।
সু-মিষ্ট ডাবের জল খাইল সকলে।
আনন্দেতে সবে তরা হরি হরি বলে।।
কেহ বলে হরিচাঁদ গুরুচাঁদ জয়।
কেহ বলে হরিভক্তগণ জয় জয়।।
কেহ বলে তারক চান্দের জয় জয়
কেহ উঠে দাড়াইয়া হরিধ্বনি দেয়।
মেয়ে লোক যত ছিল করে উলুধ্বনি।
হরি হরি বলে যত ধনীমানী জ্ঞানী।।
তারপর সবে মিলে সুস্থির হইল।
মেয়েরা সকলে মিলে রন্ধন করিল।।
ব্যাস্ত হয়ে করিলেন ভোজনের ঠাই।
ভোজনে বসিল গিয়ে সাধুরা সবাই।।
ধূপ ধুনা নিয়ে এল রামমণি যিনি।
সেই নারী হলে চন্দ্রকান্তের রমণী।।
রামমণির চক্ষু জলে ভাসিতে লাগিল।
তারকের পদে পরে কান্দিয়া কহিল।।
ওগো বাবা কর ক্ষমা অবলা বলিয়া।
ভক্তি নাই জ্ঞান নাই পুজিব কি দিয়া।।
তারক বলেছে মাগো মন খাটি চাই।
হরিচান্দের কৃপায় কোন চিন্তা নাই।।
এই ভাবে ভক্তি করি ভোজন করায়।
একজন দাঁড়াইয়া হরিধ্বনি দেয়।।
সাধু সাবধান বলে কেহ ভীর দিল।
এই ভাবে আনন্দেতে ভোজন করিল।।
তারপর আচমন করিয়া সবাই।
হরিকথা কহিলেন বসি এক ঠাই।।
তারপর সবে মিলে কীর্তনে মাতিল।
হরিগুণ গান করি সে নীশি বঞ্চিল।।
প্রভাতে উঠিয়া সবে হরিগুণ গায়।
চন্দ্রকান্ত পড়িলেন তারকের পায়ে।।
কেন্দে বলে ওগো বাবা বলি তব ঠাই।
মনের বাসনা আজি চরণে জানাই।।
মন্দির করেছি আমি মোর কথা লও।
তুমি আজ নিজ হাতে ঘট পেতে দাও।।
তাই শুনি সে তারক কহিল তখন।
তোমার বাসনা আমি করিব পূরণ।।
তাই শুনে চন্দ্রকান্ত নব বস্ত্র এনে।
ভক্তি ভাবে অর্পিলেন তারক চরণে।।
তারপর শ্রী তারক ঘট পেতে দিল।
পূজার পদ্ধিতি সব তারে জানাইল।।
রামমণি চন্দ্রকান্ত আসিয়া বসিল।
হরি নাম মন্ত্র গিয়া দীক্ষা কে করিল।।
তাই দেখে সবে মিলে হরিধ্বনি দিল।
তারপর শ্রী তারক বাহিরে আসিল।।
বাহিরে আসিয়া তিনি বলিল তখন।
একটি বেলের চারা আন হে এখন।।
তাই শুনে চন্দ্রকান্ত ঘুরিয়ে বেড়ায়।
মন্দির পিছনে গিয়ে দেখি বারে পায়।।
একটি বেলের চারা তথায় রয়েছে।
সেই চারা এনে দিল তারকের কাছে।।
নিজ হাতে সেই চারা করিল রোপন।
কহিলেন এই গাছ করিও যতন।।
এই গাছ বড় হলে ফল যদি হয়।
সেই ফল লাগাইও ঠাকুর সেবায়।।
তারপর সবে মিলে করিয়া ভোজন।
চন্দ্রকান্তে ডাক দিয়া কহিল তখন।।
শুন বাবা চন্দ্রকান্ত তোমাকে জানাই।
বিদায় কর হে মোরে জয় পুর যাই।।
চন্দ্রকান্ত বলে বাবা তোমাকে জানাই।
পদে যেন থাকে ভক্তি এই ভিক্ষা চাই।।
মহোৎসব করিতে মনে মোর চায়।
তুমি দিন করে দিলে বাঞ্ছা পূর্ণ হয়।।
তারক বলেছে বাছা মঙ্গল হইবে।
পহেলা বৈশাখে তুমি উৎসব করিবে।।
এই কথা যখনেতে তারক কহিল।
সকলে তারক পদে প্রণাম করিল।।
তারপর বলে কয়ে হইল বিদায়।
ভক্তগণ সঙ্গে করে জয় পুর যায়।।
সেই হতে চন্দ্রকান্ত বছরে বছরে।
পহেলা বৈশাখে তিনি সাধু সেবা করে।।
এইভাবে কত দিন গত হয়ে গেল।
একদিন শ্রীতারক এসে দেখা দিল।।
দেখিয়া সে চন্দ্রকান্ত প্রণমিল পায়।
রামমণি তিনি এসে চরণ ধোঁয়ায়।।
চরণ ধোঁয়ায়ে সে বসিবারে দিল।
ধূপ ধুনা দিয়ে তিনি প্রণাম করিল।।
পাক করিবারে পরে করে আয়োজন।
হেন কালে চন্দ্রকান্ত ভাবে মনে মন।।
কি দিব কি দিব বলে মনেতে ভাবিয়া।
বাড়ীর দক্ষিণ পার্শ্বে উতরিল গিয়া।
কাঠাল গাছেতে তিনি উঠিলেন গিয়ে।
পাকিয়াছে কিনা তাই দেখেছে টিপিয়ে।।
পাকে নাই সে কাঠাল দেখিলেন তাই।
মন দুখে ফিরে এল ছাড়ে শুধু হাই।।
কিছু পরে শ্রী তারক কহিল তখন।
চন্দ্রকান্ত ডেকে বলে মধুর বচন।।
কাক ডাকিতেছে বাছা কাঠালের গাছে।
যাও বাছা দেখি গিয়ে কাঠাল পেকেছে।।
তাই শুনে চন্দ্রকান্ত চলিল তথায়।
কাকেতে ঠোকর মারে কাঠালের গায়।।
গাছে উঠে সে কাঠাল আনিল পাড়িয়া।
কিভাবে কি হয়ে গেল না পায় ভাবিয়া।।
কিছু আগে দেখিলাম হস্তেতে টিপিয়া।
অতিশয় শক্ত ছিল দেখেছি আসিয়া।।
অল্প সময়ের মধ্যে নরম হিইল।
তারকের গুণে বুঝি কাঠাল পাকিল।।
তাই ভেবে চন্দ্রকান্ত কান্দিয়া ভাসায়।
গৃহে এলো সে কাঠাল করিয়া মাথায়।।
আখি জলে ভেসে ভেসে কাঠাল ভাঙ্গিয়া।
তারকেরে খেতে দিল কান্দিয়া কান্দিয়া।।
হরিচাঁদ গুরুচাঁদ স্মরণ করিয়া।
তারক কাঠাল খায় পরাণ ভরিয়া।।
এইভাবে চন্দ্রকান্ত ভকতি করিত।
মাঝে মাঝে শ্রী তারক তথায় আসিত।।
এই ভাবে কত খেলা খেলিল তারক।
কলমেতে কি লিখিব আমি অপারক।।
চন্দ্রকান্ত শ্রীতারক লীলা সাঙ্গ পরে।
কি ঘটনা হল সেথা বলিব সবারে।।
মহানন্দ নামে চন্দ্রকান্তের তনয়।
পিতার আদর্শ মেনে চলিত সদায়।।
পহেলা বৈশাখ হলে সাধু সেবা দেয়।
দলে দলে মতুয়ারা আসিত তথায়।।
তারক যে বেল গাছ রোপন করিল।
সেই গাছ বড় হয়ে ফল ধরেছিল।।
সেই ফল লাগাইতে ঠাকুর সেবায়।
প্রতিবর্ষ বৈশাখেতে মহোৎসব হয়।।
একদিন শুন এক আশ্চর্য্য ঘটনা।
হরিভক্ত কাছে আমি করিব বর্ণনা।।
দলে দলে মতুয়ারা তথায় আসিল।
বেল গাছ ছায়াতলে কীর্তন করিল।।
সেই বেল ভোগে দিতে ভুল হয়ে গেছে।
গাছ হতে পাকা বেল মাটিতে পড়েছে।।
শত শত হরিভক্ত সেই খানে ছিল।
কারো গায় না পড়িল মাটিতে পড়িল।।
তাই দেখে হরিভক্ত মানিল বিস্ময়।
মহানন্দ হীরা কান্দে পড়িয়া ধরায়।।
কেন্দ কেন্দে কহিলেন ভক্তগণ ঠাই।
ভূল হয়ে গেছে মোর সবাকে জানাই।।
সেই বেল নিয়ে শেষে ভোগেতে লাগায়।
কেহ কেহ হরি বলে নাচিয়া বেড়ায়।।
এহেন আশ্চর্য্য লীলা দেখিয়া নয়নে।
হরিভক্ত কান্দে কেহ পড়ে ধরাসনে।।
এইভাবে কীর্তনেতে সকলে মাতিল।
বহুক্ষণ পরে শেষে কীর্তন থামিল।।
এই ভাবে সাধু সেবা হইত তথায়।
তারক চাঁদের গুণ কি লিখি ভাষায়।।
অধম বিনোদ বলে বেলা বেশি নাই।
হরিচান্দ প্রীতে সবে হরিবল ভাই।।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!