ভবঘুরেকথা
বাঙালি মুসলমানের মন আহমদ ছফা

-আহমদ ছফা

৩.

মুসলমান সমাজের কোন অংশের সামাজিক চাহিদা পূরণ করার জন্য এই পুঁথিসমূহ লেখা হয়েছিল, এবং কারা লিখেছিলেন। তাদের বিদ্যাবত্তা এবং সাংস্কৃতিক অগ্রগতি কতদূর ছিল- তলিয়ে বিচার করলে কতিপয় বিষয় স্পষ্টভাবে ধরা পড়বে। মূলত বাঙালি সমাজের যে শ্রেণীটি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং নতুন ধর্ম গ্রহণ করার কারণে, অধিকতরো খোলাসা করে বলতে গেলে মুসলিম রাজশক্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দরুন, তাদের মধ্যে নতুন আকাঙ্ক্ষার উন্মেষ ঘটেছিল, সেই শ্রেণীটিতেই ছিল পুঁথিসাহিত্যের আদর সীমাবদ্ধ।

তারাই এর লেখক, পাঠক এবং সমঝদার। তাছাড়া রোসাঙ ইত্যাদি রাজদরবারে বাংলাভাষা এবং সাহিত্যের যে চর্চা হয়েছে, তাতে যে সকল মুসলিম কবি-সাহিত্যিক আশাতিরিক্ত সাফল্য প্রদর্শন করেছেন জনগণের দৈনন্দিন জীবনধারার সঙ্গে তার সংযোগ খুব নিবিড় কিংবা গভীর ছিল না। রাজসভার বিদ্যাবত্তা, মার্জিত রুচি বিলাসবহুল জীবনযাত্রার ধরনই অধিকাংশ ক্ষেত্রে আলাওল প্রমুখ শক্তিমন্ত কবির কাব্য-ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল।

আর কবিরাও ছিলেন বহুদর্শী পণ্ডিত। আরবী, ফার্সী এবং সংস্কৃত ভাষাতে ছিলেন সমান পারদর্শী। তাদের সাধনার মধ্যে কাব্যের ঔচিত্যবোধ জখম হয়নি বটে, কিন্তু জনগণের জীবনধারার সমতলে এসে চাহিদামতো কাব্যরচনা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। জনগণের সঙ্গে অনেকটা সম্পর্কহীন জ্যোৎস্নাভুক সৌন্দর্যবিলাসী ছিলেন বলেই তাদেরকে কাব্যের সামাজিক আদর্শ নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতে হয়নি।

আরবী ফার্সী থেকে যে কোনো কাহিনী অনুবাদ করে রসসমৃদ্ধ ভাষায় প্রকাশ করতে পারলেই তাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যেত এবং তাদের সে যোগ্যতায় ঘাটতি ছিল না।

দো-ভাষী পুঁথিলেখকদের সমস্যা ছিল ভিন্নরকম। তারা ছিলেন একই সঙ্গে জনগণের শিল্পী এবং শিক্ষক। পুঁথিসমূহের অনেকগুলোর রচনার পেছনে সক্রিয় ছিল সামাজিক প্রয়োজন। এই প্রয়োজন পূর্ণভাবে পালন করার জন্য তিনটি উপাদান অপরিহার্যভাবে প্রয়োজনীয় ছিল।

যে সামাজিক আদর্শটি তারা প্রচার করছিলেন, সেই বিশেষ সমাজটির লোক-সাধারণের সাংস্কৃতিক চেতনার মান; বিমূর্তভাবে নতুন সামাজিক আদর্শ ধারণ করার মতো মানসিক সাবালকত্ব অর্জন করেছে কিনা সে সম্বন্ধে একটা প্রাক ধারণা এবং পূর্বের শিল্পাদর্শের অগ্রসর ধারাটির বিষয়ে তাদের উপযুক্ত জ্ঞান আর সেই ধারাটিকে সামাজিক প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে সম্পূর্ণ নতুন একটি খাতে প্রবাহিত করার ক্ষমতা ছিল কিনা।

মুসলমান রচিত পুঁথিসাহিত্যের প্রতিক্রিয়াশীলতা আসলে সামাজিক প্রতিক্রিয়াশীলতারই সাহিত্যিক রূপায়ণ। সে বিষয়ে কোনো স্পষ্ট ধারণা পোষণ করতে হলে এই অপমানজনক দূরস্মৃতির বিষয়টি স্মরণে রাখার প্রয়োজন আছে। মুসলিম শাসনের অবসানের পর এই সামাজিক প্রতিক্রিয়া আরো গভীর এবং অন্তর্মুখী রূপ পরিগ্রহণ করে।

এই তিনটি মৌল বিষয়ের কোনোটিই পর্যাপ্ত পরিমাণে পুঁথি লেখকদের সপক্ষে ছিল না। সামাজিক বীর এবং নায়ক সৃষ্টির মাধ্যমে ইসলাম ধর্মের মহিমা কীর্তন করার উদ্দেশ্যেই তাদের বেশির ভাগ কাব্যসাধনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। কিন্তু ইসলাম সম্বন্ধে তাদের জ্ঞান কিছু লোকশ্রুতি,জনশ্রুতি, আউলিয়া দরবেশদের অলৌকিক ক্রিয়াকাণ্ড ইত্যাদির মধ্যেই সীমিত ছিল।

আরবী ফার্সী ভাষায় দখলের অভাবে অধিকাংশেরই মনে ইসলাম বলতে একটা পাঁচমেশালী ঝাঁপসা ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল এবং তাদের রচিত সাহিত্যে সেই ধারণারই অভিব্যক্তি ঘটেছে। তাছাড়া যে সমাজের লোকসাধারণের কাছে নতুন ধর্মের সারল্য এবং সৌন্দর্য ব্যাখ্যা করছিলেন, সেই সমাজটির মানসিক পরিসর অত্যন্ত সংকীর্ণ এবং সংকুচিত ছিল।

কেননা নিম্নবর্ণের অধিকাংশ হিন্দুই যুগ যুগ ধরে আর্থিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে নিপীড়িত হওয়ার ফলে মুক্তির আশায় প্রথমে বৌদ্ধ এবং পরে ইসলাম ধর্ম কবুল করেন। নতুন ধর্ম গ্রহণ ছিল একটি নির্যাতিত মানবগোষ্ঠীর আত্মরক্ষার অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত একটা ব্যবহারিক পদক্ষেপ। সুতরাং পূর্ববর্তী সমাজেও যে গরীয়ান একটা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ছিল, তারা তার মর্মমধু পান করা থেকেও বঞ্চিত ছিলেন।

আবার ইসলামি সমাজ এবং সংস্কৃতির যে একটা উন্নত উদার আদর্শ ছিল ঐতিহাসিক কারণে তাও তারা অধিগত করতে পারেননি। এই অনগ্রসর জনসমাজ ইসলামের নামে যে সকল কাহিনী চাইতেন, সেই রকম কাহিনীই তাদের শোনাতে হতো। আর পুঁথিলেখকরা ছিলেন এই জনগণেরই কণ্ঠ।

এই সকল কারণে বাঙালি মুসলমান রচিত পুঁথিসাহিত্যে উদ্ভট রসের অতি বেশি ছড়াছড়ি। হিন্দু মহাকাব্য এবং পুরাণসমূহের বীর-বীরাঙ্গনাদের চরিত্রের অপভ্রংশ মুসলিম কবিদের সৃষ্ট বীরদের মধ্যে নতুন করে জীবনলাভ করেছে। তাই পুঁথিসাহিত্যে অগ্রসরমানতার চাইতে প্রতিক্রিয়ার জের অধিক। মনের হীনম্মন্যতাবোধ থেকেই এই প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি। এর পেছনে একগুচ্ছ ঐতিহাসিক কারণ বর্তমান।

মুসলমান পুঁথিলেখকেরা সচেতনভাবে এক সামাজিক আদর্শ থেকে বেরিয়ে এসে আরেকটি সামাজিক আদর্শ, একটি শিল্পাদর্শের বদলে আরেকটি শিল্পাদর্শ নির্মাণের প্রয়াস গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু নতুন শিল্পাদর্শটির চেহারা কি রকম হবে, জীবনের কোন্ মূল্যচেতনার বাহন হবে, অতীতে কতদূর গ্রহণ করবে, কতদূর বর্জন করবে, সে সম্বন্ধে তাদের মনে কোনো পরিচ্ছন্ন ধারণা ছিল না।

তাই তারা অনেক সময় বহিরঙ্গের দিক দিয়ে নতুন সৃষ্টি করলেও, আসলে তা ছিল গলিত অতীতেরই রকমফের। উপলব্ধির বদলে বিক্ষোভ, পরিচ্ছন্ন চিন্তার বদলে ভাবাবেগই তাদের শিল্পদৃষ্টিকে কুয়াশাচ্ছন্ন করে রেখেছে। একসময় এই মুসলমানদের পূর্বপুরুষেরা যে উঁচু বর্ণের হিন্দুদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছিলেন, এই অপমানজনক দূরস্মৃতি বাইবেলের ‘অরিজিন্যাল সিন’ বা আদি পাপের ধারণার মতো তাদের মনে নিরন্তর জাগরুক থেকেছে।

মুসলমান রচিত পুঁথিসাহিত্যের প্রতিক্রিয়াশীলতা আসলে সামাজিক প্রতিক্রিয়াশীলতারই সাহিত্যিক রূপায়ণ। সে বিষয়ে কোনো স্পষ্ট ধারণা পোষণ করতে হলে এই অপমানজনক দূরস্মৃতির বিষয়টি স্মরণে রাখার প্রয়োজন আছে। মুসলিম শাসনের অবসানের পর এই সামাজিক প্রতিক্রিয়া আরো গভীর এবং অন্তর্মুখী রূপ পরিগ্রহণ করে।

অনেকটা ইউরোপীয় শাসকদের মতো সামাজিক বিচ্ছিন্নতার মধ্যেই তারা বসবাস করতেন এবং নতুন পোশাক-আশাক ফ্যাসান ইত্যাদির জন্যে দিল্লি কিংবা ইরানের দিকে সাগ্রহে তাকিয়ে থাকতেন। এই উঁচুকোটির মুসলিম শাসকবর্গ যাদের হাতে অধিকাংশ শাসনতান্ত্রিক দায়িত্ব অর্পিত ছিল, তারা স্থানীয় জনগণের স্বাভাবিক নেতা ছিলেন না।

এই প্রতিক্রিয়ার জের বাঙালি মুসলমান সমাজে এত সুদূরপ্রসারী হয়েছে যে ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শক্তিশালী গদ্য লেখক মীর মশাররফ হোসেনের সুবিখ্যাত ‘বিষাদ সিন্ধু’ গ্রন্থটিতেও ‘শহীদে কারবালা পুঁথির ব্রাহ্মণ আজরকে একই চেহারায়, একই পোশাকে,একই স্থানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। সময়ের পালাবদলের ব্যাপারটি এই অত্যন্ত শক্তিধর লেখকের মনে সামান্য আঁচড়ও কাটতে পারেনি। পুঁথিলেখকের কাণ্ডজ্ঞানহীনতাকে তিনিও বরণ করে নিয়েছেন।

৪.

যেহেতু নবদীক্ষিত মুসলমানদের বেশির ভাগই ছিলেন নিম্নবর্ণের হিন্দু, তাই আর্য সংস্কৃতিরও যে একটা বিশ্বদৃষ্টি এবং জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে যে একটা প্রসারিত বোধ ছিল, বর্ণাশ্রম ধর্মের কড়াকড়ির দরুন ইসলাম কিংবা বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা গ্রহণের পূর্বে সে সম্বন্ধেও তাদের মনে কোনো ধারণা জন্মাতে পারেনি।

পাশাপাশি ইসলামও যে একটা উন্নত দীপ্ত ধারার সভ্যতা এবং মহীয়ান সংস্কৃতির বাহন হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে একটা সামাজিক বিপ্লব সংসাধন করেছিল, বাঙালি মুসলমানের মনে তার কোনো গভীরাশ্রয়ী প্রভাবও পড়েনি বললেও চলে। প্রথমত, ভারতে ইসলাম প্রচারে মধ্যপ্রাচ্যের সুফি দরবেশদের একটা গৌণ ভূমিকা ছিল বটে, কিন্তু লোদী, খিলজী এবং চেঙ্গিস খানের বংশধরদের সাম্রাজ্য বিস্তারই ইসলাম ধর্মের প্রসারের যে মুখ্য কারণ, তাতে কোনো সংশয় নেই।

এই পাঠান মোগলদের ইসলাম এবং আরবদের ইসলাম ঠিক এক বস্তু ছিল না। অব্বোসীয় খলিফাঁদের আমলে বাগদাদে, ফাতেমীয় খলিফাঁদের আমলে উত্তর আফ্রিকায় এবং উমাইয়া খলিফাঁদের স্পেনে যে জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা হয়েছিল, ভারতবর্ষে তা কোনোদিন প্রবেশাধিকার লাভ করেনি।

মুসলমান বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকদের যে অপ্রতিহত প্রভাব ইউরোপীয় রেনেসাঁকে সম্ভাবিত করে তুলেছিল, ভারতের মাটিতে সে যুক্তিবাদী জ্ঞানচর্চা একেবারেই শিকড় বিস্তার করতে পারেনি। খাওয়া-দাওয়া, সঙ্গীত কলা, স্থাপত্যশিল্প, উদ্যান রচনা এবং ইরান, তুর্কীস্থান ইত্যাদি দেশের শাসনপদ্ধতি এবং দরবারী আদব-কায়দা ছাড়া অন্য কিছু ভারতবর্ষ গ্রহণ করেনি।

তদুপরি, এই ভারতবর্ষের লক্ষৌ, দিল্লি ইত্যাদি অঞ্চলে ইসলামের যেটুকু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ হয়েছে বাংলা মুলুকে তার ছিটেফোঁটাও পৌঁছোতে পারেনি। যে মুসলিম শাসক শ্রেণীটি নানা সময়ে বাংলাদেশ শাসন করতেন, তারা সকলেই ছিলেন বিদেশী। রক্ত এবং ভাষাগত দিক দিয়ে স্থানীয় জনগণের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না।

অনেকটা ইউরোপীয় শাসকদের মতো সামাজিক বিচ্ছিন্নতার মধ্যেই তারা বসবাস করতেন এবং নতুন পোশাক-আশাক ফ্যাসান ইত্যাদির জন্যে দিল্লি কিংবা ইরানের দিকে সাগ্রহে তাকিয়ে থাকতেন। এই উঁচুকোটির মুসলিম শাসকবর্গ যাদের হাতে অধিকাংশ শাসনতান্ত্রিক দায়িত্ব অর্পিত ছিল, তারা স্থানীয় জনগণের স্বাভাবিক নেতা ছিলেন না।

এই পুঁথিসমূহের দো-ভাষী অর্থাৎ বাংলা এবং আরবী-ফার্সী মিশ্রিত হওয়ার পেছনে একটি অত্যন্ত দূরবর্তী ঐতিহাসিক কারণ বর্তমান। হাদিসে তিনটি কারণে অন্যান্য ভাষার চাইতে আরবীকে অগ্রাধিকার দেয়ার কথা বলা হয়েছে। প্রথম হলো, কোরআনের ভাষা আরবী।

এই উঁচুকোটির মুসলমান প্রশাসকেরা এদেশীয় যে শ্রেণীটির সহায়তায় বাংলাদেশে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন,তারা প্রায় সকলেই ছিলেন স্থানীয় উঁচু বর্ণের বাঙালি ব্রাহ্মণ, কায়স্থ কিংবা বৈদ্য শ্রেণীর লোক। যখনই প্রয়োজন পড়েছে কিংবা ব্রাহ্মণ শ্রেণীর আনুগত্য সম্বন্ধে মনে সন্দেহ জেগেছে তারা অপেক্ষাকৃত নিম্নস্তর থেকে খেলাত এবং পদবী বিতরণ করে আরেকটি নেতৃশ্রেণী সৃষ্টি করেছেন।

‘খাসনবীস,’ ‘মহলানবীস’, দেওয়ান’, ‘রায়রায়ান’, ‘বখসী’, ‘মুন্সী’, ‘দস্তিদার’ ইত্যাদি পদবীতেই তার প্রমাণ মেলে। বাংলার স্থানীয় মুসলমানেরা কদাচিত বিদেশী মুসলমান শাসকদের সঙ্গে প্রশাসনিক কর্মে সহায়তা করার সুযোগ লাভ করেছেন। তার কারণ ছিল, একটি রাজশক্তির সঙ্গে সহায়তা করার জন্য যে পরিমাণ নিরাপদ আর্থিক ভিত্তির প্রয়োজন বাঙালি মুসলমানদের তা ছিল না।

মুসলিম রাজশক্তি এই দেশের সমাজ-কাঠামোর মধ্যে অতি সামান্যই রূপান্তর এনেছিলেন। তারা অনেকটা নির্বিবাদেই পূর্বতন সমাজ কাঠামোকে গ্রহণ করেছিলেন। পরিবর্তন ততটুকুই করেছিলেন, যতটুকু তাদের প্রয়োজন। অর্থাৎ পূর্বেকার শাসক নেতৃশ্রেণীর শূন্যস্থানটি তারা পূর্ণ করেছিলেন। মুসলিম শাসনের পূর্বে যে সমাজ ব্যবস্থাটি চালু ছিল, পরেও সেই একই ব্যবস্থা চালু থেকেছে।

তার মধ্যে কোনো মৌলিক রূপান্তর বা পরিবর্তন তারা আনতে পারেননি। তাই নতুন ধর্ম গ্রহণ করার পরেও স্থানীয় মুসলমানেরা ইংরেজ আমলের দেশী খ্রিস্টানদের মতো একটা উন্মত্ত গর্ববোধ ছাড়া ইসলামি কিংবা আর্য সংস্কৃতির কিছুই লাভ করতে পারেনি।

তাই খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, মুসলমান আমলেও যারা প্রশাসনিক প্রয়োজনে গার্সী ভাষা শিক্ষা করেছেন, তাদের বেশির ভাগই ছিলেন বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের উঁচু বর্ণের লোক। বাঙালি মুসলমানদের অবস্থার, পেশার এবং রুচির বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। ইসলাম গ্রহণের ফলে তারা কতিপয় মোটা অভ্যেস বর্জন করে কতিপয় মোটা অভ্যেসকে গ্রহণ করেছিলেন।

যেহেতু সংখ্যাগত দিক দিয়ে তারা ছিলেন অনেক,উৎপাদন পদ্ধতির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত ছিলেন এবং রাজশক্তি সময়ে অসময়ে তাদের প্রতি আনুকূল্য প্রদর্শন করতেন, এই সকল কারণের দরুন তাদের মধ্যে দ্রুত একটা সামাজিক আকাঙ্ক্ষা জন্মলাভ করেছিল। পুঁথিসাহিত্যের মধ্যে এই আকাঙ্ক্ষাই পূর্ণ দৈর্ঘ্যে মুক্তিলাভ করেছে।

৫.

এই পুঁথিসমূহের দো-ভাষী অর্থাৎ বাংলা এবং আরবী-ফার্সী মিশ্রিত হওয়ার পেছনে একটি অত্যন্ত দূরবর্তী ঐতিহাসিক কারণ বর্তমান। হাদিসে তিনটি কারণে অন্যান্য ভাষার চাইতে আরবীকে অগ্রাধিকার দেয়ার কথা বলা হয়েছে। প্রথম হলো, কোরআনের ভাষা আরবী। দ্বিতীয় কারণ, বেহেশতের অধিবাসীদের ভাষা আরবী এবং তৃতীয়ত, হজরত মুহম্মদ নিজে একজন আরবীভাষী ছিলেন।

এই তিনটি মুখ্য কারণে যে সমস্ত দেশে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে, সেখানে অপ্রতিরোধ্যভাবে এই ভাষাটিরও অনুপ্রবেশ ঘটেছে। আরব অধিকারের পূর্বে মিশর এবং আফ্রিকার দেশসমূহের নিজস্ব ভাষা এবং বর্ণমালা দুই-ই ছিল। কিন্তু আরবদের অধিকারে আসার পর আরবী ভাষা এবং ইসলাম অনেকটা অভিন্নার্থক ছিল। আরবী ভাষাকে গ্রহণ না করে ইসলাম গ্রহণ করলে প্রকৃত মুসলমান হওয়া যাবে না, সে সময়ে এ রকম একটা প্রবল মত অতিমাত্রায় সক্রিয় ছিল।

বাঙালি মুসলমানের চোখে ফার্সী এবং উর্দু ভাষা দুটো আরবীর মতোই পবিত্র ছিল। আর এ দুটো রাজভাষা এবং শাসক নেতৃশ্রেণীর ভাষা হওয়ায়, তাদের শ্রদ্ধা নিশ্চয়ই অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু এ দুটির একটিকেও পরিপূর্ণভাবে রপ্ত করার জন্য একটি সমাজের পেছনে যে শক্ত আর্থিক ভিত্তি এবং সাংস্কৃতিক বুনিয়াদ থাকা প্রয়োজন ছিল দুটির কোনোটিই তাদের ছিল না।

অন্য যে-কোনো সেমিটিক ধর্মের মতো ইসলামেও পারলৌকিক জীবনের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। সারা জীবন মুসলমান হিসেবে জীবন কাটিয়ে পরকালে বেহেশতে গিয়েও ভাষাজ্ঞানের অভাবে একঘেয়ে জীবন কাটাতে হবে এটা ধর্মপ্রাণ মুসলমান মাত্রেরই সহ্যের অতীত একটা ব্যাপার। তাই মিশর থেকে শুরু করে মরক্কো পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলের অধিবাসীরা আরবী ভাষা এবং বর্ণমালা দুটিই গ্রহণ করেছিলেন।

মিশরে যেভাবে সহজে আরবী ভাষা জনগণের কাছে গ্রহণীয় হয়ে উঠতে পেরেছে, ইরানে তেমনটি হতে পারেনি। কারণ ইরানীরা ছিলেন অতিমাত্রায় ঐতিহ্য-সচেতন এবং সংস্কৃতিগতপ্রাণ জাতি। তাদের মহীয়ান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে এ যুক্তি উদ্ধার করতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি যে আরবী ভাষা না আয়ত্ত করেও প্রকৃত মুসলমান হওয়া যায়।

কোরানের প্রকৃত শিক্ষা তাদের নিজস্ব ভাষায় বিকশিত করে তোলার মতো ভাষাগত সমৃদ্ধি এবং মনীষা দুই-ই তাদের ছিল। আরবী ভাষাকে গ্রহণ বর্জন প্রশ্নে ইরানী সমাজ যে একটি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছিল,কবি শেখ সাদী, দার্শনিক ইমাম গাজ্জালী প্রমুখ তা গ্রহণ করেছিলেন। ইরানীরা আরবী ভাষা গ্রহণ করেননি, কিন্তু আরবী বর্ণমালা তাদেরকে মেনে নিতে হয়েছে।

তারপরে ইরান থেকে শুরু করে আফগানিস্তান পেরিয়ে ভারতবর্ষ অবধি মুসলিম শক্তির যে জয়যাত্রা সূচিত হয়েছে তার পেছন পেছন ফার্সী ভাষাও ভারতে প্রবেশ করেছে। এমনকি মোগল বিজেতারাও তাদের মাতৃভাষা তুর্কীর পরিবর্তে ফার্সীকেই সরকারি ভাষা হিসেবে মেনে নিয়েছেন। মিশরে আরবী যেমন, আফগানিস্তান ইত্যাদি দেশে ফার্সী যেমন চাপিয়ে দেয়া সম্ভব হয়েছে, ভারতবর্ষে সেভাবে অনেক দিন রাজভাষা থাকার পরও ফার্সীকে চাপিয়ে দেয়া সম্ভব হয়নি।

ভারতের হিন্দুরা বড় আশ্চর্য জাত, তারা দরবারে চাকরি করার জন্য উত্তম রূপে ফার্সীভাষা শিক্ষা করেছেন, ‘দিল্লীশ্বরো বা জগদীশ্বরো’ উচ্চারণ করেছেন, কিন্তু নিজেদের ভাষা বাদ দিয়ে কখনো ঐ ভাষাটিকে গ্রহণ করেননি। সুতরাং ভারতে ফার্সী ছিল জনগণের দৈনন্দিনতার স্পর্শলেশবর্জিত দরবারবিহীন একটি অভিজাত শ্রেণীর ভাষা। স্থানীয় মুসলিম জনগণের মধ্যেও তার বিশেষ প্রসার ঘটেনি।

স্বাতন্ত্রগর্বী মুসলমানেরা নিজেদের প্রয়োজনে ফার্সী বর্ণমালাকে গ্রহণ করে ভারতীয় ভাষা সমূহের সমন্বয়ে উর্দু নামে একটি পাঁচমিশালী ভাষা তৈরি করেছেন। ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা যেমন রেনেসাঁর যুগে জাতীয় ভাষাসমূহের পূর্ণাঙ্গ বিকাশের পূর্বে ল্যাটিন ভাষাতে সন্দর্ভ ইত্যাদি রচনা করতেন, তেমনি মুসলিম ধর্মবেত্তারা ধর্মগ্রন্থসমূহের টীকাটিপ্পনী ফার্সী ভাষাতেই রচনা করতেন। সৈয়দ আহমদের আলীগড় আন্দোলনের পর উর্দু ভাষাতে নতুন প্রাণ সঞ্চারিত হয় এবং ঐ ভাষাতেই ধর্মীয় সন্দর্ভসমূহ লেখা হতে থাকে।

বাঙালি মুসলমানের চোখে ফার্সী এবং উর্দু ভাষা দুটো আরবীর মতোই পবিত্র ছিল। আর এ দুটো রাজভাষা এবং শাসক নেতৃশ্রেণীর ভাষা হওয়ায়, তাদের শ্রদ্ধা নিশ্চয়ই অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু এ দুটির একটিকেও পরিপূর্ণভাবে রপ্ত করার জন্য একটি সমাজের পেছনে যে শক্ত আর্থিক ভিত্তি এবং সাংস্কৃতিক বুনিয়াদ থাকা প্রয়োজন ছিল দুটির কোনোটিই তাদের ছিল না।

কলকাতার পার্কস্ট্রিট এলাকার অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা যে ধরনের ইংরেজি বলেন কিংবা ঢাকার কুটি অধিবাসীরা যে উর্দু বলেন ততটুকু ভাষাজ্ঞান অর্জন করাও সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কারণে তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কেননা অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে ইংরেজ এবং ইংরেজি ভাষা আর ঢাকার কুট্টিদের সঙ্গে উর্দু এবং নবাবদের সামাজিক মেলামেশার যে সুযোগ ছিল, বাংলার আম জনগণের সঙ্গে উর্দু-ফার্সী জানা শাসক নেতৃশ্রেণীর ততটুকুও সামাজিক মেলামেশার সুযোগ ছিল না।

এই সমস্ত কিছুর মধ্যে থেকে একটি সত্যই স্পষ্টভাবে বেরিয়ে আসে, তা হলো বাঙালি মুসলমানদের অধিকাংশেরই মধ্যে আরবী, ফার্সী, উর্দু ইত্যাদি ভাষার প্রতি একটা অন্ধ অনুরাগ অনেক দিন পর্যন্ত বিরাজমান ছিল।

কিন্তু বাঙালি মুসলমানেরা নিজেদের সামর্থ্য অনুসারে আরবী, ফার্সী এবং উর্দু এই তিনটি ভাষায় তালিম গ্রহণ করার প্রাণান্তকর প্রয়াস চালিয়ে গেছেন। আরবী ফার্সী এবং উর্দু ভাষাটাও যখন তাদের পক্ষে পরিপূর্ণভাবে রপ্ত করা অসম্ভব মনে হয়েছে তখন ঐ বর্ণমালাতে বাংলা লেখার চেষ্টা করেছেন।

এখানে একটা কথা পরিষ্কার করে নেয়ার আছে, কোনো ব্যক্তিবিশেষ একটা ভাষা রপ্ত করতে পারেন, কিন্তু সেটাকে সামাজিকভাবে রপ্ত করা বলা চলে না। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকেও আরবী হরফে বাংলা পুঁথিপত্র যে লেখা হয়েছে সেটাকে কজন অবসরভোগী পুঁথিলেখকের নিছক খেয়াল মনে করলে ভুল করা হবে। আসলে তা ছিল বেহেশতের ভাষার প্রতি কৃতজ্ঞতা নিবেদনের অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ।

যখন দেখা গেল আরবী হরফে বাংলা লিখেও সমাজে চালু করা যায় না তখন পুঁথিলেখকরা সবান্ধবে পরবর্তী পন্থাটা অনুসরণ করতে থাকলেন। বাংলাভাষার সঙ্গে এন্তার আরবী ফার্সী শব্দ মিশেল দিয়ে কাব্য রচনা করতে আরম্ভ করলেন। জনগণ তাদের এই ভাষাটিকে গ্রহণও করেছিলেন। কিন্তু কোন্ জনগণ? এরা ছিলেন সেই জনগণ সংস্কৃত ভাষা যাদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল, আরবী অজানা, ফার্সীর নাম শুনেছেন এবং উর্দু ভাষা কানে শুনেছেন মাত্র।

সুযোগ পেলে তারা আরবীতে লিখতেন, নইলে ফার্সীতে, নিদেনপক্ষে উর্দুতে। কিন্তু যখন দেখা গেল এর একটাও সামাজিকভাবে ব্যবহার করা সম্ভব নয় তখন বাধ্য হয়েই বাংলা লিখতে এসেছেন। কেউ কেউ সন্দ্বীপের আবদুল হাকিমের সেই ‘যেজন বঙ্গেতে জন্মে হিংসে বঙ্গবাণী। সেজন কাহার জন্ম নির্ণএ ন জানি’ পঙক্তিগুলো আউড়ে বলে থাকেন যে নিজেদের ভাষার প্রতি পুঁথিলেখকদের অপরিসীম দরদ ছিল।

কথাটা সম্পূর্ণ সত্য নয়। নিশ্চয়ই সে সময়ে এমন লোক ছিলেন যারা সত্যি সত্যি বাংলা ভাষাকে ঘৃণা করতেন। আবদুল হাকিম নিজে সে শ্রেণীভুক্ত নন, তাই সে উঁচু ভাষাতে তার অধিকারও নেই। তাই তিনি তার একমাত্র আদি এবং অকৃত্রিম ভাষাতেই লিখতে প্রবৃত্ত হয়েছেন।

দূর অতীতের কথা বলে লাভ নেই। ফরিদপুরের নবাব আবদুল লতিফও মুসলমান সমাজের শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে উর্দু ভাষার সুপারিশ করেছিলেন। জনাব আবুল কাশেম ফজলুল হক যিনি ছিলেন বাংলার প্রথম আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন রাজনীতিবিদ, তিনিও বাড়িতে উর্দু ভাষায় কথাবার্তা বলতেন। ঢাকার কুট্টি অধিবাসীদের অনেকেই অনেকদিন পর্যন্ত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সক্রিয় বিরোধিতা করেছেন।

এই সমস্ত কিছুর মধ্যে থেকে একটি সত্যই স্পষ্টভাবে বেরিয়ে আসে, তা হলো বাঙালি মুসলমানদের অধিকাংশেরই মধ্যে আরবী, ফার্সী, উর্দু ইত্যাদি ভাষার প্রতি একটা অন্ধ অনুরাগ অনেক দিন পর্যন্ত বিরাজমান ছিল।

(চলবে…)

<<বাঙালি মুসলমানের মন : প্রথম কিস্তি ।। বাঙালি মুসলমানের মন : তৃতীয় কিস্তি>>

…………………….
বাঙালি মুসলমানের মন (প্রবন্ধ) : আহমদ ছফা।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

…………………
আরও পড়ুন-
বাঙালি মুসলমানের মন : প্রথম কিস্তি
বাঙালি মুসলমানের মন : দ্বিতীয় কিস্তি
বাঙালি মুসলমানের মন : তৃতীয় কিস্তি

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!