ভবঘুরেকথা
বেদ রচনার গোড়ার দিক : দুই

বেদ রচনার গোড়ার দিক : দুই

-সুকুমারী ভট্টাচার্য

এই ‘ঋত’ বা বিশ্বের অন্তর্গত এক নৈতিক ভিত্তি যার প্রকাশ প্রকৃতির নিয়মানুবর্তিতায় এবং মানুষ সেই ভাবে প্রকৃতির অনুসরণ করে যাতে তার সমাজ চলতে পারে নিয়ম মেনে। ঋতের মতোই এক অদৃশ্য নীতিনিষ্ঠ আবর্তন ও আচরণের অনুসরণে মানবসমাজ নিয়ন্ত্রিত হলেই মানুষের মঙ্গল, এ-ই ছিল উপপাদ্য।

মুশকিল বাধে দু-জায়গায়: প্রথমত, প্রকৃতি বারবার নিজেই নিজের নিয়মকে ভাঙেকখনও কখনও বর্ষাকালে দেখা দেয় খরা, অথবা অতিবৃষ্টি আসে, হঠাৎ ঘটে ভূমিকম্প, পশুপালে মড়ক লাগে, তৃণভূমি শুকিয়ে ওঠে, অথবা ছুটে আসে পঙ্গপাল, দেখতে দেখতে যত্নে লালিত ফসল ধ্বংস হয়ে যায়, বিদেশি শক্র আক্রমণ করে, মানুষের সমাজে দেখা যায় মহামারি, ঘটে ব্যাপক অকালমৃত্যু।

এ সব সময়ে মানুষের বিশ্বাসের ভিত্তিভূমি টলে যায়। সহসা সে আবিষ্কার করে যে, প্রকৃতি, জীবন, সমাজ যেমন ভাবে চলার কথা, তেমন ভাবে চলছে না। হঠাৎ সে দেখে সংসারে অশুভ, অমঙ্গল, পাপ, অনুত আছে; তার সহজ বোধ বুদ্ধিতে জীবনের ছক যা হওয়া উচিত তেমন হয় না, ধাক্কা লাগে যখন তার সাধারণ বুদ্ধিতে জীবনের জটিলতার কোনও ব্যাখ্যা মেলে না।

ক্লিফোর্ড গির্জ তাই বলেন, ‘ধর্মকে দেখতে হবে অন্তত সাধারণ বুদ্ধির ক্ষেত্রে অনুভূত একটা নু্যনতার পরিপ্রেক্ষিতে; জীবন সম্পর্কে সামগ্রিক একটা মনোভঙ্গির প্রেক্ষাপটে। সাধারণ বুদ্ধির ওপরে একটা প্রতিঘাতের রূপেও (ধর্মকে) দেখতে হবে।’(৩) বৈদিক আর্যরা জীবন বা সমাজ সম্বন্ধে যে একটি ছক বা নকশা তৈরি করেছিল, তার মধ্যে নিয়মের ভূমিকা ছিল সর্বব্যাপী।

সেখানে ব্যত্যয় দেখা গেলে সমস্ত সংহতি টলে যায়। মানুষ সর্বদাই কামনা করে তার ব্যক্তি ও সমাজজীবন চলবে একটা স্বীকৃত, পরিচিত নিয়ম ধরে, যেমন চলে চন্দ্রসূর্য, শীত, গ্রীষ্ম। সাধারণ ভাবে চলেও তাই, কিন্তু মাঝে মাঝে শৃঙ্খলা ভেঙে দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা।

এই বিশৃঙ্খলা বা সুসংহত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে যে সব শক্তি দেখা দিত, তার নানা রূপ: ভিন্ন গোষ্ঠীর বা আগন্তুক গোষ্ঠীর শত্ৰু, যার হাতে পরাজয় এমনই এক অবাঞ্ছিত অপ্রত্যাশিত অভিজ্ঞতা; আর ছিল প্রাকৃতিক বিপর্যয় বন্যা, খরা, ভূমিকম্প, অজন্ম এবং মহামারি–মানুষ ও পশুর। এ সবের মধ্যে মানুষ দেখতে পেত। তার জীবনে ও সমাজে হিসেবের বাইরে এক অশুভ শক্তির অনুপ্রবেশ।

মানুষের বিপদে দুর্যোগে যাতে দেবতারা অনুকুল হয়ে তাদের পরিত্রাণ করেন ও প্রাথিত বস্তু জোগান সেই জন্যে মানুষও দেবতাকে তার প্রতি সদয় করে তোলবার জন্যে নিজের সবচেয়ে প্রিয় খাদ্য নৈবেদ্য হিসেবে দিত এবং দেবতার শক্তি, মানবহিতৈষার নানা স্তব আবৃত্তি করে ও গান গেয়ে শোনোত, যাতে দেবতারা তাদের প্রতি অনুকুল হয়ে তাদের ইষ্টসিদ্ধি করেন।

আকাঙ্গিক্ষত শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবার জন্যে সে মনে মনে কল্পনা করল দেবতার। নিজেরই শক্তিমত্তার এক প্রতিরূপ হিসেবে। যাযাবর অবুস্থ থেকে আর্যরা প্রাগার্য রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে এসে দেবতাদের দেখল রাষ্ট্রশক্তি, বিশেষত সে-শক্তির নিয়ন্তার প্রতিভূ রূপে। আর্থার উলফের কথায়, ‘দেবতারা রাষ্ট্রের শক্তির রূপক, এ রূপক হল, রাষ্ট্র পরিচালক ও ন্যায়াধীশের।(৪)

মানুষ কোন নিরিখে তার দেবতাকে নির্মাণ করেছিল? বুদ্ধিমান, শক্তিধর, সক্রিয়, সাহায্যপরায়ণ। এমন একটিই জীব তার জানা ছিল: মানুষ। কাজেই মানুষ নিজের রূপেই অধিকাংশ, দেবতাকে কল্পনা করেছিল; অবশ্য কিছু কিছু উপকারী এবং/বা ক্ষমতাশালী নিসর্গবস্তুকেও সম্রামে বা আতঙ্কে সে দেবায়িত করেছিল।

যেমন সূর্য, চন্দ্র, বায়ু, অগ্নি, পর্জন্য, ইত্যাদি। কিন্তু অধিকাংশ দেবতাতেই সে নিজের আকৃতি ও প্রকৃতি আরোপ করে নির্মাণ করল। প্রতীচ্যে এ নিয়ে পরিহাসবিজঙ্গনা আছে, ঈশ্বর মানুষকে নির্মাণ করলেন নিজের প্রতিরূপ হিসেবে। কিন্তু মানুষও তো ভদ্রলোক, তাই সে ঈশ্বরকে নির্মাণ করল। নিজের প্রতিরূপে।’ এর মধ্যে একটি সত্যও নিহিত আছে।

খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দেই এই দেবনির্মাণকার্য অনেকটাই সম্পূর্ণ হয়েছিল; তবে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চদশ শতকে আনাতোলিয়ার বোঘাজ-কে-ঈ শিলালিপিতে ইন্দ্র, বরুণ, নামত্য, ইত্যাদি কয়েকজন বৈদিক দেবতার নাম পাওয়া যায়। বৈদিক যজ্ঞে দেবতাদের বিগ্রহ থাকত না, তবু খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে যাস্ক তাঁর নিরুক্ত গ্রন্থে প্রশ্নটা তুলেছেন।

দৈবতকাণ্ডে আগে বললেন, দেবমণ্ডলীর অবস্থান নররাষ্ট্রের মতো।–তত্রৈত স্নররাষ্ট্রমিব।’ (৭:৫:১৯) অর্থাৎ দেবতারাও একটি সংহত সমাজে বাস করেন যার গঠন মানুষের রাষ্ট্রেরই মতো। পরে প্রশ্ন তুললেন, দেবতাদের আকার বিষয়ে- ‘অথাকার চিন্তানং দেবতানাম।’ (৭:৬:১)।

এর উত্তর দিতে গিয়ে প্রথমে বললেন, ‘কেউ কেউ বলে পুরুষের মতোই হবে–পুরুষবিধাঃ সুরিত্যেকম ’’(৭:৬:১) কিন্তু বায়ু, চন্দ্র, সূর্য, অগ্নি এগুলি স্পষ্টতই পুরুষাকৃতি নয়। তা হলে? তা হলে স্বীকার করে নেওয়া ভাল যে, কেউ কেউ বলে ‘পুরুষবৎ নয়–অপুরুষবিধাঃ সুরিত্যেকম।’ (৭:৭:১) দুরকম মতের সমাহারে সিদ্ধান্ত করলেন, অথবা উভয়বিষয়ই হবে–অপি বোভয়বিধাঃ সুঃ।।’ (৭:৭:৭)

অর্থাৎ অগ্নি, সূর্য, চন্দ্র তো প্রত্যক্ষ ভাবেই মনুষ্যরূপী নয়, এদের আকৃতি মানুষ নির্মাণ করতে পারেনি, এরা যে-রূপে দৃশ্যমান সেই রূপেই পূজ্য। কিন্তু বিভিন্ন প্রয়োজনে যে সব শক্তিধর সহায়ক ও আশ্রয়ারূপী দেবতা মানুষ নির্মাণ করেছে, তাদের তো স্বাভাবিক ভাবেই মনুষ্যরূপে কল্পনা করেছে।

তাদের কান থাকা চাই ভক্তের প্রার্থনা শোনার জন্যে; মন, সহানুভূতি, দয়া, হিতৈষী থাকা চাই মানুষের মতো; ক্ষমতা থাকা চাই মানুষের প্রার্থনা পূরণ করার। আর চাই বস্ত্রীলংকার, মানুষের মতো সজা এবং বাহুতে বল, অস্ত্রশস্ত্র, রথীবাহন, যাতে দ্রুত এসে মানুষের সংকট মোচন করতে পারেন।

মানুষের বিপদে দুর্যোগে যাতে দেবতারা অনুকুল হয়ে তাদের পরিত্রাণ করেন ও প্রাথিত বস্তু জোগান সেই জন্যে মানুষও দেবতাকে তার প্রতি সদয় করে তোলবার জন্যে নিজের সবচেয়ে প্রিয় খাদ্য নৈবেদ্য হিসেবে দিত এবং দেবতার শক্তি, মানবহিতৈষার নানা স্তব আবৃত্তি করে ও গান গেয়ে শোনোত, যাতে দেবতারা তাদের প্রতি অনুকুল হয়ে তাদের ইষ্টসিদ্ধি করেন।

তা যখন হয়নি তখন ছোট ছোট গোষ্ঠীর আর্যদের সংঘর্ষ ঘটতে লাগল অনুরূপ প্রাগার্য গোষ্ঠীর সঙ্গে। জয়-পরাজয়ের পরে অধিকাংশ প্রাগার্য গোষ্ঠী সন্ধি করল আর্য গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে এবং তাদের সঙ্গে মিশে গেল। এই সন্ধির অনিবার্য শর্ত এবং ফল ছিল দু-পক্ষের ধনসম্পত্তি, জমি, ফসল, পশুপাল ও অন্যান্য স্থাবর জঙ্গম সম্পত্তির আদানপ্রদান এবং অন্তর্বিবাহ; এর ফলে একটি মিশ্র নৃগোষ্ঠী গড়ে উঠল, আর্য-প্রাগার্যদের সমাহারে।

এই ভাবে নানা বিপদসংকুল পরিবেশে দেবতাদের সঙ্গে একটা পারস্পরিক আদানপ্রদানের সম্পর্ক কল্পনা করে নিয়ে মনে মনে বিপদ থেকে ত্রাণের বন্দোবস্ত করে নিয়েছিল। এর জন্যে বিগ্রহধারী দেবতা অত্যাবশ্যক ছিল না, কল্পনায় দেবশক্তিকে সহায়ারূপে পাওয়াই ছিল প্রয়োজন–’লোকায়ত ধর্মে চূড়ান্ত ভাবে প্রয়োজনীয় ছিল কোনও দেব বা দেবীকে অব্যবহিতরূপে কাছে পাওয়া- সে বিগ্রহধারীই হোক অথবা বিমূর্তই হোক।‘(৫)

দেবতাকে কাছে পাওয়া বা তার কাছে নিজেদের বিপদের সংবাদ ও ত্রাণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিবেদন পৌঁছে দেওয়ার আকুতি থেকেই ধীরে ধীরে বিধিবদ্ধ ধর্ম গড়ে উঠেছিল। এর অবশ্যই নানা স্তর ছিল: অত্যন্ত সরল সংক্ষিপ্ত প্রাথমিক স্তর থেকে প্রার্থনার চরিত্র পবিবর্তিত হতে হতে ধর্মানুষ্ঠান ক্রমে বিচিত্রতর হয়ে উঠছিল, দেবতারাও সংখ্যায় বাড়ছিলেন চক্রবৃদ্ধিহারে, বাড়ছিল পুরোহিতের সংখ্যা, যজ্ঞের সংখ্যা এবং সার্বিক জটিলতা।

বহু প্রাচীন দেবতা পরিত্যক্ত হচ্ছিলেন, কারও বা চরিত্র পরিবর্তন ঘটছিল, এবং ধীরে ধীরে বহু নতুন দেবতা দেবমণ্ডলীতে স্থান পাচ্ছিলেন। শেষ দিকে দেবতারা সংখ্যায় এত বেশি হলেন যে, মাঝে মাঝেই তাদের নাম ধরে না ডেকে এক সঙ্গে বিশ্বে দেবাঃ’ বলে সম্বোধন করা হচ্ছিল।

জীবনে হার মানতে হচ্ছিল। আগন্তুক নানা প্রাকৃতিক বিপদ-আপদের কাছে, রোগব্যাধি ক্ষয়ক্ষতির দ্বারা বিপর্যস্ত হতে হচ্ছিল, ফলে নতুন নতুন বিপদে পরিত্রাণের জন্যে নতুন নতুন দেবতা উদ্ভাবন করা হচ্ছিল।

দেবমণ্ডলীর অনেকেই আর্যদের সঙ্গে সঙ্গে ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিলেন, অনেকেই সপ্তসিন্ধু অঞ্চলে এবং পরে ব্রহ্মাবর্তে।(৬) আরও কিছু এসেছিল প্রথমে মধ্যপ্রাচ্যে ভ্রমণকালে এবং পরে এখানকার প্রাগার্য নানা নৃগোষ্ঠীর সংস্রবে এসে; তাদের দেবমণ্ডলী থেকে আত্মসাৎ-করা নতুন কিছু দেবদেবীর অনুপ্রবেশ ঘটে আর্য দেবমণ্ডলীতে।

মনে রাখতে হবে, এ দেশে আসবার সময়ে আর্যরা একটি সংহত গোষ্ঠী ছিল না, এবং এখানেও কোনও সংহত প্রাগার্য প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ ঘটেনি। ‘পশ্চিম এশিয়ার মতো আগন্তুক আর্যরা পরাক্রান্ত শক্র অথবা বৃহৎ সাম্রাজ্যের সম্মুখীন হয়নি, হলে তারা সংহত হয়ে উঠে অনেক শক্তিশালী একটি নিজস্ব সুসংহত রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলতে বাধ্য হত।’

তা যখন হয়নি তখন ছোট ছোট গোষ্ঠীর আর্যদের সংঘর্ষ ঘটতে লাগল অনুরূপ প্রাগার্য গোষ্ঠীর সঙ্গে। জয়-পরাজয়ের পরে অধিকাংশ প্রাগার্য গোষ্ঠী সন্ধি করল আর্য গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে এবং তাদের সঙ্গে মিশে গেল। এই সন্ধির অনিবার্য শর্ত এবং ফল ছিল দু-পক্ষের ধনসম্পত্তি, জমি, ফসল, পশুপাল ও অন্যান্য স্থাবর জঙ্গম সম্পত্তির আদানপ্রদান এবং অন্তর্বিবাহ; এর ফলে একটি মিশ্র নৃগোষ্ঠী গড়ে উঠল, আর্য-প্রাগার্যদের সমাহারে।

এরই সূত্র ধরে আদানপ্রদান ঘটে উপাস্য দেবতা ও উপাসনা-পদ্ধতির। এই ভাবেই আর্য দেবমণ্ডলীতে ক্রমে ক্রমে বহু প্রাগার্য দেবদেবীর অনুপ্রবেশ ঘটল। সমান্তরাল প্রক্রিয়ায় পূর্বতন দেবমণ্ডলীর বেশ-কিছু আর্য দেবতা ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত হচ্ছিল।

অথর্ববেদের একটি প্রার্থনা, সারা পৃথিবীর সর্বকালের একটি প্রার্থনা হল: যদিহ ঘোরং যদিহ ক্রুরং যদিহ পাপং তচ্ছন্তিং তাচ্ছিবম। সর্বমেব শমস্তুেনঃ।–এখানে (পৃথিবীতে) যা কিছু ঘোর, যা কিছু নিষ্ঠুর, যা কিছু পাপ, তা শান্ত হোক, মঙ্গলে পরিণত হোক, এখানে সব কিছু শান্তিপূর্ণ হোক।’ (১৯:৯:১৪) এই প্রার্থনা কখনও কোথাও পূর্ণ হয়নি, তবু সর্বত্রই উপলব্ধ ও উচ্চারিত হয়েছে।

এর মধ্যে, বিশেষত ছিলেন সেই দেবতারা যাদের বিশিষ্ট সংজ্ঞা, ভূমিকা বা তাৎপর্যের স্মৃতি তত দিনে ধূসর হয়ে এসেছে–যেমন ভগ, অংশ, দক্ষ, তার্যমন, এবং আগ্রীসূক্তগুলিতে উল্লিখিত অগ্নিবাচক এবং বিস্মৃত তাৎপর্যের অন্য দেবতারা, দ্বারো দেব্যঃ ঊষাসনাক্তা’, ইত্যাদি।

দেবমণ্ডলীতে দীর্ঘকাল ধরে অব্যাহত একটি প্রক্রিয়ায় এদের বিবর্তন ঘটছিল: পূর্বের কিছু দেবতাকে বর্জন, কিছু দেবতার তাৎপর্যে পরিবর্তন এবং নতুন কিছু দেবতার আবির্ভাব। এই শেষোক্তরা বেশির ভাগই আসছিল প্রাগার্য গোষ্ঠীর উপাসিত দেবমণ্ডলী থেকে।

মানুষের সমাজে ও দেবতাদের সমাজে যখন এই সংমিশ্রণ ঘটে তখন সে সময়ের মানুষের প্রত্যয়ের জগতে যা কিছু ধ্রুব অবলম্বন ছিল, সেগুলি হল দেবতাদের অস্তিত্ব, তাদের সর্বশক্তিমত্তা ও মানবহিতৈষা। আর বিশ্বাস ছিল, বিজেতা গোষ্ঠীর বাহুবল ও অস্ত্রবলের উৎকর্ষে; অতএব বিজিতের ন্যূনতায়।

এরই ফলে একটি নৈতিক মানদণ্ড তৈরি হল: প্রাগার্যের সম্পত্তিতে আর্যের ন্যায়সংগত অধিকার। লুণ্ঠন অব্যাহত ভাবে চলেছিলবহু সুক্তে দেবতাদের কাছে আবেদন জানানো হয়েছে, প্রাগার্য সম্পত্তি লুঠ করে এনে আর্যদের দেওয়ার জন্যে। অবশ্যই লুঠ একতরফা ছিল না, প্রাগার্যরাও আর্যদের সম্পত্তি লুঠ করত। ফলে আর্যরা তাদের ‘রাক্ষস’ (কথাটার আদি অর্থ ছিল, যাদের থেকে রক্ষা করতে হয়–যেভ্যো রক্ষ্যতে’) বলত।

এ ছাড়া আর্যদের কোনও কোনও গোষ্ঠীর মধ্যে শক্রতা ছিল, সেখানেও পরস্পরের সম্পত্তি লুঠতরাজ করা চলত। অনুপ্রবেশকারী আর্যদের অধিকার বাহুবল ও অস্ত্রবলের জোরে, প্রাগার্যদের জোর ছিল আদিম স্বত্ববোধে; কাজেই সংঘর্ষ কতকটা অনিবার্যই ছিল।

এ সব ও অন্যান্য নানা জাতের অশুভ, ক্ষতিকর অভিজ্ঞতা মাঝে মাঝে তাদের বিশ্বাসের ভূমিতে আলোড়নজাগাত: দেবতারা মানবহিতৈষী, সর্বশক্তিমান তবু এত অমঙ্গল, প্রাকৃতিক বিপর্যায়, শক্রর হানা, রোগব্যাধি, লুঠতরাজ কেন হয়? অশুভ বা মন্দকে তারা বলত পাপ, কিন্বিষ, কলুষ, পাত্মন, ইত্যাদি। মঙ্গলময় দেবতাদের সঙ্গে একই বিশ্বে এত অমঙ্গল কেমন করে থাকতে পারে?

অথর্ববেদের একটি প্রার্থনা, সারা পৃথিবীর সর্বকালের একটি প্রার্থনা হল: যদিহ ঘোরং যদিহ ক্রুরং যদিহ পাপং তচ্ছন্তিং তাচ্ছিবম। সর্বমেব শমস্তুেনঃ।–এখানে (পৃথিবীতে) যা কিছু ঘোর, যা কিছু নিষ্ঠুর, যা কিছু পাপ, তা শান্ত হোক, মঙ্গলে পরিণত হোক, এখানে সব কিছু শান্তিপূর্ণ হোক।’ (১৯:৯:১৪) এই প্রার্থনা কখনও কোথাও পূর্ণ হয়নি, তবু সর্বত্রই উপলব্ধ ও উচ্চারিত হয়েছে।

এবং পুরোহিতদের ভূমিকা তাঁদের ক্ষমতার চেয়ে সম্মানই বেশি দিয়েছিল।’(১১) উপাসনানির্ভর ধর্মের ভিত্তি হল উপাস্যদের সম্বন্ধে আস্থা। কী সেই আস্থা? যেমন আগেও বলেছি, তারা আছেন, তারা সর্বশক্তিমান, মঙ্গলময়, মানবহিতৈষী এবং উপাসনা যদি যথাযথ রীতিতে নিম্পন্ন হয় তা হলে তারা প্রার্থীর অভিষ্ট সিদ্ধ করেন।

ম্যাকক্লাস্কি দেখাচ্ছেন, ‘সহজতম আকারে সমস্যাটি হল এই: ঈশ্বর সর্বশক্তিমান। ঈশ্বর সর্বমঙ্গলময়, তবুও মন্দ আছে… এগুলির যে-কোনও দুটো যদি সত্যি হত, তা হলে তৃতীয়টি মিথ্যা হত।’(৮) এই মতের স্বাভাবিক যুক্তিগত সিদ্ধান্তটি উমা গুপ্ত-র কথা থেকে নেওয়া যেতে পারে: মন্দের উপস্থিতি থেকে আমাদের সিদ্ধান্ত করতেই হয় যে, কোনও সর্বশক্তিমান মঙ্গলময় ঈশ্বর থাকা অসম্ভব।(৯)

ফলে নানা সংশয় দেখা দিল, অভ্যস্ত প্রত্যয়ের পুনর্বিবেচনা শুরু হল, কারণ সেন্ট অগাস্টিন যেমন বলেছেন, মানুষ তা-ই বিশ্বাস করে যা বিশ্বসনীয়’ (Nulus quippe credit, nisi prius cogitavit esse credendum)। স্পষ্টতই বিশ্বসনীয়তার সংজ্ঞার মধ্যে এসে গেছে যুক্তি, তাই সর্বশক্তিমান, সর্বমঙ্গলময়ের বিধানে মন্দের, অশুভের অবস্থান যুক্তি দিয়েই অবিশ্বনীয়।

অতএব মানুষ অবিশ্বসনীয়কে বিশ্বাস করতে দ্বিধাবোধ করল। যদি কোনও সর্বশক্তিমান মঙ্গলময় ঈশ্বর বা দেবকুল না থাকেন তো মানুষের নিজের আচরণ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারেও দোলাচলত আসে; কোন নীতিতে চলা উচিত, সে নিয়েও মনে প্রশ্ন আসে। আর্যদের দীর্ঘ যাত্রাপথে এ ধরনের মন্দের অভিঘাত বেশ দীর্ঘকাল ধরেই তাদের বিশ্বাসকে ধাক্কা দিচ্ছিল।

ক্লিফোর্ড গির্জের ভাষায়, বিপর্যস্ত হওয়া, দুঃখ এবং নৈতিক দ্বিধার অজ্ঞেয়তার বোধ… যদি সেগুলি যথেষ্ট তীব্র হয় অথবা দীর্ঘকাল ধরে সেগুলিকে বহন করতে হয় তা হলে জীবন যে বোধগম্য বা আমরা চিন্তা করে জীবনের ছকে নিজেদের সার্থক ভাবে মানিয়ে নিতে পারি।

এই ধারণার মূলই প্রত্যাহত হয়।’(১০) অর্থাৎ মঙ্গলময়, সর্বশক্তিমান দেবতাদের কর্তৃত্বের অধীনে বাস করার ভরসাটা টলে গেলেই আসে সংশয়। মানুষ সর্বদাই চেয়েছে নির্ভরযোগ্য একটি বিশ্বপরিকল্পের মধ্যে বাস করতে, কারণ সেখানেই তার ধ্রুব আশ্রয়, নিৰ্ভয়, নিশ্চিন্ত অবস্থান।

অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, প্রথম যুগে দেবতাদের মধ্যে ক্ষমতার কোনও আনুপাতিক স্তরবিন্যাস ছিল না, এমনকী বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও কোনও ধ্রুব অপরিবর্তনীয় ভিত্তি ছিল না। প্রথমত, আর্যরা দীর্ঘকাল ধরে ধাপে ধাপে নানা দেশ পেরিয়ে এসেছে, এসেছে অন্যান্য বহু ধর্মবিশ্বাসীর দেশ পেরিয়ে, সেখানে অনিবার্য ভাবেই তাদের নিজেদের বিশ্বাসও বিবর্তিত এবং পরিবর্তিত হয়েছে।

কাজেই প্রাচীন গ্রিসের মতো এখানেও কোনও অনড় অবশ্যস্বীকার্য বা সর্বস্বীকৃত বিশ্বাসের ভিত্তি তাদের থাকা সম্ভব ছিল না। প্যাট্রিক দেখাচ্ছেন, ‘কোনও ধ্রুব বিশ্বাসের কাঠামো ছিল না, যাতে চিত্ত বিক্ষিপ্ত হতে পারে; আর তার চেয়েও যা বিশেষ ভাবে লক্ষণীয় তা হল (দেবতাদের) কোনও উচ্চ-নীচ ক্রম ছিল না। ধর্মছিল উপাসনানির্ভর।

এবং পুরোহিতদের ভূমিকা তাঁদের ক্ষমতার চেয়ে সম্মানই বেশি দিয়েছিল।’(১১) উপাসনানির্ভর ধর্মের ভিত্তি হল উপাস্যদের সম্বন্ধে আস্থা। কী সেই আস্থা? যেমন আগেও বলেছি, তারা আছেন, তারা সর্বশক্তিমান, মঙ্গলময়, মানবহিতৈষী এবং উপাসনা যদি যথাযথ রীতিতে নিম্পন্ন হয় তা হলে তারা প্রার্থীর অভিষ্ট সিদ্ধ করেন।

<<বেদ রচনার গোড়ার দিক : এক

…………..
(২) ‘…religion has been one of the most effective bulwarks against anomy throughout human history.’–Peter Berger, p. 87

(৩) Religion must be viewed against the background of the Insufficiency, or anyway the felt insufficiency, of common sense, as a total orientation toward life and it mut also be viewed in terms of formative impact upon common sense –Clifford Geertz, p. 96

(৪) ‘…gods are a metaphor for the system of authority, the state. The metaphor in one of rulers and Judges…’–Arthur Wolf, p 19

(৫) ‘… a crucial ingradient in folk religion is the immediate presence of and access to a god or a goddess…which may be iconic or aniconic –(i.D. Sontheimar & Herman Kulke (ed), p. 4

(৬) সরস্বতী দূষদ্বত্যোর্দেবিনদ্যোর্যর্দস্তরম। তং দেবনির্মিতং দেশং ব্রহ্মাবর্তং প্রচক্ষতে। মনুসংহিতা; (২:১৭)

(৭) Unlike in Western Asia the immigrating Aryans did not encounter nighty enemies and big empires which would have forced them to unite and to establish a more effective political organization of their own.’ –Herman Kulke & Dietmar Rothermund, p. 45

(৮) In its simplest form the problem in this God is omnipotent, God is wholly good; and yet evil exists… if any two of them were true, the third would be false.’–H J M McClosky, p. 46, God and Evil, ed. Nelson

(৯) ‘We must conclude from the existence of evil that there cannot be an omnipotent, benevolent

God.’–Uma Gupta, p. 84

(১০) ‘Baflement, suffering and a sense of Intractable ethical paradox are… if they are intense enough or are sustained long enough radical challenge to the proposition that life is comprehensible and that we can by taking thought orient oursclves effectively within it.’–Clifford Geertz p 00

(১১) There were no dogmas to confuse the mind, and what was still more remarkable, there was no hierarchy. The religion was one of worship and the position of the press conferred more honour than power. –M M Patrick, p. 4

…………..
বেদে সংশয় ও নাস্তিক্য – সুকুমারী ভট্টাচার্য।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

.……………….
আরও পড়ুন-
বেদ রচনার গোড়ার দিক : এক
বেদ রচনার গোড়ার দিক : দুই
……………
বেদে সংশয় ও নাস্তিক্য : এক
বেদে সংশয় ও নাস্তিক্য : দুই
বেদে সংশয় ও নাস্তিক্য : তিন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!