ভবঘুরেকথা
একাদশী প্রদ্বীপ আলো মুক্তি নির্বাণ ভক্তি প্রার্থনা

বিবেকের বাণী

-লুৎফর রহমান

যার মাঝে বিবেকের বর্তিকা নাই, যে অন্তরস্থ প্রজ্ঞা দেবতার কথা শুনতে পায় নাই, তার ভরা শুকনোয় তল হবে। তার জীবন-জাহাজ শুকনা গাঙে ডুবে যাবে; মনুষ্য অন্তরে বিবেক আল্লাহর বাক্যরূপে মনুষ্যকে সর্বদাই চালিত করে সাবধান করে। যে সে-কথা শোনে, সেই জয়লাভ করে। যে তা শোনে না, যে তা গ্রাহ্য করে না, বিবেকের কথা তার কাছে চিরদিনের জন্য মৌন হয়ে যায়। সে দিন দিন অধঃপতিত হতে থাকে।

আমি যখন হুগলিতে পরীক্ষা দেই, তখন অতিশয় সাধু ধার্মিক বলে সমাজে পরিচিত একজন মৌলবী সাহেব চুপে চুপে আমাকে কতকগুলি প্রশ্নের উত্তর বলে দিয়ে গেলেন।

আর একজন মৌলবী সাহেবকে জানি, তিনি পরীক্ষা-মন্দিরে ছেলেদের চুরি করে লিখবার সুবিধা দিতেন। যখন ধর-পাকড় আরম্ভ হতো, তখন তিনি তাদের কাছ থেকে গোপনে টেবিলের উপর বইগুলি এনে রেখে দিতেন।

বলতে কী, এদের এই কাজের পেছনে কিছু যুক্তি আছেই। বিপন্নকে সাহায্য করলে খোদা সন্তুষ্ট হন, হয়তো এই কথা ভেবেই এরা ছেলেদের এই গোপন অসাধু কার্যে উৎসাহ দিতেন। এ যে কত বড় অন্যায়, ছেলেদের ভবিষ্যৎ জীবনের প্রতি কত বড় নিষ্ঠুর আঘাত, তা তারা চিন্তা করতেন না, চিন্তা করাও দরকার মনে করতেন না।

বস্তুত ধর্মের অনুশাসন অন্ধভাবে মেনে চললে পদে পদেই পতন এবং বিপদের সম্ভাবনা; বিবেক যার সঙ্গে কথা বলে না, বিবেক যাকে চালিত করে না, জীবনের বহু বৎসরের ধার্মিকতা তার কাছে। নিরর্থক।

অন্ধকারে যেমন আলো মানুষের কাছে বিবেকও তদ্রূপ বর্তিকার মতো সর্বদা পথ দেখায়। বিবেকই মনুষ্যকে ধার্মিকতা শিক্ষা দেয়। যদি বিবেকের অনুশাসন অনুভব করতে পারে, কোনো ধর্মগ্রন্থ, কোনো বাইরের উপদেশ তাকে পথ দেখাতে পারে না।

বিবেক অপেক্ষা আরও একটি মহা জিনিস আছে, তার নাম প্রজ্ঞা। বিবেক মনুষ্যকে প্রতারণা করে না। প্রজ্ঞা দিবালোকের মতো উজ্জ্বল, তার দৃষ্টির সম্মুখে কোনো কুয়াশা নাই। সন্দেহ নাই- প্রজ্ঞা ধ্রুব সত্যকে দর্শন করে। যিনি এই প্রজ্ঞার সন্ধান পেয়েছেন, তিনি পরম চেতনা লাভ করেছেন, তিনি মনুষ্যের নমস্য। অতি অল্প লোকই এই প্রজ্ঞার সন্ধান পায়।

বিবেক মানব-জীবনের পরম বন্ধু, ইহা বন্ধুর ন্যায় জননীর ন্যায়, পিতার ন্যায় মনুষ্যকে পথ দেখায়; সান্ত্বনা দেয়। বিবেক কোনো সময় মনুষ্যকে প্রতারণা করে, কিন্তু সেজন্য দুঃখিত হবার কোনো কারণ নেই। আজ তোমাকে সে যদি ভুল পথ দেখায়, দশ বৎসর পর তোমাকে গন্তব্যস্থানে সে পৌঁছে দেবেই;

অপরিপক্ক মানুষ, জ্ঞানবুদ্ধি পূর্ণভাবে বিকশিত হয় নাই তার বিবেক এবং প্রজ্ঞাবান মানুষের বিবেকের মধ্যে অনেক পার্থক্য হতে পারে; তাতে দোষ নাই। মানুষ যদি আপন অন্তরস্থ বিবেকের বাণী পালন করতে যেয়ে মহা অন্যায় করে, তজ্জন্য তাকে অপরাধী করা চলে না।

স্বামীর অনুগত হওয়াই নারীর ধর্ম, তার কাজের কোনো জবাবদিহি নাই। তেমনি প্রত্যেকে আপন আপন বিবেক অনুযায়ী চল, ফলাফলের জন্য তুমি দায়ী নও। বিবেকের অনুগত থাকাই তোমার কাজ।

বিবেক আল্লাহর আসন, এই আসনের সম্মুখে মানুষ আজ্ঞাবহ ভৃত্য। জাগতিক এবং আধ্যাত্মিক সমস্ত বিষয়ের অভিজ্ঞতা আমরা বিবেকের সাহায্যে লাভ করি। মানুষের প্রতি, সমাজের প্রতি আমাদের কী কর্তব্য, মানব-জীবনের গুরুত্ব এবং দায়িত্ব, পাপের জঘন্য রূপ, ধার্মিকতার বিমল চিত্র আমরা বিবেকের সাহায্যে আপন আপন আত্মায় অনুভব করি।

বিবেকবান মনুষ্য সর্বদাই ভীত। সব সময় তিনি চিন্তা করেন- তার দ্বারা কোনো অন্যায় হয়েছে কিনা? মানুষ তাকে নিরাপরাধ বলে মুক্তি দিলেও তিনি বিবেকের বিচারে নিজকে মুক্তি দেন না। তিনি আপনার শাস্তি আপনি গ্রহণ করেন। ইহা মানব-হৃদয়ে অমর অক্ষয় চির-সুন্দর, চির-সমুজ্জ্বল চেতনাময় প্রদীপ।

বিবেকের সাহায্যে মানুষ জেনেছে, তার জীবনের এক মহাসার্থকতা আছে। চিন্তাহীন বিবেকবর্জিত জীবন তার কাছে অসহ্য। পশুর বিবেক নাই। ভালো-মন্দ জ্ঞান নাই। মানুষ ভালো-মন্দ বোঝে, বিবেক তাকে সর্বদা সতর্ক করে, ভীত করে, জীবন্ত দেবতা হয়ে তাকে এস্ত, কর্তব্যপরায়ণ, লমিতো ও সজাগ করে। বিবেকের সম্মুখে সে অস্থির হয়, বিশ্বকে উপেক্ষা করে সে আত্মার দেবতার সম্মুখে করজোড়ে দাঁড়ায়।

সমস্ত জ্ঞান, সমস্ত সাহিত্যের মূল উদ্দেশ্য মানুষের অন্তরস্থ এই বিবেক দেবতাকে জানিয়ে দেওয়া, তেজস্বী, নির্ভীক, পুষ্ট এবং সবল করে তোলা। যদি সে জ্ঞান, মানুষের উপদেশ, পুস্তক এবং সাহিত্য মানুষের অন্তরকে না জাগাতে পারে- তবে বুঝতে হবে তার পাষাণ প্রাণে সমস্ত জ্ঞান ব্যর্থ হয়েছে, মরুভূমিতে বৃক্ষ রোপণের মতো সমস্ত প্রচেষ্টা নিরর্থক হয়েছে বিবেকের জাগরণের নামই আত্মবোধ।

বিবেক অপেক্ষা আরও একটি মহা জিনিস আছে, তার নাম প্রজ্ঞা। বিবেক মনুষ্যকে প্রতারণা করে না। প্রজ্ঞা দিবালোকের মতো উজ্জ্বল, তার দৃষ্টির সম্মুখে কোনো কুয়াশা নাই। সন্দেহ নাই- প্রজ্ঞা ধ্রুব সত্যকে দর্শন করে। যিনি এই প্রজ্ঞার সন্ধান পেয়েছেন, তিনি পরম চেতনা লাভ করেছেন, তিনি মনুষ্যের নমস্য। অতি অল্প লোকই এই প্রজ্ঞার সন্ধান পায়।

(চলবে…)

<<জীবন সাধনা ।। মিথ্যাচার>>

………………..
মহৎ জীবন -লুৎফর রহমান।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………………….
আরও পড়ুন-
মানব-চিত্তের তৃপ্তি
আল্লাহ্
শয়তান
দৈনন্দিন জীবন
সংস্কার মানুষের অন্তরে
জীবনের মহত্ত্ব
স্বভাব-গঠন
জীবন সাধনা
বিবেকের বাণী
মিথ্যাচার
পরিবার
প্রেম
সেবা
এবাদত

………………….
আরও পড়ুন-
মহৎ জীবন : পর্ব এক
মহৎ জীবন : পর্ব দুই
মহৎ জীবন : পর্ব তিন
কাজ : পর্ব এক
কাজ : পর্ব দুই
কাজ : পর্ব তিন
কাজ : পর্ব চার
ভদ্রতা : এক
ভদ্রতা : দুই

……………………
আরও পড়ুন-
মহামানুষ … মহামানুষ কোথায়
মহিমান্বিত জীবন
মহামানুষ
যুদ্ধ
স্বাধীন গ্রাম্যজীবন
আত্মীয়-বান্ধব
সত্য প্রচার
নিষ্পাপ জীবন
উপাসনা
নমস্কার
তপস্যা
তীর্থ-মঙ্গল
আত্মার স্বাধীনতার মূল্যবোধ
মনুষ্য পূজা
মন্দতাকে ঘৃণা

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!