ভবঘুরেকথা
বুড়ি মা রঞ্জনা ফকিরানি

বুড়ি মা – আর আমারে মারিস নে মা

-মূর্শেদূল মেরাজ

সকালে থেকেই একের পর এক ফোন আসছিল। আমি আধো ঘুমের মধ্যেই মোবাইলে নামগুলো দেখছিলাম কারা ফোন করছে। কিন্তু ধরছিলাম না। সাধারণত দিনের এই সময়টায় আমি ফোন ধরি না। সেটা আমার পরিচিত জনেরা খুব ভালো করেই জানেন। তাই তারা কেউই এই সময়টায় ফোন দেয় না।

আর যখন দেয় তখন বড় বিপদে পরেই দেয়। তবে প্রথম যে ফোনটা এসেছিল তার নামটা মোবাইল স্ক্রিনে দেখেই মনের মধ্যে কু ডেকে উঠলো। সময়টাই এমন। চারপাশ থেকে কেবল খারাপ খবরই আসে। এই সকাল সকাল মনটা কিছুতেই খারাপ করার মানে হয় না।

এমনিতেই গতরাত থেকেই কি এক অজানা কারণে বেশ অস্থিরতা কাজ করছিল। একটানা ঘুমও হয়নি। বারবার ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল। ঘুমটা ভালো হচ্ছিল না কিছুতেই। তারউপর এতো ফোন। ভেবে নিয়েছিলাম, যে খারাপ খবরটা আসবার কথা, ভেবেছিলাম সেটাই এসেছে। তাই ভাবলাম ফোনটা ঘুম থেকে উঠেই ধরবো। এখন আর ধরছি না।

বুড়ি মা তেমনি এক মানুষ। সেই বার রাজবাড়িতে মোহম্মদ ফকিরের উপর নির্যাতন করলো মৌলবাদীরা। দলে দলে বাউল-ফকিরদের চুল-দাড়ি কেটে দিলো। তার প্রতিবাদে সাধুসঙ্গ। সেই কবে কার কথা। প্রচুর মানুষ পাংশার চরে ভিড় করেছে প্রতিবাদী সাধুসঙ্গে। বিশাল আয়োজন চলছে। বুড়ি মা এক কোণে বসে আছেন চেয়ার নিয়ে।

কুষ্টিয়ার এক সাধুগুরু বেশ অসুস্থ। তাকে নিয়েই দুশ্চিন্তা ছিল। ভেবেছিলাম খবরটা তাকে কেন্দ্র করেই হবে। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে কম্পিউটার স্ক্রীনে তাকাতেই স্তব্ধ হয়ে গেলাম। দু:সংবাদটা সেই সাধুগুরুকে নিয়ে নয়। খবরটা আরো অনেক অনেক বড়।

বুড়ি মা পর্দা নিয়েছেন!! দেহত্যাগ করে চলে গেছেন। বুড়ি মা!! এই অবেলায় বুড়ি মা চলে যাবেন ভেবেছি কখনো!!! দীর্ঘ সময় চুপচাপ বসে রইলাম। যেন কিছুই করার নেই। অন্য যে কোনো সময় হলে এতোক্ষণে ব্যাগপত্র গুছিয়ে কুষ্টিয়ার পথে রওনা হয়ে যাওয়ার কথা।

কিন্তু এই অতিমারীর কালে সেটাও বা হচ্ছে কই? ঘরে বসেই এই সংবাদ হজম করা কি এতোটাই সহজ!! কাউকেই আর ফিরতি কল করতে ইচ্ছে করছে না মোটেও। কি বলবো? বুড়ি মায়ের ফল উৎসবে যাবার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। যাবার ষোলআনা ইচ্ছাও ছিল। কিন্তু লক ডাউনের কারণে যাওয়া হলো না।

কে জানতো আর বুড়িমার সাথে দেহে দেখাই হবে না? বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে। বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে। লকডাউনে মায়ের সাথে ঈদ করতে সন্তান কি চরম ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি ফেরে না? তাহলে আমরা কেনো লকডাউনের অজুহাতে ফল সেবা নিতে যেতে পারলাম না!!!

এখনই বা যেতে পারছি না কেন?? আসলে সম্পর্ক বিষয়টাকেই কি মলিন করে ফেলেছে এই অতিমারীর আতঙ্ক?? নাকি বাস্তবতা মেনেই যাওয়া হচ্ছে না!! এই হিসেব মিলাতে আমার বহু বহু দিন লেগে যাবে। এখন কেবল বুড়ি মাকে ঘিড়ে বিচ্ছিন্ন সব স্মৃতি ফিরে ফিরে আসছে। সেই সকল মধুর স্মৃতি ঘুরে ফিরে আসছে।

বুড়ি মা’র সঙ্গে কবে কোথায় কিভাবে প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল সেটা হিসেব করে বলা বেশ কঠিন। তারচেয়েও অধিক কঠিন বুড়ি মা’র স্নেহ-ভালোবাসা যে কত রূপে-কতভাবে পেয়েছি তা প্রকাশ করা। কিছু কিছু মানুষ মাতৃগুণ নিয়ে জন্মায়। তার জন্য তাদের সন্তান জন্ম দেয়ার পর মা হতে হয় না। তারা আজন্ম মা।

বুড়ি মা তেমনি এক মানুষ। সেই বার রাজবাড়িতে মোহম্মদ ফকিরের উপর নির্যাতন করলো মৌলবাদীরা। দলে দলে বাউল-ফকিরদের চুল-দাড়ি কেটে দিলো। তার প্রতিবাদে সাধুসঙ্গ। সেই কবে কার কথা। প্রচুর মানুষ পাংশার চরে ভিড় করেছে প্রতিবাদী সাধুসঙ্গে। বিশাল আয়োজন চলছে। বুড়ি মা এক কোণে বসে আছেন চেয়ার নিয়ে।

আমি সীতল দা, এ্যাপোলো ভাই, রবি দা সহ আরো কয়েকজন বসলাম পাশে। বুড়ি মা সেখানে বসে বসে পুরো সঙ্গের সকল কিছুই নিভৃতে পরিচালনা করে চলেছেন। সেবা সহ যাবতীয় কর্ম তিনি এভাবেই সকল সাধুসঙ্গের দায়িত্ব নিজে কাঁধে তুলি নিতেন।

আমরা বসেছি। বুড়ি মা বলতে শুরু করলেন। তিনি বেশ অসুস্থ। সদ্য সেরে উঠেছেন। তাই ছোটাছুটি করতে পরছেন না। আবার তিনি শুয়ে থাকলেও সাধুসঙ্গ সুষ্ঠভাবে পরিচালনা করা শক্ত হবে। তাই তাকে বসে থেকেই সকল কাজ করাতে হচ্ছে।

প্রথম প্রথম বিষয়টা খটোমটো লাগতো নিজের কাছেই। তারপর সব ঠিকঠাক। আসলে নাম তো কেবল ডাকবার জিনিস নয়। নাম হলো বৈশিষ্ট্য। অবশ্য সবাই নিজ নামকে বৈশিষ্ট্যে পরিণত করতে পারে না। বুড়ি মা পেরেছিলেন। সবার ক্ষেত্রে পেরেছিলেন কিনা তা জানা নেই। তবে আমার ক্ষেত্রে তো পেরেছিলেন তাতে সন্দেহ নেই।

তবে বুড়ি মা যে কাজ করতে দারুণ মজা পাচ্ছেন; তা কিন্তু তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। আসলে যারা কর্মযোগী তারা কাজ না করে থাকতেই পারেন না। বুড়ি মা’ও তেমনি একজন। সব কাজ তাকে ঘিরেই তাদের কর্মপদ্ধতি চিন্তাভাবনা করে যেন।

বুড়ি মা তার অসুস্থ হয়ে উঠার গল্প বলতে লাগলেন। একজন মানুষ এতোটা রসিয়ে রসিয়ে নিজের অসুস্থতার বর্ণনা দিতে পারে সেটা আমি সে দিনই প্রথম জানতে পারলাম। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম। অন্যরা নানান কাজে এদিক সেদিক যাওয়ার জন্য ছটফট করছে। আমার কোনো কাজ নেই আমি বসে আছি, তাই আমাকে শোনাতে লাগলেন। অসুস্থতার বিন্দুবিসর্গ।

তারপর যতবার বুড়ি মায়ের সাথে দেখা হয়েছে কথা হয়েছে। প্রতিবারই তার অসুস্থতার দীর্ঘ কাহিনী শুনেছি। অসুস্থতার কাহিনী শুনতে আমার বরাবরই বিরক্ত লাগে। অসুস্থতা নিয়ে এতো দীর্ঘ কথাবার্তার কি আছে? অল্প কথায় শেষ করে সুস্থতার কথা বললেই তো ভালো। কিন্তু এই ক্ষেত্রে বুড়ি মা ছিল ব্যাতিক্রম।

তার মুখে সেই গল্প শোনার জন্য আমরা মুখিয়ে থাকতাম। তিনি দীর্ঘ সময় নিয়ে সেই আলাপ দিতেন। আমরা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনে যেতাম। গল্পকরার লোক পেলে বুড়ি মা শত ব্যস্ততার মাঝেও আড্ডা জমিলে ফেলতেন।

বুড়ি মা ছিলেন বিচক্ষণ মানুষ। যাকে তিনি পছন্দ করতেন। তাকেই তিনি তার আশপাশে আসতে দিতেন। বসতে দিতেন। যাদের পছন্দ করতেন না। তাদের সাথেও সদব্যবহার করতেন বটে। কিন্তু একটা দূরত্ব সকল সময়ই বজায় রাখতেন। কাকে দিয়ে কোন কাজটা হবে। তা তিনি মনে মনে হিসেব করেই রাখতেন।

কাকে কতটা ছাড় দিতে হবে। কার লাগাম টেনে ধরতে হবে। সবই একহাতে সামলাতেন মমতাময়ী মা। ফকির নহির সাঁইজির কন্যা হওয়ায় হিসেব মতে বুড়ি দি ডাকবার কথা ছিল। সম্পর্কের রেশ টা তেমনই হওয়ার কথা। কিন্তু বুড়ি মায়ের মাঝের মাতৃগুণেরই কারণেই তিনি বুড়ি মা ডাকটাই আমার মুখ দিয়ে ব্যক্ত করিয়ে নিয়েছিলেন।

প্রথম প্রথম বিষয়টা খটোমটো লাগতো নিজের কাছেই। তারপর সব ঠিকঠাক। আসলে নাম তো কেবল ডাকবার জিনিস নয়। নাম হলো বৈশিষ্ট্য। অবশ্য সবাই নিজ নামকে বৈশিষ্ট্যে পরিণত করতে পারে না। বুড়ি মা পেরেছিলেন। সবার ক্ষেত্রে পেরেছিলেন কিনা তা জানা নেই। তবে আমার ক্ষেত্রে তো পেরেছিলেন তাতে সন্দেহ নেই।

এই যে দৃষ্টি। অর্থাৎ দেখবার ক্ষমতা। এবং প্রেম দিয়ে কাজকে সহজ করিয়ে দেয়া। সেটা অন্য কারো কাছ থেকে আবার কবে পাবো কে বলতে পারে। এই ক্ষুদ্র জীবনে আর পাবো কিনা তাতেও সন্দেহ তো রইলোই। এই বার বাগেরহাট থেকে ফিরবার সময় কুষ্টিয়া হয়ে আমরা সোজা গেলাম বুড়ি মায়ের আনন্দধাম পাককোলায়।

ফকিরকুলের শিরোমণি লালন সাঁইজির ঘরের কোকিল সাঁইজির সিঁড়ির অন্যতম সাধুগুরু ফকির লবান সাঁইজির যোগ্য শিষ্য ফকির নহির সাঁইজির একমাত্র কন্যা রঞ্জনা ফকিরানী। যাকে আমরা ডাকি বুড়ি মা। সকলে ঠিক মা হয়ে উঠতে পারে না। আবার কেউ কেউ তীব্র ভালোবাসার বিকিরণ ছড়িয়ে ঠিক ঠিক ভালোবাসা আদায় করে নেন।

বুড়ি মায়ের সাথে কি আমার এমন কোনো আন্তরিক সম্পর্ক ছিল? যা মাথায় করে রাখবার মতো! সত্যি বলছি আজকের আগে আমি জানতামই না। বুড়ি মাকে কতটা পছন্দ করি। সারাদিন কিছুই করা হলো না। এই লেখাও কিছুতেই লিখে উঠতে পারছি না।

ক্রমাগত মাথার মধ্যে নানান স্মৃতি ঘুরপাক খাচ্ছে। মা চলে গেলে সন্তানের কি রোদন তা সন্তান ভিন্ন আর কেউ টের পায় না? নাকি পাওয়া সম্ভব!! এর উত্তর আমার কাছে নেই। জানি না করো কাছে আছে কিনা।

আসলে বুড়ি মা এমনই একজন মানুষ। যত দিন যাবে লালন ঘরের মানুষ তাকে তত অনুভব করতে শুরু করবে। বিশেষ করে লবান শাঁইজির সিঁড়ির সাধুসঙ্গে বুড়ি মা ছিলেন একাই অদ্বিতীয়। অন্য সকল সাধুগুরুরা যেখানে হাত গুটিয়ে থাকতেন। বুড়ি মা সেখানে দায়িত্ব নিয়ে সকল কিছু পরিচালনা করতেন।

কোথায় কি লাগবে, কোথায় কি লাগতে পারে। কার জন্য কি ব্যবস্থা রাখতে হবে। সকল কিছুই তার নখদর্পনে। এমন কি কাকে দিয়ে কি করানো যাবে। সবই তার মাথায় থাকতো। একবার বুড়িমার আনন্দধামের সাধুসঙ্গে অল্প সময়ে সাজসজ্জার ক্ষুদ্র কিছু কাজ করার সুযোগ হয়েছিল।

এরপর থেকে বুড়ি মার সাথে যতবার দেখা হয়েছে। ততবার বলেছেন পরেরবার আমার যা যা লাগবে সব কিছু উনি ব্যবস্থা করে রাখবেন। কিন্তু আমাকে সাজাতে হবে। কিভাবে সাজাবো সবই আমি ঠিক করবো। উনি কেবল যোগান দেবেন। সেই সময় যাতে কোনো কাজ না রাখি এজন্য প্রতিবারই মনে করিয়ে দিতেন।

করোনার এই অতিমারীর কালে বড় পরিসরে সাধুসঙ্গ করার সুযোগ হয়নি। এই প্রতিকূলতার কারণে আমাদেরও যাওয়া হয়নি। তারপরও এরই মাঝে এক ফাঁকে যখন গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলাম। তখন আবারো মনে করিয়ে দিয়েছিলেন আমাকে দায়িত্ব নিয়ে সাজাতে হবে।

এই যে দৃষ্টি। অর্থাৎ দেখবার ক্ষমতা। এবং প্রেম দিয়ে কাজকে সহজ করিয়ে দেয়া। সেটা অন্য কারো কাছ থেকে আবার কবে পাবো কে বলতে পারে। এই ক্ষুদ্র জীবনে আর পাবো কিনা তাতেও সন্দেহ তো রইলোই। এই বার বাগেরহাট থেকে ফিরবার সময় কুষ্টিয়া হয়ে আমরা সোজা গেলাম বুড়ি মায়ের আনন্দধাম পাককোলায়।

যাক এবার আমরা যখন বুড়ি মার আখড়ায় উপস্থিত। তখন আমরা সংখ্যায় চার। আমি, আশিক, ছোটভাই ফয়েজ আর রকিব। একটা দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে একটু শুয়ে বসে কাটাতে আমরা আশ্রয় নিয়েছি আনন্দধামে। এই কটা দিন আর কিছু করবো না। এমনকি বিশেষ প্রয়োজন না হলে এপাশ ওপাশও না।

আগে থেকেই আমাদের আবদার ছিল বুড়ি মার হাতে নিরামিষ পোলাও খাওয়ার। যথা সময়ে আশিক সেই কথা বুুড়ি মার কানে তুললো। তিনি মহা আনন্দে রাঁধতে বসে গেলেন। প্রতিবার তার হাতের রান্না সেবা নিতে গেলেই আমার মনে হয়- রান্নাকে তিনি শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন। কি সেই স্বাদ বলে বোঝানো মুশকিল।

একবার এক বন্ধুকে নিয়ে গিয়েছিলাম নহির সাঁইজির নারায়গঞ্জের পুষ্পধাম আখড়ায়। সেখানে বুড়ি মা উপস্থিত ছিলেন। তিনি সেই দুপুরে বহুপদের নিরামিষ সেবা করেছেন। আমার সাথের বন্ধুটির বেশ নাক উঁচু। খাওয়ার ব্যাপারে আরো কয়েক কাঠি বেশি।

উনার সাথে যতবার কোথাও খেতে বসেছি। উনি মুখে খাবার দিয়েই তার সমালোচনা শুরু করে দিয়েছেন। কোন দেশে কোথায় তিনি এর থেকে বহুগুণ ভালো রান্না খেয়েছেন। তাই আমি একটু দ্বিধায় ছিলাম। সাধুগুরুদের মাঝে না তিনি আবার বিরূপ মন্তব্য করে বসেন।

লক্ষ্য করে দেখলাম তিনি খেয়ে চলেছেন। কোনো কথা না বলে। প্রথমে একটু সন্দেহ হলো। আমি যে বলেছিলাম সেবার সময় কথা বলা যাবে না। তাই কি উনি নিরব? সেবা শেষে বাইরে এসে উনি বলেছিলেন, এটা কি মানুষের রান্না? আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম- মানে কি??

উনি বললেন- এমন রান্না শেষ কবে খেয়েছি মনেই করতে পারছি না। এমন রান্না আদৌ খেয়েছি কিনা তাও মনে করতে পারছি না। নিরামিষ যে এতো স্বাদের হতে পারে। তার উপর পেয়াজ রসুন ছাড়া। সেটা কল্পনা করাও মুশকিল। শেষে না পেরে তিনি বুড়ি মায়ের সাথে রান্নার দীর্ঘ আড্ডা দিলেন।

বুড়ি মাও স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে রসিয়ে রসিয়ে সেই রান্না গল্প বলতে লাগলো। ঝড়ঝড়া গরম ভাতের সাথে বেগুন ভাজা। কাকরোল ভাজা। কিসের যেন কয়েক পদের ভর্তা। সর্ষে পটল। ঢেরশের অস্বাধারণ একটা পিপারেশন। আরো কয়েক পদের সবজি। পাতলা ডাল। সবই ছিল অস্বাধারণ। বহুজনের কাছে তিনি সেই রান্নার কথা সেবার কথা বলে বেড়িয়েছেন বলে শুনেছি।

যাক এবার আমরা যখন বুড়ি মার আখড়ায় উপস্থিত। তখন আমরা সংখ্যায় চার। আমি, আশিক, ছোটভাই ফয়েজ আর রকিব। একটা দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে একটু শুয়ে বসে কাটাতে আমরা আশ্রয় নিয়েছি আনন্দধামে। এই কটা দিন আর কিছু করবো না। এমনকি বিশেষ প্রয়োজন না হলে এপাশ ওপাশও না।

যদিও দৃশ্যত তিনি ছিলেন না। কিন্তু আমরা ভালোই বুঝেছিলাম এই প্যাঁচ খেলেছেন বুড়ি মা। অগত্যা আমরা হাসতে হাসতে রওনা দিয়েছিলাম প্রাগপুর হেমাশ্রমের উদ্দেশ্যে। বুড়ি মা এমন খেলা সকল সময়ই খেলতেন। আর প্রতিবার বিজয়ী হয়ে সেই ভূবণ মহিনী হাসিতে সব ঠাণ্ডা করে দিতেন।

একথা শুনে বুড়ি মাও খুশি। বললো। যতদিন খুশি থাকো। খাও আর ঘুমাও। আমরা জায়গা নির্বাচন করে হ্যামক খাটিয়ে দিলাম। সারাদিন ঝুলে ঝুলে ঘুমাও। আর রাতে আখড়া ঘরে। খাবার সময় দফায় দফায় মজাদার সব খাবার সেবা নেও। এই হলো আমাদের রুটিন। হ্যামক দেখে বুড়ি মার পছন্দ হয়ে গেলো।

বুড়ি মার আরেকটা বিষয় ছিল। নতুন কিছু দেখলেই ছেলেমানুষের মতো দাবী করে বসতো। সেটা এই যাত্রাতেও ব্যাতিক্রম হলো না। গোটা দুয়েক হ্যামেকের দাবী চলে আসলো। তার আর সামসুল ফকিরের সাঁইজের দুইটা হ্যামক তার চাই-ই চাই। এর পর নাকি অন্য সাধুসঙ্গে গেলে তিনিও হ্যামকে ঝুলে ঝুলে ঘুমাবেন।

বুড়ি মা আমাদের থেকে বয়সে খুব বড় ছিলেন তা কিন্তু নয়। কিন্তু মা হয়ে গিয়েছিলেন ভালবাসার পরসে। প্রায়শই বলতেন- আমার সবচেয়ে ভালো লাগে অপরিস্কার মানুষ আমার পছন্দ না। মোটামুটি পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন হলে যে কাউকেই আমি মোটামুটি সহ্য করে নিতে পারি। কিন্তু অপরিস্কার স্বভাবের কাউকে মোটেও না।

বলেতেন- আখড়া থেকে যখন বাইরে যাই তখন একা হাতে সব গুছিয়ে পরিস্কার করে যাই। আবার ফিরে এসে যতই ক্লান্ত থাকি। সমস্ত বাড়ির পরিস্কার পরিচ্ছন্ন না করে ঘুমাতে পারি না। এমনকি বাড়ির সকল কিছু ধুয়ে মুঝে,। কাপড় কেঁচে তবে নিশ্চিন্তের ঘুম আসে।

সেই বুড়ি মা আজ দেহত্যাগ করলেন। সব কিছু রেখে পর্দা নিলেন। তার আখড়ার প্রতিটা জিনিস নিত্যদিনের মতো অপেক্ষায় থাকবে। এই বুড়ি মা এলো বলে। আর আমরা! আমরা কার অপেক্ষায় থাকবো?? কার কাছে ছুটে যাবো?

বুড়ি মায়ের আরেকটা অস্বাধারণ গুণ ছিল। যা ছিল চোরা কৌশল। তিনি এমনভাবে কলকাঠি নাড়তেন। যা সোজা চোখে বোঝার উপায় নেই। সূক্ষ্ম মারপ্যাঁচ খেলতেন। যাতে কেউ সহজে চলে না যায়। যেই তার কাছে গিয়ে চলে যাওয়ার কথা বলা হবে। তখনি তিনি এমন সব প্যাঁচ খেলবেন যে। আপনাকে আরো গোটা কয়েকদিন থাকতেই হবে।

এই তো সেই বার আমরা বুড়ি মা’র ভক্তছেলে খাইরুল ভাইয়ের সাধুসঙ্গে গেলাম। সেখানে থেকে আমাদের যাওয়ার কথা ছিল যশোর। সে সময় নহির সাঁইজি আখড়ায় একা থাকবেন। তাই আমাদেরকে কৌশলে কথার মারপ্যাঁচে নহির সাঁইজির সাথে হেমাশ্রমে পাঠিয়ে দিলেন।

যদিও দৃশ্যত তিনি ছিলেন না। কিন্তু আমরা ভালোই বুঝেছিলাম এই প্যাঁচ খেলেছেন বুড়ি মা। অগত্যা আমরা হাসতে হাসতে রওনা দিয়েছিলাম প্রাগপুর হেমাশ্রমের উদ্দেশ্যে। বুড়ি মা এমন খেলা সকল সময়ই খেলতেন। আর প্রতিবার বিজয়ী হয়ে সেই ভূবণ মহিনী হাসিতে সব ঠাণ্ডা করে দিতেন।

সাধুগুরুরা কিছুতেই ছাড়বেন না। সকলের এক কথা হোক লকডাউন। তোমরা থাকো। এখানে তো সমস্যা নেই। রান্না হবে। খাবে আর ঘুমাবে। কিন্তু আমাদের মাঝে কাউকে কাউকে ফিরতেই হবে। বুড়ি মা পরিস্থিতি ঠিক বুঝলেন। তিনি সব সামলে নিলেন। সাধুগুরুর কাছ থেকে বিদায় আদায় করে দিলেন মাতৃস্নেহে।

সবকিছু পরিপাটি রাখতে ভীষণ পছন্দ করতেন বুড়ি মা। সাধুসঙ্গ করতে এসে কারো যেন কোনো কিছুর কমতি না হয়; সেদিকে ছিল তার সজাগ নজর। চার-পাঁচ’শ সাধুগুরুদের আনন্দধাম আখড়ায় সঙ্গ করতে যা যা প্রয়োজন সবই গুছিয়ে রেখেছেন থরে থরে।

সকলের জন্য কাঁথা-বালিশ, লেপ-কম্বল, থালা বাটি, হাড়ি পাতিল সব। সাধুগুরুদের যাতে কষ্ট না হয় সে জন্য আধুনিক টয়লেট বানিয়ে দিয়েছেন। টয়লেটে বসিয়েছেন গিজার। যাতে শীতের সময় সাধুগুরুদের কষ্ট না হয় জল ব্যবহারে।

লবান শাঁই ও রিজিয়া ফকিরানির ভক্ত-শিষ্য ফকির নহির সাঁইজির কন্যা রঞ্জনা ফকিরানি বুড়ি মা যুগল বেঁধেছিলেন লবান শাঁইয়ের আরেক ভক্ত-শিষ্য ফকির সামসুল সাঁইজির সাথে। ফকির সামসুল সাঁইজিও একজন আগাগোড়া প্রেমের মানুষ।

সেই যুগল ভেঙ্গে বুড়ি মা চলে গেলেন। একা হয়ে গেলেন সামসুল ফকির। এই পাহাড় সম মানুষটার সামনে দাঁড়াতে এখন আমাদের অনেক হিম্মত লাগবে। বুড়ি মা ছাড়া তাকে শেষ কবে কে কোথায় দেখেছে কেউ সহজে বলতে পারবে না। সেই মানুষটাকে একা দেখতে হবে ভাবতেই মনটা খারাপ করে।

বুড়ি মায়ের শূন্যতা কেবল আনন্দধাম! সামসুল ফকির! নহির সাঁইজি! তার ভক্ত-শিষ্যদের বা আমাদের উপর প্রভাব ফেলবে তা কিন্তু নয়। বুড়ি মায়ের শূন্যতা লবান সাঁই সিড়ির অনেক সাধুসঙ্গেই ব্যাপক প্রভাব পরবে। কোনো কিছুই কারো জন্য থেমে থাকে না। থাকবেও না।

তবে প্রতিটা সাধুসঙ্গে সাধুগুরু ভক্ত-শিষ্য ভাললাগা-ভালোবাসা ও অনুরাগের মানুষজন যে বুড়ি মাকে স্মরণ করবে তা ক্রমেই সকলের কাছে স্পষ্ট হবে। একলা হাতে তিনি যেভাবে নিজ দায়িত্বে সকল কিছু সামলাতেন। তা সামাল দিতে এখন অনেক বেগ পেতে হবে।

এমন প্রেমময় ভঙ্গিতে সকলকে সেবা দেয়ার মনোভাব সম্পন্ন মানুষ পাওয় সহজ নয়। আসলেই সহজ নয়। রোজার আগে যখন লকডাউন ঘোষণা আসলো। তখন আমরা কুষ্টিয়া। নহির সাঁইজিকে নিয়ে য়খন আমরা লবান সাঁইজির সাধুসঙ্গে উপস্থিত হলাম।

তখন জানা গেলো আমাদের ঢাকায় ফিরতে হবে কিছুক্ষণের মধ্যেই নইলে লকডাউনে আটকে পরতে হবে। এরই মাঝে বুড়ি মা আমাদের জন্য সেবা নিয়ে বসে পরলেন। পরম যত্নে আমাদের সেবা দিলেন। আমরা তৃপ্তি সহকারে সেবা নিয়ে বুড়ি মাকে বললাম আমাদের বেড়িয়ে পরতে হবে।

সাধুগুরুরা কিছুতেই ছাড়বেন না। সকলের এক কথা হোক লকডাউন। তোমরা থাকো। এখানে তো সমস্যা নেই। রান্না হবে। খাবে আর ঘুমাবে। কিন্তু আমাদের মাঝে কাউকে কাউকে ফিরতেই হবে। বুড়ি মা পরিস্থিতি ঠিক বুঝলেন। তিনি সব সামলে নিলেন। সাধুগুরুর কাছ থেকে বিদায় আদায় করে দিলেন মাতৃস্নেহে।

আসলে এমন কত কত স্মৃতি যে আছে বুড়ি মাকে ঘিরে তা বলতে শুরু করলে কোথাও থামা যাবে বলে মনে হয় না। এই লেখা কোথাও যেয়ে শেষ হওয়ার নয়। কত স্মৃতি। কত কথা। বলতে গেলে ফুরবে না। তারপরও শেষ করতে হবে বলে থামতে হলো। পরিশেষে বুড়ি মায়ের প্রতি ভক্তি ও প্রেম। ভালো থাকবেন বুড়ি মা। আপনার নতুন যাত্রা শুভ হোক। শান্তিময় হোক। বুড়ি মাকে আরও বলি-

আর আমারে মারিসনে মা।
বলি মা তোর চরণ ধরে
ননী চুরি আর করবো না।।

ননীর জন্যে আজ আমারে
মারলিগো মা বেঁধে ধরে,
দয়া নাই মা তোর অন্তরে
স্বল্পেতে গেলো জানা।।

পরে মারে পরের ছেলে
কেঁদে যেয়ে মাকে বলে,
সেই মা জননী নিষ্ঠুর হলে
কে বোঝে শিশুর বেদনা।।

ছেড়ে দে মা হাতের বাঁধন
যাই যেদিকে যায় দুই নয়ন,
পরের মাকে ডাকবো এখন
তোর গৃহে আর থাকবো না।।

যে না বোঝে ছেলের বেদন
সেই ছেলের মার বৃথা জীবন,
বিনয় করে বলছে লালন
কাঁদছে সে করে করুণা।।

 

জয়গুরু।। আলেকসাঁই।।

………………………
ব্যবহৃত ছবি: সংগৃহিত

………………………..
আরও পড়ুন-
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব এক
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব দুই
মনোমোহনের পথে : প্রথম কিস্তি
মনোমোহনের পথে : দ্বিতীয় কিস্তি
মনোমোহনের পথে : তৃতীয় কিস্তি
দয়াময় থেকে দয়ালের দরবারে : কিস্তি এক
দয়াময় থেকে দয়ালের দরবারে : কিস্তি দুই
শাহান শাহ্’র দরবারে : পর্ব এক
শাহান শাহ্’র দরবারে – পর্ব দুই
লোকনাথ বাবার আশ্রম হয়ে মহারাজের আশ্রমে : এক
লোকনাথ বাবার আশ্রম হয়ে মহারাজের আশ্রমে : দুই
লোকনাথ বাবার আশ্রম হয়ে মহারাজের আশ্রমে : তিন
সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি- এক
সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি- দুই
সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি : তিন
সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি : চার
সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি : পাঁচ
নিরা গোঁসাইয়ের মতুয়া মহাসম্মেলন- এক
নিরা গোঁসাইয়ের মতুয়া মহাসম্মেলন- দুই
সাঁইজির ধাম হয়ে পাককোলা- এক
সাঁইজির ধাম হয়ে পাককোলা- দুই
টকিমোল্লায় গানে আসর
ফর্সা হাজীতে আরেক দফা
সাঁইজির ধাম হয়ে নহির সাইজির হেমাশ্রমে-এক
সাঁইজির ধাম হয়ে নহির সাইজির হেমাশ্রমে-দুই
সাঁইজির ধাম হয়ে নহির সাইজির হেমাশ্রমে-তিন
সাঁইজির ধাম হয়ে নহির সাইজির হেমাশ্রমে-চার
সাঁইজির ধাম হয়ে নহির সাইজির হেমাশ্রমে-পাঁচ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

1 Comment

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • মিঠু , বৃহস্পতিবার ১৫ জুলাই ২০২১ @ ৭:৫৬ পূর্বাহ্ণ

    বুড়ি মাকে চর্মচক্ষুতে দেখার প্রচন্ড ইচ্ছা ছিল। কিন্তু সাইজি কৃপা করলেন না। কি পাপের ফল যে এটা , সাইজিই জানেন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!